||১||
-“কখন মারা গেছে কেউ তো জানতেই পারেনি, মনে হচ্ছে মাঝ রাতেই, গায়ে তো পিঁপড়েও হয়ে গিয়েছিল |”
-“হ্যাঁ, একাই তো থাকতো, কী আর হবে? ছেলেপুলে নেই, স্বামী নেই, কে কাঁধ দেবে কে জানে?”
-“আরে না না, বডি দান করে গেছে শুনলাম, ওসব কোন ঝামেলা নেই |”………………….
ভিড়-এর মধ্যে টুকরো টুকরো কথাগুলো ভেসে আসছিল কানে, আজ বলার কোন ভাষা নেই আমার | আমাদের আবাসনের পাশের উইংসে মিতা মাসিমা মারা গেছেন | বিয়ে করেননি উনি, তিন কূলে কেউ নেই, আজ কে কাঁধ দেবে সেই নিয়ে পাড়ার লোকের বচসা লেগেছিল | স্কুল শিক্ষিকা ছিলেন উনি, রিটায়ার করেছিলেন বহুদিন, পাড়ার লোকের সাথে সদ্ভাব কোন দিনই তেমন ছিল না, লোক আড়ালে ডাইনি অবধি বলতো | কেন জানি না, আমি পাড়ায় আসার পর থেকে শুনে শুনে ওনার সাথে না মিশেও ওনার প্রতি বিরূপ মনোভাবই পোষন করতাম | এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনাটাই, ক্ষমাটাও চাইতে পারিনি |
||২||
(কয়েক মাস আগের কথা)
-“বিট্টু সন্ধ্যে নামার আগেই তুমি বাড়ি ফিরবে, মনে থাকে যেন |” আমার ছেলে বিট্টু,আর স্বামী প্রকাশকে নিয়ে আমার ছোট্ট সংসার চিড়িয়া মোড়ের এই ফ্ল্যাটে | আমার ছোট একটা বুটিক আছে | স্বামী ব্যাঙ্ক কর্মচারী, ছেলে বিট্টু ক্লাস টু | ছেলে রোজই স্কুল থেকে ফিরে খেলতে যায়, কিন্তু ইদানিং ফিরতে একটু দেরীই করে | সন্ধ্যে নেমে যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করলে বলতেও চায় না, এত বদমাশ হয়েছে |
***************
ঘড়ির কাঁটা যখন সন্ধ্যে সাতটা ছুঁইছুঁই, আমার টেনশনটা শুরু হলো তখনই, এত দেরী তো কোনদিন করে না, কী করছে এখনও? পাশের ফ্ল্যাট থেকে জানতে পারলাম ওর সাথে খেলে চিকু, গোলু, পটা সব বাচ্চাই যে যার ফ্ল্যাটে ফিরে এসছে | বিট্টু তাহলে কোথায় গেল? কোন অঘটন ঘটল না তো?
ততক্ষনে প্রকাশও ফিরে এসছে, তাহলে কী এবার লোক ডাকতে হবে? পাশের ফ্ল্যাটের লোকজনকে ডাকব? পুলিশে খবর দেব? হঠাৎই পাশের ফ্ল্যাটের চিকুর মা বলল,”এত সন্ধ্যে অবধি তোমার ছেলেকে কেন খেলতে দাও গো তুমি? ডাইনী বুড়িটার তো নজর আছে তোমার উপর, সে খোঁজও তো রাখো না, এখন কী করবে? কোথায় খুঁজবে?
তৎক্ষণাৎ সেই ডাইনী বুড়ি ওরফে মিতা মাসিমার ফ্ল্যাটে ছুটেছিলাম আমরা | হ্যাঁ, বিট্টু ওখানেই ছিল, কিন্তু সেই ডাইনী বুড়িটার ভয়ে জুজু হয়ে বসে ছিল না, বরং ঠাকুমার ঝুলির মত তার কাছে গল্প শুনছিল, ঠাকুমার হাতের মালপোয়া খাচ্ছিল, আর খিলখিলিয়ে হাসছিল ঠাকুমার কোলে বসে | খেলতে গিয়ে হাঁটুতে একটু কেটেছিল, তা সেই ঠাকুমাই পায়ে ওষুধ মলমটাও লাগিয়ে দিয়েছে | রাগে টেনশনে অন্ধ ছিলাম তখন, যা নয় তাই কথা শুনিয়ে বিট্টুকে নিয়ে চলে আসি ওখান থেকে | ‘ডাইনী বুড়ি’ শব্দটাও বেরিয়েছে মনে হয় মুখ থেকে | পরে বিট্টুর কাছে শুনলাম ও বেশ কিছুদিন ধরেই ঐ ঠাকুমার কাছে যায়, ওর তো ঠাকুমা নেই নিজের, খুব ভালবাসে তাই ও ওর এই ঠাকুমাকে | খুব কান্নাকাটি করছিল বিট্টু, তবু আর যেতে দিনি, মনের মধ্যে কুসংস্কারের বীজটা পোঁতা হয়ে গিয়েছিল যে অনেক আগেই |
কিছুদিন যাবার পর বুঝতে পারছিলাম যে মনের ভ্রান্ত ধারণাটা এবার নির্মূল করা দরকার, একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে এগুলো মাথায় আসে কী করে? মানুষটাকে এতটা ভুল বোঝাটা কী ঠিক হচ্ছে? কিন্তু ক্ষমাটা আর চাইতে যাওয়া হচ্ছিল না |
*****************
(এখন)
-“ফুল মালা ধূপ-এর একটা মিনিমাম ব্যবস্থা তো করতে হবে |”
-“হ্যাঁ, নয়তো ভূত হয়ে বুড়ি আমাদেরই ঘাড়ে চাপবে |”
এই টুকরো কথায় অতীতের পাতা থেকে টনক নড়ল আমার, সামনে মিনা মাসির মৃতদেহ | নাহ, ক্ষমা আর চাওয়া হয়নি, তার আগেই মানুষটা ফাঁকি দিয়ে চলে গেল, জানি না কেন আজ খুব অনুতপ্ত লাগছিল নিজেকে, নিজের না বলতে পারা কথাগুলো দলা পাকিয়ে আসছিল গলার কাছে, ভিতর থেকে কেউ যেন বলছিল, অন্তত শেষ সময়ে মানুষটাকে একটু সম্মান দি |
অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার সমস্ত দায়ভার নিজের কাঁধে নিলাম, এটুকু করতে পেরেও যদি মনটা একটু হালকা হয়, জানি, লোকজন আড়চোখে দেখছে হাসছে, হাসুক, দেখুক | অন্তত মনটা একটু শান্ত হবে |
****************
ফুলের সাজে সেজে মিতা মাসি রওনা হলো | আমি ওনার ফ্ল্যাটে গেলাম | বিট্টুটা খুব কাঁদছে, একটা বন্ধু, পরম আদরের ঠাকুমা এভাবে চলে যাবে, এভাবে হারিয়ে যাবে, ভাবতে পারেনি |
ওকে নিয়েই মিতা মাসির ফ্ল্যাটে গেলাম, এত বয়সেও ছিমছাম সাজানো ফ্ল্যাটটা | সব কাজ নিজেই করতেন, কাজের লোকও ছিল না | সুস্থই তো ছিলেন, হঠাৎ যে কী হলো… ভাবতে ভাবতেই চোখটা গেল বুক সেল্ফ-এ রাখা ডায়েরিটায় | শিক্ষিকা ছিলেন, ঘরে অনেক রকমের বই-এর মাঝেই ডায়রিটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো, বহু পুরোনো মোটা একটা ডায়েরি, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হাত আটকাল সাদা কালো ছবি দুটোয় | মিতা মাসির ছবি একটা, কী অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু ইনি কে? বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে তো ! মনের মধ্যেকার জিজ্ঞাসাটা আর দমন করতে পারলাম না, কয়েকটা পাতায় লেখা ক্ষুদ্রাক্ষর চোখে পড়েই গেল |
***************
ফ্ল্যাটের ঘড়িতে বেলা একটার ঘন্টা পড়ল, কখন যে ৪৫ মিনিট কেটে গেছে খেয়ালও করিনি | ছিমছাম একাকী ফ্ল্যাটের আশপাশটা তাকালাম ঝাপসা চোখে | হ্যাঁ, ঝাপসা, চোখের জল আর বেঁধে রাখতে পারলাম কই?
মিতা মাসি মানে মিতা চ্যাটার্জী, বাড়ি ছিল সাবেকী উত্তর কলকাতার শোভাবাজারে | শিক্ষিকা মানুষ ছিলেন, ভালোবেসেছিলেন একজন মানুষকে, দেবাংশু মল্লিক | ভালবাসার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমাজ পরিবার, পরিজন, কেন? ব্রাহ্মণে-অব্রাহ্মণের কাঁটাতার ছিল যে, বাড়ি ছেড়েছিলেন, সমাজ ছেড়েছিলেন, পরিবার পরিজন ছেড়েছিলেন নতুন সংসার পেতেছিলেন ভালবাসার মানুষটার সাথে | ভাগ্য সহায় হয়নি, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় ভালবাসার মানুষটা ছেড়ে গেছিল মৃত্যুর কাছে হেরে গিয়ে, ভালবাসার চিহ্ন একমাত্র ছেলেটাও জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় পুকুরে ডুবে মারা যায় | একাকীত্ব পিছু ছাড়েনি মানুষটার, চলে আসেন এখানে, ছেড়ে আসা পথে আর বাড়ি ফিরে যাননি | বিট্টুর মধ্যে নিজের সন্তান ‘টুকুন’কে খুঁজে পেতেন, সেটাও কেড়ে নিয়েছিলাম আমি, আমরা সবাই | মানুষটার কাছে ক্ষমাটুকুও চাইতে পারিনি | এত অনুতাপ, এত গ্লানি, কাকে বলব এসব? কে বুঝবে?
||৪||
(কিছুদিন পর)
শ্রাদ্ধর সব আয়োজন হয়ে গেছে | পাড়া পড়শী নাক সিঁটকোচ্ছে, নানা কথাও বলছে হয়তো কিচ্ছু যায় আসে না তাতে | ঠাকুমার প্রিয় নাতিই বসেছে কাজে | এতে যদি নিজের অপরাধ বোধটা একটু কমে, একটু যদি মানুষটার আত্মা শান্তি পায় | ক্ষমা চাওয়ার পথ আর নেই, যদি আগে ক্ষমা চাইতে পারতাম, যদি মানুষটাকে বুঝতাম, যদি…..|