পুরোনো পৈতৃক বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে তুলে দেওয়া হবে খুব শিগগিরি, তার আগে চূড়ান্ত ব্যস্ততা, আর জিনিসপত্র গোছগাছ চলছিল | পৈতৃক বাড়িটা শ্যামবাজারে | মা মারা যাবার সময় আমার আর আমার ছোট ভাই-এর নামে পরিষ্কার ভাবে ভাগাভাগি করে সব সম্পত্তি উইল করে গেছেন | দুজনের মিলিত সিদ্ধান্তেই আজকের এই পদক্ষেপ |
মেহগনি কাঠের আলমারিটা গোছগাছ করতে করতেই হাতে পড়ল কালো ডায়েরিটা, হাতে নিতেই বুঝলাম এটা মায়ের ডায়েরি | মা বরাবরই নিজের কথাগুলো গুছিয়ে রাখত ডায়েরির পাতার ভাঁজে, সবার আড়ালে, অলক্ষ্যে, যা দেখার, জানার অনুমতি ছিল না কারও, এমনকি বাবারও না | খুললাম ডায়েরিটা, হলদেটে পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে চোখ আটকাল কটা কথায়, দম বন্ধ লাগছিল কিছুক্ষনের জন্য | কানে তালা পড়ে ভোঁ ভোঁ করছে, পায়ের তলার মাটি যেন ক্ষনিকের জন্য সরে গেল, মায়ের ওই লেখা ওই কটা কথায়, যে আমি মা-এর পালিত সন্তান | কালো কালির অক্ষরগুলো বাস্তবটা জানান দিতেই যেন চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেল ক্ষনিকের জন্য, চোখের কোণের জলটা জানান দিচ্ছিল মনের ভিতরের রক্তক্ষরনটার | ভাগ্যিস কেউ ছিল না তখন ঘরে | এত বড় বিস্বাসঘাতকতা!
নিজের অস্তিত্বের লড়াইটা শুরু হয়ে গেছিল মনের ভিতর, আমার আসল পরিচয়টা জানার তো কোন পথও খোলা রেখে যায়নি মা | এত বড় সত্য গোপন কেন করল? আর যদিও বা করল তাহলে এই সত্যতা মায়ের মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে গেল না কেন? ডায়েরির পাতা সেটাকে কেন বাঁচিয়ে রাখল | নোনতা জলের ধারা গাল বেয়ে গড়িয়ে ডায়েরির পাতা ভেজাচ্ছিল | কেন মা কেন? কেন এমন করলে তোমরা? চোখের জল ডায়েরির পাতা ভেজাচ্ছিল যখন, তখনই দেখলাম আরও কটা শব্দ আমার ব্যাপারে | মা কোনদিন আমাদের দুজনকে আলাদা করে দেখেনি, উল্টে নিজের গর্ভজাত সন্তানের থেকেও আমায় বেশি ভালবেসেছেন হয়তো | সত্যি তো, আমার আর ভাই-এর মধ্যে তো খুনসুটি লাগতো সবসময়, মা আমায় বেশি ভালবাসে এই নিয়ে | আলগা ধূসর স্মৃতিগুলো মনের কোণে আসতেই নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি উঁকি দিল, সেই যেবার খেলতে গিয়ে আমার আঙুলটা ভেঙেছিল, তখন মায়ের চোখের উদ্বিগ্নতা, আর যেবার ধূম জ্বরে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, তখনও মায়ের ঘরের বাইরে হানটান | আর একবার আমার তখন বছর দশেক বয়স হবে, মামাবাড়িতে, খেলতে গিয়ে ছাদের সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে তিনতলার উঠোনে, জ্ঞান হারিয়েছিলাম, বেশ কটা সেলাইও পড়েছিল, শুধু মনে পড়ে জ্ঞান হারানোর আগের মুহূর্তে আমার রক্তাক্ত মাথাটা কোলে তুলে মায়ের বুক ফাটা কান্নাটা |
তারপর, ছোটবেলায় যখন বাবা মা-র সাথে দুর্গাপুজোয় মেলায় গিয়ে হাত ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল, ঐ কয়েক দন্ড যেন অন্ধকার কূপ-এ কেউ ফেলে দিয়েছিল আমায়, হাউহাউ করে কাঁদছিলাম শুধু | কয়েক ঘন্টার চেষ্টার পর যখন আমায় খুঁজে পাওয়া গেছিল, মা-ই তো ঝড়ের মত ছুটে এসে আমায় কোলে নিয়ে অজস্র হামি দিয়ে আমায় জড়িয়ে নিয়েছিল | আমিও তখন মাকে ফিরে পেয়ে কেঁদে কেঁদে মুখ চোখ লাল করে ফেলেছিলাম |
**************
বেশ কিছুক্ষন অতীতের পাতায় ডুবে থাকার পর ঘড়ির ঢং ঢং আওয়াজে বাস্তবে ফিরলাম | এই টুকরো ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে আসতেই নিজেকে খুব লজ্জিত লাগছিল | ক্ষনিকের যন্ত্রনায় মায়ের অকৃত্রিম ভালবাসার দিকে আঙুল তুলে সত্যিই নিজেকে খুব ছোট লাগছিল | মাকে নিয়ে আজ আমার আরো বেশি করে গর্ব করার দিন, আমার মা তো মা যশোদা | আজ এই মা-র জন্যই সুস্থ ভাবে বেঁচে আছি | মা তো মা-ই, সৎ মা, নিজের মা, পরের মা, এসব আবার কী? তোমায় খুব খুব ভালবাসি মা |