অভিশপ্ত

।। ১।।  

“আর মোটামুটি কতক্ষণ লাগবে?” ঘড়িটার দিকে একবার দেখে প্রশ্ন করল শ্রী। ও চলছে আগে আগে, পুপু আর টিকলি চলছে একটু তফাতে, প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ছোট ট্রলি। রোদটা এখন একদমই পড়ে গেছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যে নামলো বলে। লোকটা বলেছিল সন্ধ্যের আগেই হোটেল পৌঁছে দেবে, কিন্তু এখন ও তো তেমন কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। আশিষ বড়াল, মানে যার সাথে যোগাযোগ করে এই শিমুলতলায় এই ট্রিপটার জন্য ওদের আসা, তার সাথে শ্রীর পরিচয় ওর এক কলিগের মারফত। রিয়া তো বলেছিল খুব ভালো মানুষ, সৎ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই শ্রীর মনে কু গাইতে শুরু করেছে। এতটা ভরসা করা কি ঠিক হলো?

ভাবতে ভাবতে রাস্তাটা বাঁক নিলো আবার, এক সেকেন্ডের জন্য হলেও পুপু আর টিকলি শ্রীর চোখের আড়াল হতেই বুকটা ধক করে উঠল ওর, কিন্তু পরক্ষণেই চোখের সামনে এসে উপস্থিত হলো প্রাসাদোপম এক বাড়ি। মুহূর্তের মধ্যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলো শ্রী, বিকেল শেষে সন্ধ্যেটাও যে ততক্ষনে ঝুপ করে নেমে পড়েছে খেয়াল করেনি ও। আলোয় ঝলমল করছে ততক্ষণে গোটা বাড়ি, বিশালাকার গেট পেরিয়ে বাগান পেরিয়ে পৌঁছাতে হবে বাড়ির দরজায়। হাঁ করে ও যে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল কে জানে।  পিছন থেকে পুপু টিকলির ধাক্কায় টনক নড়ল ওর।

“কিরে কখন এলি তোরা? একটু দূরেই তো ছিলি, এত দেরি করলি কেন?”

“দেরি আবার কোথায় করলাম, আমরা তো অনেকক্ষণ থেকেই এসে গেছি, তুই-ই খেয়াল করিসনি।”

“ওহ। তাই হবে হয়তো।”

“কি সুন্দর রে বাড়িটা! আর কি ওয়েল মেন্টেনড! আই মাস্ট সে।”

“হুম। সত্যিই তাই, এত দেরিতে বুক করেও যে এত ভালো একটা জায়গা পাবো, সত্যিই আশা করিনি।”

“তোর বন্ধুটাকেটাকে আমাদের তরফ থেকে ও মেনি মেনি থ্যাংকস। যাক গে, আর দাঁড়িয়ে না থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে চল তো দেখি। ওই দ্যাখ আর একটা ফ্যামিলি ও চেক ইন করছে।”      

টিকলির কথায় প্রাসাদের সদর দরজার দিকে দেখল শ্রী। একটা ফ্যামিলি ওদের আগেই চাবি নিয়ে চলে গেল ভিতরে। ও তো ভেবেছিলো ফাঁকা ফাঁকাই থাকবে, ইনফ্যাক্ট এত সুন্দর ও আশাই  করেনি। মানুষের ভাবনার বাইরে যখন ভালো কিছু হয়ে যায়, মনটা বড্ড ভালো হয়ে যায়। সেই একরাশ ভালোলাগা নিয়েই রিসেপশনের দিকে এগোলো ওরা। এবার আর একটু অবাক হওয়ার পালা। রিসেপশনে লোকজন থাকলেও তাদের ব্যবহার বা কাজকর্ম তথাকথিত প্রফেশনালদের মতো একদমই নয়, বরং বেশ খানিকটা অন্যরকম। এখানকার স্থানীয় লোকজনই মনে হলো, পোশাক আশাক বা ভাষা শুনে। ওদের সাথে ভেঙে ভেঙে বাংলাও বললো বটে। এই যুগে দাঁড়িয়ে ও একটা মান্ধাতার আমলের কম্পিউটার আর জাবদা খাতাতেই কাজ চলছে এখনো। লোকটার পরনে সাধারণ জামা প্যান্ট, পেশাদার না হওয়ায় বেশ খানিকটা সময় লাগলো ওদের, টিকলির নাক সিঁটকোনোটা শ্রীর চোখ এড়ালো না। তবে ওর খুব একটা খারাপ লাগছে না, এরা কর্পোরেটদের মতো চূড়ান্ত পেশাদার না হলেও  এদের আন্তরিকতাটা বড় ভালো লাগলো ওর, সাথে এটাও পরিষ্কার হলো এই জায়গাটা এত দেরি তে বুক করে ও পেয়ে যাওয়ার কারণ, বহু মানুষেরই এই জায়গা ভালো না লাগার কারণ। সই সাবুদ মিটিয়ে চাবি নিয়ে ওরা যখন ঢুকলো তখন ওদের বিল্ডিং এ ওরা ছাড়া আরো ২টো ফ্যামিলি রয়েছে মাত্র। যখন ঘরে ঢুকলো তখন ৬.৩০ টা বেজে গেছে।

**********

শ্রী, টিকলি আর পুপু ছোটবেলা থেকে অভিন্নহৃদয় বন্ধু। ছোট্ট থেকেই একসাথে স্কুল, পড়াশুনো, একই পাড়ায় বাস, তিন বন্ধুর সাথে সাথে তিন পরিবার ও আজ ভীষণ ভালো বন্ধু একে অপরের, সেই সুবাদে এই সমস্ত ট্রিপ এর অনুমতি ও মেলে সহজেই। কলেজ পড়াকালীন তখন অনুমতি মিলতে একটু বেগ পেতে হতো বৈকি। কিন্তু এখন চাকরিতে ঢোকার পর থেকে বছরে অন্তত দুটো ট্রিপ ওরা করেই।

**********

টিকলি ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই দরজায় টোকা পড়লো আবার। শ্রী আর পুপু তখন জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের বিশাল বাগান টাই দেখছিলো।

“এখন আবার কে ?”

“ওই রিসেপশন থেকেই এলো মনে হয়। দাঁড়া দেখছি।”

“আর ওটাকে রিসেপশন বলিস না, লোকটাকে দেখেছিলি কিরকম অদ্ভুত ভাবে তাকায়, যেন শহরের লোক প্রথম দেখছে।”

“এবার একটু বেশিই ভাবছিস। দাঁড়া আগে খুলতে দে দরজাটা।”

দরজাটা খুলতেই একজন স্থানীয় মেয়েকে নিয়ে আশিষবাবু হাজির, মুখে একগাল হাসি।

“এই যে এই হলো বিন্দি, আপনাদের খাবার অর্ডার সব একেই বলে দেবেন, ও বাংলা ও বোঝে, অসুবিধে হবে না, আর ওর রান্নার হাত যা না ! খেলে মুখে লেগে থাকবে। অসাধারণ মাংস রাঁধে ও। বিন্দি, ম্যাডামদের থেকে খাবার অর্ডারগুলো নিয়ে নিস।

“ঠিক আছে আমরা আধ ঘন্টার মধ্যে বলে দিচ্ছি।”

“হ্যাঁ কোনো অসুবিধে নেই, কোনো কিছু বানিয়ে দিতে হলেও ওকেই ডেকে বলে দেবেন তাহলেই হবে। আচ্ছা বিন্দি তুই এখন যা। এখন স্পেশাল পাকোড়া ভাজা হচ্ছে নীচে, সঙ্গে চা মুড়ি, আসুন তাহলে। তখন বলে দেবেন।”

বিন্দি মাথা নেড়ে চলে যেতেই আশিষবাবু ফিরে তাকালেন আবার শ্রী এর দিকে, তবে এবার মুখে সেই হাসিটা নেই, বরং একটু সিরিয়াস।

“কি ব্যাপার আশিষবাবু? কিছু বলবেন ?এনিথিং সিরিয়াস ?”

“হম যেটা বলতে আসল আসা, জানলা দিয়ে দক্ষিণ দিকটা দেখতে পেয়েছেন আশা করি…”

“হ্যাঁ দেখলাম তো একটু অগোছালো ওই দিক টা, এই দিক গুলোর তুলনায়।”

“হ্যাঁ সবদিকেই যান, ঘুরে দেখুন, সাজানো বাগান খুব ভালো লাগবে, সন্ধ্যেবেলা আলোগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ভীষণ সুন্দর লাগে…”

“হ্যাঁ কিন্তু ওদিকটা তো আলো আঁধারি… ওদিকটায় কি কোনো…”

“ওদিকটায় যাবেন না, মেনটেন হয় না আসলে, কখন কী হয়, না যাওয়াই ভালো, তাই আগেই বলে দিতে এলাম আপনারা বেরোনোর আগেই।”

“মানে ?”

“ওদিকটায় একটু প্রব্লেম আছে, তাই ওদিকটা একটু এভয়েড করতে পারলেই ভালো হয়। যাই হোক আপনারা ফ্রেশ হন, নীচে আসুন, চা পাকোড়া গরম গরম খাবেন। আসছি।”

শ্রীকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো আশিষ বড়াল, অবচেতনে ওর মনে যে একটা ভয় ঢুকে গেল সেটা বুঝতেও পারলো না শ্রী। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে দরজাটা লাগিয়ে ভিতরে ঢুকে এলো ও। ওদের ঘরটার সামনেই খোলা বাগানটা বেশ অনেকদূর অবধি দেখা যায়। পাশে আর একটা বিল্ডিং আছে তবে ওটা পুরোনো, এটা তুলনামূলক ভাবে একটু নতুন। দক্ষিণ দিকে যতদূর চোখ যায়  কিছু ঝোপ ঝাড়, ছোট একটা ঘর মতন ও আছে যেন, অনেকটা সাজানোর মাঝেই যেন হঠাৎ করেই খাপছাড়া, অগোছালো খানিকটা। একটু অন্যমনস্ক হয়েই তাকিয়েছিল শ্রী, কি এমন আছে ওখানে?এভাবে বলে যাওয়ার কি মানে? হঠাৎ করেই চোখে পড়লো জিনিসটা। কিছু যেন একটা নড়ছে, আলো আঁধারিতে বুঝতে পারছিলো না খুব একটা, কিন্তু এতটা ভুল ও করবে না। জানলাটা পুরো খুলে দিয়ে আরেকবার তাকালো ও ভালো ভাবে, তখনই একটা বিকট আওয়াজে ধক করে উঠলো বুকটা।   

**********

কি রে কি হলো? এত ভয় পেয়ে গেলি কেন ?আমার হাত থেকে পড়ে গেলো গ্লাসটা হঠাৎ করে, তাই বলে এত ভয় পাবি ?”

শ্রী এর মুখ চোখ রীতিমতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য, নিজেকে  তাড়াতাড়ি সামলে নিলো ও, আরেকবার ফিরে তাকালো ও, না আর কাউকে দেখতে পেলো না। এই জন্যই কি ওদিকে যেতে বারণ করে গেলেন আশিষবাবু? এই জন্যই কি এত দেরিতে বুক করে এত ভালো ঘর পেয়েছিলো ওরা? বড় একটা কেউ আসেনা কি এখানে? ফাঁকা ফাঁকাই তো। টিকলি পুপু এদের কি বলবে ও এখনই কিছু? ওরা যদি আবার বেশি কিছু… না থাক, ওর ও তো চোখের ভুল হতেই পারে, কি দেখতে কি দেখেছে। আর বেশি না ভেবে নীচে নামলো ওরা। ততক্ষনে পাকোড়ার গন্ধে ম ম করছে একতলা।    

**********

জম্পেশ আড্ডা, খাওয়াদাওয়া আর এত সুন্দর মনোরম পরিবেশে ক্ষনিকের ভয় বহু আগেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো শ্রীর মন থেকে। আরো দুই পরিবার ও কলকাতার, দুই পরিবারের খুদে সদস্য সংখ্যা ৩ জন, আর এই ৩ জনের সাথেই বেশ ভাব জমে গেছে ওদের। আর পাকোড়া থেকে রাত্রের চিকেন কষা, বিন্দি বলে মেয়েটির হাতের  রান্না সত্যিই প্রশংসনীয়। ওদের রাত্রের খাওয়া দাওয়া মিটলো যখন তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১১ টা।

ওদের সাথেই চেক ইন করেছে আজকেই যে ফ্যামিলি তাদের বাড়ি সাউথ কলকাতা, আর একটা ফ্যামিলি এসেছে গতকাল রাত্রে। আজকের ফ্যামিলির সাথে রয়েছে দুই মেয়ে, যমজ, দেখে তফাৎ বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। ক্লাস ওয়ান হয়েছে সব এ। ভারী মিষ্টি দুজনেই, আর আরেকটি পরিবারের সাথে রয়েছে একটা দুস্টু মিষ্টি ছেলে, সে অবশ্য আরো ছোট, আগের মাসে সবে ৪ এ পড়েছেন। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝাই যায় না, সকালে ঠিক হলো সবাই মিলে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখা হবে, বাড়িটা খুব ছড়ানো, বাড়ি দেখতেই অনেক সময় লেগে যাবে।  তারপর বেরোনো হবে,  লাট্টু পাহাড়, ছাতিম পাহাড়, রাজবাড়ী এগুলো সব ঘুরে দেখা হবে ক্ষণ। উঠে পড়লো ওরা, আজ এমনিতেই টায়ার্ড, বিছানায় পড়লেই ঘুম নামবে দুচোখে, ঘরের চাবিটা নিয়ে এগোলো শ্রী, শরীরটা আর টানছে না, বাড়িতে শোবার আগে একটা ফোন করে ও বরাবর। বাবার নাম্বারটা ডায়াল করলো ও।  

কথা বলতে বলতে কখন যে বাগান পেরিয়ে এতটা এগিয়ে এসেছে খেয়াল ও করেনি ও, এদিকটায় আঁধার জাঁকিয়ে বসেছে ভীষণ রকম, সঙ্গে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকি পোকা ইতিউতি আলো ছড়াচ্ছে নিজের মতন, বেশ লাগছে কিন্তু।

“হুম খাবার তো খুবই ভালো ছিল, স্পেশালি চিকেনটা, উইথ রুমালি রুটি এন্ড স্যালাড, উফফ আর কি চাই। কাল বিন্দিকে বলেছি মটন করতে…”

“—“

“হ্যাঁ রে বাবা নিজের খেয়াল রাখবো, তুমি আর মা সাবধানে থেকো, আমি কি নতুন ঘুরতে এসেছি? কোনো চিন্তা নেই, ঘুমাও, আমি ও এবার ঘুমাতে যাবো।”

“—“

“না না সাপখোপের কোনো ভয় নেই, এখনো অবধি কিছু তো শুনিনি। আর…”

মুখের কথা শেষ হলো না আর, সামনের এরকম কিছু ওর জন্য অপেক্ষা করছে ভাবতেও পারেনি ও। নিজেকে যে কিভাবে সামলে ওখান থেকে দৌড়ে নিজের ঘর অবধি পৌছালো ও, নিজেও জানে না। টিকলি পুপু তখন করিডোরে ওর অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে, কারণ চাবি ওর কাছে। ওদেরকে চোখের সামনে দেখে একটু যেন আশ্বস্ত হলো ওর মনটা।

“কিরে কখন তো চাবি নিয়ে বেরোলি, কোথায় ছিলি তুই এতক্ষণ ধরে ?কখন থেকে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছি বলতো, ফোন টাও তো লাগছিলো না তোর। নে নে, ঝটপট খোল লকটা।”

ওদের কথার প্রত্যুত্তর করার মতো আর শক্তি ছিল না শ্রী এর মধ্যে, আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো ও। শুয়ে শুয়ে এটাই ভাবতে লাগলো বারবার, ও যা কিছু দেখলো তার মানে কি?

**********

রাত্রে মশার কামড় থেকে রক্ষার জন্য কখন যে পুপুরা আবার মশারি টাঙিয়েছে খেয়াল ও নেই, বিছানায় পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়েছিল শ্রী। এখন ঘুম ভেঙে চোখ খুলে বুঝতে বেশ খানিক টা সময় লাগলো ওর, কোথায় আছে, স্থান কাল পাত্র ইত্যাদি। চোখ দুটো বুজতেই হঠাৎ ভেসে উঠলো রাত্রের সেই দৃশ্যটা, সেই অস্বাভাবিক দৃষ্টির চোখ দুটো, ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো শ্রী। পাশে ওর বন্ধু দুটো সুন্দর ঘুমোচ্ছে, আর ওকেই খালি খালি কি যেন একটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কই বাকি আর কেউ তো কিছু দেখেনি, তাহলে শ্রী এরই শুধুমাত্র… ও কি অতিরিক্ত চিন্তা আর ক্লান্তির জন্যই এসব দেখছে? না না,শেষবারের ঘটনাটা কে কি ভাবে চোখের ভুল বলবে ও? ঐরকম কুঁজো হয়ে যাওয়া শীর্ণকায় একটা চেহারা, অর্ধেক কাপড়ে ঢাকা মুখটা, আর অদ্ভুত রকম উজ্জ্বল ওই চোখ দুটো, অন্ধকারে ওই চোখ দুটো রীতিমতো ওকে তাড়া করছিলো যেন। উফফফ !

**********

আধো ঘুমেই ছিল শ্রী, এলোমেলো চিন্তা করতে করতে আবার কখন চোখ লেগে গেছে, বুঝতেও পারেনি। ঘুমের ঘোরেই একটা কেমন অস্থির ভাব অনুভব করলো ও, নিজের মধ্যে নয়, আসে পাশে। কয়েকমুহূর্ত নাকি কয়েক মিনিট জানা নেই, বোঝা না বোঝার মাঝে যখন চোখ খুললো তখন পাশে টিকলি নেই, উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসে হাফাচ্ছে, ঘরে ততক্ষণে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে পুপু।

।। ২।।  

  রাতের আঁধার কেটে সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ, ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সকাল ৮ টা প্রায়, দিনের বেলায় এই প্রাসাদোপম বাগান বাড়ি রাত্রের থেকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর। সবুজে ঢাকা চারপাশ, তার মাঝেই এই প্রাসাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। বাগান জুড়ে অজস্র ফুল, তার সাথে অসংখ্য নাম না জানা পাখি, স্নিগ্ধ নরম সূর্যের আলোয় ইতিউতি খেলে বেড়াচ্ছে রঙিন প্রজাপতি। বাগানে কাজ করতে ব্যস্ত মালি,ওদিকে পাকশালে ততক্ষণে রান্না চেপে গেছে, কথা ছিল ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরোনো হবে, ফিরে এসে লাঞ্চ। টেবিলে আসতে একটু দেরিই হলো টিকলিদের। ততক্ষণে পুঁচকে পুঁচকি সমেত বাকি দুই ফ্যামিলি এসে পড়েছে অলরেডি। রাত্রের ঘটনার পর সকালবেলা উঠতে দেরি হয়ে গেছে ওদের। চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে অদিতি বললো, “শরীর ঠিক আছে তো ?রাত্রে ঘুম হয়েছিল? আমরা তো দারুন ঘুমিয়েছি কাল। পড়েছি আর ঘুমিয়েছি। যা ধকল গেছিলো।”

অদিতি বলে মেয়েটি খুব মিশুকে, বেশ কথা বলে, জমিয়ে রাখা যাকে বলে, ওরই দুই যমজ সন্তান, কাল এসে থেকে এত গল্প আড্ডা, যেন কত দিনকার পরিচিত। অদিতিকে থামিয়ে ওর স্বামী রণেন বললো, “রাত্রের ওই খাবার পর আর কার সাধ্যি বলতো খারাপ ঘুমোনোর ?যেমনি রান্নার হাত তেমনি দারুন কোয়ালিটি, চালটার কি মারাত্মক সুগন্ধ। দারুন দারুন !”

একটু অন্যমনস্ক ছিল টিকলি, ওদের এত কথার দুটো একটা জবাব দিছিলো শুধু, একবার ঘরের বাইরে দরজার কাছে চোখ গেলো, শ্রীকে দেখলো কথা বলতে ওই আশিষ বাবুর সঙ্গে। কিছু বললে ওই লোকটাই বলতে পারবে। তেমন হলে ওরা আজকেই তৎকাল কেটে নেবে। এর মধ্যেই টেবিলে চলে এলো গরম গরম পুরি সবজি জিলিপি।  

**********

অনেকদিন পর এতটা আনন্দ করলো একসাথে টিকলি পুপু আর শ্রী। সারাবছর কাজের ব্যস্ততার শেষে নিজের জন্য,শুধুমাত্র নিজের জন্য সময় বের করে প্রাণ ভরে এই অনাবিল আনন্দটুকু খুঁজে  নেওয়া, এই ধূসর জীবন থেকে ক্ষনিকের অব্যাহতি। আর কি চাই ! আর সঙ্গে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুগুলো যেন হঠাৎ করে ফিরিয়ে দিয়ে যায় ছেলেবেলাটাকে, ওরা তো এত ঘোর প্যাঁচ বোঝে না। এত হিসেবে নিকেশ ওদের করতে হয় না, ওরা বাঁচতে জানে, প্রাণ খুলে হাসতে জানে, আর ওদের সাথে সারাদিনের এই কটা ঘন্টা কাটিয়ে আজ যেন অনেকটা অক্সিজেন পেয়ে গেলো ওরা,হঠাৎ করেই না খুঁজতেই পেয়ে গেলো বাঁচার রসদ। নাহ, আর ফিরতে একটু ও ইচ্ছে করছে না, বরং এই প্রকৃতির বুকে রয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আরো কিছুক্ষণ।

**********

গাড়িটা যখন সামনের রাস্তার বুক চিরে, পাশে পাহাড়কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত গতিতে হোটেলের পথে, তখন আঁধার নামতে শুরু করে দিয়েছে। আকাশে চাঁদ এর সাথে উঁকি দিতে শুরু করেছে গুটিকয়েক তারা ও। অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল শ্রী। বারবার সকালের শোনা আশিষ বাবুর কথা গুলো মনে পড়ছিলো ওর।

।। ৩।।  

কাল রাত্রে যখন টিকলি ঘুম থেকে ওঠে, রাত তখন ২ টা প্রায়। ওদের ঘরের সাথে অ্যাটাচড  বাথরুমটার বেসিনে সমস্যা হচ্ছিল, ট্যাপ থেকে জল না পড়ায় ও নীচে একতলায় নামে তখনই। একতলায় তো লাইট জ্বলবেই, এই ভেবে হাতে আর কোনো লাইট নিয়ে যায়নি ও, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে লন আর হল এর লাইট বন্ধই ছিল। অন্ধকার দেখে ও আর এগোতে সাহস করেনি, এমনিতেই ও ভীতু, পিছিয়ে গিয়ে উপরে উঠেই আসছিল তখন অনুভব করে ওর আশেপাশে কেউ আছে, তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর শব্দ কিংবা তার উপস্থিতি রীতিমতো অনুভব করছিলো ও, কিন্তু  পিছন ফিরে অন্ধকারে কাউকে চোখে পড়েনা, বুদ্ধি করে যে কাউ কে ডাকবে সেটা আর তখন মাথায় আসেনি। ওর একদম পিছনেই যেন কেউ রয়েছে, এটা ও বেশ বুঝতে পারছিল, দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখটায়। সাহস করে পিছনে ফিরতেই ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। মেঘ কেটে চাঁদের আলো পড়েছিল বাগান পেরিয়ে সামনের বারান্দাতেও, সিঁড়ির কাছটায়, সেই আলোতেই স্পষ্ট দেখে ও। একজন মহিলা, হ্যাঁ একজন বয়স্ক মহিলা, কিন্তু দেখে এটুকু বুঝেছিল এ কোনো সাধারণ মহিলা নয়। বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে শরীরটা, মাথা থেকে কালো কাপড় গেছে সরে, কোটরাগত দুটো চোখ, কিন্তু কিরকম যেন আগুন জ্বলছে দুই চোখে, শীর্ণকায় দুটো হাত দিয়ে কোনোক্রমে ধরে রেখেছে হাতের লাঠিটা, খোলা হাওয়ায় উড়ছে সাদা চুল, সারা শরীরে কোথাও যেন এতটুকু মেদের আধিক্য নেই কোথাও। আর সবথেকে ভয়ঙ্কর গলার স্বর, কিছু একটা যেন বলছে ওকে। একটু একটু করে ওই জ্বলন্ত চোখ দুটো নিয়ে এগিয়ে আসছিল টিকলির দিকে, ও সরতে যেতেই খপ করে ধরে নিলো ওর হাতটা, সাঁড়াশির মতন চেপে বসেছিল ওই বৃদ্ধার হাত ওর কব্জির উপর। আর কি ভীষণ রকম ঠান্ডা সেই হাত, কি বীভৎস গলার স্বর! আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি টিকলি, নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে পড়ি কি মরি করে দৌড় লাগায় ও উপরের দিকে। টিকলির মুখে সবটা শুনে আর স্থির থাকতে পারেনি শ্রী। কিন্তু তারপর যা কিছু শুনলো তারপর…        

**********

(পরেরদিন সকালে )

আজ সকাল সকাল খেয়ে বেরিয়ে পড়ার কথা ওদের, দুপুরের খাওয়া দাওয়াও বাইরেই হবে। বিন্দির হাতের গুণে সুগন্ধে ভরপুর এখন গোটা একতলা। কাল আরো একটা গ্রুপ চেক ইন করেছে। আজ সকালে তাদের সাথে আলাপ হলো। শ্রী হাঁটতে হাঁটতে আবার দক্ষিণ দিকটায় চলে এসেছে আজ। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে আজ ওর মনে ভয়ের থেকে বেশি জিজ্ঞাসা। অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। উত্তর না পাও এপর্যন্ত যেন শান্তি নেই। কে ওই মহিলা? কি তার পরিচয়? এখানে এভাবে কেন? আশিষ বাবু যা কিছু বললেন তা বিশ্বাস করে না শ্রী, ও এসব মানে না, কিন্তু তাহলে আসল সত্যিটাই বা কি? এগোতে এগোতে একটা ছাউনি দেওয়া ঘরের সামনে এসে চোখ আটকালো ওর। দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ থাকে এর ভিতরে। এই জায়গা রীতিমতো রোজ ব্যবহার হয় এটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। প্রাসাদ আর বাগান পেরিয়ে বেশ খানিকটা ভিতরে ঘরটা, হতে পারে কোনো স্টাফ এর ঘর। নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারলো না শ্রী। এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে, দরজা খোলাই ছিল। সাহস করে আরেকটু এগোলো ও। অত্যন্ত সাধারণের মধ্যেও পরিষ্কার আর ছিমছাম গোছানো এক চিলতে ঘর, বাইরে একটা উনুন, জ্বালানো হয়নি এখনো। বাইরে ঝুলছে একটা জীর্ণ কালো শাড়ি, এইদিকটাতেও ভারী সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে রয়েছে, তবে সেটা টব এ। ঘরের মধ্যে কেউ নেই কেন? সে কি বাইরে গেছে?এভাবে কারো ঘরে ঢুকে পড়লো ও, ছি ছি ছি ! এবার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে। এই ভাবে সাত সকালে কাউকে কিছু না বলে এতদূর একা একা চলে এসে অজানা অচেনা কারো  ঘরে…

নাহ এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, ওর ফিরে যাওয়া উচিত এবার, ঘর থেকে বেরোতে যেতেই চোখ পড়লো ছবিটায়, মুচড়ে উঠলো ওর বুকের ভিতরটা, তখনই বেজে উঠলো ওর ফোনটা।  

**********

“আমি তো একটা জিনিস বুঝতে পারছি না ওরা তো দুজন একসাথেই বেরোলো ঘর থেকে, তারপর তো লক করে বেরোলে তিন্নিকে নিয়ে, এর মধ্যে ওরা কোথায় চলে গেলো? এইটুকু টাইম এর মধ্যে ভ্যানিশ তো হয়ে যেতে পারেনা দুটো বাচ্চা। আশ্চর্য !”

“আমি কিছু বুঝতে পারছি না, জিকো আমাদের ঘরে এলো, তিন্নিটা চুপ করেই বসে ছিল, চিনি টাই ঘরের মধ্যে লাফালাফি করছিল, আমি তাই বললাম যা নীচে নাম এবার, আমি বোনুকে নিয়ে নামছি, দিয়ে তিন্নিকে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় নামলাম, তারপর থেকে আর দুজনকেই দেখতে পাচ্ছি না। কি অদ্ভুত ব্যাপার।”

অদিতির কথা শেষ হতে না হতেই দেবল মানে জিকোর বাবা দৌড়াতে দৌড়াতে এলো,” নাহ কোথাও দেখতে পাচ্ছি না, আমি পুরো প্রপার্টি টাই ঘুরে দেখে এলাম, ম্যানেজারকেও বললাম, কোথাও তো নেই, কিন্তু গেট তো বন্ধ, ওরা তো বেরোতেও পারবে না। তার মানে এই বাগান বা দুটো মহলের মধ্যেই ওরা কোথাও আছে। ম্যানেজার সিসিটিভি ফুটেজ বের করছে এক্ষুনি।”

একটা রীতিমতো অশান্ত পরিবেশ এখানে এখন সেটা এসেই বুঝলো শ্রী। পুপুর ফোন পেয়েই সোজা এখানে এলো ও। চিনি মানে দুই যমজ বাচ্চার ছোট মেয়েটা আর জিকো মানে আরেকটি ফ্যামিলি এর ছোট্ট ছেলেটা দুজনকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, চিনির মা মানে অদিতি এখনই কাঁদো কাঁদো । জিকোর মা পল্লবী তাও এখনো শক্ত আছে, ভেঙে পড়েনি। একটু পরেই খেয়ে দেয়ে বেরোনোর কথা এখন এইসব…ওরা একসাথে নেমে কোথায় গেল ?আর যাওয়ার জায়গায় বা কোথায়?এখানেই কোথাও আছে, কিংবা কোথাও ফেঁসে গেছে বেরোতে পারছে না, পথ হারিয়ে ফেলেছে, এত ছোট বুঝতে পারছে না, এ ছাড়া আর কি হবে? কিই  বা হতে পারে? ওর ভাবনা কে থামিয়ে পুপু বললো,”কোথায় গেছিলি তুই এই সাত সকালে ?”

“পরে বলছি সব।” শ্রী কথা শেষ করতে না করতেই ভিতরে ম্যানেজার এর ঘর থেকে একটা চিৎকারের মতো আওয়াজ এলো, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়ে বেরিয়ে এলো রণেন। পিছনে দেবল আর আশিষ বাবুও রয়েছেন। দৌড়ালো ওরা দক্ষিণ দিকেই।  

“তুই একটা জিনিস খেয়াল করেছিস ?কাল যে চারটে ছেলের গ্রুপ চেক ইন করেছে, তাদের কিন্তু এখন কোথাও দেখা যাচ্ছে না।”

“মানে?” পুপুর কোথায় ফিরে তাকাল শ্রী। সত্যিই তো, তাদের ও তো থাকার কথা, খাবার জায়গা তো একটাই, আর ওরা নীচে যে নেমেছিল সেটা ওরা দেখেছে।

“হয়তো ওরা ইতিমধ্যেই বেরিয়ে গেছে, তাই দেখতে পাচ্ছি না, সেটাও তো হতে পারে।”

“না সকাল থেকে এখনো অবধি কেউ বেরোয়নি, আমি এটা দেখেই বলছি। ছেলে গুলো আবার কিছু…”

“ধুর কি যে বলছিস। দাঁড়া দাঁড়া ঠিক পেয়ে যাবো ওদের, কোথায় আর যাবে।”

কথা না বাড়িয়ে ওরা দক্ষিণ দিকটাতেই এগোল। অদিতি ভীষণ কান্নাকাটি করতে শুরু করেছে, ভয় যে শ্রী এর ও লাগছে না তা নয়, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করছে না ও। একটু আগে ও তো এদিকটাতেই…  

ওর ভাবনার মাঝেই উল্টোদিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে এলেন আশিষ বাবু।

“কি হয়েছে কোনো খবর পেলেন বাচ্চাদুটোর ?”

“মনে হচ্ছে একবার পুলিশ এ খবর দিতে হবে, তবে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না।”

“মানে ?”

“মানে রণেনবাবু বা দেবল বাবু চান পুলিশ এ খবর দিতে, কিন্তু পুলিশ এসে কি করবে আর ?”

“আরে যা বলার পরিষ্কার করে বলুন না। কি হয়েছে? পুলিশ এর কি প্রয়োজন? আর আপনারা সিসিটিভি ফুটেজেই বা কি দেখলেন?”

“যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হয়েছে। অনেকদিন এরকম কিছু ঘটেনি আর, আমরাও তাই এতটা তলিয়ে ভেবে দেখিনি। আপনাদের তো সাবধান করেছিলাম, তাও একা কি ভাবে ছাড়লেন ? ওই অশুভ শক্তির হাত থেকে পুলিশ কিভাবে রক্ষা করবে বলুন তো বাচ্চা দুটোকে?”

“হোয়াট রাবিশ ! কি যাতা বলছেন? এর আগেরদিন ও আপনি এসব ভুলভাল…”

পল্লবীর কথা কেটে আশিষ বাবু আবার বললেন,”সেদিন আমার কথা শুনে সাবধানী হলে আজ এই দিনটা আসতো না ম্যাডাম। ইনি কোনো সাধারণ মহিলা নন, এর মধ্যে অশুভ শক্তি আছে, এর দৃষ্টি, এর ছায়ার থেকেও আমরা দূরে থাকি। আপনাদের ও একই কারণে সাবধান করে দিয়েছিলাম এই খানটায় আসবেন না। এর আগে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে, বহুবছর এই হোটেল, ব্যবসা বন্ধ রাখতে হয়েছিল, আবার বছর তিনেক হলো সব সুন্দর করে চলতে শুরু করেছিল, আবার সেই এক অঘটন।”

“অঘটন মানে ?কি বলতে চাইছেন আপনি ?”

“দেখুন, এই জায়গায় সচরাচর কেউ আসে না, শেষ বার ও এখানেই একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল, একটা জলজ্যান্ত ছেলে মারা গেছিলো অস্বাভাবিক ভাবে, কত বয়স হবে ?৩০ ও নয়, কোথাও কিছু ছিল না, হঠাৎ করেই হার্ট এট্যাক । তার আগে একটা বাচ্চা, সামনের পুকুরটায় জলে ডুবে।তার একটা মাঝবয়সী মেয়ে। এই জায়গা অভিশপ্ত, এখানে একটা অশুভ শক্তির প্রভাব কাজ করে, আর তার কেন্দ্রবিন্দু ওই জায়গা।” বলে ইশারা করলো সেই ছাউনি দেওয়া ঘরটার দিকে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো শ্রীর। এখানেই তো এসেছিল কিছুক্ষন আগেই, ভাগ্যিস পুপুর ফোনটা এলো, নয়তো আজ ও ও…

“কেউ নামটুকুও মুখে আনেনা ভয়ে, আমি তাই নাম বলতে পারবো না। কিন্তু এটুকু জানি,  এর খুব কম বয়সে বিয়েও হয়েছিল, কিন্তু একটা অশুভ শক্তির সাথে ঘর করে কার সাধ্যি? স্বামী সন্তান কিচ্ছু নেই। তারপর থেকে ঘরে রাখাও দুঃসহ হয়ে উঠেছিল, ওর নিজের মা বাবা ভাই ওকে আলাদা রাখতে শুরু করল, ভাবুন। এর ছায়া মাড়ালে অঘটন আপনার জীবনে নিশ্চিত, এমনকি প্রাণ সংশয় ও হতে পারে, তেমনি ভয়ঙ্কর গলার স্বর!বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাবে আপনার ! এই প্রপার্টিতে অংশীদারি আছে তাই সরানো যায়নি, নয়তো কবে… যদিও সরাবেই বা কে? কার এত সাহস?” খানিক থেমে একটু ইতস্তত করে আবার বললো,”এর মধ্যে সাক্ষাৎ ডাইনির বাস, অশুভ শক্তি, রক্ত ছাড়া শান্ত হয় না।  এবার বুঝতে পেরেছেন? আর কি বলে বোঝাবো আপনাকে? যে নিজের স্বামী সন্তান কেও ছাড়ে নি, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের বেরোতে হবে। নয়তো আরো কি কি অঘটন ঘটবে কে জানে।”

শ্রীর বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছিল, মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো ওরা, পুপু তাহলে সেদিন যা কিছু বলেছিলো, আজ যদি বাচ্চাদুটোর…

ওর ভাবনার মাঝেই একটা কোলাহল এলো বাড়ি থেকে, আর একমুহূর্ত দেরি না করে ওই দিকে ছুটলো ওরা, আর কিছু ভাবার মতো সময় বা অবস্থা নেই। বাচ্চাদুটোর যেন কিছু না হয়, এটাই প্রার্থনা করছিলো বারবার। একটা সরু পাকানো পাকানো সিঁড়ি চোখে পড়লো, ঘর তো ফাঁকাই এখনো, তাহলে কি এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে গিয়েই… সামনে তো একটা পুকুর ও আছে সত্যিই, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো শ্রী। কিছু আর ভাবতে পারছিল না ও, ওর পিছনে কেউ আদৌ এলো কি না সেটা দেখার ও প্রয়োজন বোধ করেনি আর ও, কি ভর করেছিল ওর মধ্যে কে জানে। যতটা দ্রুত দৌড়ানো যায় দৌড়ে ছাদে উঠলো ও,  আর উঠেই..  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না ও ! পিছনেই ছিল বাকিরা সকলে, সকলেই উঠে এই দৃশ্য দেখবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ! চারপাশটা স্তব্ধ হয়ে গেছিল শ্রীর। আর কিছু ভাবতে চায় না ও, দেখতে চায় না ও,  চোখ ফেটে জল আসছিলো ওর, ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল চোখ দুটো, কিছুতেই সামলাতে পারছে না আর ও, কান্নায় ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্তে এগিয়ে গেলো ও সামনের দিকে, যেখানে পরম মমতায় দুটো ছোট্ট শিশুকে জড়িয়ে খেলছিল আরেক শিশু, না আর কোনো কালো কাপড়ের আড়াল নেই, বরং মুখে রয়েছে এক অনাবিল হাসি, ঠিক একটা শিশুর মতোই, খেলতে খেলতে কখন মাথার কাপড় খুলে হাওয়ায় উড়ছে পাকা চুল, খেয়ালই নেই।  আর চোখদুটো কি ভয়ঙ্কর ? কই না তো,  মুখের হাসি চোখ অবধি পৌঁছাচ্ছে মানুষটার, আজ বহুযুগ পর ভীষণ খুশি মানুষটা। আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই,  চেনা পরিচিত ঠাকুমা দিদিমার মতোই,  নিজের নাতি নাতনির বয়সী বাচ্চাদের সাথে বাঁধ ভাঙা খোলা হাওয়ায় মত্ত সে। মুখে জড়িয়ে এক নির্মল হাসি। পাশে সাজানো বৃদ্ধজীবনের একমাত্র সম্বল, ওই লাঠিটা। কই বাচ্চাদুটোর মুখে চোখ তো ভয়ের লেশমাত্র নেই। তারা তো প্রাণ ভরে খেলছে, আদরে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে নতুন ঠাম্মির গাল, ভারী সুন্দর সে দৃশ্য। সে দৃশ্যে কোনো প্যাঁচ নেই, কোনো কাদা নেই, কোনো মিথ্যা নেই, আছে অনাবিল এক সারল্য। অন্য চোখে সে সারল্য হয়তো ধরা পড়বে না, কারণ তা দেখার জন্য সবার আগে দরকার একটা সুন্দর মন। এদের সঙ্গে খেলার সাথী কালকের নতুন আসা ছেলে গুলো ও, না তারাও একটু ও ভয় পায় নি, কারণ মিথ্যাচার আর কুশিক্ষার কালো ছায়া এদের এখনো ছুঁতে পারেনি যে।         

**********

মানুষটার ও একটা নাম ছিল, রুক্মিণী। কিন্তু নামটা এই অপয়া, অশুভ, ডাইনি এই সমস্ত পরিচয়ের আড়ালে বহু আগেই হারিয়ে গিয়েছিলো। তার কোনো হাত ছিল তার জীবন ঘিরে ঘটে চলা মৃত্যুগুলোয়, না হাত ছিল নিজের চেহারায় বা গলার স্বরে, নিজের স্বামী সন্তানকে হারানোটা বাকি সমাজের থেকে তার কাছে আরো অনেক অনেক বেশি যন্ত্রণার ছিল, কিন্তু কেউ বোঝেনি, সহজেই দাগিয়ে দিয়েছিল অপয়া বলে, এটাই সহজ কাজ কিনা। নিজের স্বামী সন্তানের ছবি, এই শেষ সম্বলটুকু নিয়েই যখন কাটছিল নিজের জীবনটা, তখন আর এক পালা শুরু। একসিডেন্টে ঘটা মৃত্যুর দায় ও তার উপর। আর তিল কে তাল বানিয়ে রটানোর কাজ এই সমাজের থেকে ভালো আর কে পারে? আর তারপর এই কথাগুলোই বিশ্বাস করে একটা মানুষের জীবনকে দায়িত্ব নিয়ে নরক বানিয়ে তোলা আমরা, শিক্ষিত আধুনিক সমাজ, আমাদের দায় ও কিছু কম নয়। অভিশপ্ত আসলে কে তাহলে? আজ শ্রীর নিজেকে মানুষ ভাবতেই ভীষণ লজ্জা করছে! এই লজ্জাটা যখন গোটা মানবজাতির হবে, সেইদিন হয়তো একটা অভিশাপ থেকে আমরা মুক্তি পাবো।    

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with