আমার একলা আকাশ

।।১।।

“ফেরার সময় বাবার ওষুধগুলোর সাথে কিছু খাবার দাবারও কিনে নিস কিন্তু, আজ সন্ধ্যে বেলা মঞ্জু মাসির আসছে। মনে আছে তো? কাল ফোন করেছিল।” থালায় জলখাবারটা বাড়তে বাড়তে বললেন রমলাদেবী। তনু চেয়ারটা টেনে খেতে বসতে বসতে তাকাল মা-র দিকে। ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আবার তাহলে আজকে শুনতে হবে তাই তো?”

“ছাড়, আর অত মনে রাখিস না, যতই হোক, তোর নিজের মাসি, তোকে ভালবাসে, তোর কথা ভাবে বলেই তো বলে। না ভাবলে কি দায় পড়েছিল ওর যে বারবার বলবে আর এত সম্বন্ধ আনবে?”

“থাক মা, তুমিও জানো সত্যিটা কি, আমিও জানি, মঞ্জু মাসিও জানে, তাও।।। যাই হোক, আমায় দুটো রুটি দাও, অত খাব না। বাবা খেয়েছে? তুমি বসে পড় আমার সাথে।

“হ্যাঁ, এই তো বাবা এসে গেছে, এই বসে পড় তুমিও, একেবারে দিয়ে দি। দাঁড়া তরকারিটা গরম হয়ে গেল, নিয়ে আসি।”

প্রতি সকালের রোজনামচা এটাই, আজকেরটা আরেকটু অন্যরকম যদিও। শোভাবাজার এলাকায় এই বাড়িতে তনুরা ভাড়া এসেছে প্রায় বছর সাত-আটেক। দাদার এখান থেকে অফিস যেতে সুবিধা হতো বলে, হাজরা থেকে এখানে চলে এসেছিল ওরা। সবকিছু ঠিক থাকলে একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে নেওয়ারও ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তারপর সবকিছু এমনভাবে এলোমেলো হয়ে গেল যে।।।

“কিরে খা ঝটপট, এরপর বলবি দেরি হয়ে গেছে আর দৌড়বি না খেয়ে। আচ্ছা ভাল কথা, প্রিমিয়ামটা জমা করতে হবে, এমাসে ইলেকট্রিক বিলটাও যে পরিমাণ এসেছে, বাপরে। সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলবে এরা। তুই অনলাইনে মনে করে দিয়ে দিস কিন্তু এগুলো, ভুলিস না। আর আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস, আমি তাও ফোন করব তোকে বেরনোর আগে। ঐ হরিদার দোকান থেকেই কিনে নিস মিষ্টি জলখাবার সব।”

মায়ের কথাগুলো চুপচাপ শুনছিল তনু আর মনে মনে হিসেবটা কষছিল, মাসের শেষ, মাস পড়তেই যে মাইনে পাবে তার নিশ্চয়তাও নেই, আর মাইনে তো এখন ঐ কটা টাকা। ঘরে এত ডিগ্ৰী সার্টিফিকেটগুলো জ্বলজ্বল করছে বটে, কিন্তু অভাবের জ্বালা আর মিটল কই? যখনই একটু সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছিল তখনই দাদা।।। বাবাও তারপর  স্বাভাবিক জীবন থেকে মুখ ফেরাল। প্রাণশক্তিতে ভরপুর, হাসিখুশি একটা মানুষ কিভাবে যে বদলে একটা নিষ্প্রাণ পাথর হয়ে যেতে পারে! আজকাল তো তেমন কথাও বলে না। তনু অনেকবার চেষ্টা করেছে মা বাবাকে নিয়ে কাছেপিঠে ঘুরতে যেতে, গেছেও দু’তিনবার। কিন্তু যে কে সেই। বয়সের তুলনায় যেন অনেক বেশীই বুড়িয়ে গেছে মানুষটা, আর মা মুখে কিছু তো বলে না, হাসিমুখেই থাকে ইদানিং, কিন্তু সবার চোখের আড়ালে মানুষটা যে আজও একইভাবে চোখের জল ফেলে তনু তা ভাল করেই জানে। সব দেখে জেনেও ওর কিছুই করার নেই, এত অসহায় লাগে মাঝে মাঝে, মনে হয় সব ছেড়ে বেরিয়ে যেতে।

বেলটা বেজে উঠতে ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরল তনু, মিনুদি কাজ করতে এসে গেল বোধ হয়। ও তাড়াতাড়ি খাওয়াটা শেষ করে উঠে পড়ল।

**********

অফিস থেকে আজ ছুটি হওয়ার একটু আগেই বেরিয়ে পড়েছে তনু, বিকেল বিকেল খাবারগুলো নিয়ে বাড়ি ঢুকতে হবে। মঞ্জুমাসি আসছে শুনলে ছোটবেলায় খুব আনন্দ হতো ওর, এখন শুনলে মনে হয় পা দুটো যেন আর বাড়ি না পৌঁছায়, কেউ পা দুটো পাথর দিয়ে বেঁধে দিক। না শুধু মঞ্জু মাসি বলে না, মামা, দুই জ্যেঠু সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। আসলে দোষ এই মানুষগুলোর নয়, এরকমই তো হয় সকলে। তনুর মতো মানুষই চিনতে জানতে বুঝতে বড্ড সময় নিয়ে নেয়। হাতে খাবারের ব্যাগ আর বাজারের ব্যাগ মিলিয়ে বেশ ভারীই হয়েছে, মোড় থেকে অটো বা রিক্সা কিছু নিতেই হবে, কিন্তু এইটুকু রাস্তার জন্য যা ভাড়া বাড়িয়েছে, সত্যিই গায়ে লাগে, সচরাচর তাই ও ওঠে না, হেঁটেই যায়। কিন্তু আজ হেঁটে এতটা বয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। মোড়ের কাছে অটোর লাইনটাই গিয়ে দাঁড়াল ও। ব্যাগ দুটো বেজায় ভারী, হাত বদলে বদলে কোনোক্রমে নিয়েছে, তার উপর কাঁধে নিজের ব্যাগ, তার মধ্যে আজকের ভ্যাপসা গরম। বিকেল বেলা অফিস থেকে বেরনোর সময় যা জোর হাওয়া দিচ্ছিল, ভাবল আজ হয়তো ঝড় বৃষ্টি হবে কিছু। কোথায় কি, ধ্যুর! গলদঘর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। সামনের মিষ্টির দোকানটা আবার নতুন করে খুলেছে, আজকেই চোখে পড়ল। অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল, অন্য কেউ হয়তো কিনে নিয়ে নতুন করে খুলেছে, পুরোনো লোকগুলো আর নেই, সব নতুন।

এই দোকানটাতেই একমাত্র ভাল সরভাজা পাওয়া যেত এই এলাকায়, আর কোথাও এই মিষ্টিটা পাওয়া যেত না সেভাবে, এখনও পাওয়া যায় না। আর এই সরভাজা ভীষণ প্রিয় ছিল তনুর আর বাবাই-এর, মানে তনুর দাদার। ওর বেশ মনে আছে দাদা অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায়দিনই কিনে আনত। এমন হয়ে গেছিল ওরা দুই ভাইবোনের কেউ দোকানে গেলেই ঐ বয়স্ক মতন যে জ্যেঠু ছিলেন, জিজ্ঞাসা করতেন কতগুলো সরভাজা তুলব বল। দোকানটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে অতীতেই ডুবে গেছিল তনু, হর্নের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরল ওর। পাশের মোমোর দোকানটা বেশ বড় করেছে এখন, লাইট দিয়ে বেশ জমজমাট পরিবেশ এখন। শেষ এই দোকানে খেয়েছিল আট বছর আগে, দুর্গাপুজোর সময়। সেই বছরই দোকানটা খুলেছিল। তখনও মোমোর অত চল হয়নি। পুজোয় সেবার তনু আর বাবাই, বাবা, মা একসাথে খেতে এসেছিল এখানে। ব্যস, ঐ প্রথম, ঐ শেষ। তারপর থেকে আর কোনদিন এই দোকানে ও আসেনি, কখনও আর মোমোও খায়নি তনু, আর নামবেই না গলা দিয়ে। ঝাপসা চোখটা নামিয়ে নিয়ে মুছে নিল তনু। অটো এসে গেছে ততক্ষণে।

**********

মামার গলা বরাবরই একটু বাজখাঁই গোছের। বাড়িতে এলে মোটামুটি পাড়ার মুখ থেকে শোনা যায়। অটো থেকে নামতে নামতেই গলাটা পেল তনু। তার মানে মামাও এসেছে। ভাগ্যিস বেশী করে খাবার কিনে নিয়েছিল ও। মা একবার ফোন করে বলবে তো। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখল মায়ের তিনটে মিসড কল। ইসস! মা এই জন্যই বোধ হয় ফোন করছিল। ফোনটা এত প্রব্লেম করছে ক’দিন ধরে, একটা সস্তার ফোন কিনে নিতে হবে এবার, নয়তো আর চলছে না। অধিকাংশ সময় ফোন এলে বুঝতেই পারে না। একটু এগিয়ে সামনের দোকানটা থেকে আরও কিছু কিনে নিয়ে গেট ঠেলে বাড়ি ঢুকল তনু।

**********

ছোট্ট দুকামরার ফ্ল্যাটে বসার ঘরে বসে কথা বললে বাথরুম থেকে স্পষ্টই শোনা যায়, তনুও স্নান করতে করতে শুনতেই পাচ্ছিল পুরোটা, নিজের মনেই হাসছিল। কিছু মানুষ কোনদিন বদলায় না, যেমন এই মানুষগুলো। না, সবাই যে সমান তা নয়, কই ওর পিসিরা তো এরকম না। তারাও নিজের, এরাও তো নিজের, অথচ দ্যাখো, শাওয়ার বন্ধ করল তনু। সম্পত্তি, ভাগাভাগি, এইসব শব্দের মাঝে তনুর বিয়ের বয়স সংক্রান্ত কথাটা কানে আসতেই মাথাটা আবার গরম হতে লাগল ওর।

চোখদুটো বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিল বেশ কয়েকবার। স্যাঁতস্যাঁতে চুন খসা দেয়াল, বালতিতে জলের টুপটাপ, আর  অতি সাধারণ ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ মনটা হাঁসফাঁস করছিল বেরিয়ে কথাকটা বলার জন্য, কিন্তু নাহ। মায়ের মুখটা মনে পড়তেই নিজেকে সংযত করল তনু। মাথায় তোয়ালেটা জড়িয়ে নিয়ে বেরল বাথরুম থেকে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে বসল তনু। গলার কাছে আটকে থাকা যন্ত্রনাটা কান্না হয়ে উগরে বেরিয়ে এল আজ বহুদিন পর। কত বছর পর আজ এভাবে হাউহাউ করে কাঁদছে তনু কে জানে। দাদা চলে যাওয়ার পর বয়সের তুলনায় অনেক, অনেক বেশী পরিণত মনস্ক হয়ে গেছে ও, খুব তাড়াতাড়ি যে বড় হয়ে যেতে হয়েছিল তনুকে। মনের মাঝে একটা সদ্য কৈশোর পেরনো অষ্টাদশীর হাজারো স্বপ্ন, ইচ্ছে, অনিচ্ছেগুলো চাপা পড়ে গেছিল সেইদিন থেকেই। তারপর থেকে আর কাঁদতে পারেনি তনু। এত তাড়াতাড়ি এত কিছু দেখে নিতে গিয়ে, বুঝে ফেলতে গিয়ে ওর মধ্যেকার শিশুটা হারিয়ে গেছে আজ বহুকাল। বড্ড কষ্ট হচ্ছে আজ আসলে দাদার জন্য। আজ দাদা থাকলে।।। বাইরে বৃষ্টি নামল প্রবল বেগে। জানলাটা খোলাই ছিল, তনুর মুখে জলের ঝাপটা লাগছিল, চোখ দুটো বুজে নিল ও। এই সংসার বড় বিচিত্র, এখানে মানুষ মানুষকে খোঁচা মেরে, বিব্রত করে, তার অসহায় পরিস্থিতিতে তার পাশে না থেকে তাকে চারটে কটু কথা বলে এত সুখ কি করে পায় কে জানে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের এই রূপ পরিবর্তন নাকি মুখোশ উন্মোচন, কোনটা আসল কোনটা নকল কে জানে। ফোনটা একবার হাতে নিল ও। আবার মিসড কল হয়ে গেছে, একটা মেসেজ করে ফোনটা সরিয়ে রাখল ও। জানলাটা লাগিয়ে দিল এবার। মা ডাকছে, মাকে সাড়া দিয়ে আয়নাটার সামনে দাঁড়াল ও, চোখদুটো মুছে মুখে মেকী হাসিটুকু ফুটিয়ে দরজা খুলে বেরল তনু।

।।২।।

“কতদিন পর ব্রেকফাস্টে তোর হাতের লুচি ছোলার ডাল খাচ্ছি রে দিদি, উফফ!” গ্রাসটা মুখে পুরতে পুরতে বলল মঞ্জু।

রমলাদেবী তখন বাটিতে সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিতে ব্যস্ত। হেসে বললেন, “তোরাই তো থাকিস না, কাল নেহাত এই বৃষ্টিতে ফিরতে পারলি না তাই। কতদিন পর থাকলি বল তো।”

“তুমিও তো আসতে পারো দিদি, কতবার বলেছি, তনুটাকে নিয়ে এস ক’দিনের জন্য, সে না। একটি দিনও থাকবে না।”

গরম লুচিগুলো দিতে দিতে রমলাদেবী বললেন, “কি করে যাব বল? মেয়েটার তো রোজ বেরনো থাকে, আর তোদের জামাইবাবুকে একা ফেলে সম্ভব যাওয়া?”

“তনুর তো বিয়ের বয়সও হলো দিদি, এবার তো ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। কি করে যে তোমরা চুপচাপ বসে আছ নিশ্চিন্তে কে জানে। এই তো সামনের আশ্বিনে ৩০ হবে, তাই তো? তাহলে? এবার তো ভাব একটু।”

তনু মঞ্জুমাসির উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসেই খাচ্ছিল, কথাগুলো মুখ থেকে বেরতে চাইছিল, মা বাবার দিয়ে তাকিয়ে বারবার সংযত করছিল নিজেকে।

“সমরদার পেনশন, পি.এফ সবই তো ব্যবস্থা হয়ে গেছে, তাহলে আর দেরী করার দরকার কি? তনুও অনেকদিন চাকরি করছে, সেভিংসও আছে, তাহলে অসুবিধা কোথায়? আর তারপর আমরা তো আছিই। নাকি অন্য ব্যাপার, দেখে টেখে রেখেছিস নাকি? বল তবে। তাদের বাড়ির লোকের সাথে আলাপটা হোক। কথাবার্তা শুরু হোক।।।”

তনুর খাওয়া শেষ, জলটা খেয়ে মঞ্জুমাসির দিকে সোজাসুজি তাকাল এবার ও, “ঠিক কি কারণে তোমরা এসেছ বলতো? না, মানে সত্যিই বুঝতে পারছি না ঠিক কোন প্রয়োজনে আসতে হল তোমাদের। প্রয়োজন ছাড়া তো ফোনও কর না, তাহলে হঠাৎ? আমার বিয়ে নিয়ে অ্যাকচুয়েলি যে তোমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই, সেটা আমিও বুঝি। তাহলে? ও আচ্ছা, মামাবাড়ির সম্পত্তি ভাগাভাগি হচ্ছে, মা-র থেকে এবার NOC টা দরকার তাই তো?”

“কি হচ্ছে কি তনু? উল্টোপাল্টা বলে যাচ্ছিস তখন থেকে?” মেয়ের হাতটা চেপে ধরলেন রমলাদেবী।

“এবার একটু বলতে পার তো মা, আর কত? এই যে মাসি কথাটা বলল আমরা তো আছিই, কেন বলল মা? দাদা যখন মারা গেল, কত বয়স আমার? নিজের পড়াশোনাটুকুও শেষ করতে পারিনি তখনও, বাবার এরকম কন্ডিশন, তখন কোথায় ছিল মাসি আর মামা? আমাদের ফিনান্সিয়াল কন্ডিশন তো অজানা নয়, হেল্প করেছিল সেদিন? বলেছিল সেদিন তুই পড়াশোনাটা কর আমরা আছি? বাবার পি.এফ এর কথা বলছে, কাঠখড় পুড়িয়েছিল সেদিন? তোমার থেকে NOC নিতে এসেছে, জানে না এই দুকামরার ভাড়ার ফ্ল্যাটে আমরা কিভাবে থাকি? জানে না আমাদের প্রয়োজন আছে নাকি নেই? বিয়ের জন্য চিন্তা? আমার মা বাবাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে আমি বিয়ে করে চলে যাব? তোমাদের মতন এতটা স্বর্থপর হতে পারিনি এখনও। একটা বিয়েতে কি পরিমাণ শারীরিক, মানসিক, আর আর্থিক চাপ থাকে, ধারণা নেই কোন? কিভাবে করব বিয়ে? দাদা মারা যাওয়ার পর মানুষদুটো তো ভেঙেই গেছে, তোমরা কি কোন দায়িত্ব নিয়েছিলে? আমি তাদের আর একবার একা করে দিয়ে চলে যাব? আর কিভাবে যাব? তোমরা করবে কিছু? বিয়ের দিন খাবার পর তো ভুল ত্রুটিগুলো ধরে, টুথপিক দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে মানুষের রক্ত জল করা পরিশ্রমকে অপমান করে চলে যাবে। আর প্রেম? দেখাশোনা? কেন বলব তোমায়? কি করবে তুমি জেনে? সব প্রেমের পরিণতিই কি বিয়ে? সবার জীবন তো সমান নাও হতে পারে। সবার প্রায়োরিটিজ, সবার প্রব্লেম আলাদা, প্রতিটা মানুষের লড়াই তো আলাদা। আমায় এই বয়সে যতটা যেখানে মাথা ঘামাতে হয়, টুসকিকে তো তা করতে হয় না। কারণ ওর লাইফ অন্য, আমার জীবনের যুদ্ধটা অন্য। আমি ৩০-এ পড়লেই যে আমায় বিয়ে করতেই হবে তার যেমন কোন মানে নেই, তেমনি যারা বিয়ে করছে তাদেরও কেন বিয়ে করছে এর মধ্যেই এটা বলার ও কোন কারণ নেই। আমার জীবনটা তোমার টাইম ডাইমেনশনে নাও চলতে পারে। আমি কাউকে ভালবাসতেই পারি, কিন্তু ভালবেসেও তাকে এখন বিয়ে নাও করতে পারি, কারণ এই জীবনটা আমার, আর দায়িত্ব একাধিক, আমায় সবটা একা সামলে যা করার করতে হবে। আমি নিজের মা বাবার প্রতি দায়িত্ব এড়াতে পারি না, এড়াতে চাইও না, আর যে থাকার, সে এই সময়টুকুও দেবে, থাকবেও।”

চুপ করল তনু, এতক্ষণ ধরে কথা বলে হাঁপাচ্ছিল ও। ডাইনিং টেবিলে প্রতিটা মানুষের মধ্যে নিস্তব্ধতা বিরাজমান।

তনু টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল, বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে মুখে চোখে জল দিল ও। হালকা লাগছে আজ অনেক অনেকদিন পর। ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল ও। ডাইনিং টেবিলে তখনও মূর্তির মতন বসে মানুষগুলো। ব্যাগটা নিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল তনু, “সৌরভ, সৌরভ গুহ, জানা হয়ে গেছে নামটা? শান্তি এবার তোমাদের? ওর আর আমার সম্পর্কের মধ্যে কোন শর্ত, কোন terms and conditions নেই, কোন ডেডলাইন, টাইমলিমিটও নেই। আর বিয়েটাই একমাত্র কনক্লুশন, এটাও আমাদের সম্পর্কে কোথাও লেখা নেই। কোন বন্ধন ছাড়াই আমরা একে অপরের পাশে আছি বিগত ১০বছর, আর থাকবও। আর এই বাঁধনে বিশ্বাসী নই আমি, তোমাদের সাথে তো নিজের সম্পর্ক,রক্তের সম্পর্ক, তোমার যেভাবে পাশে ছিলে এতদিন, সেভাবে প্লিজ আর থেকো না পাশে। অনেক হয়েছে।” আর কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে পড়ল তনু হনহনিয়ে। উফফ, কি অসম্ভব হালকা লাগছে মাথাটা!

না, আর কষ্টটা হচ্ছে না বুকের মধ্যে। তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগিয়ে অটোটা ধরল ও আজ। অফিস যেতে পারবে না আজ। ভীষণভাবে ছুটি প্রয়োজন ওর। অটোয় চেপে দুটো ফোন করে বসল চুপচাপ। আকাশ আজ মেঘলা আবার, ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। হু হু করে এগোল অটো। জলের ছিটে আর ঝোড়ো হাওয়ায় যেন মনে হচ্ছিল সমস্ত মন খারাপ, সমস্ত গ্লানি ধুয়ে যাক আজ। ঘাটের কাছে এসে নামল তনু। ভাড়া মিটিয়ে এগোল গঙ্গার পাড়ে। এই দিকটা বেশ শান্ত, একটু দূরে মানুষজন স্নান করতে ব্যস্ত। এদিকটায় বসল তনু, ভরা জোয়ার, অনেকটা উঠে এসেছে জল। চুপচাপ বসে দূরের সীমানাটা চোখে ধরার চেষ্টা করছিল তনু। বাজল হাতে ফোনটা।

“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালবেসে।।। আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে তোমার কাছে এসে, শুধু তোমায় ভালবেসে।।।” মুখে হাসি নিয়ে তাকাল ফোনের স্ক্রিনে, পরক্ষণেই পিছন থেকে চিরপরিচিত গলার স্বরে ফিরে তাকাল তনু।

“কাল থেকে ম্যাডামের পাত্তাই নেই, ফোনও ধরলি না, আজ অফিস যাওয়াও নেই, কি ব্যাপার?” বলতে বলতেই পাশটায় এসে বসল সৌরভ। নিতান্ত সাধারণ, ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা ছেলে। চেক শার্ট, জিনসের প্যান্ট, পায়ে চটি, এলোমেলো চুল, চোখে চশমা পরা এই মানুষটাই তনুর জীবনের সমস্ত মনখারাপ, কষ্ট, যন্ত্রণার ফুলস্টপ বাটন যেন।

এই মানুষটার কাছে এলেই মনখারাপের মেঘ কেটে রোদ ওঠে যেন ঝলমলিয়ে, যার ঠোঁটের একচিলতে হাসিতে সমস্ত দুশ্চিন্তা শেষ হয়ে যায় একনিমেষে। দাদার চলে যাওয়ার পর তো এই ছেলেটাই তনুকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে রেখেছিল নিজের মত করে, ভরসার হাতটা কাঁধে রেখে এসেছে সবদিন।

তনুর চোখের সামনে তুড়ি মেরে বলল সৌরভ, “হঠাৎ এই জরুরী তলব? সব ঠিক আছে তো? তা ভালো এই নীল কুর্তিতে সুন্দরীকে দেখা হয়ে গেল আজ। এই সৌভাগ্য তো বারবার হয় না।”

“বাড়িতে অশান্তি, মামা, মাসির এসেছে। বিয়ে নিয়ে মাথা ব্যথা দেখাচ্ছে, কিন্তু আমার ব্যাপারটা তো আলাদা বল আর পাঁচজনের থেকে। আমায় তো এদিকটা গোছাতে হবে, মা বাবার দিকটা দেখতে হবে, এই চাকরিতে।।। চেষ্টা করছি একটা বেটার জবের, কিন্তু এখনও সেরকম।।।”

“ছিলাম, আছি, থাকব।” তনুকে থামিয়ে কথাটা বলে হাতটা শক্ত করে ধরল সৌরভ। “একটা ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো অবধি একটা মেয়ে যদি অপেক্ষা করতে পাড়ে, তাহলে একটা মেয়ে সবদিক থেকে প্রস্তুত না হওয়া অবধি একটা ছেলেও পারে অপেক্ষা করতে। এত ভাবতে হবে না তোকে। আছি তো নাকি? এত বছরেও বিশ্বাস হল না? আই উইল ওয়েট ফর ইউ। শুধু তুই একটু হাসিখুশী থাক। ব্যস।।। আমি আছি।”

ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছিল তনুর চুল। এলোমেলো হয়ে পড়ছিল মুখ চোখের উপর। চুলগুলো কানের পাশে সযত্নে নিজের হাতে করে গুছিয়ে দিল সৌরভ অগোছালো ছিল যতটুকু। সৌরভের চোখ, কপালের উপর পড়া এলোমেলো চুলগুলোও নিজের হাতে সরিয়ে দিয়ে হাসল এবার তনু, চোখে চোখে কোন শব্দ খরচ না করেই যেন বলল দুজন দুজনকে, “যা কিছুই বাধা, একসাথে ঠিক পেরিয়ে যাব বল?”

শক্ত করে হাতটা ধরে সামনের নীল সীমানায় চোখ রাখল ওরা দুজন, এভাবেও তো ভালোবাসা যায়, এভাবেই তো আসলে ভালোবাসা হয়। আবার গানটা বাজছে, পিছনে চায়ের দোকানটায় —”আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালবেসে।।। আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে, শুধু তোমায় ভালবেসে।।। তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে।।। ভয়ের শিশির ঠোঁট ছুঁয়ে যায় তোমায় ভালবেসে।।। আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে, শুধু তোমায় ভালবেসে।”

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with