মামাবাড়ি

।।১।।

একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো পাত্তা নেই। আজ তেমনি গরমও পড়েছে । গলদঘর্ম অবস্থায় পিঠের ভারী ব্যাগটা সামনে দিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিনি। ফ্যানের হাওয়ায় একটু সুস্থ বোধ হচ্ছে। মেট্রোটা এসে গেলে শান্তি। একটু ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক পাওয়া যাবে। মেট্রোর আলোটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল মিনি।

এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল হলুদ সীমারেখার কাছে। ভিড় আছে কি নেই দেখবার জন্য এদিক ওদিক দেখল একটু। এসে গেছে ট্রেন, ওই তো ফাঁকা সিট আছে। মনে মনে জরিপ করে নিলো এবার তাহলে বসতে পাবে অবশেষে। সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখন পায়ে বেশ সমস্যা শুরু হয়েছে। প্রথম প্রথম অত পাত্তা দেয়নি। কিন্তু এখন ব্যাথার তীব্রতা মাঝে মাঝে এতই বেশি হয় যে পাত্তা না দিয়ে উপায় নেই।

ব্যাগটা কোলের উপর নিয়ে বসল এবার মিনি, বয়স তো কম হল না। সামনের শ্রাবণে ৪০ এ পড়বে। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে, ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল।

মায়ের ৪ খানা মিসকল! মা তো জানে এই সময়ে হসপিটালে থাকে ও, তাও এতবার করেছে মানে কোনো ইমার্জেন্সি নিশ্চয়। বাবা ঠিক আছে তো? তাড়াতাড়ি মা কে ফোন লাগলো মিনি , মেট্রোর ভিতর ফোন লাগতে একটু বেগ পেতে হলো বটে ,কিন্তু বার দুয়েক চেষ্টা করার পর পেয়ে গেল লাইনটা।

“হ্যালো”

“হ্যাঁ এতবার ফোন করেছিলে কি হয়েছে! বাবার কিছু হয়নি তো ?”

” না না , সেসব কিছু না। “

“তাহলে? তাড়াতাড়ি বলো , যে কোনো সময়ে নেটওয়ার্ক উড়ে যাবে। কিছু আনতে হবে কি?”

” না না। কালই তো কেনা হলো সব। “

” আরে, তাহলে কি বলতে ফোনটা করছিলে এতবার? আশ্চর্য !”

“তোর মামার অবস্থা খুব খারাপ! রনি ফোন করেছিল। এখনো কোথাও ভর্তি করতে পারেনি। তুই তো হসপিটালে আছিস ,যদি একটা ব্যবস্থা করতে পারিস। “

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে কথাটা হজম করার চেষ্টা করছিল মিনি। উত্তর দিলো না কোনো। শুধু বললো , ” রাখছি। “

ফোনটা কেটে চোখটা বন্ধ করে নিলো। না চাইতেও অনেকগুলো হলুদ হয়ে যাওয়া বিবর্ণ স্মৃতি ভিড় করল চোখের পর্দায়।

*****

স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তাটায় দাঁড়াল কয়েক সেকেন্ড মিনি। কোনো এক মন্ত্রবলে যেন এখানে এসে দাঁড়িয়েছে ও আজ। স্টেশন চত্বরের সামনেই রিকশা স্ট্যান্ড। এটা তো আগে ছিল না। চারপাশটা তাকিয়ে দেখল ও , সত্যিই বদলে গেছে সবকিছু। এই তো সামনের মোড়ে একটা মিষ্টির দোকান ছিল , “শ্রী কৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভান্ডার”। এই দোকানের সরভাজা ভীষণ প্রিয় ছিল মিনির। ও এলেই দিদা এনিয়ে রাখতো ওর জন্য। আর সাথে রুচিরার রুমালি রুটি। আজ ওই দোকানদুটোর একটাও নেই। তার জায়গায় খুলে গেছে ঝাঁ চকচকে রেস্টুরেন্ট,আর এক জায়গায় গিফট শপ।

যুগের সাথে তাল মেলানোর দৌড়ে শৈশবের স্মৃতি গুলো আজ ভেঙেচুরে একাকার।

আর দাঁড়িয়ে বহু চেনা গন্তব্যের দিকে পা বাড়াল মিনি।

অনেক দিন বাদে খুব পরিচিত ,ভীষণ প্রিয় জায়গাটায় এসে পড়লে মনের মধ্যে এক অদ্ভুত দোলাচল শুরু হয়। মিনির এখন সেই অবস্থা , প্রতিটি পদের সাথেই এদিক ওদিক তাকিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছে কতটা বদলে গেছে ওর ফেলে যাওয়া শৈশবের ছবিটা। যত্নে সাজানো এই শৈশবকে ফেলে যাওয়ার সেই দিন আর কারণ মনে পড়তেই চোখ দুটো জ্বালা করে উঠল।

পার্কটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো মিনি , একটা বাচ্চা মেয়ে , বড়োজোর বয়স ৫ কি ৬ হবে, দোলনায় দোল খেতে ব্যস্ত। সঙ্গের বয়স্ক মহিলা ঠাকুমা দিদিমা হবেন হয়তো , নাতনিকে ধৈর্য্য সহকারে দোল দিয়ে যাচ্ছেন হাসি মুখে। শরীরটা বয়সের ভারে নুইয়ে গেছে একটু, পরনে সাদা কাপড়, চোখে চশমা, চুল বেশিরভাগ সাদা। মিনির চোখ দুটো যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওই অবয়বে খুঁজে পেলো নিজের আদরের দিম্মাকে। দিম্মার সাথে এসে এই পার্কার এই দোলনাটাতেই দোল খেত ও। অবিকল একরকম। নাতি নাতনিদের সাথে দাদু দিদাদের সম্পর্কটা ভীষণ সুন্দর হয় , আর কোনো সম্পর্কের সমীকরণের সাথে এর মিল পাওয়া দুষ্কর। একটা আলতো আব্দারের ছোঁয়া লুকিয়ে থাকে সেই সম্পর্কে, যে আবদার গুলো মা বাবার আদালতে পাস হয় না , সেগুলো অনায়াসে পাস হয়ে যায় এই আদালতে।

মানুষটার ফোকলা গালগুলো ছোট্ট নাতনির আদর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, দেখতে দেখতে হেসে ফেলল মিনি। আজ ভীষণ মিস করছে দিদুনকে, ওর হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে, ওর হারিয়ে যাওয়া মামাবাড়িকে।

রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল মিনি , একটা সাইকেল রিকশার হর্ণে বাস্তবে ফিরল মিনি। সরে দাঁড়াল মিনি, রণজয় কাকু, ও ঠিক চিনতে পেরেছে, কাকুর পক্ষে মিনিকে না চেনাই স্বাভাবিক। কাছাকাছি কোথাও যাওয়া আসার জন্য রণজয়কাকুর রিক্সা করেই যেত ও আর মা।

এগোতে লাগলো মিনি। আর বেশিক্ষণ না , সামনের বাঁকটা ঘুরলেই ওর হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলাটা যেখানে আটকে রয়েছে পৌঁছে যাবে ও।

ওর অনেক বার মনে হয়েছে ছোটবেলায় , ওই যে ভূতের রাজা বর দেয়, যদি ওকেও দিতো তাহলে ও কি চাইতো? কি আবার ? এটা আবার জিজ্ঞাসা করার জিনিস নাকি?শৈশবটাকে যদি আরেকবার ফিরে পাওয়া যেত তো সেটাই চাইতো! দিদার কোলে মাথার রাখার আরেকটা সুযোগ! ভাই বোনেদের সাথে আবার একবার নিষ্পাপ যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার সুযোগ! দিদার হাতের আলু পোস্ত আর গোকুল পিঠে খাবার সুযোগ ! মুহূর্তগুলো জাস্ট আরেকটিবার বাঁচার সুযোগ!

ফোনটা বাজছে। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা হাতড়াল মিনি, চোখ ঝাপসা, তাই ঠিক করে দেখতেও পাচ্ছে না ব্যাগের ভিতরটা। চোখটা মুছল। সন্ধ্যে নেমে গেছে, রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে ইতিমধ্যেই। ভারী সুন্দর লাগছে রাস্তাটা, আগে এত আলো ঝলমলে ছিল না জায়গাটা।

কানে লাগাল ফোনটা। বাবা ফোন করছে এত দেরি দেখে। বাবাকে বুঝিয়ে বললে বাবা এত টেনশন করে না। কিন্তু মা এত টেনশন করে তাই কিছু বলতেই ভয় লাগে মিনির।

বাবার সাথে কথাটা বলে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ‘মা’ এপার্টমেন্টের দিকে এগোল মিনি। এই জায়গাটা জুড়েই আছে বহু বহু স্মৃতি। কিছু রঙীন কিছু ধূসর…

ফ্ল্যাটের এন্ট্রান্সটা বদলে গেছে, আগে এতটা বড় ছিল না। যথেষ্ট সরু ছিল, আর ওই একচিলতে গেট দিয়েই তো ও আর মা এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন, মানে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। দিদার মারা যাওয়ার ঠিক পনেরো দিন পর, ২৯ শে মে। আচ্ছা আজকেও তো ২৯ শে মে ! মোবাইল থেকে আরেকবার মিলিয়ে নিলো ডেটটা, কি অদ্ভুত সমাপতন ! আজ আবারো সেই দরজায় দাঁড়িয়ে মিনি। শুধু পরিচয়টা বদলে গেছে , বদলে গেছে ওর ভূমিকা।

।। ২।।

দুদিকে দুটো বিনুনি ঝুলছে মিনির, পরনে একটা সাদা গোলাপি ফ্রক, মার পরনে একটা সবুজ রঙা ছাপা শাড়ি, চোখ মুখ শুকনো, মিনি তখন কেঁদে চলেছে। দিদার একটা ফটো প্রাণপণে আষ্টেপৃষ্টে নিজের বুকে জড়িয়ে রেখেছে মিনি , পাছে ওটাও মামা কেড়ে নেয় ওর থেকে। ছোট্ট মিনি বুঝতে পারেনি এই সামান্য ছবি বা কোনো আবেগের পরোয়া করেনা ওই লোকটা। সে শুধু ইট কাঠ পাথর আর জমির হিসেবটা ভালো বোঝে। বিষয় সম্পত্তির ভাগের কাছে এসব আবেগের কোনো জায়গাই নেই তার মনে। যদি থাকতো তাহলে শুধুমাত্র সম্পত্তির ভাগ দেওয়ার ভয়ে এভাবে নিজের বোন আর ভাগ্নিকে এক কাপড়ে গৃহহীন করে দিতে পারতো কি? বীজ বপন হয়েছিল বহু আগেই, দিদা থাকায় কিছু করতে পারছিল না শুধু। দিদার মৃত্যুর পর আর কাজ সারতে দেরি করেনি বিপ্লব সান্যাল।

ওই মুহূর্তটায় দিদা আর বাপিকে খুব মিস করছিল মিনি , ওই দুটো মানুষের একজন ও উপস্থিত থাকলে সেদিন ওদের ঐভাবে বেরিয়ে যেতে হতো না। বাপির বিজনেসে অনেকটা টাকার ক্ষতি হওয়ার পর এক প্রকার বাধ্য হয়েই চাকরি নিয়ে বাবা চলে গেছিল হায়দ্রাবাদ। যতদিন না স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে যেতে পারছে, শালাবাবুর উপর ভরসা করে রেখে গেছিল শ্বশুরবাড়িতে। বাড়ি দোকান সবই তো তখন ব্যাঙ্ক এর কব্জায়। আর ওই টালমাটাল সময়টায় ঘা মারতে দুবার ভাবেনি ওই লোকটা। অথচ সময়ের কি নিদারুন পরিহাস। সেই সম্পত্তির সিকিভাগ ও রাখতে পারেনি লোকটা। আজ গলা অব্দি দেনায় ডুবে সেই ঘর বাড়ি বিক্রি করে ভাড়া বাড়িতে রয়েছে প্রায় ৩ বছর ধরে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো ও আর…

*****

টিং টং !

দুটো ফ্ল্যাট মুখোমুখি। ফ্ল্যাটের দরজা খোলা থাকলে সামনের সরু প্যাসেজ দিয়ে ঢুকে সামনেই ডাইনিং স্পেস আর তার সামনে খোলা রান্নাঘরটা দেখা যায়। ডানদিকে আর বাম দিকে বেডরুম। একটা ছোট্ট একফালি বারান্দা সামনের ঘরটার সাথে লাগোয়া। ডানদিকের ঘরটায় ওরা থাকত। পড়তে পড়তে হাঁপিয়ে গেলে ওই লাগোয়া বারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াতো। বাড়িটা যতটা বড় ছিল সেই তুলনায় ওই জমিতে প্রোমোটারি করে যে ফ্ল্যাটটা দিদা পেয়েছিল সেটা নেহাতই পায়রার খোপ। সেখানেও যে দিদার চোখে ধুলো দিয়ে একটা বড়োসড়ো গোলমাল পাকিয়েছিল লোকটা সেটা দিদাও বুঝেছিল। কিন্তু কিছু বলেনি।

ডাইনিং স্পেসেই ফ্রিজ আর টিভিটাও ছিল, আগে মিনিকে খেতে দিয়ে তারপর মা দিদা বসত খেতে। মিনি টেবিলটায় পা দোলাতে দোলাতে ভাত খেত আর টিভির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকত , আর বকুনি খেত দিদুর কাছে। আর যেই ওই লম্বা করে গোমড়া মুখ লোকটা ঢুকত, তটস্থ হয়ে যেত। কোনোদিনই মামা ভাগ্নির সেই সুন্দর সম্পর্কটা তৈরীই হয়নি , ওর বাকি বন্ধুগুলোর কাছে ও তাদের মামাবাড়ির গল্প শুনত মিনি, কই তাদের সাথে তো এরকম হতো না। মিনির কপাল টাই…

*****

“কাকে চাই?”

“উমম…”

“আপনি কাকে খুঁজছেন ?”

“সরি, আসলে বিপ্লব সান্যাল কি এখানে…”

” না , উনি তো আর এখানে থাকেন না। “

“আচ্ছা , আপনারা কি ওনার থেকেই এই ফ্ল্যাটটা…”

“হ্যাঁ , বছর দেড়েক হলো কিনে নিয়েছি… কেন বলুনতো ? আপনি কি… “

“ঠিক আছে, সরি। আমি আসি। “

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো মিনি দোতলা থেকে।

ও খুব ভালো করেই জানতো ওরা আর এখানে থাকে না। মামিমা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওরা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে গেছে , কিন্তু তাও ইচ্ছা করেই ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আজ মিনি। ঘরের রং আসবাব সময় মানুষ সব ই আজ বদলে গেছে বটে , কিন্তু জায়গাটা সেই একই আছে , ওর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে, একটিবার চোখের দেখা না দেখে কি করে আসে ?

এবার যেন একটু ভালো লাগছে। বাড়ির দেয়ালটায় শেষবারের মতন হাত ছুঁইয়ে বেরিয়ে এলো মিনি। আর নয় , এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

।।৩।।

মা দরজা খুলেই হাজারটা প্রশ্ন শুরু করল। ও জানত মা এটা করবেই। কথার উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল মিনি। ফ্যানটা চালিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।চোখ সিলিংয়ের দিকে।

বাইরে ডাইনিং রুমে বাবা টিভিটা চালিয়ে রেখেছিলো , মা বন্ধ করে দিল ধমকে। তাই বাইরের সব কথাই কানে আসছিল মিনির। একটু আগে নাকি রনি ফোন করেছিল আবার, টাকা পয়সার জন্য, আসতেও চাইছিল , ঠিকানাটা জানতে চাইছিল , ফোন নম্বর পেয়েছে জয়ীমাসিদের থেকে। কিছু সাহায্য করা উচিত কিনা সেই নিয়েই এখন মা বাবার আলোচনা চলছে। এখনও ভর্তি করতে পারেনি নাকি। সবার কাছেই সাহায্য চেয়েছে , কতটা পেয়েছে সেটা প্রশ্নচিহ্ন।

শুনতে শুনতে মাথাটা জ্বলে যাচ্ছিল মিনির। এতটা ভালো মানুষ ও হতে পারেনি আর কোনোদিন পারবেও না। ওরা যখন একবেলা খেয়ে জীবনযুদ্ধে লড়ছিল তখন কোথায় ছিল সবাই , কেউ তো আসেনি বলতে। আত্মীয় স্বজন কেউ তো একবার ও ওই লোকটাকে বলতে যায়নি কিছু , ঠিক ভুলের পাঠ পড়াতে তো কেউ এগোয়নি। সবাই শুধু ঝামেলা এড়িয়ে নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত ছিল , তাহলে আজ এত ভালোমানুষির নাটক কিসের?

বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল বিছানা থেকে মিনি , স্নানটা করতে হবে , অসম্ভব অস্বস্তি হচ্ছে সারা শরীর জুড়ে।

ধড়াম করে শব্দ করে দরজাটা খুলে বেরোল ঘর থেকে মিনি। মা বাবার দিকে একবার শীতল দৃষ্টি নিয়ে তাকাল শুধু। ঢুকে গেল বাথরুমে।

*****

ডাইনিং টেবিলে ডিনার করতে বসে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করল মিনি, সারা বাড়ি জুড়ে, ডাইনিং টেবিলেও, যেন একটা নৈঃশব্দ গ্রাস করছে সবকিছু। মা এর মুখ থমথমে, মার জন্য বাবাও চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। রান্নাবান্নারও তেমনি অবস্থা। সারাদিন পর রাত্রের খাবার টুকুই একটু সময় নিয়ে তৃপ্তি করে খায় মিনি , আজ সেই খাবারটুকুর তথৈবচ অবস্থা। নিস্তব্ধতা ভেঙে একটু বিরক্তি নিয়েই বলে উঠলো এবার মিনি ,” কি হয়েছে টা কি মা ? বলবে একটু ?”

যেন এই প্রশ্নটা করারই অপেক্ষায় ছিলেন রমাদেবী।

“তুই জানিস না কি হয়েছে ?”

মিনিও একইভাবে আবার প্রশ্ন করল , “না সত্যিই বুঝতে পারছি না, কি হয়েছে টা কি?”

“তোকে ফোন করে এতকিছু বলা হলো, তোর কোনো হেলদোলই তো দেখতে পাচ্ছি না। আজ কোথায় একটু তাড়াতাড়ি আসবি , আজই তোকে দেরি করে ফিরতে হলো , এসেও একটা আলোচনা না কিছু না, নিজের তালেই আছিস দিব্যি। “

মায়ের কথা গুলো শুনে চোখ দুটো ২-৩ সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করল মিনি।

মাথাটা যতটা সম্ভব ঠান্ডা করার চেষ্টা করল। চুপচাপ কয়েক ঢোঁক জল খেল, তারপর বলল, ” সব শুনেছি। ফোন এ বললে তো। কিন্তু তার জন্য তাড়াতাড়ি এসে কি করব সেটা বুঝলাম না। বাড়ি বসে কি শোক পালন করব? এখনও তো বেঁচে আছে। আর এরপরেও আমি শোক পালন করব এই আশাটা আমার থেকে করো না ,তুমি করতেই পারো। আমি এত মহান নই। “

“মুখে কিছু আটকাচ্ছে না নাকি, এখনও বেঁচে আছে মানুষটা। তুই ও এরকম হলে তার আর তোর মধ্যে কি তফাৎ রইল?যতই হোক তোর নিজের মামা। “

এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না মিনি। নিজের অজান্তেই বেশ চড়া গলায় বলে উঠল , ” মামা শব্দটা ব্যবহার করে ওই সম্পর্কটার অপমান কোরো না। “

বাবা মিনির হাতটা ধরল, চোখের ইশারায় শান্ত হওয়ার জন্য বলল , কিন্তু মিনি পারছে না নিজেকে শান্ত করতে।

” সে যাই করে থাকুক আমাদের সাথে, আমরা আমাদের যতটুকু কর্তব্য পালন করব না ? তাহলে তো সমাজ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়। “

রমাদেবীর কথা শেষ হতে না হতেই মিনি টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, “দেখো মা , তোমায় একটা কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই, আমার কোনো আবেগ অনুভূতি নেই আর ওই লোকটার প্রতি , আমি সমাজ কি বলবে সেই ভেবে কোনো কাজ করতেও পারবো না কারণ এই সমাজের লোকগুলোই সেইদিন আমাদের কোনো সাহায্য করতে আসেনি। আমাদের একা লড়তে হয়েছিল , গুটিকয়েক মানুষ ছিল আমাদের পাশে, আমি বরং তাদের নিয়েই আমার সমাজটা গড়ি, তুমি কি করবে তোমার ব্যাপার।”

হতভম্বের মতন চেয়ে রইলেন দুজন, মিনি আর কোনো কথার অপেক্ষা না করেই চলে গেল ঘর থেকে। নিজের ঘরের সাথে লাগোয়া ছোট্ট বারান্দাটায় গিয়ে বসলো একা। মাথাটা দপদপ করছে রীতিমতো। চোখ দুটো বুজলো একটু ,যাতে মাথা যন্ত্রণাটা একটু কমে। কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। ঘুমটা ভাঙ্গল রাস্তায় কুকুরগুলোর চিৎকারে। ঘরটার সাথে সাথে পুরো বাড়ি অন্ধকার , সবাই শুয়ে পড়েছে। রাস্তাটাও জনমানবশূন্য ,শুধু কুকুরগুলোই নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতে ব্যস্ত। মোবাইলটা দেখল একবার, রাত দেড়টা প্রায়। বারান্দা থেকে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে এলো মিনি। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে আধশোয়া হয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে নিজের ওয়ার্ড্রোবে একটা অ্যালবাম খুঁজতে লাগল দ্রুত হাতে। খানিকটা অস্থির হয়েই খুঁজছিল, হাঁকপাঁক করছিলো ভিতরটা, পেয়ে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যেই। এই এলবামটা কোনো নির্দিষ্ট উপলক্ষের নয় , অনেক মুহূর্ত ছবি হয়ে বাঁধা রয়েছে এই ভারী অ্যালবামটায়। কিন্তু অ্যালবামের বাকি ছবিগুলোয় খুব একটা আগ্রহ নেই এই মুহূর্তে , একটা বিশেষ ছবি খুঁজছে ও। এই তো এই তো , এই ছবিটাই। অ্যালবাম থেকে ফটোটা দ্রুত হাতে বের করে নিয়ে অ্যালবামটা যথাস্থানে রেখে দিলো মিনি। এবার না শুলে কাল সকালে টাইম এ হসপিটালে পৌঁছনো অসম্ভব। আর দেরি না করে লাইটটা নিভিয়ে চোখ বুজল মিনি।

*****

(দিন কয়েক পর )

বাজছে ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে। আননোন নম্বর বলে প্রথমে ধরেনি , তৃতীয়বার বাজার পর অবশেষে ফোনটা ধরলো মিনি।

“হ্যালো ছোড়দি, রনি বলছি। “

কয়েকসেকেন্ড সময় লাগল বুঝতে মিনির , তারপরই বুঝতে পেরেই নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে বললো ও ,” হ্যাঁ বলছি। “

কুশলবিনিময় ভদ্র্রতাটুকুও দেখাল না মিনি, ইচ্ছাকৃত ভাবেই।

রনি হয়তো এতটা কঠোর স্বর আশা করেনি , একটু যেন ভেবাচেকা খেয়ে গেলো তাই। কয়েক সেকেন্ড আমতা আমতা বলল , ” বাবা এখন একটু ভালো আছে রে। তুই সেদিন হসপিটালে ভর্তির ব্যবস্থাটা না করে দিলে জানি না কি করতাম। তোর সাথে দেখা… “

মামাতো ভাইকে আর কথাটা শেষ করতে দিলো না মিনি , অপ্রাসঙ্গিক অপ্রয়োজনীয় কথা কাজের সময় কাজের জায়গায় একদমই পছন্দ না ওর। বললো , ” আমার সাথে দেখা করার বা আমায় ফোন করার কোনো প্রয়োজন নেই রনি। আমি যতটুকু করার করেছি , মানবিকতার খাতিরে। এর বেশি কিছু আশা করিস না , আর ফোন করে বেকার…ভালো থাকিস। তোর জন্য আমি আছি। কিন্তু আর কারো জন্য নয়। এটা মাথায় রাখিস। তোর কোনো দরকার হলে নিশ্চয় ফোন করবি। কিন্তু আর কারো জন্য নয় , এমনকি… ভালো মন্দ কিছু ঘটে গেলেও আমায় ফোন করে জানানোর কোনো দরকার নেই। আমি সত্যিই জানতে চাই না। রাখলাম এখন।”

রনিকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না আর মিনি , ফোনটা রেখে দিল। সিট থেকে উঠে বাথরুমে গেল একবার। মুখে চোখে জল দিল। ব্যাগ থেকে ফটোটা টেনে বের করল। ওর ছোটবেলার ফটো। মামার আঙ্গুলটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে নিষ্পাপ চোখে একরাশ ভরসা নিয়ে। মামার মুখে হাসি। কয়েক সেকেন্ড ফটো টার দিকে তাকিয়ে দ্রুত হাতে ছবিটা ছিড়ে কুচি কুচি করে ফ্লাস করে দিল মিনি।

*****

আমাদের জীবনের নানা ছবির নানা মুহূর্ত। সব মুহূর্ত, সমস্ত হাসিমুখগুলো তো সত্যি হয় না।শেষ স্মৃতিটুকুও তাই আজ নষ্ট করে দিল মিনি। আর কোনো মুহূর্তের সাক্ষী নেই , নেই কোনো প্রমাণ। মিথ্যে সম্পর্কের মিথ্যে মুহূর্তগুলো আজ শুধুই ধূসর অতীত।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

রক্ত

মালপত্র মোটামুটি সব নামানোই হয়ে গেছে, তাও আরেকবার দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে নিচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু। নতুন পাড়া, নতুন সব লোকজন , কালচার ও আলাদা। সাউথ থেকে সোজা

Read More »

Share with