বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা , অটো, গাড়ি কিছু তো একটা নিতেও হবে।
চুপচাপ বসে বৃষ্টির এই অপরূপ সৌন্দর্য্যই অনুভব করছিল নয়না, ওর ছোট থেকেই বৃষ্টি খুব পছন্দের। আগে বৃষ্টি হলে ওর প্রিয় জানালাতে উঠে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনিই কাটিয়ে দিতে পারতো ও , কিন্তু একটু বড় হওয়ার পর থেকেই বুঝলো ওর সময় সবসময় ওর জন্যই বরাদ্দ থাকবে তা নাও হতে পারে। নিজের পড়াশোনা , ঘরের কাজ , ভাই এর কাজ এই সব কিছু মিলিয়ে নিজের জন্য খুব একটা সময় বের করতে পারতো না ও। তাই প্রথম যখন বাবা হোস্টেল পাঠানোর কথা বলল তখন প্রথমে খুব দুঃখ হলেও মনে মনে এটাও ভেবেছিলো এবার অন্তত নিজের ইচ্ছে মতো সময় কাটানোর সুযোগ পাবে ও। তাই এই কলেজ এ এডমিশন নিতে খুব একটা আর ভাবতে হয়নি ওকে।
আজ বাবা ভর্তি করে দিয়ে চলে যাবে, তারপর ওকে একাই থাকতে হবে এখানে। অনেক বন্ধু হবে , একসাথে ক্লাসে যাওয়া , খাওয়া দাওয়া, ঘোরা ফেরা সে একআলাদাই রোমাঞ্চকর জীবন। পাশের বাড়ির রিনিদি গরমের ছুটিতে যখন বাড়ি এসেছিল কথা হচ্ছিল হোস্টেল লাইফ নিয়ে। সেই সব শুনে উৎসাহে উত্তেজনায় সেদিন বাড়ি ফিরতেই কত দেরি করেছিল ও! মা কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে না গেলে কখন যে গল্প ছেড়ে উঠতো কে জানে।
*****
ওদের টানাটানির সংসারে নয়না , নয়নার দুই ভাই , মা , বাবা সবমিলিয়ে ৫ জন। নয়নাই সবথেকে বড় ভাই বোনেদের মধ্যে, বাকি দুই ভাই ওর থেকে দু তিন বছরের ছোট। দুই ভাই-ই ছোট থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো , দেখতে শুনতেও রাজপুত্রের মতন , নয়না সেই দিক থেকে দেখতে গেলে খুবই সাধারণ , শিক্ষার্থী হিসেবেও , আবার চেহারার দিক দিয়েও। এই নিয়ে ছোট থেকেই কথা শুনেই আসছে ও, মায়ের থেকে, এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
ভাইয়ের ইঞ্জিনিরিংয়ের এডমিশনের জন্য টাকাটা অনেকটাই প্রয়োজন ছিল, তাই অগত্যা ও একবছর পরেই এখানে ভর্তি হলো। বাবারএকার পক্ষে দুজনের জন্য একসাথে এতগুলো টাকা জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছিলো না , যে কোনো একজনকে অপেক্ষা করতেই হতো, আর ওর একবছর দেরিতে ভর্তি হওয়ায় কিছু তেমন যাবে আসবেও না, তাই ও ও আর তেমন কোনো আপত্তি করেনি। সত্যিই তো , ভাই পড়াশোনায় কত্ত ভালো , ইঞ্জিনিরিংএ ভালো কলেজে চান্স পেয়েছে , আগে ওর ভর্তি হবারই কথা। মা যদিও চায়নি ও আর পড়তে বাইরে আসুক , বয়স বেড়ে চলেছে, বিয়ের জন্য মা বেশ চিন্তিত , সম্বন্ধ দেখতেও শুরু করেছে, নেহাত বাবা খুব একটা আমল দেয়না তাই।
বাবার জিদ এর জন্যই তো ওর এখানে পড়তে আসা। বাবা ওকে বোঝে , সঠিক অর্থে বলতে গেলে বাবাই একমাত্র ওকে বোঝে। মার আদর ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য খুব একটা হয়নি , ও যখন ছোট তখন থেকেই ওর মা খুব অসুস্থ থাকতো, নানা অপেরাশনের ধকল বয়ে গেছে মানুষটার শরীরের উপর দিয়ে। ওষুধ পত্রের রাঙতার মোড়কের আওয়াজে, ওষুধের গন্ধে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আর হাজারো টেস্টের মধ্যে দিয়েই কখন ওর শৈশব ফুরিয়ে গেলো বুঝতেই পারেনি। যখন একটু মা সুস্থ হলো , ততদিনে ও বড় হয়ে গেছে, আর বড় হওয়ার সাথে সাথেই সংসারের সমস্ত দায়িত্বও ওর কাঁধেই। দুই ভাই ছোট, পড়াশোনায় তুখোড় , তাদের পড়াশোনায় কোনো বিঘ্ন যাতে না ঘটে তার খেয়াল ওরা সকলেই রাখতো, শুধু ওর বেলায় খেয়াল রাখতেই কি করে জানি সবার ভুল হয়ে যেত। ভাইয়ের পড়া শেষ হলে তবেই সকলে খেতে বসত, ওর পড়া শেষ হলে উঠে এদিক ওদিক কই কাউকে অপেক্ষায় দেখেনি কখনো।
*****
বাবা বাইরে বাইরেই থাকেন বেশিরভাগ সময়ে , সপ্তাহান্তে একবারই বাড়ি ফেরেন , তখন খুব খুশি থাকে মনটা। আদর আহ্লাদ আব্দারের একটাই জায়গা নয়নার, জানে এই খানে এসে আবদার জানালে কখনো খালি হাতে ফিরবে না।
সেই ছোট বয়স থেকে মায়ের কাছে “বড় হয়ে গেছো” শুনতে শুনতে সত্যিই খুব তাড়াতড়ি বড় হয়ে গেছে নয়না , ক্লাস সেভেন থেকেই ৪ জনের রান্না বেশিরভাগটাই একা হাতে সামলাতোে ও। মাঝে মাঝে ওর-ও মায়ের কাছে আহ্লাদী মেয়ের মতন আবদার জানতে মন চাইতো , কিন্তু সুযোগ কোনোদিন হয়নি। বাবা ওর পড়াশোনা নিয়ে যতটাই সিরিয়াস মা ততটাই ওর বিয়ে নিয়ে। তা সে তো হবেই! ওদের গ্রামে বাকি ওর সমবয়সী সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে বা হবে। তো ওকে নিয়ে চিন্তা হওয়া তো স্বাভাবিক। তার উপর রূপসী হলে তাও একটা কথা ছিল , গায়ের রংটা একটু পরিষ্কার , কিন্তু এতই রোগা পাতলা চেহারা যে হাওয়া দিলে উড়ে যাওয়ার উপক্রম। এই তো গত আষাঢ়ে ২৪ পুড়ে ২৫ এ পা দিয়েছে। এখনো ওজন সেই ৪০। শুধু আছে বলতে একঢাল মেঘের মতন কোমর ছাপানো ঘন কালো চুল, আর টানা দীঘল চোখ। ওই জন্যই বাবা সাধ করে নাম রেখেছিলেন নয়না, কিন্তু সেই চোখ দিয়ে হবেই কি, তোবড়ানো গাল আর হাড়গিলে চেহারার জন্য এমনিতেই সবাইকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে ও।
তা এই সব কিছু মিলিয়েই যখন বাবা এই হোস্টেলে আসার জন্য সব ব্যবস্থা করল, ও অন্তত খুব খুশি ছিল। মা খুব একটা খুশি ছিল না ঠিকই, বাবার কথার উপর কথা বলতে পারেনা কি না।
*****
নিজের লেখা ডাইরীটা খুলে স্মৃতিচারণ করছিল নয়না। এই ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেয়ার পর থেকে আর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি , অনেকটা দূর ওর বাড়ি এখান থেকে। ট্রেনে যেতে লাগে প্রায় ঘন্টা পাঁচেক। “একেবারে পুজোর সময় ছুটি পড়লেই না হয় আসবি খন।” এই বলেই বাবা রোজ ফোনটা রাখে। কিন্তু ওর মন যে আর মানছে না। বাবাকে একবার দেখতে বড় ইচ্ছে করছে, এখানে যা ভেবে ও এসেছিল তা তো ও আদৌ পায়নি। না এখানে কেউ কারোর বন্ধু না কেউ কারোর কথা ভাবেও , সবাই নিজের দৌড়ে সামিল, সকলে শুধু নিজেরটা নিয়েই ব্যস্ত। আর সেই ইঁদুর দৌড়ের লড়াইয়ে এন্টারটেইনমেন্ট করতে যখন কোনো কার্টুন সামনে আসে তখন তো আর কথাই নেই। এটাই তো নাম হয়েছে না এখন ওর ? “কার্টুন”!
ও বরাবরই শান্ত , নিজের মতো করে থাকতে ভালোবাসে , ঘর ছেড়ে এখানেও মহানন্দে এই ভেবেই এসেছিলো , নিজের মতো করে থাকবে , কিন্তু এখানে নিজের মতো করে থাকাটা যে লোকে মস্করার চোখে দেখে তা তো ওর জানা ছিল না , কি বললো সেদিন মেয়েটা ওকে? “আনসোশাল “, তাই না? যে হুল্লোড়বাজি করতে পারে সে সোশ্যাল আর যে পারে না সে আনসোশাল, গেয়ো ভূত !
এখানে আধুনিকতার সংজ্ঞা ছোট খাটো পোশাক পরা, কেন ছোট খাটো পোশাক না পরে কেউ আধুনিক হতে পারে না?
সেই দিকে থেকে দেখতে গেলে ও তো সত্যিই গেয়ো ভূত , ওর কোনো ভবিষ্যত নেই , বাবা বৃথাই ওর পিছনে এত টাকা খরচ করছে!
ওর ঘরটা থেকে সামনের মাঠটা পুরো দেখা যায়, ওখানেই চুপচাপ বসেছিল নয়না। কাল রাত থেকে দু চোখের পাতা এক হয়নি। একটা অজানা আতঙ্ক যেন সব সময় ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে, ঘর থেকে বেরোলেই তো আবার অসংখ্য টিপ্পনীর খোঁচায় বিদ্ধ হতে হবে ওকে। ওর চেহারা , ওর গড় গড় করে ইংরেজি না বলতে পারা, ওর অতি সাধারণ পোশাক, ওর শান্ত স্বভাব, ওর সবার সাথে এক লহমায় না মিশে উঠতে পারা এই সব কিছুর জন্য ওকে বারংবার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে , ওকে নিয়ে হাসাহাসি করা হবে আরো একবার। ওর কোনো বন্ধু নেই এখানে, ওর এই একাকী জীবনে হোস্টেলের ঘরে বসে নিশ্চিন্তে দুটো কথা বলার কেউ নেই। ওর স্কুলের দুই প্রিয় বন্ধুও বিয়ে করে সংসারী, সংসারের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে কথা বলার সময় ফুরিয়েছে তাদের। তাই ওর মনের ভিতর যে কি চলছে সে বোঝার, শোনার ,জানার কেউ নেই এই বিশ্ব সংসারে। কেউ এত একাও হতে পারে ?
ও ছোট থেকেই ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসে , হাতের কাজ ওর ভারী সুন্দর , ওর ভালো লাগে এই সব নিয়ে মেতে থাকতে। কিন্তু এই নেশাকেই পেশা হিসেবে ভাবার কথা ভাবতে পারেনি ও কখনো, তার প্রধান কারণ ওর অতি সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম, “এসব ভাবনা বড়লোকরা ভাবতে পারে আমরা নয়।” মা বার বার ওকে এটাই মনে করিয়ে দিতো… তরপর থেকে লুকিয়ে লুকিয়েই এই সব কান্ড কারখানা করতো ও , কাল সারারাত জেগে একটা ছবি এঁকেছে ও। ঠিক যেমনটা ও নিজেকে দেখতে চাইতো, তেমনটাই। একটা মেয়ে , তার খোলা চুল উড়ছে, সমস্ত বন্ধন পেরিয়ে সে আজ স্বাধীন!
*****
বারবার দরজায় টোকা পড়ছে। ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। আজ বেশ বেলা হয়ে গেছে , সেই কখন থেকে বসে বসে আকাশ পাতাল ভেবেই চলেছে। দিদিরা ঘর পরিষ্কার করতে আসেন , ও রোজ আগেই দরজা খোলে, আজ খোলেনি তাই হয়তো বার বার টোকা মারছে। নয়তো ওর ঘরে সাধারণত কেউ আসেনা সেভাবে , তাও আবার সাত সকালে।
।। ২।।
ওদের ক্লাসের মিথিলা সেদিন এসেছিল নয়নার ঘরে, তার আগেরদিন নয়নার সাথে যে বিশ্রী ব্যবহার করেছিল ক্লাসের বাকি ছেলে মেয়েরা, আর চুপ থাকতে পারেনি মিথিলা , বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে আর নয়নার জন্য নয়নার সাথে প্রতিবাদ করতে সেদিন নয়নার দরজায় পৌঁছেছিল মিথিলা। কিন্তু আসতে দেরি হয়ে গেছিল , বন্ধুত্বের হাত যদি একটু আগে বাড়াতো তাহলে হয়তো নয়নার মৃতদেহটা বেরোতো না ২০৩ নম্বর রুম থেকে! জীবনের প্রতি পদে জর্জরিত নয়না সেই কাজটাই করেছিল, যেটা একজন বন্ধু পাশে থাকলে হয়তো আটকানো সম্ভব। যে কোনো নালিশ , অভিমান , অনুযোগ, ঝগড়া সব কিছুর উর্ধে উঠে শুধু পাশে থাকতে পারে, মন দিয়ে কথাগুলো শুনতে পারে, ব্যাস , এটুকুই। এই শোনার লোকই আজকালকার দুনিয়ায় বড় কমে গেছে , সবাই বলতে ব্যস্ত , জাজ করতে ব্যস্ত , শুনতে কারো সময় নেই , পাশে বসার পাশে থাকার সময় কারোর নেই।
*****
এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ আলাদা, প্রত্যেকে তার নিজের মতন করে সম্পূর্ণ, তার মতন করে সুন্দর , শুধু দেখার চোখ থাকা চাই।