||১||
“একটু ঠিক করে ওজন করে দিস বাবা”, ভাঙা বৃদ্ধ কন্ঠস্বরে ফিরে তাকালাম পাশে, সবজি কিনতে কিনতে | বয়স্ক ভদ্রমহিলা বয়সের ভারে বেশ খানিকটা কুঁজো, দেখেই খুব কষ্ট হচ্ছিল, এই বয়সেও এইভাবে বাজার করতে হয়, ছেলে মেয়েই বা কী | অন্যমনস্কভাবে তাকিয়েছিলাম ওনার দিকে, আমার আলুপটল ওজন হয়ে গেছে তাগাদাটা কানে যেতেই টনক নড়ল, টাকা মিটিয়ে হাঁটা লাগলাম |
**************
এই পাড়ায় আমি আমার পরিবার নিয়ে এসেছি একমাসও হয়নি, ঐ জন্যই সবার সাথে ভালভাবে আলাপ পরিচয় হওয়ার সুযোগ এখনও অবধি ঘটেনি | পাড়ার ক্লাবে যাওয়া আসা শুরু করেছি কয়েকদিন যাবৎ | চাকুরী সূত্রে এখানে আসা, আগে ছিলাম জামশেদপুরে | সেখান থেকে এখানে এসে মানিয়ে নিতে হবে ভেবে প্রথমে যে মনে আশঙ্কা হয়নি, এরকম বললে ভুল বলা হবে | কিন্তু, এখানে আসা ইস্তক বেশ ভালই লেগেছে, পাড়ার মানুষজনও খুব ভাল, মিশুকে | আমার স্ত্রী, পুত্র, মা বাবাও বেশ খুশী দেখে আমিও শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম |
*************
রোজ সন্ধ্যে থেকে ক্লাবে ক্যারামের আসর বসে | সেই আসরে এখন আমিও নতুন সদস্য | আড্ডা মেরে খেলে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে ঘুম | আমার রোজ নামচা, এভাবে ভালই কাটছিল |
আজ সন্ধ্যের দিকে, ঘুঁটিতে মন নিবিষ্ট ছিল, এমন সময় আমাদের পাড়ার শঙ্কর দা একটা কথা বলল কথায় কথায়, আপাত সাধারণ কথার মধ্যেই শুনলাম দত্ত বাড়ির ছেলে মারা গেছে নাকী বেশ ক’মাস হলো, কিন্তু দত্ত গিন্নিকে দেখে বোঝার উপায় নেই, এই বুড়ো বয়সেও কত শখ ইত্যাদি, ইত্যাদি |
||২||
আমার স্ত্রী তার সংসার শ্বশুর শাশুড়ি নিয়েই থাকে সারাদিন, ব্যস্ততার শেষে রাত্রি বেলা স্বামী স্ত্রী দুটো মনের কথা বলি | কথায় কথায় জানলাম, আমার স্ত্রীও আশেপাশের পরিবারের সাথে বেশ ভালই মিশে গেছে, দত্ত বাড়ি থেকে নাকী নিমন্ত্রণও এসেছে | দত্ত বাড়ির বৌ-এর সাধ উপলক্ষ্যে, দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রনে সব মহিলারাই নাকী নিমন্ত্রিত | আমি শুধু শুনলাম, কিচ্ছু বলিনি, শুয়ে পড়লাম | শঙ্কর দার কথাটা মনে পড়ছিল, যার ছেলে কমাস হলো মারা গেছে, সে ঘটা করে বৌ-এর সাধ দিচ্ছে! দুঃখ কষ্টও নেই নাকী ! ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম জানি না |
**************
(কয়েকদিন পর)
দত্ত বাড়ি আর দত্ত বাড়ির মানুষগুলো আমার চোখে অমানবিক, অমানুষ, অদ্ভুত, এই বিশেষণগুলো নিজগুনে অধিকার করে নিচ্ছিল | কিন্তু হঠাৎ করেই ঐ পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের মেশার একটা সুযোগ ওপরওয়ালা করে দিল | আমার বাবার রেয়ার ব্লাড গ্রূপ অপারেশনের সময় রক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না, দত্ত বাড়ির মেয়ে, তখন সেই সময় এগিয়ে এসছিল |
এভাবেই দুই পরিবারের মধ্যে সখ্যতা বাড়ছিল, তারপর যে এভাবে পুরো সত্যিটা আমার সামনে চলে আসবে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, পুরোটা জেনে বুঝে নিজের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না বেশ ক’দিন |
||৩||
দত্ত বাড়ির বড় ছেলে সৌভিক দত্ত সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিল আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে | মা বাবারও সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল ছেলের এই মহৎ সিদ্ধান্তের উপর | কিছুদিন পর বিয়েও হয় রিমার সাথে, রিমাও সৌভিকের মতোই নিজের দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করার মানসিকতা রাখে, তাই সেও স্বামীর কাজকে সম্মান তো করতোই, উল্টে আর পাঁচজন নববধূর মতো স্বামীর এখানে না থাকা নিয়ে অভিযোগ না করে স্বামীর পাশে থাকতো সবদিন |
কিন্তু বলে না, ভালো মানুষের সাথে সবসময় খারাপটাই হয় | ভাগ্য বেশিদিন সুখ দেয়নি এই মানুষগুলোর জন্য | কিন্তু কী অসম্ভব মনের জোর মানুষগুলোর |
ছেলের মৃত্যুর পাঁচমাস পরেও বৌমাকে এখনও সত্যিটা জানতে দেয়নি মানুষগুলো | উল্টে অন্তঃসত্ত্বা বৌমাকে এই সময়ে যতটা সম্ভব খুশী রাখতে চেষ্টা করছেন বুড়োবুড়িগুলো | তার সামনে এখন চোখে জলটুকুও আসতে দেয়নি মানুষগুলো | বারবার তার জন্য বৌমার সামনে মিথ্যে বলতে হয়েছে | অপ্রিয় সত্য কথাটা এই বয়সে মনের মধ্যে চেপে অভিনয় করে চলেছেন | খুশী মনে এখনও ভেবে রেখেছেন, আসছে যে সেও যেন বাবার মতো নির্ভিক হয়, দেশের জন্য যেন কিছু করে | সবটা জেনে নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট লাগছিল |
রিমা আর সৌভিকের ভালবাসার বিয়েটা টেকেনি বটে, কিন্তু সৌভিকের দেহ এবাড়িতে আসেনি, মালা ওঠেনি ছবিতে, সৌভিকের বাড়ি না আসা, ফোন এই সব কিছু নিয়েই অনেক যুক্তি তক্কো-র পালা চলেছে রিমার সামনে |
কিন্তু, রিমা সবটা জেনে বুঝেও মা বাবাকে বুঝতে দেয়নি যে ও সবটা জানে বোঝে, এই কথা রিমা নিজের আমার স্ত্রীর সামনে বলেছিল |
কী অদ্ভুত, দুই পক্ষই দুতরফের কথা ভেবে সমস্ত কষ্ট মনে চেপে রেখে ভাল থাকার, ভাল রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে, সব সত্যিটা জেনেও | ভাগ্যের একী পরিহাস, আড়ালে চোখের জল মোছে সবাই, সামনে সবাই হাসে সবার সাথে | এভাবে কতদিন সত্যিটা লুকোবে জানা নেই, সৌভিক কী রিমার স্বপ্নে আসে, না বলা হাজারো মনের কথা বলতে? জানা নেই, কিন্তু এই মানুষগুলোর অসম্ভব মনের জোরই সেই সমস্ত বীর যোদ্ধাদের তৈরী করে, এই লড়াকু মায়েরাই পারে হাসি মুখে নিজের সন্তানকে শহীদ হতে দেখতে, দেশের জন্য, তবু ভেঙে পড়ে না মানুষগুলো | এদের ত্যাগের জন্যই তো আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোই, সবাই কী পারে এভাবে ভাবতে? মা তোমায় সেলাম….|