“থালাটা আবার ছুড়ে ফেলে দিল ঘর থেকে |”-মা কথাটা বলতে বলতেই দালান পেরিয়ে গেল ওপারের ঘরের দিকে |
এটা রোজকার ব্যাপার, আমার মেজ কাকীকে নিয়ে রোজ একটা না একটা কিছু লেগেই থাকে | ঠাম্মি গজ গজ করতে করতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল,”এরকম করলে হয় বৌমা? তুমি কি আর কোনদিনই…যাকগে যা, বলে লাভই বা কী? এই জন্যই বলেছিলাম বাড়িতে না রেখে পাগলা গারদে রাখতে, আমার কথা শুনলে তো | গছিয়ে দিলো, যত্তসব |”
এভাবেই দেখে আসছি বিগত ২২ বছর ধরে | মেজ কাকীর ঘরে মা ঢুকল, আমি মনে মনে ভাবলাম, লাভ নেই | কিছুক্ষন পর বিফল হয়ে, রোজকার মতো বেরিয়ে এল, আমার মর্নিং কলেজ তাই দুপুরে বাড়ি ফিরে আসতে পারি |
“কী খেলোনা তো?” বলে ফোনটা পাশে রেখে তাকালাম মার দিকে |
“নাহ, দেখ তুই, তোর কথা শোনে তাও..”|
আমি, থালা সাজিয়ে ঘরে ঢুকে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, মিটি মিটি হাসছে মেজকাকী |
“হাসলে হবে না, আমি খুব রেগে আছি, এবার কিন্তু ঝাড় খাবে, চুপচাপ খেয়ে নাও |”, মেজকাকী আমার থমথমে মুখটা দেখে চুপ করে খেয়ে নিতে লাগল | কিছু পর বলল,”মামণি তুই খেয়েছিস?”
মেজকাকী আমায় কখনো আমার নাম ধরে ডাকে না | বাড়ির বাকি লোকের কাছে আমি মিতু হলেও মেজকাকীর কাছে শুধু মামণি |
“নাহ, খাইনি, তোমায় খাইয়ে খাব |”,বলেই এক গাল ভাত নিয়ে তার মুখের কাছে ধরলাম |
আমার হাতটা ধরে মেজকাকী বলল,”বড্ড জ্বালাচ্ছি তোকে…” কথা শেষ করতে না দিয়েই বললাম,”আমায় না নিজেকে শেষ করছ, কেন এরকম কর? আর কেউ না জানুক আমি তো জানি তোমার এসব ওষুধের কোন প্রয়োজন নেই…তাও…”|
-“চুপ, চুপ, দেওয়ালেরও কান আছে | এসব কথা কেউ জানতে পারলে রক্ষে থাকবে না, আর নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভালও লাগে না |”
-“তুমি আমায় আজও বললে না বলো?”
-“বলব, একদিন সব বলব, তুই আর বাবাই, এই দুজনই তো আমার সব |”
***************
শ্রাবণের মেঘে আকাশটা পুরো কালো, ছাদে ঝোড়ো হাওয়া, ছাদের কার্নিশের পাশে বেতের চেয়ারটা টেনে বসলাম | দমকা হাওয়ায় বাড়ির সামনের রাধাচূড়া গাছ নুইয়ে পড়ছে রাস্তার উপর, হলুদ ফুলে ঢাকা সামনের রাস্তা টুকু | শান্তি পিসি ছাদের টবগুলো গোছাতে ব্যস্ত, মা, কাকীমারা জামা কাপড় ছাদ থেকে তুলছে | আসন্ন ঝড়ের সংকেত জানাচ্ছে মেঘের গর্জন |
হঠাৎ মনে পড়ল, এরকমই একটা দিনে, অনেকদিন আগে, তখন কত বয়স হবে,ক্লাস ফাইভ সিক্সই মনে হয় | বাড়িতে আমি, শান্তি পিসি আর মেজকাকীই ছিলাম, আমি স্কুল থেকে সবে ফিরেছি | সবাই গিয়েছিল একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে | আমি ছাদে খেলছিলাম, শান্তি পিসি ছিল রান্না ঘরে | ছাদ থেকে নেমেই প্রথম ঘরটাই ছিল মেজকাকীর, রান্না ঘরটা বেশ খানিকটা দূরে | কী হলো হঠাৎ কে জানে, ছাদ থেকে নামতে গিয়েই পা-টা ফসকে গেছিল | সেদিন মেজকাকী না থাকলে কী হতো কে জানে | মেজকাকী দালান দিয়েই যাচ্ছিল ভাগ্যিস, আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসছিল, শক্ত করে ধরে ফেলেছিল আমায়…সেদিন আমি প্রথম আমার আসল মেজকাকীকে দেখেছিলাম | জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই যেকোন ভাবেই হোক আমি এটাই জানতাম যে মেজকাকী স্বাভাবিক নয়, সোজা বাংলা ভাষায় আমরা যাকে বলি ‘পাগল’ | কিন্তু সেদিন প্রথম আমি পর্দার আবরণে ঢাকা আসল মানুষটাকে দেখে ফেলেছিলাম, যে আসলে সম্পূর্ণ সুস্থ |
হ্যাঁ, ঘটনার আকস্মিকতায় মেজকাকী ওই মুহূর্তে আবরণটা টানতে হয়তো ভুলে গেছিল, কিন্তু তার চোখমুখ, কথা, অভিব্যক্তিতে আমি ঐটুকু বয়সেই এটা বুঝে গিয়েছিলাম যা দেখেছি, যা জানি তা সত্যি নয় পুরোটা |
***************
ঐ ঘটনার পর স্বভাবতই মনে একটাই প্রশ্ন এসেছিল “কেন?” এই প্রশ্নটা করেওছিলাম, বহুবার করেছি, তবু আজও উত্তর পাইনি, শুধু একটি উত্তরই এসেছে,”সময় হলে জানবি |”
নাহ, কাউকে এগুলো বলার সাহস আমার হয়নি, শুধু তার পর থেকেই মেজকাকীর সাথে আমার সম্পর্কটা অসম্ভব রকম মজবুত হয়ে গেছল | একমাত্র আমার সামনেই মানুষটা স্বাভাবিক ভাবে হাসতে পারে, কথা বলতে পারে | কিন্তু কেন এই অভিনয়?
**************
আজ আমার আর প্রীতমের ব্যাপারে কথা বলতে যাচ্ছে আমার বাড়ির লোকজন প্রীতমের বাড়ি | আজকের দিনটা আমার কাছে কতটা গুরুত্তপুর্ন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না | এরকম একটা দিনে আমি সত্যিই চাই মাজকাকীও থাকুক | অনেকবার মেজকাকীকে বলেওছিলাম, কিন্তু as usual কিছুতেই রাজী হলো না | কিছু বলিনি, জাস্ট কিচ্ছু না, রাগে দরজাটা বন্ধ করে ঘরে চলে এসেছিলাম, খুব ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে দি |
-“মামণি, দরজাটা খোল |”
-“প্লিজ যাও মেজকাকী অসহ্য লাগছে আমার |”
-“একবারটি খোল, সবটা শোন, তাহলেই সব বুঝবি | খোল মামণি, মা আমার |”
-“disgusting just”,বলতে বলতেই দরজাটা খুললাম |
****************
নাহ, সেদিন মেজকাকী ম্যাজিকের মতো কথা শুনে প্রীতমের বাড়ি চলে যায়নি | কিন্তু, সবটা শুনে সত্যি কিছু বলার ভাষা ছিল না |
**************
আমার মেজকাকু কোনদিনই সুবিধের মানুষ নন, নিজের কাকা তাও সত্যিটা বলাই শ্রেয় | এমন আত্মকেন্দ্রিক, অহংকারী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি যার কাছে টাকা ছাড়া আর কোন কিছুর কোন মূল্য নেই | নিজের মা বাবা, ভাই বোন, স্ত্রী সন্তান কেউ না |
এরকমই একজন ‘অমানবিক’ মানুষকে বিয়ে করে মেজকাকী যখন আমাদের বাড়ি আসেন, তখন আমি জন্মাইনি, এ সবটাই মেজকাকী আর আমার মা, ঠাম্মির থেকে শোনা |
মেজকাকী ভালবাসতেন আরেকজনকে, মানুষটা অর্থে, প্রতিপত্তিতে সমকক্ষ ছিল না | তাই মেজকাকীর বাবা, কাকা, দাদারা মনে হয় তার বাঁচার অধিকার আছে সেটাও মনে করেনি | মেজকাকী এত বড় ঘটনাটা মেনে নিতে পারেনি | আর সময়টা ৫০ এর দশক, তখন প্রভাবশালী একটা পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু কেউ করে কার সাধ্যি | মেজকাকীর বাপের বাড়ি আর আমার পিসির শ্বশুরবাড়ি একই পাড়ায় , সেই সূত্রেই পরবর্তী কালে এগুলো জানতে পারে আমাদের বাড়ি, মেজকাকী নিজেও আমায় বলেছিল |
ঘটনার পর মেজকাকী মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পরে, ওষুধও শুরু হয় | সেই সময় একটু ভালবাসা, একটু যত্ন পেলে হয়তো সব মিটেও যেত, কিন্তু তা হয়নি | উল্টে ‘প্রেমিকের ভূত’ ঘাড় থেকে নামাতে সবকিছু লুকিয়ে কাকার সাথে বিয়েটা দিয়ে দেয় মেজকাকীর বাড়ির লোকজন, মেজকাকী মানসিকভাবে সুস্থ হওয়ার আগেই |
আমার কাকা প্রথমে এসবের কিছুই জানতেন না, জানার ইচ্ছেও ছিল না তার | সে দৌড়তেই ব্যস্ত অর্থের পিছনে | এমনকী মেজকাকীকে বিয়েটাও কাকা মোটা টাকার লোভেই করেছিলেন |
বিয়ের পর থেকেই মেজকাকীর আচার আচরণ মানুষের অদ্ভুত ঠেকছিলই | মেজকাকা এগুলোকে বিশেষ আমল দেয়নি, হয়তো বা পুরুষত্বে আঘাত লেগেছিল, ভেবেছিল জোর করে স্বামী অধিকার ফলাবে, একটা সন্তান এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে |
বাবাই মানে আমার ভাই কোনো সুখী দাম্পত্যের ভালবাসার সন্তান নয়, বরং অসুখী ভালবাসাহীন শুধুমাত্র ‘বিয়ে’ কথাটুকু লাগানো একটা নামহীন সম্পর্কের চিহ্ন মাত্র |
ততদিনে বাড়ির সবাই মেজকাকীকে ‘পাগল বৌ’-এর তকমা মেরেই দিয়েছে, যে নিয়মিত ওষুধ খায়, যাকে তার মা বাবা, স্বামী হয়তো মানুষ বলেই গণ্য করে না |
এতকিছুও হয়তো কম ছিল, যখন মেজকাকিমা একটু একটু ভাল হয়েই গেছিল, তখন মেজকাকী নিজের স্বামীকে অন্য নারীতে আসক্ত আবিষ্কার করেন | …আরও একটা ধাক্কা, আবার একবার তছনছ হয়ে যাওয়া সবকিছু | মেজকাকী আর পারেনি, সুস্থ হয়ে গিয়েও অসুস্থতার মোড়কে আবৃত করে রেখেছে সবদিন, যাতে আর ‘অমানবিক’ মানুষটার কাছে নিজের সম্মান না হারাতে হয় আবার, তার থেকে বরং অসুস্থতার আবরণে ঢাকা থাকুক সবটা সবার কাছ থেকে | কেউ তো পাশে ছিল না, থাকবেও না, কী লাভ তবে সুস্থ হয়ে?মা বাবা, স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেউ তো অসুস্থতার কারণটা বুঝল না, শুধু নাক সিঁটকোল | নিজে থেকেই ওই ভয়ঙ্কর নার্ভের ওষুধ গুলো নিয়ে গেছে মেজকাকী | আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল একবার, ফিরে এসেছে আবার, তখনও কাকা পাশে থাকেনি, নার্সিং হোমেই যায়নি |
***************
মেজকাকীর জীবনটা দেখে একটা কথাই মনে হয়, ভগবান তো সবার ভাগ্যেই কিছু না কিছু ভাল দেয়, তাহলে মেজকাকীর এরকম কেন? কোন দোষ তো ছিল না মানুষটার, তাও জীবনে কিছুই পেল না |
মেজকাকী বলে,”আমার মামণি আর বাবাই আছে তো |”, কাকীর শূণ্য দৃষ্টিতার দিকে তাকালে শুধু মনে একটাই প্রশ্ন আসে-“এত সবকিছু একজনের ভাগ্যেই কেন? এগুলো কী সত্যিই তার প্রাপ্য ছিল? অভিনয়ের মোড়কে চাপা পরে রইল গোটা একটা ‘মানুষ’, যার মনুষ্যত্ব বেঁচে আছে আজও, যে ভালবাসতে জানে, কিন্তু তার হদিশ পেল না কেউ |”