।। ১।।
রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না। নেহাত মা-বাবাও জোর করল তাই বাধ্য হলো আসতে। বাবা ওর এই বন্ধুগুলোকেই চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারে। সেই ছোট্টবেলা থেকে ওরা একসাথে। স্কুল কলেজ পেরিয়ে কর্মসূত্রে আলাদা আলাদা জায়গায় চলে গেলেও এই সুতোটা ছেড়েনি। তাই ওর একটা ফোন করা মাত্রই কেউ এতটুকু দেরি করেনি ওর কাছে পৌঁছাতে। পাশে থাকলেও হাতটা ধরার লোকের এখন বড় অভাব। আর এই সময় বন্ধুগুলো যদি পাশে থাকে, সাথে থাকে, এর থেকে সুখের আর কি হতে পারে।
ট্রেন তখনও ছাড়েনি স্টেশন থেকে, লোকজন উঠতে ব্যস্ত, নিজের মালপত্র বাগিয়ে গুছিয়ে সিট এ বসতে ব্যস্ত, ওদিকে একজন হয়তো বাড়ি থেকে দূরে কোথাও পড়তে বা কাজের জন্য যাচ্ছে, তার বাবার আর মায়ের সাথে সাথে তার চোখ ও ছলছল। একটা বাচ্চা সামনের কোনাকুনি সিটটায় বসে একটা চিপসের প্যাকেট হাতে নিয়ে, হা করে ওর দিকে তাকিয়ে বিস্মিত চোখে। কি চলছে ওই পুচকু মাথায় কে জানে। মাথার দুদিকে দুটি এই টুকু ঝুটকি বাঁধা, পরনে একটা মিষ্টি হলুদ রঙের ফুলের কাজ করা ফ্রক। গায়ের টুকটুকে রঙের সাথে জামার রং টা মিলে ভারী মিষ্টি লাগছে বাচ্চা মেয়েটাকে। ফোকলা মুখে খানিক হাসল ও নিজের মনেই ওর দিকে তাকিয়ে। এইরকমই একটা পুতুলের স্বপ্ন একসাথে দেখেছিল ও আর নীল।
চোখটা জ্বলে উঠল, অনেকক্ষণ ধরে একভাবে তাকিয়েছিল বলে, চোখ দুটো বুজে ফেলল নন্দিনী। চোখের পাতা ভিজে গেছে, রুমাল দিয়ে তাড়াতাড়ি করে চোখের কোণটা মুছে নিলো ও,কাজলটা ঠিক আছে তো, মোবাইলের ক্যামেরা অন করে আরেকবার নিজেকে দেখছে নিলো ও। এই তো আসছে সঙ্গীতা, হাতে একগাদা জিনিস নিয়ে। গেল একটা লুডোর কার্ড কিনতে, আর আসছে দেখো ! এই মেয়েটা না সত্যি ! আর বদলাল না। তবে এই-ই ভালো, যতদিন এরকম থাকে, ততদিনই ভালো, বদলে কি লাভ হলো নন্দিনীর ?
নিজেকে ভিতর থেকে বেশ ঝেড়ে নিলো যেন ও। ওরা দেখলে আবার বকাবকি শুরু করবে। ওর ভালোর জন্যই বলে অবশ্য। এই বন্ধুগুলার ভালোবাসা একটু অন্যরকম ই হয়। কিন্তু বড় মধুর হয় এই সম্পর্ক গুলো। একেবারে নিখাদ। কোনো হিংসা নেই, নেই কোনো ঘৃণা, এই মানুষগুলো নিঃশর্তভাবে ওর ভালই চায় শুধু।
মিতালি, সঙ্গীতা, রিকু আর নন্দিনী এই ৪ জন যেন একে ওপরের পরিপূরক। ছোটবেলা থেকেই ওদের সবাই চিনতো হরিহর আত্মা হিসেবেই। আজ তাই একজনের জীবনে যখন ঝড় উঠেছে, বাকিরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে একইভাবে।
সঙ্গীতা একটা বেসরকারি স্কুলে ঢুকেছে কিছুদিন হলো, মিতালি একটা চাকরি করছিল একটা বড়োসড়ো কোম্পানিতে, এখন কিছুদিন হলো ছেড়েছে, আর রিকু একটু শিল্পী গোছের। গান নিয়ে থাকতেই ভালোবাসে। বিয়েও করেনি।
*****
ট্রেন দুলে উঠল, হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ওর প্রাণের সইরা, ওর একাকী নিঃসঙ্গতায়।
*****
পাহাড়ের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত মাহাত্ম্য আছে, যা অস্বীকার করা যায় না। এক অমোঘ আকর্ষণ, যার টানে বার বার ছুটে আসে মানুষ। নন্দিনীই মনে হয় একমাত্র মানুষ যে এর আগে কখনো এই পাহাড়ের বুকে আসেনি। নীল বহুবার বলেছিল, কিন্তু একটা অদ্ভুত ভীতি কাজ করত মনে, সযত্নে এড়িয়ে যেত এই পাহাড়ের হাতছানি ও এতদিন। কিন্তু আজ এখানে নামার পর থেকে বার বার এটাই মনে হচ্ছে নন্দিনীর, কেন এর আগে আসেনি ? যেন বড্ড দেরি হয়ে গেছে কোনো প্রিয় মানুষের কাছে পৌঁছাতে।
পাহাড় যতটাই সুন্দর ততটাই ভয়ঙ্কর, এই অসাধারণ সৃষ্টির দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাটাদিন। আর কিছুর প্রয়োজন ই নেই। নীল ও ঠিক এটাই বলতো, “একবার চল, খারাপ লাগলে আমায় জুতোপেটা করিস।”
ভাবতে ভাবতে নিজের মনেই হেসে উঠল নন্দিনী।
ওরা যে হোটেল টায় উঠছে ওখান থেকে ঘরে বসেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। কিছু ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনি আছে, সেরকমই দুটো ঘর পছন্দ করেছিল সঙ্গীতা। তার একটাতেই থাকবে ওরা দুজন, আরেকটায় রিকু আর মিতালি। পাশাপাশিই পেয়ে গেছে। রিসেপশনে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকিয়ে জায়গাটার ভিন্ন জীবনযাত্রা, ভিন্ন মানুষজনের সাহচর্য উপভোগ করছিল নন্দিনী। একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে খেলছিল সামনেটায়, স্থানীয়ই হবে। তার মা তাকে বকছে এটুকু বুঝতে পারছে ও, যদিও ভাষা বুঝতে পারছে না। কিন্তু যেখানেই যায় না কেন, পৃথিবীর যেকোনো কোনায় মায়ের ভাষা একই হয় হয়তো। খেলতে খেলতে একবার বাচ্ছাটা ওর কাছে দৌড়ে চলে এসেছিল, কোলে নিতেই যাচ্ছিল তখনি রিকু ডাকল।
“আরে সইটা কর। “
“ও হ্যাঁ… “
রিসেপশন ডেস্কে ফিরে গেল নন্দিনী, বাচ্ছাটা তখন ও হাতে একটা লাল বল নিয়ে ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। ভাবখানা এমন, যেন কোলে নিতে গিয়ে ও নিলে না কেন ? এ তো ভারী কথার খেলাপ !”
বাচ্ছাটার চোখের ভাষার মতোই চোখের চাহনি ছিল নীল এর ও, কলেজ লাইফ এ। ভীষণ নিষ্পাপ, ভীষণ উজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসী ও সৎ ছিল সেই দৃষ্টি। যার প্রেমে পড়তে দুবার ভাবেনি নন্দিনী কিন্তু আজ সব কিছু এভাবে উল্টে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি কোনোদিন ও ও, নীল ও।
পেনটা হাতে নিয়ে খাতাটা নিজের কাছে টেনে নিলো নন্দিনী। সইটা করবার জন্য। কিন্তু পৃষ্ঠার একদম প্রথম নাম আর ঠিকানাটার দিকে চোখ পড়তেই থমকে গেল ওর চারপাশটা। বুকের ভিতর হৃদপিন্ডটা যেন বড় বেশি করে কাজ শুরু করে দিয়েছে, হাতুড়ি পেটার মতো করে সজোরে নির্মমভাবে ধাক্কা মেরে চলেছে বুকের খাঁচার মধ্যে।
চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রায় দশ বছর আগের ফেলে আসা ক্লাসরুমটা। বিবর্ণ, হলুদ হয়ে যাওয়া স্মৃতিটা এক নিমেষে যেন জীবন্ত রঙিন হয়ে উঠল চোখের সামনে। এন ডি এম কলেজ, ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্ট, সেকেন্ড ইয়ার, রোল নম্বর ওয়ান, আবির রায়চৌধুরী।
।। ২।।
(দশ বছর আগে )
“দ্যাখ দ্যাখ !”
“তোদের দেখতে হয় দ্যাখ। আমার অলরেডি দেখা হয়ে গেছে। “
উফফ ! কি দারুণ দেখতে রে ! কি ফর্সা ! গালে হালকা দাড়িও আছে। কালো পাঞ্জাবিতে হেব্বি হ্যান্ডসাম লাগছে কিন্তু। আমায় বললে তো আমি এখুনি হ্যাঁ বলে দিতাম। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে না বলে কি থাকা যায় ?”
“আবার বাজে বকছিস। অনেকবার বারণ করেছি। “
“আরে আমার সত্যি জানতে ইচ্ছে করে, তুই কি ভাবে ছেলেটাকে পাত্তা না দিয়ে থাকিস। না বলে দিবি সটান ! একটু ও কষ্ট হবে না রে তোর !”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল নন্দিনীর বান্ধবীরা। কলেজ একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে ও আর আবির। আবির নানাভাবে বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে নিজের মনের কথা নন্দিনীকে। নন্দিনীই পাত্তা যায়নি। আসলে নীলকে ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন ও বোধ করেনা ও। নীলের জায়গা আর কেউ নিতে পারবে না। তা সে যে যতই বলুক ওকে। এখনো আবির সরাসরি কিছু বলেনি যদিও। তবে বললে… “
রীতার ধাক্কায় ফিরে তাকাল নন্দিনী।
“কিরে চল। এ.বি আসছে। তাড়াতাড়ি চল ক্লাসে। “
নেক্সট ক্লাসের জন্য তাড়াতাড়ি দৌড় লাগাল ওরা দোতলার দিকে।
*****
আবিরের মত ভদ্র ছেলে সত্যি বলতে কি কমই আছে। দেখতে শুনতেও ভালো, সুপুরুষ যাকে বলে! কলেজের বাকি মেয়েরা তো তার উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টিতে, তার বুদ্ধিদীপ্ত কথায়, তার মুক্তোঝরা হাসিতে কুপোকাত। একমাথা ঘন চুল সামলাতে হিমশিম হাত দুটো স্পর্শ করার সুযোগ কোনো মেয়ের হয়নি। আর সেই পুরুষই আরেক জনের জন্য পাগল। নন্দিনী। জানে সবাই, বোঝে সবাই, নন্দিনী ও। কিন্তু না তো এর বেশি আবির এগিয়েছে, না নন্দিনী। কারণ নন্দিনীর জীবনে আরেকজন আছে যে। নীল! এই মানুষটাই নন্দিনীর জীবনের চরম সত্যি।
ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট, সেকেন্ড ইয়ার, স্কলার!
*****
নীলের সব কিছুতেই ফাজলামো। ওকে অনেকবার বলেছে নন্দিনী, পাত্তাই দেয় না।
মাঝে মাঝে ভাবে নন্দিনী, ওর কি একটুও ইন্সকিউরিটি ফিল হয় না? হওয়া তো উচিত। আবিরের নামটাও মনে থাকে না ওরা মাঝে মাঝে। নন্দিনীর প্রতি যে ও উদাসীন তা নয়, কিন্তু তাও একটু অদ্ভুত লাগে।
কিছু বললেই বলে, ভালো লাগলে আবিরকে পছন্দ করলেও ওর নাকি কোনো অসুবিধা নেই। এ আবার কেমন প্রেম? যে নির্দ্বিধায় প্রেমিকাকে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে পারে?
নীল বলে, যখন ভালোবাসা গভীরতম, তখনই এমন পর্যায়ে মানুষ পৌঁছাতে পারে!
অত দরকার নেই নন্দিনীর। এই জন্য মাঝে মাঝে ভাবতে না চাইলেও ভাবনা এসেই যায় নন্দিনীর মনে, ও কিছু ভুল করছে না তো?
*****
কিছুদিনের মধ্যেই ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। হাতে আর মাত্র কটা দিন। নীল ও চূড়ান্ত ব্যস্ত, ওর ও চাপ। বেশ কদিন তাই দেখা সাক্ষাৎ কথা বার্তাও কম।
আজ কিছু নোটসের জন্য কলেজের লাইব্রেরিতে এসেছে নন্দিনী। এই বিল্ডিংটায় নতুন লিফটের ব্যবস্থা হয়েছে কয়েক মাস হল। লাইব্রেরি ৪তলায়, লিফটের ভিতর ঢুকে বোতাম টিপে দিল নন্দিনী। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিজের গন্তব্যে পৌঁছে পড়ায় মন দিল ও।
*****
কেউ একদৃষ্টে কারো দিকে তাকিয়ে থাকলে সেটা ঠিকই অনুভব করা যায়। নন্দিনীরও সেরকমই মনে হচ্ছিল, কিন্তু বারংবার তাকিয়েও নিজের প্রশ্নের উত্তর পেলো না ও।
নন্দিনীর পরনে আজ একটা কালো রঙের সালোয়ার সুট, ওড়না দিয়ে মুখটা মুছে নিল একবার। বেশ ঘাম হচ্ছে, কিন্তু কই আর কেউ তো ঘামছে না।
ও একটু বেশিই ভাবছে। এত টেনশন কেন হচ্ছে কে জানে, তাও দিনের বেলায়, রাত হলেও না হয় কথা ছিল।
*****
ঘন্টাখানেক পর উঠে পড়ল নন্দিনী, ঘড়িটা দেখে নিল একবার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। পড়ন্ত রোদে কেউ নেই ও তেমন। কিন্তু সেই অনুভূতিটা এখনও কেমন তাড়া করছে। কেন হচ্ছে কে জানে, লিফটের বোতাম টিপে উঠে পড়ল নন্দিনী।
লিফ্টটা বেশ বড়, দুপাশ বাইরে থেকে দেখা যায় না, ঢুকেই বাম দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল নন্দিনী। আবির। আগে থেকেই ছিল লিফ্ট এর ভিতর। সাথে আরও দুটো মেয়ে ছিল, একটু ভরসা পেলো যেন নন্দিনী। উঠেই গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপে দিল। পরের ফ্লোরেই নেমে গেল মেয়েদুটি।
একটা অদ্ভুত অসহায়তা গ্রাস করছে যেন নন্দিনীকে। আবির ওর দিকে তাকায়ওনি, তাও যেন কত কিছু বলে দিচ্ছে ওরা শরীরী ভাষা! এই জন্যই কি মনে হচ্ছিল নন্দিনীর, যে কেউ ওকে দেখছে! আবির ই তার মানে!
অজানা আশঙ্কায় বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটতে শুরু করল যেই, তখনই ঘটল বিপত্তিটা।
অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে, প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল লিফ্টটা। স্বাভাবিক ভাবেই বেশ ভয় পেয়েই একবার তাকাল আবিরের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল আর কারো সাথে না, এর সাথেই বিপত্তি ঘটতে হল!
এই প্রথম মনে হয় আবির ওর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে কথা বলল।
আবিরের গলার স্বর, ওরা চোখের চাহনি এই প্রথম এত কাছ থেকে দেখল নন্দিনী। খুব বেশি কিছু বলল ও না আবির, একটা আশ্বাসের ছায়া ছিল ওর চোখে, শুধু বলল “একটু ধৈর্য্য ধরো, এত ভয়ের কিছু নেই।” দৃপ্ত বলিষ্ঠ সেই কণ্ঠ, চোখ দুটো উজ্জ্বল, এক নিমেষের মধ্যে নন্দিনীর ভিতর চলা অস্থিরতা যেন তলিয়ে যেতে লাগল একটু একটু করে। একটা অদৃশ্য ভরসার হাত যেন জড়িয়ে ছিল ওকে। আর তো সেই অস্বস্তিটা হচ্ছে না! আবিরের দিকে তাকিয়ে ছিল নন্দিনী, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে, নিজের অজান্তে, অকারণেই।
এর আগে কোনোদিনও আবিরের সাথে দাঁড়িয়ে এত কাছ থেকে কথা বলেনি ও।
একটা জাদুকাঠি যেন কেউ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল চারপাশটায়, লিফ্ট চালু ও হয়ে গেল। যথা সময়ে নীচে নেমেও গেল ওরা দুজন, কিন্তু যে অনুভূতি আজ অব্দি কাজ করত ওর মনে, তার এক আমূল পরিবর্তন ঘটল।
লিফ্ট থেকে বেরোনোর সময় নিজে থেকেই কথা বলল নন্দিনী, নিতান্তই কেজো কথা একটা দুটো। কিন্তু ইচ্ছে হল কথা বলতে, আবির অতিরিক্ত একটি কথাও বলল না। সেই ভুবন ভোলানো হাসি হেসে চলে গেল এগিয়ে।
অনেকটা ভালোলাগা নিয়ে একাই দাঁড়িয়ে রইল নন্দিনী। খুব ভালো লাগছিল ওর।
আচ্ছা সবাই যে বলে, ও ও অনুভব করেছে আবির ওর দিকেই, ওর জন্যই… তাহলে আজ তো সুযোগ ছিলই। সেই সুযোগের সদব্যবহার না করে এভাবে উপেক্ষা করে চলে গেল কেন আবির!
তাহলে কি আদতে কিছুই ছিল না বা নেই, নন্দিনীই ভুল ভাবতো!
*****
সেই দিনের পর থেকে আবিরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি টা কোনো এক অজানা কারণেই বদলে গিয়েছিল। বন্ধু হতে বেশি সময় লাগেনি তারপর। নন্দিনীর একবারের জন্য ও মনে হয়নি আবিরের মনে অন্য কিছু আছে বন্ধুত্ব ছাড়া। ক্লাসের বাকি বন্ধুরাও ধীরে ধীরে মজা মস্করা করা কমিয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিল সবকিছু, কিন্তু সাথে সাথেই তৈরী হচ্ছিল এক গভীর নিমচাপ, তুমুল ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে গিয়েছিল নন্দিনী সেইদিনই, যেদিন এক্সিডেন্টটা হয়েছিল।
*****
৬ই জুন, আবিরের জন্মদিন। সেইদিন টা ঐ বছর বৃহস্পতিবার পড়েছিল। আবিরের বহু চেষ্টাতেও কোনো আমিষ খাবার খায়নি নন্দিনী, সব বন্ধুদের খাওয়াবে, শুধু নন্দিনীর জন্য সবার কেন অসুবিধা হবে, তাই যেতে চাইছিল না ও। আবির অনেকবার বলায় যেতে বাধ্য হল। নীল কে সবকিছুই বলে নন্দিনী, আজকের কথাটা বলতে ইচ্ছে হল না। কেন কে জানে? বেমালুম একটা মিথ্যে কথা বলে দিল নীলকে, যা কোনোদিনও বলে না। বিগত কিছুদিন ধরেই নীলকে এক আধটা মিথ্যে কথা হামেশাই বলছে নন্দিনী। অবশ্য বলার যে কোন জোরালো কারণ আছে তাও নয়।
সবাইকে নিয়ে যাওয়ার কথা হল সন্ধ্যায়। ‘মধুমালতি’ বলে যে রেস্টুরেন্টটা খুলেছে, সেখানেই যাওয়ার কথা হল। সবাই পৌঁছে যাবে নিজের মতন বাড়ি থেকে, নন্দিনীকে আবির নিতে আসবে ওর বাড়িতে, দাদার বাইক নিয়ে।
আবিরের সাথে বাইকে বসার সময় প্রথম একটু অস্বস্তি এলো নন্দিনীর মধ্যে, কিন্তু সেই অস্বস্তি মনের মধ্যে বিরক্তির উদ্রেগ করে না, একটা মিষ্টি অনুভূতি ছড়িয়ে দেয় যেন।
হেলমেটটা পড়তে পারছিল না নন্দিনী, আবিরের দিকে সাহায্যের দৃষ্টি নিয়ে তাকাল নন্দিনী। আবির আর বাইক থেকে নামেনি, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নন্দিনীর দিকে, ওই দৃষ্টিতে কি ছিল কে জানে। আচমকাই যেন সব কিছুতে আগুনে রং ছড়িয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে, সময় যেন থমকে গেছে ওই দৃষ্টিতে, নন্দিনী ওর দৃষ্টি ফেরাল না, আবিরের ওই চোখের দিকেই তাকিয়ে রইলো বোকার মতো, একবারের জন্য ও আর ইচ্ছে করছিলো না আর চোখ নামাতে। আগুনে রং কখনো এত মনোমুগ্ধকর হতে পারে ! আবিরের পরনে একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি, মাথায় হেলমেট নেই। হাত দুটো বাড়িয়ে নন্দিনীকে হেলমেটটা পরাতে উদ্যত হলো, কিন্তু আর তো কোনো হেলমেট নেই ! আবিরকে চোখের ইশারায় হেলমেটটা পড়তে বললো নন্দিনী, মাথা থেকে খুলে দিলো হেলমেট।
“কি হলো?”
“আপনার হেলমেট কোথায় ?”
“একটাই হেলমেট। “
“তো সেটা আমায় দিচ্ছ কেন। বাইকটা চালাবে তুমি আমি নই। “
চোখ দুটো নামিয়ে নিয়েছিল এক সেকেন্ডের জন্য আবির, নিজের মাথা থেকে খুলে ওই মুহূর্তের মধ্যে জোর করে পরিয়ে দিয়েছিল নন্দিনী হেলমেটটা । নন্দিনীর সাথে কথায় পারেনি সেদিন আবির, ভাগ্যিস পারেনি !
সব কিছু ঠিকঠাকই ছিল, একটু রাত হয়ে গেছিল বটে। ফুটপাথের দোকানপাটগুলো পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে, বাইকটা একটু দ্রুতই চালাচ্ছিল আবির। নন্দিনীর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে এই ভয়ে, বার বার বলছিলো ও সেটা, নন্দিনী একটা কথাও বলেনি। বৃষ্টি ভেজা শহরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলো শুধু, হাওয়ায় উড়ছিল চুল, চোখটা বার বার চলে যাচ্ছিল সামনের আয়নাতে, আবিরের মুখটা দেখছিল নন্দিনী আর বাতাসে ভেসে চলা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিটুকু মেখে নিচ্ছিল সারা গায়ে। রাস্তাটা ভিজে ছিল, বাইকটাও স্পীডেই ছিল, একবার আয়নায় নন্দিনীর মুখটা দেখতেই কি আবির ও চোখ নামিয়েছিল কাঁচে !
একটা জোরালো ধাক্কা! আর হাড় ভাঙা অসহ্য যন্ত্ৰণা, অন্ধকার হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে সব কিছু চোখের সামনে। এটুকু বুঝতে পেরেছিল নন্দিনী যে রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়ল, বাইকের চাকাটা স্কিড করল নাকি ! শ্রবণক্ষমতাটা তখনও বজায় ছিল। আর সেটা ছিল বলেই কথা গুলো শুনতে পেয়েছিল নন্দিনী। যদি শুনতে না পেত তাহলেই হয়তো ভালো হতো !
।। ৩।।
(এখন)
সকাল সকাল সূর্যোদয় দেখতে উঠতে হবে কাল, ঠান্ডাটাও ভালোই। আর ক্লান্তি তো আছেই। আজ তাই তাড়াতাড়ি শুতে যাবার তোড়জোড়। কিন্তু নন্দিনীর চোখে যেন ঘুমের চিহ্নমাত্র নেই। সেই তখন থেকে একটাই নাম ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। রুম নম্বরটাও দেখে নিয়েছে, ফার্স্ট ফ্লোর, যাবে একবার?
ধুর! কি সব ভুলভাল ভাবছে ও? সে হয়তো আজ বিবাহিত, ঘোরতর সংসারী। মাথাতেই এল কি ভাবে কথাটা? ছিঃ!
*****
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সব, নন্দিনী একটু পরে শোবে বলল, সামনের সোফাটায় বসল ও। সামনে বিশাল জানলা কাঁচে ঢাকা, আজ হয়ত পূর্ণিমা, চাঁদের আলো জানলার কাঁচ বেয়ে এসে চুইয়ে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। সামনে পাইন গাছের সারি। আর কিছু দেখা যায় না, শুধু চাঁদের নির্মল জ্যোৎস্না। নিঝুম চারদিক! চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিল নন্দিনী, চাঁদের দিকে তাকিয়েই সারারাত কাটিয়ে দেওয়া যায় যেন, এত্ত সুন্দর!এত্ত পবিত্র! কলঙ্ক আছে তাও যেন সেই দাগই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
কতক্ষণ এভাবে বসেছিল কে জানে, কাঁধে একটা ভরসার হাত পড়তে জেগে উঠল যেন।
চোখ দুটোয় জল যেন মুক্তোর মত ঝলমল করছে এই চাঁদের আলোয়। পিছন ফিরে দেখল, সঙ্গীতা।
“কি এত ভাবছিস? আর কত ভাববি বলত? তুই ভাবলেও তো কিছু বদলাবে না রে আর।”
সঙ্গীতার কথা গুলো কানে ঢুকছে না খুব একটা নন্দিনীর, কারণ ওর ভাবনা এখন অন্য খাতে বইছে। আর এই কথাটা পৃথিবীতে আর কেউ জানে না। কাউকে কখনও বলতে পারেনি ও।
সঙ্গীতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল নন্দিনী, “তুই আমায় কতটা চিনিস?”
” এ আবার কি ধরণের কথাবার্তা। তোকে আমার থেকে ভালো কে চেনে শুনি?কাকু কাকিমার পর আমিই সেই জন যে তোকে মজ্জায় মজ্জায় চিনি। “
খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল নন্দিনী, ” না রে, চিনিস না। আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমি কাউকে ঠকাতে পারি? “
” কি যাতা বকছিস বলত রাতদুপুরে ঠাণ্ডার মধ্যে বসে? কোথায় এখানে এসে এখানকার সবকিছু উপভোগ করবি তা না… “
সঙ্গীতার কথা শেষ করতে না দিয়েই আবার বলল নন্দিনী, ” তোকে আমি আবিরের কথা বলেছিলাম মনে আছে? “
সঙ্গীতা মনে করার চেষ্টা করল বটে কিন্তু তেমন কিছু যে ওর মনে পড়ল না সেটা ওরা মুখ দেখেই বুঝতে পারল নন্দিনী। স্বাভাবিক, মনে রাখবার মতন ঘটনাগুলো ও কখনও বলেইনি, সঙ্গীতাকেও না।
কিন্তু… আজ বলবে। কাউকে না বলা অব্দি ওর মন যে কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না।
“আমি আজ যদি তোকে বলি আমায় জাজ না করে আমার কথা গুলো একটু শুনবি শুধু? একটু বোঝার চেষ্টা করবি?”
“কি হয়েছে তোর নন্দু, বল আমায়।”
“তুই আগে বল তুই আমায় জাজ করবি না। আগে শুনবি সবটা। এখন বলার লোক প্রচুর কিন্তু শোনার লোকের বড় অভাব রে। শুনবি?”
“তুই নির্দ্বিধায় বলতে পারিস আমায়, আমি আছি।”
এই ‘আমি আছি’ কথাটাই যেন অনেকখানি ভরসা জোগায় মনে।
নন্দিনী সঙ্গীতার হাতটা চেপে ধরল, তারপর…
*****
(তখন)
একটা অসহ্য যন্ত্রণা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে সারা শরীর, রক্তপাত হচ্ছে কি জানা নেই। চোখ দুটো বুজে গেছে যন্ত্রণায়। শুধু শুনতে পাচ্ছে আবিরের আর্তনাদ। আবির পাগলের মত ডাকাডাকি করছে একটা সাহায্যের জন্য। আবিরের হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে নন্দিনীর মাথা, কপাল, গাল, ঠোঁট! আবিরের ঠোঁট যেন ছুঁয়ে গেল নন্দিনীর কপাল! আর সাথে বুকফাটা আর্তনাদ। ওর জন্যই ওর নন্দিনীর এই অবস্থা এ কথাই যেন বার বার বলছে আবির। আচ্ছা! কি বলে যাচ্ছে আবির? ও তো জানে না নন্দিনী শুনতে পাচ্ছে সব কিছু, তাই অকপটে স্বীকার করে চলেছে নিজের মনের কথা! হ্যাঁ, আবির নন্দিনীকে ভালোবাসে, নন্দিনীকেই ভালোবাসে, শুধু লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন। কারণ নন্দিনী ওর নীলের সাথে ভালো আছে যে! কিন্তু আজ আর নিজেকে আটকাতে পারল না ও, কান্নার সাথেই বেরিয়ে এল মনের কথাগুলো। এত যন্ত্রণার মাঝেও যেন সেই আর্তনাদ বুকের মাঝে একরাশ শান্তি এনে দিচ্ছিল, এখন যেন মরে গেলেও কোনো দুঃখ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবিরের বাহুডোরে আবদ্ধ হল নন্দিনী, নন্দিনীকে কোলে তুলে নিল ও, রওনা হল হয়ত হাসপাতালের পথে। তারপর আর নন্দিনীর কিছু মনে নেই।
।। ৪।।
“ঐ ঘটনার পর আমি নাকি প্রায় দুই দিন বাদে চোখ খুলেছিলাম, চোখ খুলতেই মা বাবা আর নীল ছিল সামনে। কিন্তু আমার চোখ খুঁজছিল আবিরকেই। আবির ছিল, বাকি বন্ধুদের সাথে। হয়ত নীল ছিল বলেই ও দূরত্ব বজায় রেখেছিল আমার থেকে। আমরা ইচ্ছে করছিল সব বাঁধন ছিঁড়ে ছুটে চলে যাই আবিরের কাছে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, আমার চাওয়ায় কি যায় আসে। আবির যদি সত্যি চাইতো তাহলে ও কেন সবার সামনে নির্ভয়ে নিজের মনের কথা গুলো বলল না। কিসের দ্বিধা ওর? এ আবার কেমন ভালোবাসা? খুব রাগ হচ্ছিল আমার।
এরপর থেকেই আবিরের সাথে আমি না চাইতেও একটা দূরত্ব তৈরী করতে থাকি, কেন করতে থাকি আমি নিজেও জানতাম না। আমি তো নীলকে ভালোবাসি, তাহলে আবির আসছে কেন? আর যদি আবির আসছে তাহলে নীলের সাথে আমার সম্পর্কটা কিসের?তাহলে তো নীল আর আবির দুজনকেই ঠকাচ্ছি আমি, নিজেকেও তো ঠকাচ্ছি। কি করছি এসব? কি ভাবছি আমি? নীলকে কিভাবে ঠকাতে পারি আমি? এ হতে পারে না। নীল কে কষ্ট দেওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে। আর আবির?”
*****
“একটা মানুষের সাথে যতটা দুর্ব্যবহার করে, মিথ্যা বলে তাকে সরিয়ে দেওয়া যায় আমি সেটাই করেছিলাম। আর দেখ, নীলের সাথেও সুখী হতে পারলাম কই। পাপের প্রায়শ্চিত্ত তো মানুষকে এই জন্মেই করতে হয়। আমিও হয়ত তাই করছি।
আবিরের সাথে আমি যা ব্যবহার করেছি তার কোনো ক্ষমা হয় না। সব জেনেও আমি ওকে বার বার আঘাত করেছি। হয়ত নীলের সাথে স্ট্যাটাস, সিকিউরিটি এই গুলো ছিল বলেই। নিজের স্বার্থের কথা ভেবেছি, তাই নীলকেও ঠকিয়েছি, ওকেও ভালো রাখতে পারিনি। আর তাই আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে। ” থামল নন্দিনী।
” বুঝলাম। কিন্তু হঠাৎ আজ এসব… “
“কারণ ভাগ্য আমায় আজ আরেকবার সুযোগ দিয়েছে, নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার। আবির এই হোটেলেই আছে।”
“হোয়াট? একই নাম আর পদবীর তো অন্য লোক ও হতে পারে, তুই তো চোখে দেখিসনি। কি ভাবে সিওর হচ্ছিস তাহলে?”
“ঠিকানা টা তো জানি। “
“আমি তোকে জাজ করছি না। শুধু জানতে চাইছি, তুই কি আবিরকে…”
“হয়ত। হয়ত আবিরকেই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভালোবাসতে গেলে গাটস লাগে জানিসতো। নেই সেটা আমার। ছিল না আমরা মধ্যে সাহস। তাই নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যে নীলকে ভালোবাসি, যেখানে আদৌ ভালোবাসা ছিলই না, হয়ত।”
“হয়ত কেন?”
“এখনও সত্যিটা স্বীকার করার সাহস আমরা মধ্যে নেই বলেই এভাবে ‘হয়ত’ যোগ করছি।”
“হুম, যদি সত্যিই ভালোবাসা থাকত দুই তরফ থেকেই, তাহলে তো সংসারটা…”
“ভাঙত না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল নন্দিনীর ভিতর থেকে।
” আচ্ছা, আমি তো কোনো কিছুর ভূমিকাতেই যোগ্য নয় রে। এবার যদি আবির ও আমায় ক্ষমা না করে, আমি তো নিজের চোখে চোখ রাখতে পারবো না আর। এত খারাপ একটা মানুষের বেঁচে থেকেই কি লাভ… “
“একদম বাজে কথা বলবি না। ভুল মানুষ মাত্রেই হয়। ভুল আর অপরাধের মধ্যে পার্থক্যটা বোঝা আগে প্রয়োজন।”
*****
কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না আর নন্দিনীর। কাল সকালটা কখন হবে শুধু সেটুকুর অপেক্ষা,ইচ্ছে করছিল এখনই যেতে কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। আজকের রাতটা না হয় জেগেই কাটিয়ে দেবে অপেক্ষায়।
“এই রাত জাগা অপেক্ষাটা সবার জন্য নয়। সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের জন্য করা খুব প্রয়োজন, নয়তো জীবন কোনোদিন রাত কেটে ভোর হতে দেখে না। ” এটুকু বলে নন্দিনীর দিকে তাকাল সঙ্গীতা। কি বলতে চাইল ও নন্দিনীকে? নন্দিনী এখন ভুল করছে নাকি আগে ভুল করেছিল ?
নন্দিনীর মনের কথা পড়ে নিয়ে সঙ্গীতা বললো আবার, “ঠিক ভুল সেটা যার যার নিজের পার্সেপশন। তোর কাছে কোনটা ঠিক সেটা বেশি জরুরি।”
মুখ ঘুরিয়ে স্নিগ্ধ চাঁদের দিকে তাকাল নন্দিনী… ভোরের অপেক্ষায়।
।। ৫।।
রাত জাগার পর সূর্যোদয় যে কতটা আনন্দ দিতে পারে এর আগে জানতো না নন্দিনী। ঘুম ভেঙে সূর্যোদয় দেখা আর রাত জাগার শেষে সূর্যোদয় দেখা দুটো সম্পূর্ণ আলাদা অনুভূতি। যেন এক অন্তহীন অন্ধকার অপেক্ষার অবসান, এবার যেন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আকাশটা জুড়ে যেন লাল আবির মাখিয়ে দিয়েছে কেউ, আর তার পর মুড়ে দিয়েছে সোনায়। সবথেকে বেশি আবির মেখে বসে আছেন স্বয়ং সূর্যদেব, একটা আভা ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে পাহাড়ের কোলে। ঝলমল করছে চারপাশ, কিন্তু কোনো উগ্রতা নেই। শুধুই স্নিগ্ধ শীতল প্রশান্তি।
ভোরবেলা স্নান করে নিয়েছে এই ঠান্ডাতেও নন্দিনী। বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে, কি ভাবে ফেস করবে ও আবিরকে ? কি বলবে ? কিভাবেই বা বলবে ? ওর ও নিশ্চয় সংসার আছে। তাহলে ? কিন্তু বলতে যে ওকে হবেই। নয়তো মরেও শান্তি নেই।
*****
ম্যাল রোড ধরে লোকজন চলতে শুরু করেছে। ব্রেকফাস্ট করতে যাওয়ার প্ল্যান চলছে, যেভাবেই হোক এবার বেরোতেই হবে। নয়তো…
আর না ভেবে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল নন্দিনী। তিনমূর্তির মধ্যে একজন স্নান করছে, একজন আধো ঘুমেই বকছে, একজন ঠিকঠাক জেগে উঠে বসে আছে খাটে। আর এক মুহূর্ত ও তর সইছে না নন্দিনীর। একপ্রকার ছুটেই বেরিয়ে গেলো। একতলায় চলে এল দ্রুত পায়ে। আর লিফটের অপেক্ষা করেনি। কিন্তু ঘরটার সামনে এসে দাঁড়াতেই একরাশ নিরাশা চেপে ধরল এক লহমায়। ঘরটায় তালা ঝুলছে। তাহলে কি চলে গেল? এত তাড়াতাড়ি ? কিন্তু চেক ইন তো কালকেরই ছিল তাই না? একই পৃষ্ঠায়। নাহ, সেইভাবে তো মনে পড়ছে না। ঠিক যেন কিছু একটা হাতছাড়া হয়ে হচ্ছে, চেষ্টা করেও হাত থেকে ফসকে গেলো খুব মূল্যবান কিছু, এরকমই আফসোস নন্দিনীর চোখে মুখে। আশেপাশের ঘর থেকে যারা বেরোচ্ছে তারা দেখছিল ওকে,নিজের অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও পারছেনা ও।
ফোনটা বেজে উঠল। ওকে দেখতে না পেয়ে ফোন করছে ওরা। কারুর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর। একটা টেক্সট করে ফোনটা কেটে দিল সঙ্গীতার। তাহলে কি কলকাতায় ফিরে গিয়েই যাবে আবিরের সাথে একবার দেখা করতে…
নীচে রিসেপশনে নেমে এল ও। ইতস্তত করতে করতেও জিজ্ঞাসা করেই নিলো এবারে, ” আবির রায়চৌধুরী কখন চেক আউট করে গেছেন বলতে পারবেন ? মানে আমি ওনার পরিচিত তাই আর কি… ঘরে তালা ঝুলছে দেখলাম তাই জানতে চাইছি। “
” রুম নম্বর ?”
” ওই যে কলকাতা থেকে যিনি… আচ্ছা রুম নম্বর ১০১। “
” ওহ আচ্ছা, বুঝেছি। না উনি তো চেক আউট করেননি। “
এক সেকেন্ডের জন্য যেন মনটায় একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল নন্দিনীর। মানে ও খুব একটা দূরে চলে যায়নি। এখানেই আছে। দেখা হবে তার মানে।
নন্দিনীর ভাবনার মাঝেই রিসেপশনের মেয়েটি বলে উঠলো আবার, ” ভোরের দিকেই ওনার শরীর অসুস্থ হয়, তাই ওনাকে নিয়ে ওনার বন্ধুরা সামনেই ‘রেড হার্ট নার্সিং হোম ‘ এই গেছেন। আপনি চাইলে ওখানে চলে যেতে পারেন। এখন থেকে মিনিটে ৫ – ৭ লাগবে।
বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়তো একেই বলে! নন্দিনীর কোনোভাবেই এরকম কিছু শুনবে এক্সপেক্ট করেনি।
” মানে? আই মিন কি হয়েছে ওনার কিছু বলতে পারবেন ?”
” সরি ম্যাডাম, এত ডিটেলস তো বলতে পারবো না। তবে ওনারা বন্ধুরা একসাথে এসেছিলেন চারজন, দুটো রুম নিয়েছেন, তো ভোররাতে হঠাৎই হোটেলের মেন্ গেট খুলতে বলেন তাদের মধ্যে একজন। সেই জন্য জানি। কানাঘুষো শুনছিলাম এবার না জেনে তো কিছু কারো ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারি না তাই না ?”
নন্দিনী যেন ঘন কালো আঁধারে ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। যদি বা একটা আশার আলো খুঁজছিল সেটা এভাবে নিকষ অন্ধকারে রূপান্তরিত হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। পাশ থেকে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বললেন, ” “আমার পাশের ঘরেই ছিলেন। দুদিন আগে থেকেই আছেন। আমিও সেইদিনই এসেছি আজ বেরিয়ে যাবো। আমি যতদূর জানি উনি ক্যান্সার পেশেন্ট, কথা হচ্ছিল সেইদিনই, তো ওই কারণেই হয়তো সিচুয়েশন কোনোভাবে ডিটোরিয়েট করেছে। “
মাথাটা আর কাজ করছিল না, একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে ভিতরে। কি হচ্ছে জানে না। এভাবে এখানে এরকম একটা পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়াবে নন্দিনী কল্পনাও করতে পারেনি। যন্ত্রের মতোই আর কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে এলো নন্দিনী ওখান থেকে। পা দুটো দৌড়াতে লাগল রীতিমতো। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন টেনে নিয়ে চলেছে নন্দিনীকে। ও আর ওর মধ্যেই নেই। আর কিছু ভাবার বোঝার শোনার মতো অবস্থাতেও নেই ওর ইন্দ্রিয় বা মস্তিষ্ক। ছুটে বেরিয়ে সামনে থেকে একটা অটো নিলো নন্দিনী। ‘রেড হার্ট ‘ এ যখন পৌঁছাল তখন সময় পেরিয়েছে আরো ১৫ মিনিট।
রিসেপশনে গিয়ে নামটা বলতে গিয়ে অনুভব করল যে গলাটা কাঁপতে শুরু করেছে অজান্তেই। ওরা যতক্ষণে ডিটেলস বের করতে ব্যস্ত ছিল ওর চোখ এদিক ওদিক ঘুরছিল শুধু অযথাই।
রুম ফ্লোর নম্বর জেনে দৌড়াতে লাগল লিফটের দিকে। শরীরে রক্তপ্রবাহের প্রাবল্য বেড়ে গেছে যেন বহুগুণ।
প্রতিটা ফ্লোরেই লিফ্টটা দাঁড়াচ্ছিল আর নন্দিনী যেন আরো বেশি করে অধৈর্য হচ্ছিল। সেভেন্থ ফ্লোর আসতেই ছুটে বেরিয়ে এল লিফ্ট থেকে নন্দিনী। দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডকে জিজ্ঞাসা করল ২৫ নম্বর রুমটা কোনদিকে।
” এখন যাবেন না। ” মুখের উপর গার্ড এর এই জবাবটা আশা করেনি নন্দিনী।
” আমি ওনার পরিচিত, যাবো না কেন? “
” দেখুন পরিচিত যখন তখন তো সবই জানেন। থার্ড স্টেজ। এখন ডাক্তারবাবুও চেষ্টা করছেন। ওনাকে ওনার কাজটা করতে দিন অন্তত। এখন প্রতিটা সেকেন্ড ক্রিটিকাল। আপনি বাইরে থেকে দেখতে পারেন। রুমে ভিড় করবেন না প্লিজ।”
পায়ের তলা থেকে মাটিটা সরে গেল নন্দিনীর। একটা ধাক্কা লাগল খুব জোরে ভিতর থেকে, দেওয়ালটা কোনোমতে ধরে দাঁড়াল। আবিরের এই রূপটা দেখার থেকে যে রূপ ওর মনে রয়ে গেছে সেই রূপেই মনে রাখতে চায় ও। কাঁপা কাঁপা পায়ে যন্ত্রের মতো ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়লো অতি কষ্টে নন্দিনী। সামনে বেশ ভিড়। কে বা কারা সেদিকে আর তাকাল না নন্দিনী। ছোট্ট কাঁচটা দিয়ে ঘরটার ভিতর তাকাল, কাঁপা হাতটা রাখলো কাঁচটার উপর।
“হে ঈশ্বর!” এটুকুই বেরিয়ে এলো ওর গলা দিয়ে। ভেজা চোখ দুটো বুজে ফেলল নন্দিনী, নিজের অজান্তেই ওর হাত দুটো করজোড়ে করে দাঁড়াল, আর যে ক্ষমা চাওয়া হলো না।
আবিরের খুব কষ্ট হচ্ছে বলেই এদিকওদিক মুখ করে ছটফট করছিল। এ কেমন রূপ? একবার চোখটা দরজার দিকেও গেলো। ও কি চিনতে পেরেছে নন্দিনীকে? একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নন্দিনীর দিকেই, আর মুখ ফেরাল না ও। নন্দিনীর দিকে তাকিয়েই শান্ত হলো, মুক্তি পেলো যাবতীয় পার্থিব যন্ত্রনা থেকে। ওর বন্ধুরা বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। জানতো এই বন্ধু বিদায় নেবে খুব তাড়াতাড়ি তাও যে কঠিন সত্য মানা যায় না সহজে।
নন্দিনীর সামনেই আবিরের চোখ দুটো বুজিয়ে মুখটা ঢেকে দেওয়া হলো। আর দাঁড়াল না নন্দিনী। ক্ষমা চাইতে বড্ড দেরি করে ফেলল নন্দিনী। আর কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না ও। উদ্ভ্রান্তের মতোই ওখান থেকে বেরিয়ে গেল নন্দিনী, নিরুদ্দেশের পথে। বাকি সব রইল পড়ে। বার বার বেজে চলেছে মুঠোফোনটা, পিছুটান ছাড়ানো যে বড্ড কঠিন। ২৩ টা মিসডকল।
মা, বাবা, সঙ্গীতা আর… নীল!
*****
“ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি, পারিবে না চিনিতে আমায়। হে বন্ধু, বিদায়।”