||১||
শেষ যখন বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিলাম, টবগুলো ফুল সমেত ঝলমল করতো, ফুলের টবগুলো আজ আর নেই | অনেকদিন পর এলাম তো, অনেকটাই পাল্টে গেছে |
বসার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর আগেও যেমন সাজানো ছিল, এখনও অনেকটা তেমনই, একটু আপডেটেড হয়েছে এই যা | বড় কাঠের টেবিল সরে ছোট কাচের খাবার টেবিল, এইরকম আর কী, সদস্য সংখ্যা কমেছে, স্বাভাবিক ভাবেই সেই জন্য |
শোবার ঘরে ঢুকে যেখানে আমাদের বিয়ের ছবিটা সাজানো থাকত, সেখানে আজ অন্য ছবি, মালিনী আর পিকলুর, মানে আমাদের ছেলের | পিকলুর বড় বেলার ছবিও সাজানো, খুব হ্যান্ডসাম দেখতে হয়েছে আমাদের ছেলে, মুখটাও ভারী সুন্দর | হবে নাই বা কেন, মালিনীর মুখটাও যে বড্ড মিষ্টি ছিল, ছেলে মা’র মতোই সুন্দর হয়েছে |
***************
কুহেলীর জন্য যখন এবাড়ির সবার সাথে অশান্তি করে চলে গেছিলাম, তখন পিকলু চোদ্দ বছর, তারপর আজ কেটে গেছে দীর্ঘ আট বছর | কুহেলী চলে গেছিল তিন বছর পরেই, শেষ পাঁচ বছরে সব হারিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল, নিতান্ত নিরুপায় হয়ে এবাড়িতে এলাম, নয়তো এই মুখ আমি কাউকে দেখতাম না | আমি মালিনীর সাথে যা করেছি তারপরও মালিনী বলেই…. |
||২||
খানিক অদ্ভুত ভাবেই ডায়েরিটা হাতে এসে গেল, মালিনীর লেখা | ও লিখত? কোনদিন দেখিনি তো, ওর কোন জিনিসে আর কোনদিন হাত দিতে পারব, অধিকার পাবো, ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন | লুকিয়ে কালো ডায়েরিটা যখন নিজের ঘরে নিয়ে এসে পড়তে শুরু করলাম, নিজের ভাঙাচোরা মুখটা যেন আরও বেশী করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আয়নায় নিজের চোখে চোখ অনেকদিনই রাখতে পারতাম না, এরপর হয়তো আর দাঁড়ানোর মেরুদন্ড টুকুও নেই |
*************
” কুহেলীর সাথে আজ প্রথম পরিচয় হলো অফিস পার্টিতে, আবেশের অফিসের কলিগ | ভারী মিষ্টি মেয়েটা, প্রথম আলাপেই কত সহজে মিশে গেল, ভারী সুন্দর গানের গলাও | ওকে বলেছি আমাদের বাড়ি যেন অবশ্যই আসে |”
” আজ আবেশের জন্মদিন | ওর জন্য ওর পছন্দের সমস্ত রান্না করেছিলাম, মটন, চিঙড়ির মালাইকারি, ভেটকী পাতুড়িটা এনিয়ে নিয়েছিলাম, এগুলো পিকলুরও ফেভারিট | আজ আমার আবেশকে খুশি লাগছিল, আমার হাতের মালাইকারি খেয়ে | অনেকদিন পর করলাম |”
” আজ কুহেলী প্রথম আমাদের বাড়ি এল, আমাদের বাড়ির কাছে মানে ঐ আহিরীটোলার দিকে ওর কী কাজ ছিল, তাই | খুব ভাল লাগল ও এসেছে বলে | খালি পিকলুটাই এত বাজে ব্যবহার করল যে কী বলব, ও যে কবে বড় হবে |”
” আজ কেন জানি না খুব অস্বস্তি হচ্ছে | ছেলেটার কথা শুনে নিজের মনটাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না | ওকে যাই হোক বলে শান্ত করলাম কিন্তু নিজেকে কীভাবে শান্ত করব? পিকলু আজ হঠাৎ বলে উঠল, “বাবা আর তোমায় ভাল বসে না মা |” এতটুকু ছেলের মুখে এরকম কথাবার্তা বরদাস্ত করা যায় না, আমিও করিনি, হাতও উঠেছে | এতক্ষনে শান্ত করে খাইয়ে এলাম, কিন্তু ও কিসের ভিত্তিতে এত বড় একটা কথা বলল, সেটাই বুঝতে পারছি না |”
” আজ পিকলু্লুটার জন্মদিন, মন্দির পুজো দিতে গেছিলাম, বাড়িতে একটা অনুষ্ঠানও ছিল | খুব অবাক লাগলো এই প্রথম নিজের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আবেশ থাকলো না | যখন ফিরলো তখন লোকজন বেশির ভাগই চলে গেছে | পিকলুর মনটাও খারাপ হয়ে গেল আজ, “বাবা আজকের দিনে রইল না” | যদিও আবেশ বারবার বলল অফিসের কাজে আটকে গেছিল, কিন্তু কেন জানি না মনে হলো আবেশের চোখ সত্যি বলছিল না | আবেশ কেমন যেন সত্যতা ঢাকা দেওয়ার জন্য আপ্রাণ মিথ্যে যুক্তি সাজাচ্ছিল | আমার ধারণা যেন ভুলই হয় |
” আমার আবেশ আজ অনেক বদলে গেছে, অনেক | আমাদের বিবাহ-বার্ষিকীর দিন, ও আমায় উইশ করেনি, এই প্রথম সেটা হলো | শুধু তাই নয়, ও আজকাল আমায় এড়িয়েই যাচ্ছে | পাশের বাড়ির বোস কাকীমা যা বলল, আমি জানি এ সত্যি হতে পারে না | আমি আমার আবেশকে বিশ্বাস করি, ও আমায় এভাবে ঠকাতে পারে না | “
” পাশের মানুষগুলোর কথা অবিশ্বাস করা যায়, কিন্তু নিজের চোখকে কীভাবে অবিশ্বাস করব আবেশ? কুহেলীর সাথে আজ আমি তোমায় এ কী ভাবে দেখলাম? এতবড় বিশ্বাস ঘাতকতা? নিজের স্ত্রী সন্তানকে ভুলে অন্য আর একজন মানুষকে তুমি রেস্টুরেন্টে বসে খাইয়ে দিচ্ছো? ভাগ্যিস আমায় দেখতে পাওনি, আমার এতদিনের ভালবাসার এই প্রতিদান? আজ আর লেখার ক্ষমতা নেই |”
” অপেক্ষা করব তুমি কবে নিজে থেকে সবটা বল, তার আগে তোমায় কিচ্ছু বলব না আমি | এখন তোমার ফোন, তোমার জামার পকেট, রুমাল, ব্যাগ-এ কুহেলীর উপস্থিতিগুলো বড় বেশি চোখে পড়ছে | তুমি কী ইচ্ছে করেই করছো সেটা? আমায় সোজাসুজি বলার সাহস নেই বলে? আর কত নামবে?”
” তুমি চলে যায় আবেশ, তুমি চলে যায়, আমি তোমায় কক্ষনো আটকাব না | শুধু চলে যাওয়ার সাথে সাথে আমার আর পিকলুর উপর সমস্ত অধিকারটাও তোমায় ছেড়ে যেতে হবে | কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, তুমি আমার সাথে, আমার আবেশ আমার পিঠে এভাবে ছুরি মারতে পারে | এত বছর পর এসবের কী খুব দরকার ছিল? একবারও মনে পড়ল না, আমাদের কাটানো একসাথে এতগুলো বছর, আমাদের ভালবাসা? কলেজে ক্লাসের বাইরে তোমার আমার জন্য মুগধ দৃষ্টিতে অপেক্ষা, আমাদের একসাথে দেখা প্রথম সূর্যাস্ত, আমাদের প্রথম সরস্বতী পূজো একসাথে কাটানোটা মনে পড়ে? তোমার জন্য নিজের বাড়ির সাথে লড়েছিলাম, আমার শক্তি ছিলে তুমি, এভাবে কেন পিঠে ছুরি মারলে বলতে পারো? তোমার হাতের প্রথম ছোঁয়া, প্রথম আমার শাড়ীর কুচিটা সামলে দেওয়া, সব ভুলে গেলে? আজ কীরকম বেপরোয়ার মত নিজের ইচ্ছে আর সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে দিয়ে চলে গেলে | তোমার সামনে কাঁদব না আর ঠিকই করে নিয়েছিলাম, তাই ভিতরের রক্তক্ষরণটা দেখলে না, এতবড় ক্ষতটা নিয়ে বাঁচবো কীভাবে? তুমি সুখী হও, কিন্তু, কুহেলী তোমায় সত্যি সুখী করবে তো?”
” বাড়ির সকলকে ছেড়ে নিজের সন্তানকে ছেড়ে যেতে তোমার এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না? দ্রুত হাতে তোমার ব্যাগপত্র গোছানো দেখে কে বলবে তুমি এবাড়ির ছেলে, বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছ? যায়, তোমায় আটকাব না | শুধু আর ফিরে আসার সাহসটা খবরদার দেখিও না, আর পারব না তোমার আশ্রয় হতে | তুমি ভালো থেকো, খুব ভালো থেকো, শুধু আর ফিরে এসো না, ক্ষমা চাইতেও না | ক্ষমা তোমায় অনেক দিন-ই করে দিয়েছি | আমি বেঁচে আছি যতদিন এবাড়ির উপর আর কোন অধিকার ফলাতে ফিরে এসো না যেন | যখন আমার ভালবাসাটাও কম পড়ল তোমার কাছে, তখন যেখানে ভাল থাকবে সেখানেই থেকো | ভালোথেকো, দূরে থেকো | “
আর পড়তে পারিনি ডায়েরিটা | পড়তে চাইনি আসলে | আজ মালিনী নেই, ওকে শেষবার দেখার অনুমতি টুকুও ছিল না | হারিয়েছি সবকিছু | পিকলুকেও হারিয়েছি, কুহেলীর মরণ ফাঁদে, নিজেরই দোষে সব গেছে, আত্মসম্মানটুকুও | জীবনটা এখন ডায়েরির খালি পাতা ছাড়া আর কিচ্ছু না |