।।১।।
আজ বহুদিন পর কোনরকম তাড়াহুড়ো ছাড়া নিজের কফি মাগ আর নিউজপেপারটা নিয়ে ব্যালকনিতে বসল রাজীব। তাড়াহুড়ো, দৌড়োদৌড়ি, লেটনাইট, মিটিং, ট্র্যাভেলিং, এইসব যার জীবনে বিগত প্রায় ২৫বছর ধরে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আজ হঠাৎ করেই তার জীবনে অখন্ড অবসর। প্রথমে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল বইকি! ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু আজ সকালটায় যখন দৌড়োদৌড়ি না করে সূর্যোদয়টা প্রাণভরে দেখল, ব্যালকনিতে রাখা নিজের প্রিয় চেয়ারটায় সময় নিয়ে বসল তখনকার অনুভুতিটা একদম অন্যরকম ছিল। কোথাও যেন হারিয়ে ফেলা নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিল রাজীব, যেটা এতদিন স্বেচ্ছায় চাপা দিয়ে রেখেছিল মিটিং, ফাইল, প্রমোশন, ইনক্রিমেন্টের তলায়। না, কেউ তো ওর উপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি, বরং নিজেই ও এই ভারী বোঝাটা বইবার জন্য বাকি সবকিছুকে ভুলেছে। পেপারটা ভাঁজ করে রেখে ফোনটা হাতে নিল রাজীব। হোয়াটস্যাপ এ একদম নীচের দিকে পড়ে ছিল গ্রুপটা। অফিস কলিগ, আর অফিস গ্রুপের ভিড়ে এই মিউট করে রাখা গ্রুপটায় জমা পড়েছে কত অজস্র কথা। খুলেও দেখেনি রাজীব, উল্টে মিউট করে দিয়েছে। উত্তর দেওয়ার সুযোগটুকুও বের করতে পারেনি, বা চায়নি। আজ বাকি সব গ্রুপ, চ্যাট, পেরিয়ে, আঙুলটা এই গ্রুপটার উপর এসেই থামল, ঠিক আগে যেমনটা ছিল। সমস্ত মান অভিমান, রাগ দুঃখ ঝগড়া, মনখারাপ, সমস্ত কিছু শেষ করার এই একটাই ঠিকানা। নিশ্চিন্তে একে অপরের কাঁধে মাথা রাখার এই একটাই নির্ভরযোগ্য জায়গা, ওদের কলেজের বন্ধুগুলো। ও, অমিত, প্রণব, মিতালী, দীপক আর… নন্দিতা।
ওর বেশ মনে আছে, একটা সময় এমন ছিল কলেজের ছুটি পড়লে একে অপরের সাথে দেখা না হলে রীতিমত বিরক্ত লাগত ঘরে বসে। মনের একটা জায়গা যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগত ভীষণ। তখন তো এত ফোনের বাড়বাড়ন্ত ছিল না, একে অপরের বাড়িতেই আড্ডার আসর বসত। আর সেই আড্ডা শুরুর সময় থাকলেও শেষের কোন সময় থাকত না। দু’ ঘন্টা, চার ঘন্টা, ছ’ ঘন্টা… কোন বিরাম নেই। অমিতের মা অসাধারণ রান্না করতেন। ওদের একান্নবর্তী পরিবার তখন। বিশাল বাড়িতে ঘরের অভাব নেই। দোতলার বারান্দার দিকের ঘরটায় ওদের আড্ডা বসত।
আড্ডার মাঝে মাঝেই চলে আসত মাসিমার হাতের তৈরী গরম গরম সিঙ্গাড়া, বা লুচি আলুরদম। আড্ডার সাথে সাথে খাওয়াটাও জম্পেশ হতো। সেই আড্ডার বহর এমনই হতো যে খেয়ে হাত ধোয়ার কথাটাও মনে থাকত না। দু’ঘন্টা ধরে ঐ এঁটো হাতেই আড্ডা চলার পর টনক নড়ত মাসিমার বকুনিতে। সেসব কিছু দিন ছিল বটে! ভাবতে ভাবতে হারিয়েই গেছিল রাজীব ওর কলেজের সোনালী দিনগুলোতে। ক্লাস কেটে আড্ডা, সিনেমা, ঘোরাঘুরি, প্রেম!
“দাদা, অফিসের টিফিন কি বানাব আজ?”
সত্যদা দরজাটার কাছে এসে ডাকতে টনক নড়ল রাজীবের। ওর ঘর, রান্নাঘর, সংসার নামক যা কিছু সব ঐ সত্যদাই দেখেশুনে সামলে রাখে। আরেকজন আছে, সে এসে কাজ সেরে চলে যায়। সত্যদাই রাজীবের এখন সর্বক্ষণের সঙ্গী। জোরে একটা শ্বাস নিয়ে একটু হেসে তাকাল রাজীব সত্যদার দিকে, বলল, “নাহ, আর অফিসের টিফিন করতে হবে না। যাব না অফিস।”
“বাব্বাহ, তুমি অফিস থেকে ছুটি পেয়েছ? অফিস তোমায় দিয়েছে ছুটি? ভাবতেই পারছি না তো। কোন দিকে সূর্য উঠল গো।” বলতে বলতে আবার রান্নাঘরে চলে গেল সত্যদা। রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলল, “বাড়িতে আছ যেকালে, একটু লুচি ছোলার ডাল খাবে নাকি?”
“একদম, কর, কর, জলদি কর।” সত্যদাকে উদ্দশ্য করে বলল রাজীব। একটা সময় গেছে রবিবারেও দম ফেলার ফুরসত পায়নি ও। ঘরে নিজের বিছানায় ভাত ঘুম দেওয়ার বদলে দিনগুলো কেটেছে কনফারেন্স রুমে। দেশ বিদেশের হোটেলগুলোয় প্রচুর আরাম, সুখ থাকলেও শান্তি কোনদিনও পায়নি ও। মাকে হারানোর পর ওর এই লুচি ছোলার ডালের আবদার মেটাত নন্দিতাই… কিন্তু তারপর…
ভাবনা থামিয়ে ফোনটা হাতে নিল রাজীব। আজ বড্ড ইচ্ছে করছে গল্প করতে, আড্ডা দিতে আগের মত। ফোন বুকটা খুলে সার্চ করল নামগুলো। বেশ ক’বার চেষ্টা করল, কিন্তু বেকার, কোন লাভ হলো না। হয় নাম্বারের অস্তিত্ব নেই, নয় সুইচ অফ, নয় আনরিচেবল। আচ্ছা, হোয়াটস্যাপ-এ তো থাকবে নাম্বারগুলো। হোয়াটস্যাপ-এর ওদের গ্রুপটা খুলল ও আজ, বহুদিন পর। হাজারখানেক মেসেজ জমা হয়ে রয়েছে। গুড মর্নিং, গুড নাইটের ফরওয়ার্ডেড মেসেগুলো দেখলে ভীষণ বিরক্ত লাগত ওর। আজ সেই ইরিটেশনটা কই হচ্ছে না তো! গ্রুপ থেকে অমিত, প্রণব এদের সব নাম্বারগুলো সার্চ করতে করতেই মেসেজটা চোখে পড়ল। মেসেজটা পড়ে এক সেকেন্ডের জন্য যেন অন্ধকার হয়ে গেল চারপাশটা। ঠিক পড়ছে তো? দু’ তিনবার পড়ল মেসেজটা। নিজের অজান্তেই ওর চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে কখন। একবার খুঁজে দেখল কবেকার মেসেজ এটা? ১৯ তারিখ, মানে চারদিন আগের। ওদের গ্রুপের সব থেকে হাসি খুশি ছেলেটা, যার কাছে থাকত সব মুশকিলের আসান ফর্মুলা, যার সাথে কথা বললে হালকা হত মনটা, একটা সময় রাজীব নিজের বাড়িতে কম এই ছেলেটার বাড়িতে বেশি থাকত, সেই ছেলেটা আজ নার্সিং হোমে ভর্তি? যে ছেলেটা সবাইকে হাসিয়ে বেড়াত সে আজ মুখ বন্ধ করে সবাইকে কাঁদিয়ে নার্সিং হোমের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়ছে? রাজীবের চোখে একমুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল সাদা কালো ছবিটা। ওর আর অমিতের বন্ধুত্বের কিছু অমূল্য স্মৃতি। ওদের ছেলেমানুষি, ওদের একসাথে পুরীর ট্রিপটা। একসাথে কলেজ রিইউনিয়নের রাতে হুল্লোড় করা, একসাথে চাকরি পাওয়া সব সব সব। চোখটা মুছে ফোন নাম্বারটা দেখে দীপককে তাড়াতাড়ি ফোন লাগাল রাজীব।
।।২।।
“এক্সকিউজ মি, মাই ফ্রেন্ড মিঃ অমিত বসু, হি ইজ অ্যাডমিটেড হিয়ার, ক্যান ইউ প্লিজ।।।” রাজীবের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর নাম ধরে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর কানে এল ওর। বাঁ পাশে তাকাতেই দেখল বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে একটা মোটা সোটা গোছের মানুষ। মাথায় চুল বলতে কয়েকটা সুতোর মতো কিছু বিচরণ করছে হাওয়ায় এদিক ওদিক, চকচক করছে টাক। চোখে চশমা, ঢিলেঢালা পাজামা পাঞ্জাবীতে সেই কলেজের দীপক। চশমার ফ্রেমটা এখন আর আগের মত হিরো মার্কা না, বরং একটু বুড়োটে গোছের। পাওয়ারটাও বেড়েছে, কারণ চোখগুলো এই টুকু টুকু লাগছে। হাফ-হাতা পেস্তা রঙের পাঞ্জাবী, সাদা পাজামা, পায়ে চটি, হাতে একটা কালো ব্যাগ নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে দীপক ব্যানার্জ্জী, ওদের সবার আদরের দীপু।
একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল দীপু, রিসেপশন থেকে হাত নেড়ে ভিতরের দিকে চলে এল রাজীব। কত বছর পর দীপুকে দেখল? কত বছর পর আজ দীপুর সাথে ফোনে কথা বলল ও? পনের কুড়ি বছর প্রায়। কিন্তু দীপুর সাথে দেখা হওয়ার পর দীপুর চোখে বরাবর যে উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা দেখে এসেছে ও এত বছর সেটা দেখল না আজ । ওকে দেখেও… উল্টে ভীষণরকম ব্যস্ত হয়ে এগোল লিফ্টের দিকে। বড় অদ্ভুত লাগল রাজীবের। দীপু কি ওকে এখানে দেখে খুশি হয়নি? কিন্তু কেন? এত বছর পর দেখা! ওকে বেশি ভাবার সময় না দিয়েই লিফ্টের দরজা খুলে গেল, লিফ্টে হয়ত এক মিনিট মতো ছিল ও আর দীপু। আশ্চর্যজনকভাবে ঐ চুলবুলে ছেলেটা আজ অনেক অনেক বদলে চুপচাপ, শান্ত। রাজীবের কাছে সবকিছুই বড্ড অন্যরকম লাগছিল। কলেজের সেই চিরপরিচিত উষ্ণতাটা কিছুতেই পাচ্ছে না খুঁজে,যদিও একটা নার্সিংহোমে সেটার আশা করাই বোকামি। এলোমেলো চিন্তা ভাবনা করতে করতে কখন অমিতের রুমের বাইরে পৌঁছে গেছে ওরা। দরজার বাইরে ছোট কাঁচের অংশটুকু দিয়ে দেখল অমিতকে। এ কি চেহারা হয়েছে? এই কি ওর সেই অমিত? বন্ধুর জন্য হাসিমুখে সব করতে রাজী ছিল এই পাগলটা, আর আজ সেইই… অমিতের এই রূপটা কিছুতেই দেখতে পারছে না রাজীব। মুখটা ঘুরিয়ে সরে এল ও। এতক্ষণে ওর কাঁধে হাত রাখল দীপু। বলল, “আসলে পাপিয়া মারা যাওয়ার পর থেকেই ড্রিঙ্ক করাটা এত বাড়িয়ে দিয়েছিল না, তার মধ্যে সিগারেট তো আছেই। অনেকবার বারণ করেছি, কিছুতেই শুনত না। আমি লাস্ট কয়েকমাস একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম… একটা কথা শুনতো না। কতবার কতভাবে চেষ্টা করেছি। কিছুতেই কিছু না। আমাকেই কোনরকমে ফোনটুকু করতে পেরেছিল এটাই বাঁচোয়া। তখন কটা হবে, রাত আড়াইটা বোধ হয়। আমিই সবথেকে কাছে থাকি তাই এটা একটা বড় সুবিধা হয়েছিল। আর এখানে আমার এক পিসতুতো দাদা…ঐ ভাস্করদা…তোরা দেখেছিস, মনে নেই হয়তো। ও এখন ইন্ডিয়াতেই আছে, এখানেই প্র্যাকটিস করছে, তাই সুবিধে হল। তাও ভর্তি করতে করতে সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।
“হুম, ডাক্তার এখন কি বলছে?”
রাজীবের কথা শেষ হতে না হতেই দীপুর ফোনটা বাজল। ওকে ইশারা করে একটু সরে গেল দীপু। কাঁচটা দিয়ে অমিতের দিকে তাকিয়েছিল রাজীব, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাজারটা নল, সারা শরীরে বেঁধানো সূচ, গলার কাছে যন্ত্রনাটা দলা পাকিয়ে আটকে রয়েছে, কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু পারছে না, পুরুষমানুষ যে…
বরাবরই অমিত ওর খুব কাছের, সেই জন্যই হয়তো মনে অভিমান মনোমালিন্যের গভীরতাটা অনেক বেশী। অমিত যেমন সমস্ত পরিস্থিতিতে সবদিন রাজীবের পাশে থেকেছে, তেমন রাজীবও কোনদিন কোন কিছুতে না করেনি। কিন্তু যেবার ওর হ্যাঁ বলার কথা ছিল সেই বারই… ওর বেশ মনে আছে ওর আর নন্দিতার ডিভোর্সের সময়টা। মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েছিল যখন রাজীব, অমিতই সামলেছিল ওকে। কিন্তু ও… যখন অমিতের ওকে সবথেকে বেশি দরকার ছিল তখনই তো ও ওর পাশে ছিল না… এই অনুতাপ কোনদিন যাবে না রাজীবের মন থেকে। অমিতকে একবার সরি অবধি বলেনি ও, দেখা অবধি করতে আসেনি, নিদেনপক্ষে একটা ফোন। ছিঃ! অফিস, মিটিং, প্রজেক্টের চক্রবূহ্যে আটকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল ও ওর অমিতকে। আজও… মাথাটা নীচু করে নিল রাজীব।
“এই শোন না…” ফোনটা কেটে রাজীবের দিকে তাকাল দীপু।
“হ্যাঁ বল।”
“বলছি, প্রণব, মিতালী, ওরা সব আসছে। ওরা জানে না তুই এসেছিস। ওরা এক্সপেক্টও… মানে, তুই একটু মাথাটা ঠান্ডা রাখিস। জানিসই তো, প্রণব একটু মুখরা… প্লিজ একটু।”
“হুম, হুম, ঠিক আছে।।। তুই চাপ নিস না।” রাজীব মুখে জোর করে একটা হাসি এনে আশ্বস্ত করল দীপুকে।
সামনে বসার জায়গাটা ফাঁকা হতেই গিয়ে বসল একটু। প্রণব আর মিতালীর বিয়েতেই শেষ দেখা হয়েছিল ওদের সাথে। প্রণবের ট্যুরিজমের বিজনেস, অনেক ট্যুরেই বন্ধুদের ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরিয়েছে, সকলেই গেছে, রাজীব ছাড়া। শেষবার ওর মেয়ের জন্মদিনে আসব বলেও যখন শেষ মুহূর্তে এল না রাজীব, সেই থেকেই… সেদিন সকলকে অপেক্ষা করিয়ে শেষ মুহূর্তে আসেনি রাজীব নন্দিতা। রাজীব বাড়ি ফেরার পর নন্দিতার সাথে অশান্তি চরমে উঠেছিল। সবদিক বিবেচনা করে ভেবে রাজীবের নিজের দিকটাই ঠিক বলে মনে হয়েছিল তখনও সবদিনের মত, নিজের কোন ভুল চোখে পড়েনি সেদিন। কিন্তু আজ যেন ভুলগুলো ওর চোখে ভীষণ স্পষ্ট। চাকরি, টাকা, মিটিং, প্রোমোশনের চক্করে বহু কিছু হারিয়ে, হেরে বসে আছে ও।
“আরে! রাজীব যে। কি খবর ভাই?” রাজীবের টনক নড়ল প্রণবের কথায়। অন্যমনস্ক থাকায় কখন এসেছে বুঝতেই পারেনি। লম্বা, রোগা, যদিও এখন শরীরে মাংস লেগেছে খানিক। ব্যস, বাকি সব একই আছে। হ্যাঁ চুলে পাক ধরেছে বটে। কাঁচা পাকা একমাথা চুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রণব।
“ভাল, তুই, আর মিতালী?”
“সব ঠিক আছে। আসছে, তা তুই হঠাৎ! আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এত হাইফাই, বিগ ম্যান, সে আজ এখানে? হল কি? স্বপ্ন দেখছি না তো?”
রাজীবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের কথাগুলো বলে ডাক্তারকে দেখে এগিয়ে গেল প্রণব। কথাগুলো একদিন না একদিন রাজীবকে শুনে হজম করতেই হত। দীপুর দিকে একবার তাকাল, আর কিছু বলল না রাজীব। নিজেকে এই সবকিছুর মধ্যে ভীষণ খাপছাড়া, অযাচিত মনে হচ্ছিল ওর। অপ্রয়োজনীয়, হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ, যাকে ছাড়াই এতদিন এ বিশ্বসংসার দিব্যি চলে যাচ্ছিল, কিচ্ছু থেমে ছিল না। সত্যিই তো কারও জন্য তো কিছু থেমে থাকে না। অপেক্ষা করতে করতে আর কোন আশাই যখন বেঁচে থাকে না, কারও থাকা না থাকার উপরে, তখন তো এরকমটাই হবে। খুব স্বাভাবিক। মাঝখানে অনেকখানি সময় হারিয়ে ফেলেছে ও। মাথা নীচু করে সাইডে রাখা পাতাবাহারটার দিকে তাকিয়ে বারবার এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল ওর, তখনই মিতালীর গলার স্বর, আর মাথা তুলে তাকাতেই, মিতালীর সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিপছিপে রোগা মেয়েটা… রাজীবের জীবনের প্রথম ও শেষ প্রেম… নন্দিতা।
।।৩।।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছিল রাজীব। অনেকগুলো মুহূর্ত ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কিছুতেই কোন উত্তর পাচ্ছে না ও। অনেক ভেবেছে কাল রাত থেকে… পায়নি উত্তর। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজের জীবনটাকে নিজের যোগ্যতায় গুছিয়ে নেওয়া অন্যায়? না। নিজের স্বপ্নকে পূরণ করার সাহস দেখানোটা কি অন্যায়? একদমই না। নিজের যোগ্যতায় সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কি অন্যায়? কখনো না। তাহলে? কি অন্যায় করেছে ও যে… কেন? যে কাঁধগুলো সবসময় পাশে ছিল তোমার প্রয়োজনে, তাদের দরকারে পাশে না থাকাটা অন্যায়। ‘বন্ধুত্ব’-এর এই সংজ্ঞাটাকে অস্বীকার করা অন্যায়। শুধুমাত্র নিজেরটা ভেবে নিজের প্রিয়জনদের ভুলে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া অন্যায়। আর এগুলোই তো রাজীব করেছে,তাহলে আজ মানতে এত অসুবিধে হচ্ছে কেন এই মানুষগুলোর ব্যবহার? এই একই অবহেলা, এই একইভাবে ইগনোর তো ও-ও করে এসেছে এতগুলো বছর। বন্ধুত্বের খাতিরে কি করে গেছে ও? ওর সবথেকে কাছে বন্ধু, জীবনের কঠিন সময়গুলোয় ওর পাশে ছিল, কিন্তু ও? মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে নিজের মা আর নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল অমিতের। আর রাজীব? অফিসের মিটিং, কনফারেন্সকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল রাজীবের, অমিতের পাশে থাকার থেকে। এতটাই ব্যস্ত ছিল যে একটা ফোন, একবার দেখা, একটু পাশে হাতটা ধরে বসা… কিচ্ছু না।
নিজের ব্যবসার কাজে মার খেয়ে সবার আগে নিজের নির্ভরযোগ্য বন্ধুটাকেই বলতে এসেছিল দীপক। নিজের জীবনে মশগুল থাকা রাজীবের একবার মনেও হয়নি ফোনটা ধরা উচিত। চারমাস পর নিজের ইচ্ছে হলে ফোন করেছিল রাজীব, সবটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর। প্রণবের যখন ক্যান্সার ধরা পড়ল, তখনও কোথায় ছিল ও? একবারের জন্যও প্রণবের পাশে এসে বসে দুটো কথা বলার সময় বের করতে পারেনি রাজীব নিজের ব্যস্ত শিডিউল থেকে। কিভাবে এক্সপেক্ট করছে তাহলে যে সব একইরকম থাকবে? ও তো নিজে দায়িত্ব নিয়ে বদলে দিয়েছে সবটা। তাও কার জন্য? কিসের জন্য? চাকরির জন্য।
অন্যের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে সেই কোম্পানিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে বাহবা কুড়িয়েছে। অর্থও উপার্জন করেছে প্রচুর, কিন্তু পাওয়ার থেকেও না পাওয়ার ভার যে কতটা বেশি, সেদিন বোঝেনি। বুঝবে কি করে? দু’দন্ড বসে ভাবলে তো বুঝতো।
আচ্ছা এই যে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে ও। স্বপ্নকে পূরণ করতে পারার জন্য নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াচ্ছে, সত্যিই কি তাই? এই অগোছালো ঘরটাকে দেখে সত্যিই কি মনে হচ্ছে ও ওর জীবনটা গোছাতে পেরেছে? যদি সত্যিই গোছাতে পারত, তাহলে আজ ওর পাশে নন্দিতাও থাকত, কই নেই তো। তাহলে? এই যে স্বপ্নকে পূরণ করেছে নাকি, বিশাল প্রতিষ্ঠিত, এইটা কি সত্যিই ওর স্বপ্ন ছিল, নাকি অন্যকিছু ছিল যেটা পাওয়ার কোন চেষ্টাই না করে এটাকেই নিজের স্বপ্ন বলে নিজেকে ভুল বুঝিয়ে এসেছে ও? অন্যের জন্য নিজের জীবনের মূল্যবান সময় দিয়ে কিছু করাটা অন্তত ওর স্বপ্নের লিস্টে তো ছিল না। ও তো নিজের জন্য কিছু করতে চেয়েছিল। এই পথে অনেক অর্থ এসেছে বটে, অর্থ জীবনে প্রয়োজনও, কিন্তু শান্তি পেয়েছে কি? ও তো সব হারিয়ে বসে আছে। চারপাশে কেউ নেই, কেউ না। যে চাকরির জন্য, যে কেরিয়ারের জন্য, নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিল ও, আজ তারা ওকে কত সহজে ভুলে গেল। আর নিজের পরিবার, বন্ধুবান্ধব সবকিছু ভুলে এদের জন্যই নিজের জীবনের সবটুকু সময় দিয়ে বসেছিল রাজীব। ভীষণ আফসোস হচ্ছে আজ। অথচ একটা সময় ছিল যখন এই জিনিসটাই ওর সবথেকে অপছন্দের জিনিস ছিল – ‘আফসোস করা।’ অনেকগুলো বছর, অনেকটা সময় হারিয়ে গেছে, জীবন তো একটাই, আর তো সেই সময় সেই মুহূর্তগুলো ফিরে আসবে না, যদি ফিরত তাহলে সবার আগে… ফোনটা বেজে উঠল পাশের ঘরে। হয়ত নার্সিংহোমের ফোন, তাড়াতাড়ি ফোনটা ধরতে গেল রাজীব।
**********
(দু’দিন পর)
“তোর কি দরকার ছিল ওকে ফোন করার? ওকে ছাড়া এতদিন যখন চলেছে, তখন আজও চলতই। ঠিকই ম্যানেজ হয়ে যেত, কেন বলতে গেলি?”
“আরে, রাত্রে কে থাকতে পারবে বল আজ, সেই জন্যই আমি ওকে…”
“না দীপু, এটা তুই ঠিক করিসনি। এই ক’দিনে ওর এতদিনের ব্যবহার ভুলে গেলি কি করে?”
“আরে তোরা নার্সিংহোমের সামনে দাঁড়িয়ে কি অসভ্যের মত চিৎকার করছিস তখন থেকে। আর এত চিৎকারের আছে টাই বা কি… প্লিজ দয়া করে চুপ কর।”
“দ্যাখ মিতালী, আমি প্রণবকে এটাই বোঝাচ্ছি, এবার কিন্তু তুই ওভার রিয়াক্ট করছিস।”
প্রণব, মিতালী, দীপকের এই তর্কযুদ্ধ চলার সময়ই নার্সিং হোমে পৌঁছাল রাজীব। ঘড়িতে একবার সময়টা দেখল, গাড়ি থেকে নামার আগে। ভিজিটিং আওয়ার্স তো শুরু হয়ে যাওয়ার কথা, তাহলে এখনও এখানে দাঁড়িয়ে কেন এরা? কিছু হল না তো? তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনেটায় পৌঁছাল রাজীব। ওকে দেখে দীপু প্রণবকে চুপ করতে বললেও প্রণব দমবার পাত্র নয়। রাগে যেন ফুঁসছে রীতিমত। কেন এত রাগ, কিসের জন্য এত রাগ ও নিজেও জানে না। কিন্তু রাজীবকে দেখলে ওর মাথার ঠিক থাকছে না।
“কি হয়েছে, তোরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিজিটিং আওয়ার্স তো শুরু হয়ে গেছে।”
“এবার কি তোর পারমিশন নিয়ে এখানে দাঁড়াতে হবে?”
প্রণবের কথায় মাথাটা গরম হলেও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল রাজীব। দীপক, মিতালী বারবার ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেও লাভ হলো না কোন।
“কি বলতে চাইছিস প্রণব ঠিক করে বল।”
“বলতে তো চাইনি কিছু, তুই বলতে বাধ্য করছিস।”
“মানে?”
“মানে আবার কি, আজ এত বছর কোথায় ছিল তোর বন্ধুত্ব, যে আজ তোর ভরসায় অমিতকে রেখে আমরা চলে যাব?”
“মানে? অমিত তোর যতটা আমারও ততটাই প্রণব।”
“একদমই না। বেকার বাজে কথা বলে মুখ খোলাস না আমার।”
“না, না, বলেই দে আজ তুই। তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি যে এরকম ব্যবহার করছিস?”
“তোর মতন স্বার্থপরের সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে নেই আমার। তুই অনেক বদলে গেছিস রে, অনেক বদলে গেছিস। আগের রাজু নেই আর। আর এই রাজীবকে আমি চিনি না, এ আমার বন্ধু নয়। এ শুধু নিজেকে ভালবাসে, আর কাউকে না।”
এক সেকেন্ডের জন্য থমকাল রাজীব। এইভাবে চরম সত্যিটাকে বেআব্রু অনেকদিন পর কেউ করল। চুপ করে গেল রাজীব কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপর বলল, “হ্যাঁ, স্বার্থপর আমি, এই পৃথিবীতে সকলেই স্বার্থপর, সবাই নিজের ভালটা বোঝে, এতে অন্যায়ের কি আছে?”
“তোর সাথে এই জন্যই আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না রে। নিজের ভাল পাগলেও বোঝে। কিন্তু তুই শুধুই নিজেরটুকু বুঝিস। আর কারোটা নয়।”
“নিজেরটা বুঝি বলেই এখানে দাঁড়িয়ে, নয়ত তোর মতন ঐ ট্যুরিজমের ছোট বিজনেস নিয়ে টানাটানি করে সংসার চালাতাম।”
“আমি তো এটলিস্ট সংসারটা চালাই, একটা সংসার আছে, নিজের বলতে আছে কেউ, তোর তো সংসারটাও নেই। লাইফে কোনটা ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত বোধ থাকলে আজ তোরও সংসার থাকত। তুই তো নিজের বাচ্চাটার সময়ও…”
কাছেই কোথাও টায়ার বার্স্ট করার বীভৎস জোরে একটা শব্দ হল। আর কিছু বলতে পারল না রাজীব। আর কোন কথা কানে ঢুকছিল না ওর, মাথা নীচু করে সামনের লিফ্টের দিকে এগিয়ে গেল ও।
**********
আজ রাতটা নার্সিংহোমেই আছে রাজীব। অমিতের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। পরশুর মধ্যে অপারেশন করতেই হবে। যত খরচই হোক, এইভাবে অমিতকে শেষ হতে দিতে পারবে না ও। অন্যমনস্ক ছিল রাজীব, নন্দিতা কখন একটা চেয়ার ছেড়ে পাশে এসে বসেছে খেয়ালও করেনি। চিরপরিচিত পারফিউমটার গন্ধে ফিরে তাকাতে দেখল ফোনটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে নন্দিতা। চোখে চশমাটা নতুন সংযোজন, আর কালো চুলের ফাঁকে ফাঁকে ইতিউতি রুপোলী আভা। এর বাইরে তেমন কিছু চেঞ্জ হয়নি। আর একটা বদল হয়েছে বটে, কপালের লাল টিপের জায়গাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিন্তু টিপ পড়লে ভারী মিষ্টি লাগত ওর মুখটা। বিয়ের পরের ছবিগুলোতে বিশেষ করে…
ভাবনা থামিয়ে নন্দিতার দিকে সোজাসুজি তাকাল রাজীব।
“তুই রয়ে যেতে গেলি কেন? আমি তো আছিই।”
সেদিনকার পর থেকে দুজনের মধ্যে কোন কথা হয়নি। সুযোগ যে আসেনি তা নয়, কিন্তু বলা আর হয়ে ওঠেনি। আজ এত বছর পর নন্দিতার মুখে নিজের নামটা শুনল রাজীব।
“আরে দীপু বলল রাজীব থাকছে, কিন্তু এখানে অনেকদিন তো ছিলি না তুই, অনেক কিছু বদলে গেছে দোকানপাট। হঠাৎ রাতদুপুরে কোন দরকার পড়লে…”
“তাই আর আমার উপর ভরসা করতে পারলি না বল?” নন্দিতার চোখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল রাজীব।
নন্দিতা যেন খানিক অপ্রস্তুত। চোখটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “ধ্যুর, তা কেন হবে? তুই এতগুলো দিন দেশের বাইরে, ভুলে যাওয়া বা সমস্যায় পড়াটা তো খুব স্বাভাবিক। প্রব্লেম থাকলে বল, চলে যাব?”
এটুকু বলে রাজীবের দিকে তাকিয়ে সেই মিষ্টি হাসিটা হাসল নন্দিতা, যে হাসিটা দেখে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই পাগল হয়েছিল রাজীব।
“আরে না, না, বস, বস…”
আর কিছু বলল না রাজীব। একটা সময় ছিল যখন কথা শেষই হত না। তারপর কথা কমতে লাগল, একসাথে থেকেও সারাদিনে একটি কথাও বলেনি এরকম দিনও গেছে। অশান্তি বাড়তে বাড়তে একটা সময় কাছে থাকার থেকে দূরে থাকাটাই দুজনের জন্য ভাল মনে হয়েছিল তাদের যারা একটা সময় দু’দন্ডও আলাদা থাকতে পারত না। রাজীবের আজ ও মনে আছে দিনটা, 24th August। ঐ দিনই নন্দিতার মিসক্যারেজ হয়, আর রাজীব, নন্দিতার বারংবার অনুরোধ উপেক্ষা করেও নিজের কনফারেন্সে ব্যস্ত ছিল লন্ডনে। কমপ্লিকেটেড প্রেগনেন্সি জানা সত্ত্বেও নন্দিতাকে একা ছেড়ে গেছিল সেদিন রাজীব। জীবনের সবথেকে বড় ভুল হয়ত সেদিনই করেছিল, আর একটা…
“তুই কি খাবি কিছু?”
নন্দিতার প্রশ্নের উত্তরে টনক নড়ল রাজীবের। ছলছলে চোখদুটোকে চশমার কাঁচের আড়ালে সুনিপুনভাবে সামলে রাজীব তাকাল নন্দিতার দিকে।
“তুই আমাকে আজও ক্ষমা করতে পারিসনি বল?”
“আমি? ধ্যুর, কবে করে দিয়েছি। তুই নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছিস তো? তাহলেই হবে। আমার দিকটা মিটে গেছে, চাপ নেই।”
এইটুকু বলে রাজীবের দিকে তাকিয়ে হাসল নন্দিতা, সেই হাসিটা নিছক হাসিই ছিল কি? না তো…আর বলার মত কিছু ছিল না রাজীবের। কি-ই বা বলত? সম্পর্কটা শেষ হওয়ার পিছনে এতদিন তো ও নিজের দিকটা দেখেইনি। বলা ভাল, বসে ভাবার সময়টুকুই খরচ করেনি।
কয়েকমুহূর্তের নীরবতা ভেঙে আবার নন্দিতাই বলল, “প্রণব, দীপু এরা তোর সাথে… মানে মিতালী বলল আমায়… আসলে কি বলতো, ওরা মন থেকে কিছু বলেনি সেটা তুইও জানিস। একটু সময় দে, সব ঠিক হয়ে যাবে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে তো, অনেক কিছু বদলে গেছে। পরিস্থিতি বদলেছে, সময় এগিয়ে গেছে অনেকটা, মানুষগুলোও অনেক বদলে গেছে, তুইও বদলে গেছিস অনেক, তাই না? একটু সময় লাগবে তাই।
“হম। তুই কিন্তু একটুও বদলাসনি। একইরকম।।।”
রাজীবের কথাটা খানিক উপেক্ষা করেই নন্দিতা আবার বলল, “তোর অফিস নেই কাল? এই ক’দিন ধরেও… কিভাবে ম্যানেজ করছিস? এখন কি এখানেই আছিস? ছুটিতে?”
রাজীব মাথা নীচু করেই হেসে ফেলল। এ হাসিটা নিজের উপরেই। মাথা নীচু করেই বলল, “চলে গেছে চাকরিটা।”
“হোয়াট?”
“হ্যাঁহ, এই করোনায় যে হারে মানুষ চাকরি খোয়াচ্ছে, আমিও বাদ যাইনি।”
নন্দিতা চেয়েছিল রাজীবের দিক, কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। রাজীবই বলল আবার, “ভালই হয়েছে চলে গেছে, নয়ত আজও কি কি কেড়ে নিত কে জানে?”
“ভুল বললি। তোর থেকে কিছু কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই, যদি না তুই তাতে সায় দিস।”
“মানে?”
“অবশ্যই, তুই তোর থেকে কেড়ে নিতে দিয়েছিস তাই-ই এটা সম্ভব হয়েছে। তোর প্রায়োরিটিগুলো নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলে আজ কোনভাবেই এগুলো হতে পারত না, তাই না? ক্ষণস্থায়ী জিনিসগুলোকে চিরস্থায়ী ভেবে চিরস্থায়ী জিনিসগুলোকে ক্ষণস্থায়ী তো তুই-ই করেছিস। তোর হাতেই ছিল, তোর চয়েস ছিল, এখন তুই কোনভাবেই আরেকজনকে, বা তোর জবকে, কেরিয়ারকে দোষারোপ করতে পারিস না। তুই প্রায়োরাটাইজ করতে অপারগ, তার দায় তো তোকেই নিতে হবে। খামোখা জবটা কেন নিতে যাবে।।।?”
রাজীব চুপ করে শুনছিল কথাগুলো। সত্যিই তো, আমরা কতজন বুঝি এটা? কাজের দোহাই দিয়ে একটু একটু করে নিজের পরিবার, নিজের বন্ধুবান্ধব, নিজের প্রিয়জন সবার থেকে দূরে সরতে সরতে একটা সময় যখন চারপাশটা তাকিয়ে দেখি, তখন চারপাশে কেউ নেই, একদম একা। অনেকটা সময় পার করে দি এইটা ভাবতে ভাবতে যে রিটায়ারমেন্টের পর এইটা করব, চাকরিটা ছাড়লে এইটার প্ল্যান করব – যেখানে কিনা জানিই না আদৌ অতদিন বাঁচব কি না। জীবনে যে জিনিসগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত না দিয়ে যে জিনিসগুলো আদৌ কাল সাথ দেবে কি না জানি না সেসবের পিছনে মূল্যবান সময় খরচ করি, আর ‘বাঁচার প্ল্যান’টা তোলাই থাকে। বাঁচা আর হয়ে ওঠে না। একটা সময় পর যখন অনেকটা সময় নষ্ট করে বসে আছি তখন দোষারোপ করতে শুরু করি। ব্যস, এর বাইরে আর কি করি?
‘জবস আর টেম্পোরারি, রিলেশনস আর পার্মানেন্ট’ – এই সরল সত্যটা কেন বুঝতে পারি না আমরা? নাকি বুঝতে চাই না, কোনটা? ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে, লাস্ট মিনিট মিটিং পড়ে গেছে রে বলে, ছুটি নিতে পারব না বলে, ফোন করব বলে ফোন না করে, দেখা করব বলে দেখা না করে কাকে ঠকাচ্ছি আমরা? সময়টা তো সেই পেরিয়েই যাচ্ছে।
অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছে ও নিজের দোষেই। বন্ধু, বান্ধব, সম্পর্ক, সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিল যে কারণে, সেই কারণটাই আর ওর জীবনে নেই। কারণটা একদিন না একদিন কিন্তু যাওয়ারই ছিল, রাজীবই সেটা বুঝতে এত সময় নিয়ে নিল। আর যদি বুঝতে তাহলে আজ সব হারিয়ে ১৬০০ স্কয়ারফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হত না। ঘড়ির দিকে তাকাল একবার, একবার নন্দিতার দিকে। রাত ১টা প্রায়। নন্দিতা চোখদুটো বুজে ঘুমোচ্ছে, বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে ওর দিকে তাকিয়েছিল রাজীব। অমিতটাকে সারিয়ে তুলতেই হবে, যে করেই হোক। শুনশান করিডর, নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা, আর একটা দীর্ঘশ্বাস, একটু চোখ বুজল রাজীবও।
।।৪।।
“অমিতের অবস্থা ভালো নয় একদম, অপারেশনটা সাকসেসফুল হবে তো রে? আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল…”
নার্সিংহোমে করিডোরে বসেছিল নন্দিতারা, মিতালীর কথায় ওকে ভরসা দিয়ে হাতদুটো ধরল নন্দিতা।
মিতালী বরাবরই ভীষণ টেনশন করে, ওর মনটা একটু শান্ত করতে নন্দিতা বলল, “তোর মনে আছে অমিতের বিয়েতে আমরা সারাটা রাত বাসর জেগে ভোরবেলা বেরিয়ে এসেছিলাম ওকে না বলে, তাই কি রেগে গেছিল?”
“হ্যাঁ, ও তো বরাবরই খুব নরম স্বভাবের, কেন পি.কে.বি স্যার ওকে ঝাড়বার জন্য যতই চেষ্টা করুন, ওর মুখ দেখে আর কিছুতেই বলতে পারতেন না। অ্যাসাইনমেন্ট আর জমা দিতে হত না আমাদের, ওর জন্য বহুবার বেঁচেছি কিন্তু |আর আমাদের একবার কলেজ থেকে দীঘা ট্রিপটা? সারারাত ওর আবোলতাবোল গল্প, উফফ। মিস দোজ ডেজ ইয়ার…”
“অমিত ফিরুক, আবার ওরকম আড্ডা হবে, বহুদিন হয়নি।”
“কিন্তু চিন্তা অন্য জায়গায়, এই করোনার জন্য যা বিলের স্ট্রাকচার দেখাচ্ছে নার্সিংহোমগুলো… প্রণব গেছে ওর পেমেন্ট আনতে, কিন্তু করোনার জন্য ট্যুরিজমের বিজনেসও… জানি না অ্যাট লাস্ট কি হবে।” বলতে বলতেই ফোনটা বাজল মিতালীর। ফোনের অপর প্রান্তের কথায় মিতালীর মুখে চিন্তার ভাঁজ, নন্দিতার নজর এড়ালো না। ফোনটা রাখার পর নন্দিতার দিকে তাকাল মিতালি, “এখনও আড়াই লাখ মতো কম পড়ছে। অমিতের মেডিক্লেম, আমাদের সেভিংস সব দেওয়ার পরও … এরপরও টাকা ডিপোজিট না করলে তো এবার দুপুরে অপারেশন! অশান্তি করবে তো নার্সিংহোম অথরিটি। কিচ্ছু মাথায় আসছে না আমার।”
মিতালীর কথা শেষ না হতেই দীপু আর প্রণবের গলা পেল ওরা। কথা কাটাকাটি চলছে, আসছে ওদিক থেকে। এদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? নার্সিংহোমের মধ্যে চিৎকার করে কথা বলছে কেন?
“আরে কি হচ্ছে টা কি, আস্তে কথা বল।”
“তুই দীপুকে বোঝা, ভীষণ বাজে কথা বলছে।”
“আরে এখন টাকাটা জোগাড় করাটা বেশি জরুরী, তুই ইগো নিয়ে বসে থাকলে ভুগবে অমিত। এটা কেন বুঝতে চাইছিস না? কোথা থেকে আনব এতগুলো টাকা? এই তো অবস্থা, একটু প্র্যাকটিক্যালি ভাব, ইমোশনালি না ভেবে।”
“ব্যস, হ্যাঁ আমি একাই ইমোশনালি ভাবছি, তোরা নয়। এত বছরে কটা খোঁজ নিয়েছে রাজু, আজ হঠাৎ করে চলে এল আর তোরা গলে গেলি। কত কত ফোন করেছিলাম, সবাই করেছি। যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি, ক’টার উত্তর দিয়েছিল? গোটা পৃথিবীতে কি ও একটাই কাজ করে বলতো? নাকি বিদেশে কেউ থাকে না? ক’দিন তোর ফোনের উত্তর দিয়েছে ও? এতটুকু সেল্ফ রেস্পেক্ট নেই তোদের? আজ ওর টাকা আছে, দয়া করতে চলে এসেছে এতদিন পর, আর নিয়ে নিবি?”
প্রণব মুখরা হলেও কতটা আবেগপ্রবণ সেটা আর কেউ না বুঝুক ওর এই বন্ধুগুলো ভালই জানে, রাজীবও। কথাগুলো বলার সময় ওর চোখ মুখই বলে দিচ্ছে কতটা অভিমান লুকিয়ে আছে চোখ দুটোয়। রাগ আর অভিমানের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে, যেটা সবাই বোঝে না। আর যারা বোঝে, তাদের সাথেই সম্পর্কটা থেকেই যায়, আলাদা করে রাখতে হয় না। পিছন ফিরে তাকাতেই রাজীবকে দেখে একমুহূর্তের জন্য চুপ করে গেল প্রণব। রাজীবও আর একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। প্রণবই বলল আবার, “এই যে এসে গেছেন আমাদের কোটিপতি ক্লাসমেট, বিশ বছর পর এখন দয়া করতে…” আর কথা শেষ হল না প্রণবের। মুহূর্তের মধ্যে প্রণবকে জড়িয়ে ধরে নিল রাজীব! প্রণবেরও আর কিছু বলার ইচ্ছে ছিল কি? না তো, অনেক কষ্ট দিচ্ছিল ও ওর বন্ধুটাকে, জানে ও সেটা।
“ক্ষমা করে দে না ভাই, সব ভুল আমার, কিন্তু ক্লাসমেট বলিস না। আমি জানি আমি অনেক ভুল করেছি, অনেক কষ্ট দিয়েছি তোদের। ঝগড়া কর, মারপিট কর, কিন্তু…”
প্রিয় বন্ধুটাকে জড়িয়ে ধরল বুকে প্রণব , “কোন কথা রাখিস নি তুই ভাই। কত কিছু প্ল্যান করেছিলাম একসাথে, অনেক বদলে গেছিস তুই।” আর কিছু বলতে পারল না ও, চোখদুটো বন্ধ করে নিজের বন্ধুটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েছিল বুকে।
“খুব মিস করতাম তোকে, কিন্তু গর্বও হত খুব। তোর সাকসেসে মাসি মেসোর পর আমাদের থেকে বেশি খুশী আর কেউ হয়নি এটুকু বলতে পারি।”
“জানি, আমি জানি, আর যে যাই করুক, তোরা কখনও আমার খারাপ চাইবি না। অনেক কটা কথা বুঝতে সময় লেগে গেল অনেক। কিন্তু আর কোন ভুল হবে না দেখিস।”
দীপু, মিতালী, নন্দিতা কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। আসলে কিছু জায়গায় কিচ্ছুটি না বলাই ভাল। এসমস্ত জায়গায় কোন শব্দ বিনিময় প্রয়োজন হয় না, অনুভূতিটাই এত জোরালো, হাজার হাজার শব্দও কম পড়ে সেখানে। বন্ধুত্ব মানেই তো তাই, অত ভেবে চিনতে, বুঝে শুনে কথা বলে যেমন ভালবাসা যায় না, তেমনি বন্ধুত্বও হয় না। বন্ধুত্বও তো ভালবাসার এক রূপ। শত ভুল, দোষত্রুটি করলেও বন্ধুটা যতই মুখে যাই বলুক, দিনের শেষে হাতটা ছেড়ে কোথাও যাবে না, পরিস্থিতি যাই হোক। বন্ধু এমন একজন মানুষ, যাকে বেশি কিছু বলতেই লাগে না। মনের না বলা কথাগুলো নিজের থেকেও আগে যখন সেই মানুষটা বুঝে নেয়, তাকেই তো প্রকৃত বন্ধু বলে। আর যাদের সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়, ‘বন্ধুত্ব’ বাঁচানোর জন্য, নাহ, আর যাই বলা যাক তাকে বন্ধু বলা যায় না।
“এক্সকিউজ মি, আপনারা প্লিজ ঐদিকে গিয়ে বসুন।”
সিস্টারের নির্দেশে এতক্ষণে টনক নড়ল ওদের। মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেছিল যেন সেই পুরোন সাদা কালো হয়েও ভীষণ রঙিন, প্রাণবন্ত দিনগুলিতে।
“তোর ব্লগ রোজ ফলো করত প্রণব, এখন এরকম করছে তো? কিন্তু আসলে সব খবর রাখত তোর।”-মিতালী |
“খালি নাটক না? নাটকটা আর গেল না?”-রাজীব |
“তোর সমস্ত আর্টিকেল, ইন্টারভিউ, ব্লগ, তোর যাবতীয় পোস্ট, সবকিছুর খবর আমাদের কাছে আছে, প্রত্যেকের কাছে, নন্দিতার কাছেও…”-দীপু |
নন্দিতার হাসিমুখটার দিকে তাকাল রাজীব, কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলতে পারল না আর। “একজন খুব খারাপ জীবনসঙ্গী হতে পারি, খারাপ প্রেমিক হতে পারি, কিন্তু একজন ভাল বন্ধু, ভাল মানুষ হওয়ার চেষ্টা করব এবার,” কথাগুলো মনে মনেই বলল রাজীব। নন্দিতাও শুনে নিল কি, রাজীবের না বলা কথাগুলো, ঠিক আগের মতন…?
**********
(তিনদিন পর)
“আজ তো অমিতের সাথে দেখা করতে দেবে বলেছে, এখন আউট অফ ডেঞ্জার, এই ডাক্তারের সাথে কথা বলে এলাম,” রিপোর্টসগুলো গোছাতে গোছাতে এল নন্দিতা।
“উফফ, শান্তি এবার। আচ্ছা ভাইলোগ, আমার একটা আইডিয়া আছে। অমিতের সাথে প্রথমে দেখা করতে রাজু যাক। রাজুকে চোখের সামনে দেখে এমনিই ও অর্ধেক জোশ পেয়ে যাবে, ক্যালানোর জন্য!” কথাগুলো বলে নিজের বিখ্যাত উৎকট হাসিটা হাসল দীপু।
“একদম, প্রথমে তো বিশ্বাসই করতে পারবে না। রাজুকে দেখে ওখানেই তড়াক করে উঠে পড়বে। অর্ধেক ওখানেই সুস্থ হয়ে যাবে শালা,আর ওষুধ লাগবে না।” – প্রণব।
“এই সাবধান, অমিত যা পাগল, আনন্দের চোটে মাথাই না ফাটিয়ে দেয় রাজুর! তোদের ফুটবল ম্যাচটার মতন!” -মিতালী।
**********
(দিন কয়েক পর)
আজ অমিতকে ডিসচার্জ করছে নার্সিংহোম থেকে। একটা সুমধুর উপন্যাস যেন শেষের পথে। অনেকটা আনন্দের সাথে একটু মন খারাপও। পড়ে যে তৃপ্তি, যে আনন্দ পায় মন, সেই মনেই লেগে থাকে বিষন্নতার ছোঁয়া…শেষ হয়ে গেল যে। আরেকটু যদি… এই যাত্রাটাও যেন তাই… একদিকে প্রিয় বন্ধুকে সুস্থ করে বাড়ি ফেরার আনন্দ, আরেকদিকে আবার কবে দেখা হবে? একটু যেন মন বিষণ্ণ।
অমিতকে গাড়িতে বসিয়ে দরজাটা বন্ধ করে বাকীদের দিকে তাকাল রাজীব। সবাই এবার যে যার জীবনে, যে যার কাজে, আবার।
“তুই আবার কাজে জয়েন করছিস কবে থেকে? নতুন কোম্পানি তো? -প্রণব |
“নেক্সট উইক কি প্ল্যান তোদের” -রাজীব।
“নাথিং, কেন বলতো” -দীপু।
“ওকে, নেক্সট উইক সানডে তাহলে ওই হারামি টার বাড়িতে মিট করছি আমরা।” -রাজীব।
“ওহো! ডান, ডান। কিন্তু তোর অফিস?”
“ও অমি ম্যানেজ করে নেব। তাহলে নেক্সট উইক দেখা হচ্ছে। অনেকদিন হারামি টার লেগপুল করা হয়নি।”
“আর পরের মাসে তো কলেজ রিইউনিয়নও আছে।”
“সুপার! ডান, আচ্ছা, তাহলে নেক্সট সানডে, হামলা সকাল থেকে। চল বাই |”
“বাই।”
**********
স্টার্ট দিল গাড়ি, এগোল ওরা যে যার গন্তব্যে। সামনের সিগন্যালটায় গাড়িটা দাঁড়াতেই চোখ পড়ল ঝলমলে হোর্ডিংটায়, অনেকগুলো ফোকলা দাদু দিদাদের মিষ্টি প্রাণখোলা হাসির ছবি একটা, পাশে জ্বলজ্বল কাছে শব্দটা, “বন্ধু”।