।।১।।
সাউথসিটির ১২তলার বিলাসবহুল এই ফ্ল্যাটে এখনও সকাল হয়নি। সূর্যের আলো ঘরে ঘরে উঁকি দিলেও এই ঘরে দিতে পারেনি, দামী পর্দা পেরিয়ে তার ঢোকার অনুমতি নেই কিনা। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সকাল এগারোটা প্রায়। ঘরে ইতিউতি ছড়িয়ে কাগজপত্র, সিগারেটের টুকরো। অগোছালো ঘরটার মাঝেই গোল খাটটা। সেখানেই এখনও নেশায় বেহুঁশ পঙ্কজ, পঙ্কজ চৌধুরী। একটা নামজাদা কোম্পানীর উচ্চপদস্থ অফিসার। যার ঘুমোনোর,খাওয়ার, বাঁচার সময়টুকু রাশি রাশি টাকার নীচে কবরচাপা পড়ে গেছে।
ফ্ল্যাটের বেলটা বারবার বাজতে ঘুমটা খানিক ভাঙল পঙ্কজের । কাজের মাসি রবিবার এই সময়েই আসে। কোনোরকমে উঠে দরজাটা খুলে আবার সোফায় গিয়ে বসল পঙ্কজ।
মাথাটা এখনও ধরে আছে, কোনোরকমে মাথাটা চেপে ধরে খানিক বসে রইল ও। ফোনে রিং হতে ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখে আননোন নম্বর। ফোনটা ধরতেই ওপর থেকে ভেসে এল, “কিরে পঙ্কা, চিনতে পারছিস?”
রীতিমত নড়েচড়ে বসল পঙ্কজ। ওকে এখন এই নাম ডাকার সাহস কারই বা আছে, আর এই নামে ডাকারও তো আর কেউ নেই। খানিক বিষম খেয়ে বলল, “কে বলছেন?”
-“এই রে, চিনতে পারছিস না দ্যাখ, যদিও তোর দোষ নেই, আরে আমি সুবীর রে।”
সুবীর নামটা কানে আসতেই একসাথে অফিসের পার্চেজ ডিপার্টমেন্ট, ব্যাঙ্কের ভদ্রলোকটি, ইনশিওরেন্স-এর এজেন্ট এসবই মাথায় ঘুরতে লাগলো ২সেকেন্ড মতো। কিন্তু তারা তো পঙ্কা বলে ডাকবে না। তবে?
-“সুবীর মানে কে বলুন তো? ঠিক চিনতে পারলাম না।”
-“আরে আমি কলেজের সুবীর রে, সুবীর চ্যাটার্জী। এবার চিনতে পারছিস?”
কথাটা শোনার পরই একসাথে অনেকটা ধূসর মুহূর্ত যেন চোখের সামনে ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে উঠল পঙ্কজের। কলেজের ক্যান্টিন, ক্লাসরুম, খেলার মাঠটা সব এক এক করে কর্পোরেট জগতের যান্ত্রিকতাকে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছিল পঙ্কজের মনে।
-“কীরে, শুনতে পাচ্ছিস?”
সুবীরের কথায় অতীতের ভাবনা থামাল পঙ্কজ। কয়েক সেকেন্ডেই ধূসর অতীতটা সবুজ হয়ে গেছে বেশ খানিকটা।
-“হ্যাঁরে, শুনতে পাচ্ছি রে। কেমন আছিস বল।”
-“মনে পড়ল তাহলে, কেমন আছিস রে ভাই?”
সুবীর আর পঙ্কজ কলেজে পড়ার সময় ভীষণ ভাল বন্ধু ছিল। তারপর কলেজ পাশ করে সুবীর ঢুকল ওর বাবার বিজনেসে, আর পঙ্কজ চাকরির চেষ্টা আর সঙ্গে টিউশনি। অস্তিত্বের লড়াইটা এতই জোরদার হয়ে গেল যে যোগাযোগটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে আর থাকেইনি।
পঙ্কজ আজ যে জায়গায়, এখানে কোনদিন থাকবে স্বপ্নেও ভাবেনি, তবে চরম দারিদ্রতার কাছে ইচ্ছাশক্তি হার মানেনি। তারপর টাকা রোজগার করতে করতে কবে ঝুলপিতে রূপোলী আভা উঁকি দিলো কে জানে । আর আজ এতগুলো বছর পর আবার সেই পুরোনো কলেজের বন্ধু। সকাল সকাল মনটা বড্ড খুশি হয়ে গেল, এরকম খুশী অনেকদিন হয়নি ও। মনের ভিতর থেকে আনন্দটা চোখ অবধি আজ অনেকদিন পর পৌঁছল, এতদিন তো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আর মেকী হাসিতেই ভরে ছিল ফ্ল্যাটটা, আজ মন খুলে অনেকদিন পর একটু গল্প করল ও।
-“দেখলি শালা, নাম্বারটা ঠিক জোগাড় তো করলাম।”
-“হ্যাঁ ভাই, এতদিন পর মনে পড়েছে এই-ই অনেক।।।”
-“এই, এই, তুই কটা খোঁজ নিয়েছিলি রে ব্যাটা।।।”
কথা চলতেই লাগল। এত বছর পর দুই বন্ধুর কথা ড্রয়িংরুমের ঘড়িটা, সোফাসেট, সেন্টার টেবিল কান পেতে চুপি চুপি শুনল দুই বন্ধুর কথোপকথন।
-“যাক গে, শোন না, তোকে যে জন্য ফোন করা, আমি আমাদের গ্রুপটার বাকী লোকজনের নাম্বারগুলোও জোগাড় করে হোয়াটস্যাপ-এ একটা গ্রুপ বানাচ্ছি, তোরটাও পেয়ে গেলাম, তোকেও অ্যাড করছি। একটা ট্রিপের প্ল্যান হচ্ছে বহুদিন পর। তোকেও কিন্তু যেতে হবে, কোন কথা শুনব না, বাকী কথা গ্রুপেই হবে, অনেক বকলাম, রাখ এবার ফোনটা।”
বহুদিন পর কোন কিছু না ভেবে প্রাণ খুলে কথা বলে নিজেকে খুব সতেজ লাগছিল পঙ্কজের। ও, সুবীর, মিঠুন, মহুয়া, আবীর, গোপাল, পাপিয়া, পবিত্র, ঈশিতা- এই একটা গ্রুপ ছিল কলেজে। একসাথে খাওয়া, পড়া, খেলা, ঘোরা সবকিছু। আজ কতদিন পর ছড়িয়ে যাওয়া ঘুঁটিগুলো আবার জড়ো হচ্ছে, ভাবতে ভাবতেই সামনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল পঙ্কজ। নীচে থেকে মানুষজন, বাড়ি, গাড়িগুলো কত ছোট ছোট। নিজেকে অনেকটা উঁচুতে আর বাকী সবকিছুকে অনেকটা নীচুতে দেখার নেশাতেই একসময় এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিল ও আর সুরভী। তারপর তো সবটাই এলোমেলো, ছন্নছাড়া…।।।
।।২।।
সুরভীর সাথে বিয়ের আগের আর বিয়ের পরের জীবনটা সম্পূর্ণ আলাদা পঙ্কজের। এখন রোজ মিটিং, অফিস, কাজের প্রেশার আর তার মাঝে টাইম বের করে কোর্টে ছোটা। ডিভোর্সের কেসটা যে কতদিন ধরে ঝুলে আছে, তার হিসেবে নেই। সুরভী কে যেদিন অন্যের হাতে হাত রাখতে দেখেছিল, সেদিন থেকেই নিজেকে অন্য ধাতুতেই গড়ে নিয়েছে পঙ্কজ।
এই সুরভীকে বিয়ের জন্যই নিজের পরিবারের সাথে লড়াই, সুরভীর সাথে থাকার জন্যই বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ছাড়া, সুরভীর জন্যই এই ফ্ল্যাট, আর আজ যার জন্য সবকিছু, সেই হাত ছেড়ে চলে গেছে।
মাঝে মাঝে নিজের উপর নিজেই হাসে পঙ্কজ। বাইরের লোকজনের কাছে আজ ও, ওর জীবন কতটা ঈর্ষণীয়, অথচ ও জানে এই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের দরজার এপাশটা আর অফিসের কেবিনের ভিতরটা কতটা একঘেঁয়ে, কতটা ফাঁপা।
**************
হোয়াটসাপের নতুন গ্রুপটায় জয়েন করার পর থেকেই কত যে কথা সেই পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে। এই মেকী সম্পর্ক আর প্রতিযোগিতার সময়ে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব, এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী-ই বা হতে পারে। কারও সাথেই যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু আবার সবাই একসাথে, আগের মতো না হলেও সেই আড্ডা, খিল্লিতে ভালই কাটে সময়।
সেই পবিত্র, যে কিনা একা ঘরে থাকতেই পারত না, এত ভীতু, সে কিনা এখন চাকরিসূত্রে কোয়ার্টারে একা থাকে নির্দ্বিধায়। যে পাপিয়া লাভ-ম্যারেজ ছাড়া বিয়েই করব না বলে লাফাতে, সেও আজ দিব্যি সুখী দাম্পত্যের আড়ালে চোখের জল মুছে অভিনয় করতে শিখে গেছে। যে মিঠুন নিজের ছোট্ট প্রিয় বোনটাকে ছাড়া কিছু ভাবতেও পারত না, সেই আজ বোনের ছবিতে মালা পরিয়ে বুকে পাথর রেখে চলতে শিখে গেছে। মহুয়ার মতো এত মিশুকে, আলো ঝলমলে একটা মেয়ে, কে মানতে পারবে মহুয়া আজ নেই। আজ ঈশিতা খুব সুখী তার স্বামীকে নিয়ে, যে কিনা একদিন পঙ্কজকে ছাড়া বাঁচতেই পারবে না ভেবেছিল। পঙ্কজ শুধু বন্ধু ভাবলেও ঈশিতা পারেনি, সেই ঈশিতাই আজ সুখে সংসার করছে। সেই গোপাল এখন সুটেড-বুটেড হয়ে অফিস করছে, একসময় যে কিনা ইংরেজিতে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করত।
সুবীরও তো নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে তাও বাঁচছে। জীবন তো থেমে থেকে না, কারও জন্যই থেমে থাকেনি। সবাই আজ অতীত থেকে পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে।
পঙ্কজেরও এবার মুভ করা উচিত। ফ্ল্যাটের পর্দা, দেয়ালের রঙে, পছন্দ করা টিভিতেও সুরভীই জড়িয়ে আছে। পঙ্কজের সুরভী, যাকে ভালবেসে বিয়ে করতে সব ছেড়ে ছিল ও। সুরভীর ভালবাসা কোনদিনই এই তাসের সংসারে জড়ায়নি, এটা পঙ্কজের বুঝতে বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
এখন নেশায় বেহুঁশ থাকাটা রোজ রাত্রের রুটিনের মধ্যে পড়ে। তার মধ্যেই হঠাৎ এক মুঠো ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে এই বন্ধুদের হঠাৎ পাওয়া। এবার একটু বাঁচতে চায় পঙ্কজ। অনেক তো হলো ধূসর, এবার ইট কাঠ পাথরের জীবনে একটু সবুজের বড্ড দরকার। কবে ও শেষবার একটু মন ভরে শ্বাস নিয়েছিল? কবে ও মিটিং, এচিভমেন্টের বাইরে বেরিয়ে নিজের ধুলো পড়া গিটারটাকে হাতে তুলেছিল, কবে শেষবার বৃষ্টিতে ভিজেছিল, এসি রুম থেকে বেরিয়ে মাটির সোঁদা গন্ধে শ্বাস নিয়েছিল? মনে নেই কবে শেষ ও গাড়ির কাঁচের বাইরে বেরিয়ে নিজের শহরটাকে দেখেছিল। কবে শেষ ও বাঁচার মতো করে বেঁচেছিল?
এবার পঙ্কজও বাঁচবে।
।।৩।।
-“জানি না ছুটি পাবো কী না।”
-“ব্যস, শুরু হলো আবার, আরে দ্যাখ না, হবে। আজ কতদিন পর প্ল্যান হচ্ছে, প্লিজ এভাবে বানচাল হতে দিস না।”
ফোনটা রাখল পঙ্কজ। যে ট্রিপটার কথা হচ্ছিল সেটায় যাওয়া যাবে কী না, সেটাই বুঝতে পারছে না। এতগুলো মিটিং, অফিস সামলে ছুটি ম্যানেজ হবে কী করে? ব্যালকনিতে দাঁড়াল পঙ্কজ। মাথাটা নীচু। আবারও একবার হেরে যাচ্ছে ও। বারবার খুশী, চাওয়া পাওয়াগুলো টাকা, দায়িত্ব, পজিশন, প্রমোশন এই শব্দগুলোর সামনে এত ছোট হয়ে যায় কেন? ১৯তারিখ, ওদের যাওয়ার কথা, সব বুকিং কমপ্লিট, আর এখন ওর এই আর্জেন্ট কাজ। কাকে বোঝাবে ও? নিজেকে নাকি ওদের?
**************
-“স্যার, আমার সত্যিই ঐ সময় ছুটিটা খুব দরকার।।।”
-“ওসব বলে কিছু হবে না পঙ্কজ, তখন প্রজেক্টটায় তোমায় দরকার, কীভাবে ছুটি চাইছ তুমি?”
-“কিন্তু স্যার, দেবব্রতও তো আছে।।।”
-“তোমাকেও লাগবে,try to understand that,তোমায় তো আমি ম্যাচিওর জানতাম ।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসের কেবিন থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগোল ও , থমকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ । পিলপিল করে লোক নামছে, এগোচ্ছে যে যার ঘরের দিকে।
ও কী করছে? কেন করছে? কার জন্য করছে? ওর বিলাসবহুল আবাসনটা কী আদৌ ঘর কোনো? হাঁপিয়ে উঠছে ও, ছুটতে ছুটতে, চলতে চলতে, যুদ্ধ করতে করতে, এবার একটু শ্বাস নেওয়ার দরকার। কিন্তু অক্সিজেন কোথায়? পুরোটাই তো ইট কাঠ বালি, ধূসরে বদ্ধ জীবন। সবাই চলছে, ঘুরছে, ফিরছে, খাচ্ছে, কিন্তু সবাই ধুঁকছে, পঙ্কজও তাই।
***************
অফিসে বসে মেইলটা চেক করছিল পঙ্কজ, আজই ওদের বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল, পারল না ও। শেষ পর্যন্ত মরে মরে বাঁচার অভ্যাস ছাড়তে ও জাস্ট পারল না। টাকা, প্রমোশন, যশ, খ্যাতির গন্ধ চাপা পড়ে গেল মাটির সোঁদা গন্ধের কাছে,আবার ।সুরভী কে হারানোর দায় ও এড়াতে পারে না, এটাই আজ মনে হচ্ছে, কেন থাকবে কেউ ওর মতো যন্ত্রমানব এর সাথে |
-“পঙ্কজ, ভিতরে এসো একবার।”
স্যার এর ডাকে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে ঘরে ঢুকলো ও |
-“ইয়েস, স্যার।”
-“ওয়েল ডান, তোমার রেসপনসিবিলিটি দেখে ভাল লাগল, আমি তাই ভাবি, পঙ্কজ তো এরকম ছিল না, হঠাৎ কী হলো…তোমার থেকে তো আমি ও এই আশাটাই রাখি… “
কান টা ভোঁ ভোঁ করছিলো ওর,
বসের কথাগুলো কানে যাচ্ছিল না আর পঙ্কজের। কানের মধ্যে ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক আওয়াজটা যেন প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। ট্রেনের আওয়াজ,স্টেশন এ শেষ মুহূর্তের দৌড়াদৌড়ি, নস্টালজিয়ার স্বাদ পেতে বস, অফিসের চাকচিক্য, ওর চেয়ারটা সবকিছু আবছা হয়ে যাচ্ছিল পঙ্কজের কাছে। স্টেশন, ট্রেন, ওর কতদিনকার হারিয়ে যাওয়া কলেজবেলার বন্ধুগুলো ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, এই ডাক ও কী করে এড়াবে?………….
-“স্যার, সরি টু ইন্টারাপ্ট। স্যার, আই হ্যাভ টু গো।”
-“হোয়াট?এটা ইয়ার্কির সময় না, যাও প্রজেক্টটার সব কাজ জুনিয়র গুলো কমপ্লিট করলো কি না দেখো আগে… তোমার মাথা কী খারাপ হলো পঙ্কজ?”
-“খারাপ ছিল, আজ ঠিকভাবে ভাবনা চিন্তা করতে পারছি। নিজেই যদি না বাঁচি, এসব করে লাভ কী?”
-“তুমি জাস্ট পাগল হয়ে গেছো, চাকরি থেকে বের করে দিলেই সব মাথায় ঠিক চলে আসবে,আর এই ব্যবহারের জন্যও, ইউ হ্যাভ টু পে, এটা মনে রেখো পঙ্কজ।” উত্তেজিত গলায় বলছিলো পঙ্কজের বস, কিন্তু কথা শেষ হলো না, তার আগেই পঙ্কজ আবার বললো, “থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”
এটুকু বলেই আর ফিরে তাকাল না পঙ্কজ, বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আর দাঁড়াল না অফিসে, ব্যাগটা নিয়েই লিফটের দিকে দৌড়াল ও, লিফটের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যেন মনে হচ্ছিল এক একটা যুগ। অবশেষে লিফ্ট, লিফ্ট পেরিয়ে পার্কিং লট, পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে সোজা স্টেশন, উফফ।
এক একটা সেকেন্ড পেরোচ্ছে আর পঙ্কজের উত্তেজনার পারদ যেন চড়ছে, পৌঁছতে পারবে তো ও? ট্রেন ছেড়ে দেবে না তো? এই তো সামনের মোড়টা ঘুরলেই আর বেশীদুর না, সুবীররা ওকে দেখে বিশ্বাসই করতে পারবে না। ভাইজাগ ওর ঘোরা কিন্তু বন্ধুদের সাথে ঘুরে একটা শান্তি, যেন অক্সিজেন পাওয়া।
গাড়ির স্পীডের কাঁটা উঠছে, তার সাথে চড়ছে সময়ের কাঁটা।।।।
**************
-“আরে, ওটা পঙ্কজ না? ট্রেনে লাগেজ তুলতে তুলতে বলল সুবীর।”
পবিত্র আশ্বস্ত করল, “আরে, হ্যাঁ, ঐ তো। ও এটলাস্ট এলো তাহলে?”
হ্যাঁ,সবাইকে অবাক করে অবশেষে পঙ্কজ পৌঁছাল, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। আজ কত্তদিন পর !!! সবাইকে দেখে ভালভাবে না দেখলে চেনাই যাচ্ছে না। সেদিনকার বেলবটস আজকের পাজামা, সেদিনকার কালো চুল আজ টেকো, সেদিনের টানটান ত্বক আজ কুঞ্চিত। সেদিনকার সানগ্লাস, আজকের পাওয়ারের চশমা। সবটা বদলে গেছে, কিন্তু মানুষগুলো এক। শুরু হলো যাত্রা।
**************
ঋষিকোন্ডা বীচের জলে পা ভিজিয়ে বন্ধুরা মিলে ছবি তুলতে পেরে মনে হচ্ছিল এই তো জীবন, ভুডা কৈলাসগিরির সাজানো বাগানে বসে আড্ডায় মনে হচ্ছিল এই তো জীবন, আরাকু যাওয়ার সর্পিল পথে কিংবা বোরা কেভ-এ মায়াবী রহস্যময় আলোয় হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলে মনে হচ্ছিল এই তো জীবন। এক বুক নিশ্বাস নিতে আসা মানুষগুলো আজ ভীষণ, ভীষণ খুশী, বিশেষত পঙ্কজ।
“বাঁচার সময় মরতাম, আর এখন এতদিনে বাঁচছি, আলাদাই থ্রিল”, হাসতে লাগলো পঙ্কজ।
কালকে আবার ফেরার পালা। আবার সেই এক দশটা পাঁচটার একঘেয়ে জীবন। সেই বিবর্ণ, মলিন জীবনটা আবার ডাকছে হাতছানি দিয়ে।
একটা সিগারেট ধরালো পঙ্কজ। আর পারছে না ধরে রাখতে, এনার্জিটা ভাঙছে আসতে আসতে, কষ্ট হচ্ছে আবার। আর কিছুক্ষণ, ব্যস, ওর আর কোন দুঃখ নেই। অনেক না পাওয়ার মধ্যে এই পাওয়াটা ওর জীবনের সোনালী মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম।
**************
চলন্ত ট্রেনেই সুবীরের ফোনটা এল। কথা কেটে কেটে যাচ্ছিল। ওদেরই এক বন্ধুর ফোন। যেটুকু শুনল তারপর সুবীরের চোখ বাইরে বেরিয়ে আসার অপেক্ষা।
-“পঙ্কজ আর নেই। ১৯তারিখ একটা কার এক্সিডেন্ট-এ মারা গেছে। স্টেশন আসার পথে, আমরা বেড়াতে গেছি ভেবে কিছু জানায়নি মৃণাল । আজ বলল। তাহলে এতদিন আমাদের সাথে যে ছিল সে কে? ঐ জন্যই কোন ফটো তুলতে দিচ্ছিল না ও? কোথায় ও?”
সত্যিই তো এতক্ষণ তো খেয়ালই করেনি, পঙ্কজ কোথায়? একসাথেই ট্রেনে উঠেছিল তো ওরা।ততক্ষণে পঙ্কজের ধুম্রমান শরীরটা এনার্জি ফুরিয়ে আসতে আসতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে, হাসিমুখে, বাঁচার আনন্দে, মুক্তির সুখে।শেষ পর্যন্ত অনেক দেরি তে হলেও বাঁচলো ও |