||১||
“ঐ দ্যাখ, দ্যাখ, আসছে”, পাশে বসে পিয়ালী বলতেই এক কাঁড়ি খাতার পাহাড় সামলে তাকাল নীরু | নীরু মানে নীহারিকা, এবছর কলেজে ঢুকল | যার আসা নিয়ে এত কথা হচ্ছে সে এই নীরু-রই ক্লাসমেট ওরফে ক্রাশ ইত্যাদি ইত্যাদি | সমুদ্র, সমুদ্র সেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃন্ময় সেন-এর একমাত্র পুত্র, গ্রীক ভাস্কর্যের অধিকারী, এই সুন্দর সুঠাম সুপুরুষটি অনেক ছেলেরই হিংসার কারণ, আর অনেক মেয়েরই রাতের ঘুম কেড়ে নেয় ঐ গভীর ভাবুক চোখদুটো |
নীরু কিছুক্ষন ভেবে তাকিয়েই চোখটা নামিয়ে নিল, যা সম্ভব না, তা ভেবে তো কোন লাভও নেই | ওর খাতা থেকে সব জেরক্স করছিল, ও ওর খাতাগুলো চুপচাপ গুছিয়ে নিতে লাগল, আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরবে |
**************
নীরুর সমুদ্রকে ভাল লেগেছিল কবে থেকে ও নিজেও জানে না, কিন্তু নবীন বরণের দিন যখন ছেলেটা ভাবুক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে নিজের লেখা কবিতাটা পাঠ করেছিল, যেদিন নীরুর কানের থেকে খুলে যাওয়া ঝুমকোটা ঐ ছেলেটাই ফেরত দিয়েছিল ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে, ধক করে উঠেছিল নীরুর হৃৎপিন্ডটা | লোহিত কণিকাগুলো যেন শিরা বেয়ে আলোর থেকেও দ্রুত বেগে ঝড় তুলেছিল | ঐ গ্রীক ভাস্কর্যের অধিকারী সুপুরুষকে কবে মন দিতে শুরু করেছিল নীরু, ওর জানা নেই |
কাল যখন প্র্যাক্টিকাল ক্লাসের পার্টনার ভাগ হচ্ছিল, নীরুর পড়ল সমুদ্র-র সাথে | আজ থেকে এই সমুদ্রের সাথেই প্র্যাক্টিকাল গুলো করতে হবে ওকে | ঝড় উঠছিল ভিতরে আবার, কিন্তু, তারপর-ই সমস্ত ভাললাগা-গুলোর অনুভূতি হারিয়ে যায় যখন চরম বাস্তবটা চোখের সামনে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে |
“কী রে চল ক্লাস স্টার্ট হবে”- নিজের ভাবনায় ছেদ টেনে বান্ধবীর ডাকে সাড়া দিয়ে আপাতত পি.কে.বি-র ক্লাসে হাঁটা লাগল নীরু |
||২||
জেদী, একরোখা, উদ্ধত, এই সব কটা বিশেষণই মোটামুটি সমুদ্র-র সাথে যায় | আজ প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে গ্রূপ ভাগ হওয়ার পর থেকেই কে জানে কেন সমুদ্র-র মন থেকে একটা ছবি কিছুতেই সরছে না | ফেসবুক খুলে নীহারিকার ডিপি টা বেশ খানিক ক্ষণ তাকিয়ে দেখছিল সমুদ্র, কখন যে চোখ লেগে গেছে নিজেই বুঝতে পারেনি | ঘুম যখন ভাঙল, মায়ের ডাকে খেতে যাওয়ার সময় হাতে তখনও ফোনটায় জ্বল জ্বল করছে সেই রহস্যময়ীর ছবি | সমুদ্র-র মন থেকে সেই ছবি সরছে না, নাকী সমুদ্রই সরাতে চাইছে না তা ওর-ও অজানা, শুধু কাল কলেজে আবার কখন তাকে দেখবে এরকম অনুভুতিটা মনে জমাট বাঁধছিল |
(বেশ কিছুদিন পর)
সময় নিজের নিয়মে প্রবহমান | নীরুর প্রতি সমুদ্রের আবেগটা বেড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু নীরুর দিক থেকে কোনদিন কোন প্রত্যুত্তর পাচ্ছিল না, তাই মনে মনে রক্তক্ষরণটা বেড়েই যাচ্ছিল | নীরু জানত সমুদ্রের ওকে হুট ভাল লাগে, কিন্তু সবটা জানার পর ভালবাসা সম্ভব না, কিন্তু তাও, নিজের আবেগকে আটকে রাখে কার সাধ্যি? প্র্যাক্টিকাল ক্লাস করতে করতে চোখে চোখ, প্রয়োজনীয় কথার মাঝেই তার দিকে একবার মন ভরে দেখে নেওয়া, কাজের মধ্যে তার হাতের স্পর্শ এসব কিছুর মধ্যেই না চাইতেও সমুদ্রকে না ভালবেসে পারছিল না নীরু |
***************
সমুদ্র বরাবরই একরোখা | নীরুর প্রতি তীব্র আকর্ষণই ওর মধ্যে জিদ-এর সৃষ্টি করেছিল | নীরু সমুদ্রকে ভালবাসে কী না, তার হদিশ নীরু জানতে দেয়নি সমুদ্রকে, কিন্তু তা না জেনেই সমুদ্র নীরুকে নিজের মনের কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল | সেদিন সকাল থেকেই আকাশটা মেঘে ঢাকা, যেন খারাপ কিছু ঘটার আগের অশনি সংকেত, খুব বৃষ্টির জন্য সেদিন কলেজ থেকে বেরতে অনেকটা সন্ধ্যে নেমে গেছে, আর জলও জমেছিল ইতিউতি তাই বাসের সংখ্যাও কমে গেছল | নীরু খুব তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল, হঠাৎই কেউ পিছন থেকে ওর হাতটা চেপে ধরে, ভয়ে শিউরে উঠেছিল নীরু | কিন্তু স্পর্শটা যেন খুব চেনা, পিছন ফিরে তাকিয়েই দেখে সমুদ্রকে | যেন সে আজ এক অন্য মানুষ, চোখের ভাষা, যেন অন্য এক ইঙ্গিত চাহনিতে | নীরু হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও যেন হারতে চাইছিল সমুদ্রর সামনে | বর্ষাস্নাত দুটো মনও প্রেমের বাঁধনে আবদ্ধ হচ্ছিল হয়তো, একদৃষ্টে তাকিয়েছিল দুজন দুজনের দিকে, তিরতির করে কাঁপছিল ঠোঁট দুটো খুব কাছাকাছি | নীরুর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে সমুদ্র বলল,”ভালবাসি” | যে শব্দটা শোনার জন্য আকুল ছিল নীরুর মনটা, কিন্তু না, নীরু তার ভালবাসার কথা পারছিল না নিজের প্রিয় মানুষটাকে জানাতে |
এতদূর বলে চোখটা খুললেন নীহারিকা দেবী, ‘আলো’ নামের NGO -র কর্ত্রী | সামনে বসা তার আদরের মিঠুকে চোখ বুজে শোনাচ্ছিলেন একটা ধুলোপড়া অসম্পূর্ণ প্রেম কাহিনী, যেটা শুধু নীরুর তরফ থেকেই ছিল | নিজের মনের জিজ্ঞাসাকে চাপনে না পেরে মিঠু প্রশ্ন করল,”কিন্তু মামনি, তুমি না করলে কেন সমুদ্রকে? সমুদ্রও তো তোমায় ভালবাসতো |”
হাসলেন নীহারিকা দেবী, মিঠুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ভালবাসা না রে, ওর মনে হতো ওটা ভালবাসা, সত্যি ভালবাসলে আমার বংশ পরিচয় জেনে ঘেন্নায় সরাতে পারতো না রে | আমিও তো তোকে কত ভালবাসি, সরিয়েছি কী? তোর বাবার মতো |”
-“মানে?”
মিঠুর চোখের অবাক দৃষ্টি দেখে নীহারিকা দেবী বললেন,”রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিল আমায় আমার মণিমা, মানুষটা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা ছিল, পুংলিঙ্গ বা স্ত্রীলিঙ্গের গন্ডির বাইরে, এইটাই আমার ‘অপরাধ’ ছিল | যা আমার হাতে নয়, তা কীভাবে আমার অপরাধ হয়? তারপর কেটে গেছিল অনেকদিন, কিন্তু ভগবানের কী লীলা দেখ, সেই বাবার কোলেই তুই এলি, মা-কে জন্মের সময় হারালি, তোকে আমি আর কাছ ছাড়া করিনি, তোর বাবাও তোকে ত্যাগ করতেই নিয়ে এসেছিল এখানে, ছেলে বা মেয়ে নোস বলে | সে তার কৃতকর্মের শাস্তি তো পেয়েই গেল, শুধু শেষদিন তোর বাবার অবনত চোখ আর নতমস্তক দেখে খুব করুণা হচ্ছিল মানুষটার ওপর |”
মিঠু ওর মামণির কোল ঘেঁষে বলল,”তার মানে…|”
-“হুম, মিঃ সমুদ্র সেনই তোর জন্মদাতা বাবা | না অনেক গল্প হলো ওঠ এবার |”
এক পশলা বৃষ্টি শেষে তখন পূব আকাশে লাল আভা |