।।১।।
-“কর্তামশাই ফিরেছেন?”, চোখদুটো বুজেই আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে প্রশ্নটা করলেন কর্তামা ওরফে চৌধুরী বাড়ির জমিদারগিন্নী ।
-“না কর্তামা, এখনও….”
কথাটুকু বলে আর শেষ করতে পারলেন না এ বাড়ির বিশ্বস্ত সদানন্দ, হাতের ইশারায় ওকে যেতে বললেন কর্তামা । নিঃশব্দে, সে আজ্ঞা পালন করল সদানন্দ, যাওয়ার আগে বিশাল ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল । আরাম কেদারায় হাত দুটো ছড়িয়ে চোখ খুললেন এবার মৃণালিনী, এবাড়ির সর্বময় কর্ত্রী, প্রজাদের প্রিয় কর্তামা ।
ঘরের ঝাড়বাতিতে ঝলমল করছে ঘরের প্রতিটা কোণ, উঠল মৃণালিনী, সামনেই বিশাল মাপের আয়নায় একবার নিজেকে দেখল, খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবেই, পরনে কালো শাড়ি সোনালী কাজে মোড়া, ভারী সোনার গয়না, চোখে মুখে দৃঢ়তা, বুদ্ধিমত্তার ছাপ স্পষ্ট, চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে দেখে নিল একবার, কিছু দেখা যাচ্ছে না তো? বাইরে গাড়ি এসে থামল ততক্ষনে, তাড়াতাড়ি চাবির গোছাটা সামলে বাইরের দিকে পা বাড়াল মৃণালিনী ।
।।২।।
জমিদারি প্রথা, বনেদীয়ানা এখনো পুরোপুরি অবলুপ্ত হয়নি, তার প্রমান এই বৃন্দাবনপুর ।
জমিদার বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ প্রবাল চৌধুরী, বিদেশে লেখাপড়া শেখার পরও বাবা মা-র ইচ্ছেয় আবার ফিরতে বাধ্য হয়েছে এই বৃন্দাবনপুরে । বাপ ঠাকুরদার বিশাল ব্যবসার অংশীদারি থেকে কে-ই বা বঞ্চিত হতে চায় । প্রবালও সেই বোকামোটা করেনি । কিন্তু এতগুলো বছর বিদেশের রুচি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে এখানকার রুচি সংস্কৃতিতে আবার মানিয়ে নেওয়া মুখের কথা নয় । প্রবালও পারছিল না, তাই বারবার বিদেশী আদবকায়দা জোর করে এখানে খাটানোটা ওর নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আর শরীরে যখন জমিদারী রক্ত, তখন তো….।
****************
প্রবাল বিদেশে লেখাপড়া করছিলো আর মৃণালিনীও এখানে লেখাপড়া শিখেছিল, দুইজনের বিয়ের ব্যাপারে দুই সম্ভ্রান্ত পরিবার ভাবনা চিন্তা করার অনেক আগে থেকেই প্রবাল আর মৃণালিনী একে অপরকে পছন্দ করে রেখেছিলো, ভালবেসেছিল । বিয়ের পর তারপর চার বছর কেটে গেছে । নিজ গুনে মৃণালিনী এই জমিদারী, বিপুল ব্যবসা একই সামলাচ্ছে, ঘরে বাইরে সবটা সামলাতে সামলাতে কখন যে ওর ভিতরকার শিশুসুলভ মিনু বড় হয়ে এই বাড়ির জমিদার গিন্নী হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি, মাত্র ২৬ বছর বয়সেই পরিস্থিতি অনেক বেশি অভিজ্ঞ করে তুলেছে ।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ার সুবাদে ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক চালানো এসবেও সমান পারদর্শী মৃণালিনী । এই জমিদারী, ব্যবসা চালানোর জন্য এর থেকে সুযোগ্য আর কে-ই বা ছিল? প্রবালের বাবা প্রতাপ চৌধুরীও নিশ্চিন্তে একমাত্র বৌমার উপর সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন ।
।।৩।।
প্রবাল এখন বেহুঁশ, এখন এটা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে । ওর অবচেতন মুখটার দিকে তাকিয়েই ওর পাশে বসেছিল মৃণালিনী । ঘরে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ ছাড়া চারিদিক নিশ্চুপ, মেহগনি কাঠের পালঙ্কটা দুধ সাদা সিল্কের চাদরে মোড়া । আজ ওদের বিবাহবার্ষিকী, মৃণালিনী নিজের হাতে ঘরটা সাজিয়েছিল আজ, ওর আর প্রবালের জন্য । ফুলদানিতে রাখা রাজনীগন্ধাগুলো যেন উপহাস করছে মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে । প্রবালের মাথায় হাতটা রাখতে গিয়েও পারল না, প্রবালের শরীর থেকে আসা সুবাস, ওর কপালের লালচে আভাটা পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল ও এতক্ষন কোথায় ছিল ।
-“আর কত নীচে নামবে প্রবাল? আর কতবার”
সবার সামনে না, একান্তে ওরা একে অপরকে নাম ধরেই ডাকে ।
“আমাদের ভালবাসা, আমাদের বিয়েটাকে একটা ঠাট্টা কেন বানিয়ে দিলে প্রবাল?” বলতে বলতেই নিজের কপালের ঢেকে রাখা কাটা দাগটায় হাত দিয়ে কঁকিয়ে উঠল আরও একবার । চোখের কোণে জমে থাকা জলকে তাও কিছুতেই চোখের গন্ডি পেরিয়ে বেরতে দিল না, নিজেকে দ্রুত সামলে নিল মৃণালিনী । ও এবাড়ির সবার আশা ভরসা, এতগুলো মানুষের কর্তামা, আস্থার জায়গা ।
নিজের বিয়ের বাঁধানো ফ্রেমটা হাতে নিয়ে লাগোয়া বারান্দাটায় দাঁড়াল একবার, দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা । অতীতের রঙ্গিন স্মৃতিগুলোকে আজকের ধূসর বর্তমানটা কেমন সযত্নে চাপা দিয়ে দিচ্ছে সেটাই ভাবছিল, প্রবালের বিকৃত শারীরিক চাহিদার কথা বিয়ের আগে তো জানত না মৃণালিনী, প্রবালকে নিজের মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল ও, বিয়ের পর প্রবালের সেই রূপ দেখার পর থেকেই একটু একটু করে মরতে শুরু করেছিল ভিতরে ভিতরে । তাও, নিজের ভালবাসার খাতিরে সব যন্ত্রনা মুখ বুজে আজও সহ্য করে চেলেছে ও, যতই হোক, বড্ড ভালবাসে যে ও ওর প্রবালকে । যেদিন থেকে আপত্তি শুরু করল, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওর শরীরটা, এইতো পরশুই কপালে….।
সন্তানও দিতে পারেনি এখনও ও এই বংশকে । কিন্তু শ্বশুরমশাই, শাশুড়িমা, খুড়শ্বশুর-শাশুড়ি, খুড়তুতো দেওর, ননদ সবার খুব আদরের ও, শুধু যাকে ভালবেসে এবাড়িতে পা রেখেছিল, সেই মানুষটাই বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে ।
।।৪।।
এবাড়ির কাজ শুরু হয় কৃষ্ণ বন্দনা দিয়ে, আজও তার অন্যথা হয়নি । শীতের হিমেল আমেজ গায়ে মেখেই ঠাকুর ঘরে হাজির সবাই, শান্ত পবিত্র সোনালী আভাটা সূয্যিমামা বড় যত্নে ছড়িয়ে দিচ্ছিল এই বাড়ির আনাচে কানাচে, পাখিগুলোও কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে, আরতি শেষে প্রসাদের থালাটা নিয়ে রোজকার মতো সবার হাতে প্রসাদ দিচ্ছিল মৃণালিনী, হঠাৎই সদানন্দকে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে আসতে দেখে থমকে দাঁড়াল মৃণালিনী ।
-“কর্তামা, বাইরে কিছু লোকজন জমা হয়েছে, খুব ঝামেলা করছে, আপনি একবার তাড়াতাড়ি আসুন ।”
-“কিন্তু কী হয়েছে এতো সকালে?”
কিছু বলতে পারল না সদানন্দ, “আপনি আসুন একবারটি ।”
প্রসাদের থালাটা রেখেই লম্বা দালান পেরিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হাঁটা লাগলো এবাড়ির কর্তামা, পরনে তখনও পুজোর লালপেড়ে গরদ । সিক্ত চুল পিঠ ছাপিয়ে কোমর অবধি নেমেছে, গলার সীতাহার, হাতের কাঁকনের ছটাও যেন হার মানছে তার জৌলুসের সামনে, সিঁথি ভর্তি লাল টকটকে সিঁদুর, কপালে বড় লাল টিপে সাক্ষাৎ মা দূর্গা, নীচে নামার সাথে সাথে থতমত খেলো মৃণালিনী । এরা তো ওর খুব চেনা, যাদের সাথে জমিদার গিন্নী হিসেবে নয়, বরং একান্ত আপন বন্ধুর মতো মেসে ও, ওরা সবাই এত সকালে এভাবে বিধ্বস্ত হয়ে, “কী হয়েছে?”
****************
ঘরজুড়ে শুধু নিস্তব্ধতা, বলার মতো কোন শব্দই আর বাকী নেই । এরকম একটা দিন আবার মৃণালিনীর জীবনে আসতে পারে, ও স্বপ্নেও ভাবেনি । যে দাপট, যে ক্ষমতার সাথে ও নিজেকে প্রমান করেছে, সংসার আর বাইরের জগৎ এক হাতে সামলাচ্ছে, এক লহমায় সেই সম্মান এইভাবে দুমড়ে মুচড়ে যাবে তা কে জানতো? তাও সেই মানুষটার জন্য, যাকে ভালবেসে ওর এই বাড়িতে আসা । অথচ দেখো, তার চোখে মুখে অনুশোচনার একটা বিন্দুও নেই, যেন যা করেছে, বেশ করেছে ।
***************
“আর কত নীচে নামবে তুমি? ঘেন্না করছে আমার তোমার সাথে কথা বলতে”, রাগে দুঃখে কথাগুলো উগরে দিলো মৃণালিনী । বাইরে তখন অকাল বৃষ্টির পূর্বাভাস । গোটা আকাশ কালো মেঘে ঢাকা পড়ছে আস্তে আস্তে, নিম্নচাপের খবর শোনাচ্ছে টিভিতে আবহাওয়া দপ্তর । ঝোড়ো হাওয়ায় জমিদার বাড়ির দামী পর্দা হুহু করে উড়ছে । মৃণালিনী প্রবালের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখে আগুন ঝরছে, যন্ত্রনায়, অপমানে, দুঃখে ।
“তোমায় বাঁচানোর জন্য আর কতবার আমায় পাঁকে নামতে হবে বলতে পারো? তোমার সাথে সাথে তো আমিও অন্যায় করছি । এর আগেও দুটো মেয়ের সর্বনাশ করেছ তুমি । তোমায় বাঁচিয়েছিলাম অন্যায়ের সাথে আপোষ করে, সবার সাথে লড়াই করে, কিন্তু এবার? এই মেয়েটার যা অবস্থা ও আদৌ বাঁচবে? ও না বাঁচলে তুমি…”
কথাটা আর শেষ করতে পারল না মৃণালিনী, ঝোড়ো হাওয়ায় ভারী পেতলের ফুলদানীটা আছড়ে পড়ল মাটিতে । না বলতে পারা শব্দগুলো কোনরকমে গিলে নিল মৃণালিনী ।
-“এই সব কিছুর জন্য তুমি দায়ী, বুঝলে?”
প্রবালের অদ্ভুত দাবীটা শুনে ফিরে তাকাল মৃণালিনী । ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে বসে পড়ল মাটিতেই,”আমি? কী বলছটা কী তুমি?”
-“হ্যাঁ, তুমি, নিজের স্বামীকে খুশি করতে পারো না, একটা সন্তান দিতে পারো না, লজ্জা করছে না তারপরও আমায় দোষ দিতে? যা করেছি বেশ করেছি….”
কথার উপর কথা বাড়তে লাগলো । মৃণালিনী প্রবালের বিকৃত যৌন আকাঙ্খা পূরণ করতে পারছিল না আর, আর তাই সেই আকাঙ্খা মেটাতে অন্য মেয়েদের উপর ঝাঁপিয়ে একদম ঠিক করছিল পশুটা, এমনই দাবী করছিল একের পর এক । এর আগেও দুইবার এই ঘটনা ঘটেছিল, নিজের স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সবার কথা শুনে, সবার কথা ভেবে পাঁক ঘেঁটেছিল মৃণালিনী, নিজের প্রভাব, প্রতিপত্তি, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল । কিন্তু এবারে মেয়েটার যা অবস্থা, ও যদি না বাঁচে, তাহলে…. ধর্ষক-এর সাথে খুনি, কিভাবে বাঁচাবে ওকে এবার? নাহ, আর ভাবতে পারছে না মৃনাল । কাকে ভালবেসেছিল ও? মানুষ নাকী পশু?
।।৫।।
বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি, চৌধুরী বাড়ির সিংহদুয়ারের বাইরে থিকথিক করছে লোক । নীচের দালানে সাদা চাদরে ঢাকা শবদেহটি । কিছু দূরেই বিধ্বস্ত হয়ে বসে আছে মৃণালিনী । অবিন্যস্ত চুল, পোশাক, কাজল ঘেঁটে দিয়েছে চোখের জল । চোখের শূন্য দৃষ্টি দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠবে যে কারও মন ।
বাড়ির প্রতিটা মানুষের চোখে এখনও যেন অবিশ্বাসের ছায়া, সব যে শেষ ।
***************
আর যে দেরী করা যাবে না, পোস্টমর্টেম-এরও সব কাজ শেষ, আর সময় নেই, এবার তো যেতেই হবে । বাইরে কড়া পুলিশি নিরাপত্তা । বাইরের অঝোর বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করেই গাড়ি এগোল শ্মশানের পথে ।
***************
(কিছুদিন পর)
শ্রাদ্ধ শান্তি মিতে গেছে বেশ ক’দিন হলো, নিজের ঘরে ছেলের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছিলেন মা, মৃনাল ঘরে ঢুকলো, হাতে সেই আগের মতোই পুজোর থালা, শুধু পরনে টিপের বদলে চাঁদের ছোঁয়া… মা-কে সামলে বসাল পাশে । প্রবালের ছবিটার দিকে তাকাল মৃনাল । প্রবালের চোখে চোখ রেখে একমনে তাকিয়েই ছিল… চোখে জলের সাথে আগুনও ছিল কী?
***************
পাপের ঘড়া পূরণ হলে প্রায়শ্চিত্ত তো আমাদের এই জীবনেই করতে হয়, কখনও ভগবানই যা করার করেন, কখনও কারোর মাধ্যমে করান । ঠিক ভুল-এর মধ্যে নির্বাচন করার থেকে দুটো ঠিক বা দুটো ভুলের মধ্যে নির্বাচনই আমাদের জীবনের পথ নির্ধারণ করে । মৃণালের ক্ষেত্রেও তাই । শেষ ঘটনার পর আবার নিজের বাড়ির আশ্রিত ১২ বছরের ছোট্ট মেয়েটার উপর যখন আবার প্রবাল পাশবিক অত্যাচার-এর চেষ্টা করেছিল, তখন আর নিজের চোখে দেখে নিজেকে আটকাতে পারেনি মৃনাল, বলা ভাল আটকাতে চায়নি । নিজে হাতে…। জানল না আর কেউ, ছোট্ট মেয়েটা, মৃণালিনী, প্রবাল নিজে আর বিশ্বস্ত সদানন্দ ছাড়া । আর … নিশ্চিন্ত হলেন অন্তর্যামী ।