।।১।।
ফুলপিসির বিয়েতে তোমার পরা ময়ূরকন্ঠী রঙের বেনারসীর কথাটা মনে পড়ে? মাথায় জুঁই-এর মালাটার সুবাসে আর মোহময়ী রঙে তোমায় বড় অন্যরকম লাগছিল । খুব ইচ্ছে হয়েছিল তোমার সাথে এক ফ্রেমে দাঁড়ানোর, আসোনি তুমি, বড় সংকোচ ছিল যে তোমার, বাকী আর পাঁচটা দিনের মতো আমার মনটা আবার ভেঙেছিল ।
মনে পড়ে, প্রথম বিয়ের পর দেশের বাড়িতে সর্ষেক্ষেতে ঘুরতে যাওয়াটা । লাল হলুদ শাড়ি, কপালে চওড়া সিঁদুর, শাখাপলা নোয়ার বতুন বউ তুমি, সর্ষের মিষ্টি হলুদ রঙের সাথে সুন্দরী তোমার সাজ সেদিন মিলেমিশে একাকার হয়েছিল, ইচ্ছে হয়েছিল, সর্ষেক্ষেতের শেষ সীমানায় একান্তে তোমার হাত দুটো ধরার । আসোনি তুমি ।
আচ্ছা, কনে দেখা আলোয় বলে মেয়েদের দেখতে সব থেকে সুন্দর লাগে, লাল টকটকে আগুন রঙা শাড়ীটায় বিয়ের পর প্রথম রথযাত্রায় আমাদের গ্রামে সবার সাথে হাত মিলিয়ে রথ টেনেছিলে তুমি, আমার সাথে হাতের ছোঁয়ায় সেদিনও হাতটা খানিক সরিয়ে নিয়েছিলে, ভুলিনি আমি । বিয়ের পরের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে সকলের হাজারো খুনসুটির মাঝে চোখ বার বার ফিরে যাচ্ছিল তোমার দিকে । বিয়ের লাল বেনারসীটায় প্রথম দিনের মত সেদিনও ছিলে অপরূপা, আমার দিকে চোখ পড়তেই নামিয়ে নিয়েছিলে চোখ, বুঝিয়ে দিয়েছিলে হাতের অস্থিরতায়, ভালো লাগছিল না তোমার ।
তুমি আমায় অনেক দিয়েছ বেলা, কোনো কর্তব্যে কোন ত্রুটি আজও কেউ চাইলেও দেখাতে পারবে না । তুমি আমাদের সংসার পূরণ করেছ তিন ছেলে মেয়ে দিয়ে | একালে যেমন সকালের প্রেশারের ওষুধ থেকে রাতের ছানাটা, কিছু ভুল হয়না তোমার, তেমনি ওকালে সকালের অফিসের ভাত, দুপুরের হরেক দিনের হরেক টিফিন থেকে রাতের খাবার, সব করেছ হাসি মুখে ।
তোমার হাতের কাজে সাজানো এ সংসার, যেদিকে তাকাই তোমারই ছোঁয়া, টেবিলের টেবিল ক্লথ থেকে খেতে বসার আসনটা, সব জায়গা জুড়েই শুধু তুমি, তবু তুমি আমায় জুড়ে নেই, ছিলে না কোনদিন ।
বাবার জিদের কাছে নতি স্বীকার করে তোমায় বিয়ে করেছিলাম, তা তো অজানা নয় তোমার কাছে, ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম মাধবীকেই । ফাঁকি দিয়ে অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়ার পর এই পরিবার তোমায় আমার জীবনে আনে, কিন্তু, তুমি আমার জীবনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ালে । তোমার চোখেও দায়িত্ব কর্তব্যের ছায়া দেখেছি, আমার জন্য, এ সংসারের জন্য, কিন্তু আমার জন্য টান তো কখনো দেখিনি ।
তোমার আমার এই সংসার, এই ঘর একটা সমঝোতার তাঁবু-ই হয়ে রয়ে গেল, ভালবাসার ঘর বোধ হয় হলো না আর । দুজনের দুজনের প্রতি কোনদিন কোন অভিযোগ নেই, কোন অশান্তি নেই, যেন এক বিশাল বরফের চাঁই-এর নীচে চাপা পড়া একটা সম্পর্ক, থুড়ি সমঝোতার বন্ধন, যার কোন পচন হয়নি, বরফের জন্য, যেমনটি প্রথমে ছিল তেমনটিই । সাজানো গোছানো, কিন্তু তাতে কোন উষ্নতা নেই, ভালোবাসার আর্তি নেই, আছে শুধু সমঝোতা আর কর্তব্যের তুষার ।
**************
আর পড়তে ইচ্ছে করল না বেলা দেবীর, আজ হুট করেই সমরবাবুর ডায়েরিটা পড়ে ফেললেন | তা’ ভালো, ভাগ্যিস পড়ে ফেললেন, নয়তো সবদিনের মতো ওনার মনে সেই অপরাধ বোধটা চলতেই থাকতো – ভালো না বাসার অপরাধ ।
হ্যাঁ, সত্যিই তো, বিমলদাকে ছাড়া আর কোনদিন কাউকে তো ভালবাসতে পারেননি, ভালবাসতে চানওনি বেলাদেবী । বিপ্লবী মানুষটার প্রতি ভালবাসার সাথে অপার শ্রদ্ধাও ছিল । সে শ্রদ্ধা নিজের স্বামীকেও করেন, কিন্তু ভালোবাসা? নাহ, সেটি আর হয়নি । আজ ওনারও ১০০% নিশ্চিত হয়ে মনটা শান্ত লাগছে যে, উনি একাই ওনাকে ভালবাসেননি তা নয়, ওপাশ থেকেও ভালোবাসা আসেনি । মাসতুতো দাদার বিবাহবার্ষিকীতে উপহার দেবে বলে কনকচাঁপা রঙের শাড়িটা কিনে এনেছিলে, আমি ভেবেছিলাম আমার জন্য বুঝি… তোমার মনেই ছিল না কোন একদিন আমিও ঐ শাড়িটার আবদার রেখেছিলাম ।
মাংস খেতে বড্ড গন্ধ লাগে, জানতে তুমি, তবু সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠানে বাড়িতে লোকজন এলে তুমি সবার পছন্দের মাংস কিনে আনো । আমার জন্য আলাদা করে একটুকরো মাছ জোটেনি কোনদিন, তোমার মনেই থাকেনি ।
তোমার আমার বিয়ের তো খুব বেশি ছবি নেই, একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখব বলে আবদার রেখেছিলাম, ছবিটা বাঁধাবে বলে দোকানে দিয়ে এসেছিলে, ওটা দোকানেই হারিয়ে গেছিল, আর বাড়ি অবধি আসেনি ।
এই ভালো, কাউকে ভালবাসা পাওয়ার জন্য কষ্ট তো পেতে হলো না । সমঝোতার আড়ালে বেশ চলেছি দু’জন । নাহ, আমিও তোমায় কোনদিন ভালোবাসিনি, সত্যিই বাসিনি ।