।।৫।।
গভীর নিম্নচাপের কারণে, পুরো কলকাতা আজ কার্যত ভাসছে, জল জমে অচলাবস্থা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে।
বসার ঘরে টিভিতে কলকাতার অবস্থা যতই দেখাচ্ছে, ততই টেনশন বাড়ছে নীলিমা দেবীর। পইপই করে বারণ করলেন আজ দুজনের কেউ যদি একটা কথা শোনে। আরে প্রাণটা তো আগে। এই অবস্থায়, জ্বর নিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। আর তার বউ-ও তেমনই, একটা যদি কিছু বোধবুদ্ধি থাকে। যেভাবে জল বাড়ছে, কার সাধ্যি মাথা ঠান্ডা রাখে।
************
আজ বাড়িতে থাকতেই পারতো সাগ্নিক, স্টুডিওতে আজ তেমন জরুরী কোন কাজও নেই, দু’জন ক্লায়েন্টের সাথে দেখা করার যে কথা, সেটা পোস্টপন্ড করাই যেত। ইচ্ছে করেই বেরিয়ে পড়ল ও আজ। প্রথমে যাবে কালীঘাট, তারপর আবার যাবে গড়িয়া। কিন্তু জেদের বশে এই অবস্থায় বেরোনোর সিদ্ধান্তটা যে একেবারেই ভুল, সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেল। কাল জ্বর গেছে, শরীর ভীষণ দুর্বল, মাথাও ঘুরছে, তারমধ্যে এরকম বেহাল অবস্থা, পৌঁছবে কী করে?
************
এদিকটায় বেশী জল জমার আগেই মেট্রো ধরে মুন নিজের অফিসে পৌঁছে গেছিল।
নিজের ডেস্কে এসে একটু শান্ত হয়ে বসল মুন। ঘামে, জলে কুর্তিটার তথৈবচ অবস্থা। একটু বসে ওয়াশরুমে যেতে হবে, তারপর একেবারে কাজে হাত দেবে।
জল যেভাবে বাড়ছে, ওরকম জিদ করে বেরিয়ে গেল, ওর তো আর মুন-এর মতো অফিস নয়, ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলতেও ঘুরতেই হয়। একবারটি ফোন করবে? ও জানে ওর ওপর রাগ করেই এরকম করছে সাগ্নিক। কাল ঐভাবে রিয়্যাক্ট করাটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
গরমটা একটু কমতে ওয়াশরুমে ফোনটা নিয়ে গেল মুন। গলার মঙ্গলসূত্রটা ঠিক করে নিল একবার। চুলটা একটু আঁচড়ালো, মুখে চোখে জল দিয়ে মুখটা মুছে নিজেকে আয়নায় দেখছিল ও, কী করছে? কেন করছে ও? এভাবে তো কেউ-ই ভাল নেই ওরা।
সাগ্নিক তো ওর সাথে কোনদিনও কোন অন্যায় করেনি, ও-ই বরাবর মিসবিহেভ করেছে মানুষটার সাথে। কেন কে জানে, ওকে দেখলেই মনে হয় ও ওকে দয়া করছে, উদ্ধার করে দিয়েছে বিয়ে করে, ও ওর করুণার পাত্র। পুরোটাই ওর মনে হওয়া, ও জানে সেটা। কিন্তু, কিছুতেই মাথার ঠিক রাখতে পারে না ও। ভাবনার মাঝেই ঠোঁটের কাছে হাতটা দিয়েই নিজের অখেয়ালেই হেসে ফেলল মুন। বাইরে প্রবল জোরে বাজে পড়ল একটা, কেঁপে উঠল মুন। বাইরে এমন দুর্যোগ, ও এভাবে কী করে যাবে এদিক ওদিক? ফোনটা নিয়ে সাগ্নিককে কল করল মুন -আনরিচেবল।
বার তিনেক ট্রাই করে না পেয়ে বাধ্য হয়ে নিজের সীটে গিয়ে বসল মুন।
*************
এই দিকটায় বহুদিন পর এলো সাগ্নিক। বড় একটা আসা হয় না। ক্লায়েন্টরা তো ভাবতেই পারেননি এই অবস্থায় কথা বলতে আসবে ও। কিন্তু, ক্লায়েন্টের বাড়ি থেকে বেরিয়ে তো আরও খারাপ অবস্থা। আর গড়িয়া অবধি আজ যাওয়া হবে মনে হচ্ছে না। এখানে সাগ্নিকের এক অফিসতুতো দাদার বাড়ি আছে, খোকনদা। আগে খুব যাওয়া আসা ছিল, তারপর খোকনদা মাঝখানে বেশ কিছুদিন কলকাতার বাইরে ছিল কাজের সূত্রে। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে কিছুদিন আগেই দেখল খোকনদা ব্যাক টু কলকাতা। আর তাছাড়া, ঐভাবে বিয়েটা হওয়ার পর ও-ও আর… আজ ওখানে গেলেই হয়। রুমা বৌদি দারুণ রাঁধে, আর ওকে না খাইয়ে যে রুমা বৌদি ছাড়বে না, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ফোন করে আর যাবে না, এতদিন পর গিয়ে চমকে দেবে ক্ষণ। একটু কষ্ট করে জল ভেঙে যেতে পারলেই।।।। ব্যস।
*************
কাজে মনটা লাগছেও না মুন-এর, পুরো আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে, ঘন কালো মেঘে দিন না রাত বোঝা দায়। অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে আছে বলে কিছু টের পাচ্ছে না। ওদিকে জল কমারও তো কোন লক্ষণ নেই। বাড়িতে ফোন করল, ও এখনও ফেরেননি, কোন ফোনও করেনি। যদিও ফিরতে দেরী হবে বলেই গেছল, কিন্তু, তাও এই অবস্থায় টেনশন হওয়াটা স্বাভাবিক। ফোনে ট্রাই করে আবারও কোন লাভ হলো না। জোর করেই এক্সেল সীটটায় চোখ বসাল মুন, মনটা নয়।
*************
-“আর না বৌদি, এত পারব না সত্যি।”
-“না বকে চুপচাপ খা বলছি, খিচুড়িটা তোর ভালই লাগে জানি, তাই খা আগে।”
মুগ দলের খিচুড়ি, আলুরদম, ডিমভাজা আর কী বা চাই এই বৃষ্টির দিনে?
খোকনদার সাথে সাগ্নিকের সম্পর্কটা অফিসের প্রথমদিন থেকেই। সবাই যখন ১০টা-৫টা ডিউটি করতে ব্যস্ত, তখন একমাত্র খোকনদার সাথে স্বপ্নের ঝাঁপি খুলে বসত ও। খোকনদারও স্বপ্ন ছিল বড় গায়ক হবে, তারপর বড় হয়ে গেল, আর সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে যা হয়, স্বপ্ন চাপা পড়ল দায়িত্ব কর্তব্যের ভারে।
সাগ্নিকের এই চাকরি ছেড়ে নিজের প্যাশনটাকে নিয়ে বাঁচা সম্ভব হয়েছে অনেকটা এই মানুষটার দৌলতেই। এই মানুষটা যদি ওকে না বোঝাত, জোর করত, পুশ করতো, ও কোনদিনই ওই সিদ্ধান্তটা নিতে পারত কী না সন্দেহ। খোকনদার একটা সংসার আছে, এতটা রিস্ক নেবার সময়টা পেরিয়ে গেছল, আরেকটা এরকম খোকন যেন না হয়, এটাই বলত সাগ্নিককে সবসময়।
খিচুড়িটা মুখে পুরে, অমলেটের টুকরোটা মুখে চালান করতে করতে বলল খোকনদা, “বিয়ে করে নিলি কিন্তু, কিছুই তো বললি না একবারও। হঠাৎ কী এমন হলো এভাবে? প্রেম-টেমও তো করতিস না, তবে? কী কান্ড বাধিয়ে ছিলিস বলতো?”
সাগ্নিকের বিয়ের সময় খোকনদা ব্যাঙ্গালোরে, কিছুই বলা হয়নি আর মানুষটাকে।
সাগ্নিক খানিক্ষণ মাথা নীচু করে বলল,”দাদা বিয়েটা তো আমার হওয়ার কথা ছিল না। বীথিকে যে আমার কতটা ভাললাগে সেটা তো তোমায় বলেওছিলাম কয়েকবার ফোনে।”
-“হ্যাঁ, বলেছিলি। কিন্তু, সেই মেয়ের বিয়ের ফটোগ্রাফির দায়িত্বেই তো তুই ছিলি। হেরো ম্যাচ নিয়ে ভেবে কী লাভ? তোকে তো বুঝিয়েছিলাম, কিন্তু তারপর থেকে আর তোর কোন পাত্তাই নেই। ফোন, মেসেজ কিচ্ছু না। তারপর হঠাৎ শুনলাম বিয়ে করে ফেলেছিস। কী হলো কিছুই বুঝলাম না।
-“হুম, বীথিকে ভুলতে পারছিলাম আর কই। ওর বিয়ের দিনও সকাল থেকে ওর প্রতিটা হাসিমুখের মুহূর্ত তো আমিই লেন্সবন্দী করেছিলাম। ওর কপালে, গালে ছোঁয়ানো প্রথম হলুদটা, ওর আলতা পরা পা,ওর কপালের টিপ, ফুলে মোড়া ওর খোঁপা, সব তো আমিই আঁকছিলাম, আমার ক্যামেরার ক্যানভাসে, নিখুঁত ভাবে। সব ছবি আমি ওকে দিইনি। কিছু নিজের জন্য রেখে দিয়েছি। এই যেমন ওর শাড়ির কুঁচি ঠিক করা, কিংবা অবাধ্য চুলগুলোকে যখন সরাচ্ছিল ঘাড়ের উপর থেকে, কিংবা কপালের টিপটা ঠিক আছে তো, যখন দেখে নিচ্ছিল – তখনকার মুহূর্তগুলো শুধুই আমার। সন্ধ্যাবেলা ও যখন লাল বেনারসী পরে হাসিমুখে বসছিল মন্ডপে, আমি তো মাঝে মাঝে ছবি তুলতেও ভুলে যাচ্ছিলাম। এত্ত সুন্দর লাগছিল, মনের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল আমার। বিয়ে বাড়ির রঙ-বেরঙের আলোর রোশনাই-এ ঝলমল করছিল চারপাশটা। সানাই-এর সুর, লোকজন, খাওয়াদাওয়া, জাঁকজমক সবই চলছিল নিজের ছন্দে, কিন্তু তারপরই।।।। তাল কাটলো।
-“মানে?” খোকনদার প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস জোরে একটা বাজে পড়ল বাইরে।
-“উফফ, কী অবস্থা আজ, কতদিন এরকম চলবে কে জানে, পাওয়ার কাট হতে পারে যে কোন মুহূর্তে।”
হাত টাত ধুয়ে খাটে আয়েশ করে বসল ওরা তিনজন।
-“বল, বল তারপর কী হলো?” জোয়ানটা সাগ্নিকের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল বৌদি।
ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে পৌঁছাল, কিন্তু তারপরই দেনাপাওনা নিয়ে একটা প্রবল অশান্তি শুরু হলো। আমাদের মতন তো না, যতই হোক মফস্বল অঞ্চল, এখনও পণ,পাওনা গন্ডা ভালই ছেয়ে রয়েছে বর্ধমানের ঐ দিকটায়।
আমি ঐ মুহূর্তে শুধু বীথির মুখটা দেখছিলাম, সারাদিনের ঐ আলো মাখা মুখটা কোথায়? ধরতেই তো পারছি না। ওর অসহায় চোখ দুটো জলে চিকচিক করছিল। ও আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, নিজেকে ধরে রাখতে কিন্তু, পারছিল কই? ওর মুখ চোখ কান অপমানে, রাগে, দুঃখে লাল হয়ে গেছল। ওর হবু স্বামী প্রবাল ও তার বাড়ির লোকের সাথে একমত। কথামতো পুরো টাকা দেওয়া না হলে এই বিয়ে হবে না।
আমি শুধু ভাবছিলাম, শিক্ষিত একটা মেয়ে হয়ে ও এই বিয়েতে রাজী হয়েছিলই কীভাবে? ও এতকিছুর পরেও চুপ? আর বেশিক্ষন চুপ থাকতে পারেনি, যে বাড়ি, যে ছেলে ওর মা বাবাকে এইটুকু সম্মান দেখতে পারে না, যার এতটুকু মেরুদন্ড নেই, তাকে বিয়ে করে আর কোন ভুল ও করতে চায় না। প্রতিবাদটা ওর অনেক আগেই করা উচিত ছিল, ওটাই ওর ভুল ছিল।
যা কিছু দেওয়া নেওয়া হয়েছিল, সব ফেরত নিয়ে, হিসেবে বুঝে বিয়ে বন্ধ করে চলে গেছল ছেলের বাড়ি। কিন্তু, এভাবে বিয়ে ভেঙে গেলে আবার ভালভাবে বিয়ে হতে পারে নাকী? উল্টে আমাদের সমাজই দায়িত্ব নিয়ে বন্ধ করে দেবে। ও কিন্তু তখনও কান্নায় ভেঙে পড়েনি, এরপরও আমি চুপ থাকব? আমি পারিনি আর নিজেকে আটকাতে, ওর বিয়ে ভেঙে গেছে বলে স্বার্থপরের মতন আমি সেদিন খুশিও হয়েছিলাম বলতে দ্বিধা নেই, আমি নিজে ওর বাবাকে বলে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলাম। ওর সিঁদুর দানের ছবি আর আমায় তুলতে হয়নি। ওর সিঁদুর মাখা মুখটা, আর ওর দিকে মুগধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আমি|
আমার এতদিনকার কাজে সবথেকে নিঁখুত আর সুন্দর ছবি। ছবিটাকে বাঁধিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল, পারিনি। মুন দেয়নি বাঁধাতে।”
-“এক মিনিট, এক মিনিট, বীথিই তো তাহলে তোর বউ। তাহলে মুন?”
-“বীথিকে বীথি বলে ডাকার অধিকার কারও নেই, ওর নিজের এই নামটা নাকি একদম পছন্দ নয়, তাই সবার কাছ ও মুন। কিন্তু, আমি বীথিকেই ভালবাসি, ঐ রগচটা মুনকে নয়। ঐ শান্ত মিষ্টি মেয়েটা, যাকে প্রথম দেখেছিলাম কচি কলাপাতা রঙের কুর্তিটায়।”
-“মানে বীথিই মুন? মানে তোর বউ? ওহ মাই গুডনেস!”
-“হ্যাঁ দাদা, বীথিই মুন।কিন্তু, আমার ওকে বীথি নামে ডাকার অধিকার টুকুও নেই। একটা অদ্ভুত রাগ ওর আমার উপর, কেন জানি না। যেন আমায় ও মাঝে মাঝে সহ্যই করতে পারে না। আমি ওকে বিয়ে করে যেন ওর জীবনটাই শেষ করে দিয়েছি। কর্তব্যে কোন ত্রুটি রাখে না, কিন্তু।।।।। মাথাটা নীচু করে নিল সাগ্নিক।”
-“দ্যাখ, ওরকম একটা ঘটনার পর হুট্ করে একজনকে স্বামীর জায়গায় বসানো, সব মেনে নেওয়া এগুলো অত সহজ নয়। ও প্রতিনিয়ত নিজের সাথেও এককিভাবে লড়াই করছে, তাই তুই ঐ রুক্ষ, রগচটা মেয়েটাকে দেখতে পাস। আমি বলব, ওকে ওর মতন ছেড়ে দে, ও ঠিক নিজেকে গুছিয়ে নেবে, তোকেও গুছিয়ে নেবে ও, দেখে নিস।”
-“আমি জানি দাদা, আমি ওকে ছেড়েই দিয়েছি…ও…ইসস” কথা থামিয়ে মাথায় হাত দিল সাগ্নিক। উফফ, এবার পাওয়ার কাট। শরীরটা এখন ঠিক আছে, কিন্তু, এই দুর্যোগে তো যা-তা অবস্থা হবে। এতক্ষণে খেয়াল পড়ল, ওর ফোনটা সেই কখন থেকে অফ। একটু আগে খেয়াল পড়লে চার্জটা দিতে পারতো। ওদিকে গল্পে গল্পে খোকনদার সাথে একটু সুরাপানও হয়ে গেছে। কিন্তু, এবার তো বেরোতেই হবে।
।।৬।।
না, আর ওয়েট করা সম্ভব না বীথির পক্ষে, সাগ্নিককে এবার কোথায় খুঁজবে ও? অফিসে শুনে এল, ঐ কালীঘাট এলাকায় বাজ পড়ে দুজন-এর মৃত্যু হয়েছে, বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে গুরুতর অবস্থা কিছুজনের, ও তো ওখানেই আজ গেছল। তারপর থেকে আর ফোনেও পায়নি একবারও। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা নিয়ে রাস্তায় ঐ অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়ল বীথি।
খোকনদার ফোনে একটু নিউজটা দেখে বেরলো সাগ্নিক। এলাকায় পাওয়ার কাট হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় বাড়িতে জল ঢুকে গেছে এবার, মেট্রো পরিষেবাও বিপর্যস্ত। চাঁদনী চক মেট্রো স্টেশনের কাছে মেট্রো আটকে, বিদ্যুৎ বিভ্রাট। এসি মেট্রো বলে যাত্রীদের অবস্থা দুর্বিসহ।
তাড়াতাড়ি ঘড়িটা দেখল সাগ্নিক। এই মেট্রোটাই তো ধরে বীথি, ধর্মতলা থেকে অফিস ফেরার সময়। ও ঠিক আছে তো? ফোনটাও তো আনরিচেবল।
**************
আজ এই প্রথমবার মনে হয় সাগ্নিকের জন্য প্রার্থনা করছে মুন। অসম্ভব টেনশন হচ্ছে ওর, কী দরকার ছিল কাল ওরকম ব্যবহারের। তাহলেই তো আজ সাগ্নিক বেরত না। আর না বেরলেই তো এত টেনশন, ঝামেলা কিছুই হতো না। এখন ভগবান না করুন ওর যদি কিছু হয়, মুন নিজেকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। যতই রাগ দেখাক, মেজাজ দেখাক, আজ এই মানুষটার জন্যই ওর উপর অনেক তির্যক মন্তব্য এসেও আসতে পারেনি। আগুপিছু না ভেবেই সাগ্নিক নির্দ্বিধায় মুনকে নিজের জীবনে জায়গা করে দিয়েছে। আর ও।।।।। সবসময় সাগ্নিককে দেখে শুধু।।।।। না না, এ হতে পারে না, ও যতখন না ফিরবে, ওর গলা দিয়ে একটা কণাও নামবে না।
শাশুড়ি মাও চিন্তায় পাগল হচ্ছেন। এত দেরী তো হওয়ারও কথা নয়। ওর কাছে সাগ্নিকের বন্ধুবান্ধব-এর নম্বর আছে, তারা কেউই কিছু জানে না। টেনশনে রাস্তা থেকে ভিজে অবস্থায় বাড়ি ফিরে এখনও ফ্রেশ অবধি হয়নি ও।
*************
ঘড়ির কাঁটা রাত ৮টা ছুঁই ছুঁই। বৃষ্টি এখন একটু ধরতে শুরু করেছে, তবে জল এখনও নামেনি। এখনও প্রায় অচল কলকাতা। আবারও গুরুতর জখম-এর সংখ্যা বেড়েছে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৬, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে, বজ্রাঘাতে।
যে ক’দিন বিয়ে হয়েছে, আজ অবধি এত রাত কোনদিন করেনি ফিরতে সাগ্নিক। ওর কাজের শেষে ক্লাব, আড্ডা, খেলা ওর প্রাণ। শ্যুট থাকলে আলাদা ব্যাপার, কিন্তু আজ তো তাও নেই। ঐ দুটো জায়গায় ঘুরতেই বা কতক্ষন লাগে।
মুন এসে থেকে কিছু আর খেতেও পারেনি। শাশুড়ি মা বকে তাও হাত মুখটা ধুয়েছে। কিন্তু ঠায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
আর কোনদিন এভাবে বলবে না, আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না, প্লিজ ঠাকুর, আর যে পারছে না মুন।
*************
যখন বাড়ি পৌঁছল সাগ্নিক, তখন রাত প্রায় পৌনে ৯টা। পুরোপুরি কাক ভেজা। হালকা টলছে, চোখ লাল, গায়ে আবার জ্বরটা এসছে। ঘরে ঢুকেই মুনের জুতোটা দেখে আশ্বস্ত হলো মনটা। মা বাবা তো প্রথমেই চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল।
-“আরে, কেউ তো কিছু বলতেই দিচ্ছ না।”
হঠাৎ মাঝখান থেকে বীথি এসে হাতটা ধরে টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে চলে গেল, তখন সাগ্নিক সত্যিই কিংকর্তব্য-বিমূঢ়।
মুন ওর গালে সপাটে একটা চড় মেরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে যখন ওকে জড়িয়ে ধরল, জ্বরের ঘোরে আর অল্প নেশায় মাথা রীতিমত ঘুরছে।
-“তোমার লজ্জা করে না? কোথায় ছিলে সারাদিন? আর এভাবে ভিজে গেছ, জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে, মানুষকে কি মেরে ফেলবে টেনশনে?” বলতে বলতেই বীথি একটা তোয়ালে নিয়ে এল তাড়াতাড়ি আর ভেজা শার্টের বোতামগুলো নিজেই খুলতে লাগল, “একে জ্বর, তার মধ্যে ভিজে জামাকাপড় পরে, কী আশ্চর্য বুদ্ধি।”
এরকম ট্রিটমেন্ট কোনদিনই বীথির থেকে পায়নি সাগ্নিক।
-“আরে তুমি তো আমায় কিছু বলতেই দিচ্ছ না। তুমি যে সময়ের মেট্রো ধরে ফের, তাতে ওরকম একটা এক্সিডেন্ট, শর্টসার্কিট হয়ে মেট্রোয় আগুন। এসব জেনে সঙ্গে সঙ্গে মেট্রোয় ছুটেছি। ওখান থেকে ফিরতে পুরো ভিজে-তিতে একসা। ঐ জন্যই ফিরতে এত দেরী। তোমায় যে ফোন করব, ফোনটাও চার্জ আউট। টেনশনে মাথা খারাপ। আর দুপুর অবধি খোকনদার বাড়িতে ছিলাম। ওখানেই খেয়েছি। কিন্তু ফোনটা তখনও দেখিনি, শরীরটাও খারাপ লাগছিল। এখন আবার মাথায় লাগছে।”
তোয়ালে দিয়ে ততক্ষনে মাথাটা মুছিয়ে দিয়েছে বীথি। জামা টামা খুলে দিয়েছে, জবজবে জামা পরে আরো ঠান্ডা লাগবে নয়তো।
-“তুমি আমার জন্য মেট্রোয় খোঁজ করতে গেছিলে? আর তুমি মদ খেয়েছ? আমার জন্য চিন্তায় নাকী ফুর্তিতে? থাক আপদ বিদায় হলো।।।।”
-“ব্যস, শাট-আপ জাস্ট, বেশ করেছি মদ খেয়েছি, বোঝ তুমি কিছু? বোধ আছে তোমার কোন? কোনদিন ভালভাবে যদি আমার চোখে তাকিয়ে দেখতে তাহলে আজ এই কথাগুলো বলতে না। তোমার জন্য তো।।।।।”
আর কিছু বলল না সাগ্নিক। সামনে থেকে সরিয়ে দিল বীথিকে।
-“এই শোন, তুমি কবে আমায় বলেছ কিছু? কোনদিন একবার হাতটুকুও ধরেছ? না। তাহলে?”
-“এই শোন” বীথিকে জোরে ধরে সামনে দাঁড় করিয়ে বলল সাগ্নিক, জ্বরে তখন প্রায় কাঁপছে খালিগায়ে। কিন্তু, রাগে আর কোনদিকে হুঁশ নেই, “তোমায় আমি সেদিন থেকে ভালোবাসি, যখন প্রবাল আর তুমি হাতে হাত রেখে দাঁড়াতে সূর্যাস্তের সময়, তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জেনেও তোমায় আমি পাগলের মতো ভালবেসেছি। তোমার জন্য খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না, ঠিকভাবে কাজ করতে পারতাম না। তোমার ফটোশ্যুট ছাড়তে চেয়েছিলাম এই কারণেই। তোমার সিঁদুর পরা মুখের দিকে প্রবালের তাকিয়ে থাকাটা সহ্য করতে পারবো না বলে। ইয়েস, তোমায় বিয়ে আমি কোন দয়া করে করিনি। তোমায় ভালবেসে করেছি। আর কাল রাত্রে যা কিছু হয়েছে সেটা আমার ভালবাসার জন্যই। যে কোন একটা নারী শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো এরকম মেরুদন্ডহীন পুরুষ আমি নই। তোমার প্রব্লেম কী জানো? তুমি কখনো আমায় মানুষ বলেই ভাবোনি ।।।।।।”
-“চুপ, যদি না ভাবতাম তাহলে তোমার জন্য আজ এরকম পাগলের মত টেনশন করতাম না, ঠাকুরকে শুধু বলছিলাম, একবার খালি ওকে ফিরিয়ে দাও,আর কিছু চাই না, খুব বেশি বোঝ তুমি তাই না? কোনদিন তুমি জানিয়েছ আমায় ভালবাসার কথা? আমি একটা মেয়ে হয়ে কীভাবে।।।।।।”
বীথির চোখ দিয়ে জল বেয়ে ওর নরম গালটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। কখন যে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে গেছেন সাগ্নিকের মা, ঝগড়ার চোটে আর খেয়ালই করেনি ওরা।
ওর নরম গাল দুটো নিজের দু হাত দিয়ে চেপে ধরল সাগ্নিক। বড্ড কথা বলছে মেয়েটা, আর এতদিন তো কথাই বলেনি ওর সাথে। আর কিচ্ছু না ভেবে বীথির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল ও।
না, এবারে আর বীথি দূরে ঠেলে সরিয়ে দেয়নি। বরং, সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে ওর সাগ্নিককে, দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে সাগ্নিকের অনাবৃত শরীরটা।
বীথির চোখের দিকে তাকাল সাগ্নিক, আজ সাগ্নিকের চোখেও জল। বীথি সাগ্নিকের বুকে মুখ লুকোলো তাড়াতাড়ি, বড্ড লজ্জা করছে যে ওর।
-“গায়ে তো জ্বর, খেয়ে শুয়ে পড় তাড়াতাড়ি, আর কাল একদম বাড়বে না এই শরীরে, আমিও কাল ছুটি নিয়ে নেব।”
-“বেশ, কিন্তু তার বদলে কী পাব আমি?”
-“কী পাবে মানে।।।।” সাগ্নিকের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বীথি বুঝল সাগ্নিকের চোখের দুস্টু ইঙ্গিতটা।
-“ধ্যুত। অসভ্য একটা।
ভরা শ্রাবণে শুরু হলো ওদের ছোট্ট লালনীল প্রেমের সংসার।