ক্লিক

।।১।।

-“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ?

-“ম্যাম, সকাল ১১টা।”

-“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?”

-“ইয়েস ম্যাম।”

-“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।”

টেবিল থেকে ফোনটা তুলে কানে দিল শিবানী। চোখের ইশারায় মালিনীকে এখন যেতে বলল। মালিনী বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ হতে ফোনে কথা বলা শুরু করল ও। বহুদিন পর এই নাম্বার থেকে ফোন, তাই খানিক ইতস্ত করছিল বৈকি।

অফিসে ওর কেবিন থেকে গোটা শহরটা দেখা যায়। আঁধার নেমে গেছে ততক্ষণে। লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো ও কথা বলার জন্য। দেওয়ালেরও কান আছে। আর ও ওর পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কোনদিনই স্বচ্ছন্দ নয়। মালিনী ওর একদম পাশের ঘরেই বসে, তাই ব্যালকনিটাই ঠিক আছে। 

“হ্যাঁ দাদা বল,” বহুদিন পর এই দাদা শব্দটা উচ্চারণ করল ও। ওপাশের মানুষটার কথা শুনে তখন ওর মুখ চোখের অভিব্যক্তি বদলাতে শুরু করেছে। অফিসের ঘড়ি তখন জানান দিচ্ছে সন্ধ্যা ৬:৩০টা প্রায়।

*****

-“হ্যালো, হুম, কেবিনে এস।”

ভীষণ রেস্টলেস লাগছে ওর। হাতের কাছে জিনিসপত্র তাড়াতাড়ি গোছাতে শুরু করেছে ততক্ষণে। ড্রাইভারকে ইতিমধ্যে ইনফর্ম করে দিয়েছে। উফফ, মালিনীর আসতে এত দেরী হয় কেন?”

-“ইয়েস ম্যাম।”

-“শোনো, আমার আপকামিং যত মিটিং আছে, যা কিছু আছে শিডিউল, সব পোস্টপন্ড করে দাও, এভরিথিং।”

-“হোয়াট? না মানে ম্যাম, হঠাৎ? এই ক্লায়েন্টের সাথে অনেকদিন ধরে আসলে।।।”

-“যা বললাম করো, এক্ষুণি।”

-“ও – ওকে ম্যাম।”

-“আর খুব দরকার না হলে আমায় ফোন করবে না। আমি এখন কিছুদিন অফিস আসব না। গুডনাইট।”

কথাগুলো কোনোরকমে জানিয়ে ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল শিবানী। মালিনী তখনও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। যে মানুষটাকে জীবনে কোনদিন ছুটি নিতে দেখেনি ও, সে আজ।।। নীচে গাড়ি স্টার্ট দিল ততক্ষণে।

*****

-“হ্যাঁ, পরাগ, ফ্লাইটের টিকিটটা দেখলে?”

-“হ্যাঁ ম্যাম, কিন্তু, রাত ২:৩০টে একটা আছে, ওটা ব্রেক করে যেতে হবে। এখান থেকে দিল্লী দেন কলকাতা।”

-“আর কিছু নেই?”

-“না ম্যাম, আর তো।।।”

-“ওকে, বুক করে আমায় পাঠাও।”

-“ওকে।”

ফোনটা রেখে কাঁচ দিয়ে ব্যস্ত শহরটার দিকে তাকাল শিবানী। বাড়ি কতক্ষণে পৌঁছবে এই ভেবে বারবার ঘড়িটা দেখছিল ও। ওদিকের ফুটপাথে একটা দোকানের সামনে বাবার সাথে ছোট্ট মেয়েটা বেলুন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর একহাতে সম্ভবত চকলেট, সেটা গলে গিয়ে একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছে। বাবা সযত্নে মেয়ের মুখ হাত পরিষ্কার করে দিচ্ছে দোকান থেকে জল নিয়ে। ট্রাফিকে দাঁড়ানো শিবানীর গাড়িটা ছেড়ে দিল তখনই। গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিয়েছে। শিবানী একদৃষ্টে সেই মুহূর্তটার দিকেই তাকিয়েছিল। মুখ ঘুরিয়ে দেখছিল যতক্ষণ দৃষ্টি যায়। ওর অজান্তেই আজ বহুদিন পর চোখ ঝাপসা।

*****

-“ঝিমলি, তুমি কিন্তু একদম ক্যান্টিনের খাবার খাবে না।”

-“বাপি, নতুন খুলেছে ক্যান্টিন, খুব ভিড় হয়। মাসিটা কত কী নিয়ে আসে। সবাই তো খায়, ঘুগনি, আলুরদম, চপ, কাটলেট।।।”

-“বাপি তো তোমার ভালোর জন্যই যা বলার বলছে, খাবে না একদম।”

-“আচ্ছা।”

-“আর নাচের মিসকে বলে দেবে যে তুমি এই নাচটা পারবে না। আর তুমি তো নাচ শেখোওনি কখনো।

-“কিন্তু বাবা…”

-“নাচের জন্য কতরকম পোশাক লাগে তুমি জানো তো মা। তোমার বাবার কী সেই সামর্থ্য আছে? একটু তো বুঝতে হবে মা। বিজনেসটা একটু দাঁড়িয়ে যাক, তারপর আর বাপি বারণ করবে না।”

-“ওককে বাপি। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা দাও, ঘন্টা পড়ছে প্রেয়ারের।”

-“সাবধানে যাবে সোনা মা, টাটা।”

-“টাটা বাপি। টাটা।

*****

-“ম্যাম, ম্যাম… ম্যাম শুনছেন।”

-“হুঁ… হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

-“ম্যাম এসে গেছে আপনার এপার্টমেন্ট।”

-“ওহ, ওকে। আসলে একটু… ঠিক আছে। তুমি তাহলে চলে এসো রাত্রে, দেরী করো না। এখন তো আরো আগেই চেক-ইন করতে হচ্ছে।

-“ওকে ম্যাম।”

গাড়িটা পার্ক করে চলে গেল ছেলেটা। সবে মাস চারেক হলো ঢুকেছে কাজে। রহিম চাচার চলে যাওয়ার পর। আর না দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাটের দিকে এগোল শিবানী।

।।২।।

-“ঝিমলি, তোমায় কতবার বলেছি না এভাবে মারপিট, ঝগড়া করবে না। হলো তো আজ, হলো তো গার্জেন কল। ভালোলাগল বাপিকে মিস কত কী শোনাল।”

-“সরি বাপি, ঐ মেয়েটা খুব বাজে। উল্টোপাল্টা কথা বলছিল সবার বাবা মাকে নিয়ে। ঐজন্য তো ওকে রাসটিকেট করে দিলো। এর আগেও ও অনেক এরকম করেছে। রেজাল্টে ওর বাপির সাইন নকল করে এনেছে। আর বলেছে বাপি অসুস্থ। ও খুব বাজে গো।”

-“আহ, ঝিমলি, কাউকে ভাল খারাপ বলার আমরা কেউ নই। প্রশ্ন হচ্ছে তুমি যখন জানো, তুমি নিজেকে সরিয়ে নিলে না কেন? তোমার প্রতিটা কাজে তোমার মা বাবার সম্মান জড়িয়ে আছে, এটা সবসময় মনে রাখবে। আর কেউ এসে কিছু একটা বলে দিল আর অমনি সেটা হয়ে গেল তা হয় নাকী। ওহ, আবার কাঁদছো কেন? আমি তো বোঝাচ্ছি। তুমি তো লক্ষী মেয়ে, সব কথা শোনো, তবে?”

-“কেউ তোমার নামে কিছু বললে আমি পারবো না চুপ থাকতে।”

-“আবার কাঁদে! আচ্ছা ঐ ক্যাডবেরিটা চাই? তাহলে চোখ মোছো।”

-“হু, সরি বাপি।”

-“হুম, চলো, চলো।”

*****

“লেডিস এন্ড জেন্টেলমেন অ্যাটেনশন প্লিজ।।।”

ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্টে টনক নড়ল শিবানীর। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই টেক অফ করবে। বড্ড অবসন্ন লাগছে, কিন্তু চোখে একটুও তন্দ্রা নেই। সিট বেল্ট পরে নিয়েছে। অন্যমনস্কভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল ও। হঠাৎই পাশে একজনের ডাকে একটু চমকে উঠল তাই।

-“আপনিই শিবানী রয়, রাইট?”

-“হ্যাঁ,” স্মিত হেসে উত্তর দিল ও।

-“ম্যাম, অ্যাম ইওর বিগ ফ্যান। ভাবিনি এভাবে কখনো দেখা হবে আপনার সাথে। এক মিনিট।।।” বলেই ব্যাগ থেকে নোটবুকটা বের করে সামনে এগিয়ে দিল ওর, “প্লিজ ম্যাম একটা অটোগ্রাফ।”

-“হুম, সিওর। আপনার নাম?”

-“রঞ্জন।”

নামটা কানে যেতেই ধড়াস করে উঠল শিবানীর বুকটা।

*****

-“আরে আমি বলছি ছাড়। আমি পারব, তুই কী সবদিন থাকবি আমার লাগেজ বইবার জন্য। ছাড় না রানা।”

-“আরে চল না, দেখতে পেলাম তাই এলাম।”

-“তুই হঠাৎ স্টেশনের সামনে কী করছিস আজকাল?”

-“না, মানে ইয়ে…”

-“ঢপটা দিতে যখন পারিস না, দিস কেন বলতো?”

-“যাক অনেক বকেছিস, ওঠ বাইকে। পল্টুদা তোর লাগেজ পৌঁছে দেবে।”

-“উফফ, রয়েল ট্রিটমেন্ট তো পুরো।।।”

-“ঠিক করে বসেছিস? স্টার্ট দি?”

-“হুঁ।”

-“বসন্তদার দোকান থেকে কিনবি কিছু?”

-“নাহ।”

-“আরে ছাড়, জিলিপি যার ফেভারিট, সে গরম গরম জিলিপি ভাজা দেখেও বলছে না ! এত সংযমী হলে ঠাকুর পাপ দেয়।”

-“কী করবো? তোর মতো হিরোর পাশে হীনমন্যতা আরো বেড়ে যায় বৈকি ।”

-“থাক, আর বকতে হবে না। চল এসে গেছে বাড়ি।”

-“থ্যাংকস।”

-“বিশাল এটিকেট শিখে গেছিস তো রে।।। আচ্ছা নে এটা সোনাদাকে দিয়ে দিস।”

-“এটা আবার কী? ছোড়দা আবার শরদিন্দু অমনিবাস কবে থেকে পড়তে শুরু করল?”

-“নে নে ধর। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।” ঝিমলিকে নামিয়ে দিয়েই হঠাৎ করেই ভীষণ তাড়ায় বাইক চালিয়ে বেরিয়ে গেল রানা, রঞ্জন গুহ। ছোড়দার বন্ধু। ছোড়দা মানে ঝিমলির জ্যাঠার ছোট ছেলে। সম্পর্কে দাদা হলেও বয়সের ফারাক মোটে আট মাস। তার বন্ধু, তাই ছোট থেকেই তুই তোকারিটাই চলে ওদের। ঝিমলি বইটা এদিক ওদিক দেখে, বাড়ির দিকে এগোল। 

*****

কলকাতা থেকে ফিরলে এখানে খাতির আলাদা রকমেরই হয়। ওদের বাড়ির কেউ এর আগে কলকাতায় কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায় নি। তাই ঝিমলির যখন প্রথম নাম বেরোল লিস্টে, বাবা সবথেকে বেশী খুশী হয়েছিল সেদিন। মুখে বলেনি বটে, কিন্তু বাবার মুখের হাসিই সব বলে দিয়েছিল সেদিন। ঝিমলির যে কলকাতায় পড়ার বিশাল ক্রেজ ছিল তা কোনদিনই নয়। বাড়ি থেকে এত দূরে যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল না ওর। কিন্তু বাবার ইচ্ছেকে অবহেলা ঝিমলি কোনদিনই করেনি। বাবাকে কোনদিনও ঝিমলিকে কিছু বলতে হয়েছে তাও নয়, কোন একটা অব্যক্ত বোঝাপড়া ছিল বাপ মেয়ের মধ্যে, সবাই বলতোও সেটা। বাবার মনের কথা বুঝে নিয়ে ঝিমলি যেমন সবদিনই চেষ্টা করত, কীভাবে সবার সামনে বাবার মাথা উঁচু করা যায়, মানুষটাকে গর্বিত করা যায়, বাবাও তাই, ঝিমলির আগেই বুঝে যেত কোনটা ঠিক ওর জন্য। ঝিমলির বাপির  বাড়ি ফিরতে দুপুর ২টো হয় প্রায়। আগের বিজনেসটার পর এই বিজনেসটা খুব ভালোভাবে দাঁড়িয়ে গেছে, কিন্তু বাপির খাটনি ভীষনরকম বেড়ে গেছে। ঝিমলি বোঝে সেটা। তবু ঝিমলি আসলেই বাপিই যাবে স্টেশনে আনতে। আজ নেহাত বাবার খুব কাছের একজন বন্ধু অসুস্থ, হসপিটালে গেছে, কোনো উপায় ছিল না আর তাই। ঘরে ঢুকে বইটা টেবিলে রেখে নিজের খাটটায় একবার বসল ঝিমলি। সামনেই সামার ট্রেনিং, ও এবারে সবটা বলে দেবে। ও বলবে যে কীভাবে ওর শয়নে স্বপনে ওর প্যাশন, ওর ভালবাসা,জড়িয়ে যাচ্ছে রোজ একটু  একটু করে, যা এতদিন ও জানতোই না। হাতে ছোড়দাভাই -এর ক্যামেরাটা না পেলে ও কোনদিনই বুঝত না আসলে ও কী চায়। ছোট থেকেই ওর মাথায় এটাই গেঁথেছিল যে যা করার পড়াশোনা করেই করতে হবে। কিন্তু এখন ওর এটাই মনে হয়, যার জন্য দিনরাত এক করে খাটলেও কোন কষ্টই বোঝায় না সেটাকেই যদি পেশা করা যায়? কেন নয়? ও যেন বাড়তি অক্সিজেন পেয়ে যায় ক্যামেরাটা হাতে পেলে। এই ইন্টার্নশিপের পর টাকাটা পেলে ওটা দিয়ে একটা ভাল ক্যামেরা কিনবে ও ভেবেই রেখেছে। যেখানে সবাই ঠান্ডা ঘরে বসে কাজ পেতে ব্যস্ত, সেখানে ওর ইচ্ছে বনে জঙ্গলে ঘুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য, বন্য প্রাণীগুলোকে ক্যামেরায় ধরার।

না এতে ওর কোন ক্লান্তি নেই, উপরন্তু এক অনাবিল মুক্তির আনন্দ পায় যেন ও। এবারেই কথা বলতে হবে বাপির সাথে, ভাবতে ভাবতেই বইটা নিয়ে অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করছিল ও। তখনই বেরোল কাগজটা।

*****

প্রবল ঝাঁকুনিতে চোখটা খুলে গেল শিবানীর। ল্যান্ড করবে এবার ফ্লাইট। হাত ঘড়িটা দেখল একবার। এসে গেছে। আবার আর একটা ফ্লাইট। তারপর সেখান থেকে গাড়ি, পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে আর একটু হিসেবে কষে নিল মনে মনে। এক একটা মিনিট যেন এক একটা যুগ মনে হচ্ছে ওর। আচ্ছা, ওর জন্য কী সবাই অপেক্ষা করছে? একটা ফোন করবে নেমে? নাহ, থাক। ডেটটা হঠাৎই চোখ পড়ল, এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। 28th June, আর দুদিন পরই ওর জন্মদিন, আর ঐ দিনই… জোর করে নিজের ভাবনায় দাঁড়ি টানলো শিবানী।

*****

-“কীরে, হঠাৎ জরুরী তলব?”

চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে রীতিমত টেনশনে আছে। ঝিমলিদের বাড়িটা মেন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, বেশ অনেকটা জমির উপর, প্রায় ১০০ বছর হতে চলল, ঝিমলিদের ঠাকুরদার আমলের, পুরোনো কালের বাড়ি। চারপাশের জমি নিয়ে বেশ বড়সড় বাগানেই বলা চলে। এই বাগানেই ছোটবেলায় ওরা ভাইবোন মিলে একটা দোলনা লাগিয়েছিল। সেটা এখনও আছে। ওখানেই আজ রানাকে ডেকে পাঠিয়েছে ঝিমলি।

সোনাদার বন্ধুর সুবাদে, আর ঝিমলির বাবা জ্যাঠাদের সাথে পারিবারিক বন্ধুত্বের সুবাদে এই বাড়িতে রানার অবাধ যাতায়াত। সে ঠাকুমার ঘরে বসে গল্প শোনাই হোক, বা ছাদ থেকে আচার চুরিই হোক, বা শীতকালে পিকনিকের সময় একসাথে রান্নাবান্নাই হোক, সবসময় রানা থাকেই। রানা নিজের ঠাকুমাকে দেখেনি, তাই ঝিমলির ঠাকুমাও দায়িত্ব নিয়ে আদর যত্নে ভালোমতো মাথায় তুলেছে ওকে। তাই এমতাবস্থায়, এভাবে লুকিয়ে বাগানের মধ্যে ওর টেনশন হচ্ছিল ভীষণ।

-“এটা কী রানা?” কাগজটা রানার চোখের সামনে ধরে প্রশ্ন করল ঝিমলি।

কাগজটার দিকে চোখ পড়তেই রানা বুঝল ব্যাপারটা। তার মানে কী ঝিমলি…ও কী ওকে অপমান করতে এখানে ডেকেছে? না না, ঝিমলি ওরকম মেয়েই নয়। তাহলে কী ওরই বুঝতে ভুল হলো? পুরোটাই কী একতরফা? এইগুলো বলতেই কী তার মানে ও ওকে ডেকেছে? ঝিমলিকে কিছু বলতে না দিয়েই ফস করে বলে উঠল ও, “তোর উত্তর হ্যাঁ বা না যাই হোক, তাতে আমার তোর প্রতি অনুভুতিটা বদলাবে না। আমি তোর কাছে কিছু জানতে চাইনি, শুধু নিজের কথাটা জানিয়েছি। তোকেও যে হ্যাঁ বলতেই হবে।।।”

কী যে ভর করেছিল কে জানে, যে ছেলেটা বরাবরের শান্ত স্বভাবের, যে ছেলেটা ঝিমলিকে কোনদিন আদৌ বলতে পারবে না ভেবে সেই স্কুলবেলা থেকে নিজের অনুভূতিগুলো সযত্নে আড়াল করে রেখেছিল, সেই আজ নিজের মনের মধ্যে চলা প্রতিটা দ্বন্দ্ব, প্রতিটা আলোড়ন কী অবলীলায় রেখে দিল ঝিমলির সামনে। কোন প্রত্যাশা ছাড়াই যে ছেলেটা ঝিমলির শৈশব,কৈশোর, সদ্য যৌবনের প্রতিটি ধাপে, সেভাবেই তাকে ভালোবেসে গেছে, শ্রদ্ধা করে গেছে, সে আজ অকপটে সবটা, সমস্ত মুহূর্তগুলো বলে দিল ঝিমলির সামনে। এই ভালোবাসা এড়াবার ক্ষমতা কী আছে কারো?

বিকেল নামছে, ঝিমলিদের বাড়ি সন্ধ্যে দিচ্ছে জ্যেঠিমা, শাঁখের শব্দে যেন নিজেকে থামাল রানা। রানাকে কষ্ট দিতে চায়নি ঝিমলিও, দুর্বলতা যে ঝিমলিরও নেই তা ও কীভাবে অস্বীকার করবে। কিন্তু সবার জন্য সব না। কিছু পেতে গেলে কিছু তো দিতেও হয়।

-“এই সম্পর্কটার কী পরিণতি রানা? আমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে তোর জীবনটা নষ্ট করিস না। তোকে কষ্ট দিতে পারব না আমি। এই সংসার, বিয়ে, এসবের মাঝে নিজেকে বাঁধতে পারব না রে আমি। একটা ঘরোয়া বউ-এর মতো চার দেওয়ালের মাঝে কাটিয়ে দিতে পারবো না আমি সারা জীবনটা। এই সম্পর্কটার কোন ভবিষ্যৎ নেই। নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না। আমি তোর জন্য সঠিক নই।”

কথাগুলো বলে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায় সেদিন ঝিমলি। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া রানা সেদিন কতটা বুঝেছিল ঝিমলির কথাগুলো জানা নেই। কিন্তু সম্পর্কটা কোনভাবে হয়েই গেছিল। বারংবার বাধা দেবার পর ঝিমলিও আর এড়াতে পারেনি রানাকে। ওদের নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্কে সযত্নে জুড়ে গেছিল আর একটা পালক, প্রেমের।

।।৩।।

এয়ারপোর্টে নেমে গাড়িতে উঠে রওনা দিল যখন, তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে। বহুদিন পর আবার কলকাতার রাস্তা। পুরোনো স্মৃতিগুলো ভিড় করছিল চোখে। এই সামনের রাস্তাটা বাঁক নিতেই একটা বড় দোকান ছিল, স্যান্ডউইচ, চা, কফি, টোস্টের। এখন আর নেই। ওখানে একটা ছোট সোনার দোকান হয়ে গেছে। এই যে এই খানটায় টিউশন পড়তে আসতো ও, পাশেই কচুরীর দোকানটা আছে এখনও। কত আড্ডা মেরেছে এখানে ওরা সব। হু হু করে এগোচ্ছিল গাড়ি। এইসবের মাঝেই মনে উঁকি দিচ্ছিল খানিক অস্বস্তিও, এত বছর পর, কত যেন? ১৮ বছর পর নিজের বাড়ি ফিরছে ও। মনের মধ্যেকার দ্বন্দ্বটা কাউকে বলবার, বোঝাবার উপায়ও নেই। কিভাবে ফেস করবে ও? আবার যদি… আর ভাবতে পারছে না এত। কতদিন পর সবাইকে দেখবে! কত বদলে গেছে হয়তো সব। চেনাই যাবে না হয়তো। মনের মধ্যে অজস্র এলোমেলো চিন্তাগুলো নিয়ে জানলায় দিকে চেয়ে বসেছিল শিবানী। শিবানী রয়, রায়বাড়ির ছোট মেয়ে, একসময় ঐ বাড়ির সকলের আদরের ঝিমলি।

*****

সামনের বাগানটা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে একটা লম্বা শ্বাস নিল শিবানী, সবার ঝিমলি। থমকে গেছে যেন সবটা। ওকে আসতে দেখে সাবিত্রী মাসি এগিয়ে এল। কত বয়স হয়ে গেছে মানুষটার। শুধুমাত্র মা আর ছোড়দাভাই-এর সাথে কথা হতো ওর। চোখটাও তাই তাদেরই খুঁজছিল। নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকাটাই এতটা অস্বস্তির হবে স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন।

সবার চোখের আড়ালে মা আর ছোড়দার  সাথে ভিডিও কল হতো, তাই সামনে থেকে ছোড়দাকে দেখে মেলাতে চেষ্টা করছিল ও। হাঁ করে তাকিয়েছিল শুধু। 

-“দাঁড়িয়েই থাকবি না ভিতরে যাবি?”

-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, চল।”

বাড়ির রঙ থেকে শুরু করে ঘরের পর্দা, সামনের সিঁড়ির বাঁধানো মা কালীর ছবিটা থেকে শুরু করে প্রতিটা ঘর, কত্ত বদলে গেছে সবকিছু। সবটাই বদলে গেছে যেন, কিন্তু… কিন্তু… বারান্দা দিয়ে চলতে চলতেই চোখ পড়ল দেওয়ালে বাঁধানো ছবিটায়। সেলাই করে বাঁধানো হয়েছিল। ওর স্কুলের হাতের কাজ। ঝিমলিরই বানানো। ওটা সেই এক জায়গাতেই আছে। তারপর ওর পাশ করার পর এখানকার ঐ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ছবি। মা-র বহু বারণ সত্ত্বেও বাবা ওটা পূবদিকের বারান্দাটার মাঝেই টাঙিয়েছিলেন। ওটা এখনও ওখানেই আছে। কিন্তু বাড়ির বাকী সব লোক কোথায়? চোখ দুটো খুঁজছিল সারাক্ষণ। ঐ যে জ্যেঠু, বড়দা, ওই ঘরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাশ থেকে ছোড়দা বলল, “ডাক্তারবাবু এসেছেন তো তাই সব ওই ঘরেই আছে।”

-“এত সকাল সকাল ডাক্তার?”

-“আরে সুবীর জ্যেঠু। মনে আছে তোর?”

মনে পড়লো বটে। হ্যাঁ ছিল তো মানুষটা। এখানকার খুব ভাল হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। একটু সর্দি কাশি জ্বর হলেই ঝিমলিকে বাপি নিয়ে যেত। খুব স্নেহ করতেন সুবীর জ্যেঠু। ওর ভাবনায় দাঁড়ি টেনে ছোড়দাই বলল আবার, “ওনারই ছেলে। খুব ভাল ডাক্তার এখন এখানকার, ও বলেই এলো, নয়তো এখন।।।”

-“আমি একবার যাবো?”

-“হ্যাঁ, চল না, কেন যাবি না?”

ছোড়দার সাথে ঘরটার দিকে এগোল ওরা, একটু কী অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যাচ্ছে সেদিনকার ডাকাবুকো মেয়েটা? এটা তো নিজেরই বাড়ি, সবাই নিজেরই লোক, তবে? ঘরে ঢুকতেই অনেকগুলো মুখ এলো চোখের সামনে, যাদের সাথে এতগুলো বছর কোন যোগাযোগ, কোন কথা নেই, দু তরফ থেকেই। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল ঝিমলির, মাকে খুঁজছিল চোখটা। ঐ তো মা। মেয়েকে এতদিন পর দেখে এই পরিস্থিতিতেও আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। একলহমায় নিজের একমাত্র আদরের মেয়েকে জড়িয়ে নিলেন বুকে। আহ, এই তো সেই মা মা গন্ধটা, যার জন্য আকুলি বিকুলি করেছে ও কত রাত, অজানা অচেনা শহরে। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেনি যে মানুষটার কথা ভেবে। 

-“মা আমার এসছিস? এতদিনে মনে পড়ল? আয়।”

এটুকু বলেই বুঝলেন ঘরে নিজেদের লোক ছাড়াও বাইরের লোকজনও আছে, ডাক্তারবাবু আছেন। নিজেকে সামলে নিলেন রমলাদেবী। সবাইকে পেরিয়ে চোখদুটো আটকালো ঝিমলির খাটের উপর। শুয়ে আছেন মানুষটা, চোখ বন্ধ। ডাক্তারবাবু ইসিজি করতে ব্যস্ত। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে তাই এখনও পুরো ঘোর কাটেনি হয়তো। ঝিমলির ভিতর ঠিক কী চলছিল বলে বোঝাবার মতো ক্ষমতা ওর এই মুহূর্তে নেই।” তুই হাত মুখটা ধুয়ে আয়, ফ্রেশ হয়ে নে।” ঝিমলিও ঘরটা থেকে বেরতেই  চাইছিল।ছোড়দার কথা শুনে তাই আর একমুহূর্তও দেরী করল না। সাবিত্রী মাসি ওকে ঘরটা দেখিয়ে দিল। বড় অদ্ভুত লাগছে। ওরই বাড়িতে ওরই ঘর ওকেই দেখিয়ে দিচ্ছে মানুষজন। এতটা পর কবে যে হয়ে গেল…কিন্তু এটাই তো স্বাভাবিক। ১৮বছরে তো আর সময়টা থমকে যায়নি। সবকিছুই কত বদলে গেছে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগল ও। সেই জানলাটা, ওর পড়ার টেবিল, এই খাটটায় নিশ্চিন্তে মার সাথে ঘুমোতে যেত তো ও। এই যে জানলাটা, এখানে দাঁড়িয়েই ছাদে পাখিগুলোর খুনসুটি দেখতে ও। এই জায়গাতে দাঁড়িয়েই তো প্রথম নিজেকে আবিষ্কার করেছিল ও। প্রথম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। এই স্টাডি টেবিল, এই বই, ডিগ্রি এসবের বাইরে অন্যকিছু, আরও বড় কিছু ওর জন্য,শুধুই এগুলো না। আরও অনেক বড় কিছু ওর অপেক্ষায়। ক্যামেরাটা এখনও এখানেই আছে, সযত্নে। ঠিক যেমনটা ও গুছিয়ে রেখে গেছল, তেমনি। ক্যামেরাটায় আঙ্গুল ছোঁয়াল ও চোখদুটো বুজে। টেবিলে পেন স্ট্যান্ডে রাখা রুপোলী পেনটা। দুর্দান্ত রেজাল্টের পর পিসিমণি এনে দিয়েছিল এটা। খুব প্রিয় ছিল এটা ওর। ওর ছোট্ট ছোট্ট সঞ্চয়ে ওটাই সবথেকে দামী পেন ছিল। তুলে নিল হাতে পেনটা। যখন প্রথম কলকাতায় গেল, কী ভীষণ কেঁদেছিল ও। মায়ের কাছে বসে এইখানটাতেই। বাপির সামনে কাঁদলে যে বাপি কষ্ট পেত। বাবাকে লুকিয়েই কেঁদেছিল তাই সেদিন। কীভাবে সকলকে ছেড়ে এক থাকবে? একটা অজানা অচেনা শহরে। আজ এতগুলো বছরে লড়াইটাও একাই করতে হলো, নিজের স্বপ্নকে তাড়া করার জন্য, ও যে ভুল নয় সেটা কোথাও প্রমান করাটা বোধ হয় জরুরী ছিল। ঐ ফ্ল্যাটে একার লড়াইটা, সমাজ, মানুষ, নিজের পরিবার, নিজের মনের সঙ্গে। দম বন্ধ লাগত, খুব কষ্ট হতো, খুব। হাঁপিয়ে বসে পড়েছে কতবার। জানলার গরাদে আঙ্গুল বুলিয়ে চোখ বুজে একটা লম্বা শ্বাস নিল ও।

*****

-“বাবা তুমি দ্যাখো একবার, আমি যদি একবার ওনার সাথে কাজের সুযোগ পাই, এর থেকে বড় পাওনা আর কিছু হতে পারে না।”

-“তাহলে এত কষ্ট করে এতদূর পড়াশোনাটা করলে কেন? সারাজীবন বনে জঙ্গলে ফটো তুলে বেড়াবে বলে? এটা কোন প্রফেশন হলো? তোমায় এতদূর পড়ানো হলো, এত ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট, তুমি তো নিজে যেচেই এটাই পড়লে। এত ভাল স্কোপ, পাশ করলে। এখন বলছো এসব কিছু করবে না, ফটো তুলবে?”

-“বাবা ওটা ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি।”

-“ওই হলো।”

-“বাবা পড়তে ভালো লাগতো তাই পড়েছি। আমি তো বলিনি তোমরা আমায় প্রেসারাইজ করেছ। স্বেচ্ছায় এতদূর পড়েছি। রেজাল্টও ভাল। কিন্তু আমার ট্রেনিং-এ গিয়ে ফটোগ্রাফির ভূতটা হঠাৎই ভীষণ ভাবে মাথায় চাপল, কিন্তু ভাগ্যিস চাপল। এখন আমি ফটোগ্রাফি ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারছি না। আর আমি খারাপ কাজও করছি না নয়তো এই চিঠি, কল লেটার, সার্টিফিকেট এগুলো আনতে পারতাম না বাবা তোমার সামনে। আমি এটাই করতে চাই বাবা। তুমি একবার যেতে দাও। আমি তো কখনো।।।”

-“ভূত যখন চেপেছে ভূত ক’দিন পর নেমেও যাবে। তখন আফশোস-এর সীমা থাকবে না।”

-“না বাবা, এই ভূত নামবে না। আই অ্যাম ভেরি মাচ সিওর এবাউট দ্যাট।”

-“এটা কোন লাইফ? আজ এখানে কাল ওখানে। কতদিন চলবে এভাবে? আর তোমার বিয়ের পর তাঁরাই বা কেন মানবেন তোমার এসব কাজ? কোনো সিকিউর চাকরি করো, আরও পড়ো, ঠিক আছে। এসব আবার কী? প্রতীক দা-ই বা কী বলবে? মেয়েটা কলকাতায় গিয়ে একেবারে।।।”

-“এক মিনিট। প্রতীক কাকু এখানে কোথা থেকে এলো বাবা, বুঝলাম না তো।”

-“তো বয়সটা কত হয়েছে? বিয়েটা তো দিতে হবে। আর রঞ্জন তো খুব ভালো…”

-“এক মিনিট বাবা। আমার বিয়ে সবাই ঠিক করে ফেলল। আর আমিই জানি না। কই রানা তো আমায় কিছুই বলেনি।”

-“আমি তো যা করবো তোমার ভালর জন্যই নাকি? এসব তো আলাদা করে বলার দরকার নেই। বারবার বারণ করছি, ভুল করছ। এসব মাথা থেকে বের করো।”

কান মাথা গরম হয়ে গেছিল ঝিমলির। কিছুতেই আর নিজেকে সংযত রাখতে পারছিল না। মা থাকলে চুপ করিয়ে দিত। কিন্তু মা যখন এখনো আসেনি এবার বলাটা দরকার।

-“এক মিনিট বাবা, এক মিনিট। প্রথমত, আমি কোনো ভুল করছি না এটা আমি খুব ভাল করে জানি। ভুল করলে আমি তোমার কথা শুনতাম, যেমনটা ছোট থেকে শুনে এসেছি। এত সিওর এর আগে আমি কোনোদিন ছিলাম না, যতটা আজ আমি সিওর এই ব্যাপারে। আর বাবা, এটা আমার লাইফ, আমার কেরিয়ার, আমার বিয়ে…সবসময় তোমার কথা মানা সম্ভব নাও হতে পারে বাবা। ভুল কিন্তু তোমারও হতে পারে।”

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে বাবার দিকে তাকিয়েছিল সেদিন ঝিমলি। নয়তো বলতে পারতো না। সেই দৃষ্টি কোনদিনও ভুলবে না ও। 

-“এই মুহূর্তে এই ঘর থেকে বেরিয়ে যাও, আমার চোখের সামনে যেন আর না দেখি। এত ঠিক ভুলের জ্ঞান হয়ে গেছে তো? কটা দিন বাড়ির বাইরে একা থাকো,খেটে  রোজগার করো, এসব জ্ঞান কোথায় থাকে আমিও দেখব।”

হাওয়ায় ফুলদানিটার আওয়াজে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরল ঝিমলি। সেইদিন বাবার প্রতীক কাকুকে দেওয়া কথা রাখতে না পাড়ার লজ্জা ঝিমলির স্বপ্নের মূল্যের থেকে অনেক বেশী ছিল। এতদিন ধরে বাবার মুখে একটু হাসি দেখার জন্য যা কিছু করেছিল সব এক লহমায় মূল্যহীন হয়ে গেছল একটা ঘটনায়। যখন বাবার সাপোর্টের ঝিমলির সবথেকে বেশী প্রয়োজন ছিল, তখনই এটা করলে বাপি! এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ভুল তোমারও হতে পারে বাপি, আর তুমি ভুল ছিলে সেদিন, আর আমি সেটা করে দেখিয়েছি। বুঝেছ? আচ্ছা আমি কী খুব বড় অন্যায় করেছিলাম? নিজেরই জীবনটাকে নিজের মত গোছাতে চেয়েছিলাম, তোমায় গোছাতে দিইনি। এটাই কী আমার অন্যায় ছিল? নিজেকে ভালবাসা, নিজের স্বপ্নকে ভালবাসা, তাকেই প্রাধান্য দেওয়া এগুলো কী কখনো কোনো অন্যায় হতে পারে? লড়াইটায় তোমায় পাশে পাব বলে নিজের জন্মদিনের দিন তোমায় সবটা জানিয়েছিলাম বাপি। তারপর থেকে ঐদিনটা এলে আর কোনো আনন্দ হয় না, রাগ হয়, খুব রাগ।

তোমায় এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে একদম ভাল লাগছে না বাপি। মা-র কাছে সবসময় তোমার খোঁজ নিতাম। আজ এতদিন পর তোমায় এভাবে দেখতে চাই না বাপি। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু বলবই বা কাকে। ১৮বছর কথা বলি না, ১৮বছর! কত্ত সময় নষ্ট হয়ে গেল, তাই না বাপি? কার ভুলে?

শাওয়ারটা বন্ধ করল ঝিমলি। একটু হালকা লাগছে। অনেকদিন পর এভাবে কাঁদলো ও। দরজায় টোকার শব্দ। মা ডাকছে। কতদিন পর এই নামে কেউ ডাকছে। তাড়াতাড়ি বেরল ঝিমলি।

*****

সকাল থেকে মেঘটা জমতে জমতে এখন পুরো আকাশটা ঘন কালো মেঘে অন্ধকার প্রায়। বৃষ্টি নামেনি বটে। কিন্তু ভীষণ ঝোড়ো হাওয়া বইছে। ছাদে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল ঝিমলি। ছাদটা এখন বাঁধানো হয়েছে, আগে ছিল না, রঙও হয়েছে। গাছ আরো বেশী ছিল যেন আগে, এখন খানিক কমেছে। আচ্ছা চিলে কোঠাটা কী খোলা হয় আর? তাকিয়ে দেখল একবার, তালা ঝুলছে। নতুন মোড়কে ঢাকা পুরোনো স্মৃতিতে মুহূর্তগুলো হাতড়াচ্ছিল ঝিমলি। ছাদের এই কোনটা খুব প্রিয় ছিল ওর। সামনে কী বিশাল বাগানটা দেখা যায়, আর ভীষণ হাওয়া। মেঘে সূর্য ঢেকে গেলেও সামনের দিকটা এখনও কেমন উজ্জ্বল। আর চারপাশটা ঘন মেঘে ঢাকা।

-“অটোগ্রাফ পাওয়া যাবে ম্যাডাম, দ্য ফেমাস শিবানী রয়? চেনা গলার স্বরে চমকে পিছন ফিরে তাকাল ঝিমলি। এতবছরেও গলার স্বর চিনতে একটুও অসুবিধা হয়নি। চোখে চশমা হয়েছে, ঝুলপিতে পাকও ধরেছে হালকা। গলার স্বরটা একটু ভারী যেন। পাঞ্জাবী খুব একটা পরতে পছন্দ করতো না কিন্তু আজ পরনে পাঞ্জাবীই। রানার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল ঝিমলি।

-“অনেক বদলে গেছিস তো।”

-“আর তুই তো রীতিমত ফেমাস হয়ে গেছিস।”

-“গুড টু সি ইউ।”

-“আছিস কেমন?”

-“যেমন দেখছিস। হঠাৎ পাঞ্জাবী? ভীষণ বিরক্ত লাগত তো তোর?

-“হুম, এখন বদলে গেছি। ইনফ্যাক্ট বদলাতে হয়েছে। মেয়ে, বৌ-এর জ্বালায়।”

এক সেকেন্ডের জন্য হলেও থমকাল ঝিমলি। তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে বলল, “বাহ্, ঘোরতর সংসারী। মেয়ে কত বড় হলো?”

-“এই তো ক্লাস থ্রি হবে।”

একটা সময় যার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলত, আজ তার সাথেই কত ভেবে চিনতে, হিসেবে করে কথা বেছে বলতে হচ্ছে। কী বলবে খুঁজতে হচ্ছে। চুপ করে গেল ঝিমলি। সামনের আকাশটার দিকে তাকাল। রানাও আর কিছু বলল না। দুজনেই চুপচাপ দেখছিল আকাশটাকে। এক পশলা বৃষ্টির অপেক্ষা করছিল যেন দুজনেই। নির্বাক দুজন, একটু একটু করে ঝড় তুলছিল প্রকৃতি।

ঝিমলি ১৮বছর আগে যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছল নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে, এই একটাই মানুষ যে ভুল বোঝেনি। যার কিনা ভুল বোঝার সবথেকে বেশী সম্ভাবনা ছিল। 

-“সরি রে, অ্যাম রিয়েলি সরি।” নিস্তব্ধতা ভেঙে বলল ঝিমলি, তাকাল রানার দিকে।

রানা তখনও সামনের দিকেই তাকিয়ে। ঝড়ে সামনের গাছটা প্রবলভাবে দুলছে, নুইয়ে পড়ছে, কিন্তু ভাঙছে না, আবার মাথা তুলছে।

-“সরি? ফর হোয়াট?… না রে, সরি টা  যখন মন থেকে আসবে তখনই বলবি। আর আমায় সরি কেন? নিজের জীবনটাকে নিজের মত বাঁচতে গেছিলি বলে? ধ্যুর। তোর উপর, তোর জীবনের উপর যদি কারো সব থেকে বেশী অধিকার থাকে, তাহলে সেটা তোর, আর কারও না। আমায় পারলে কখনো সত্যিটুকু বলিস সময় করে। আমি শুধু সত্যিটা শুনতে চাই। আদৌ কী ছিল কিছু আমাদের?”

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মুখে চোখে তার ছোঁয়া বেশ লাগছিল ঝিমলির। চুপ করে এই মুহূর্তটার নির্যাস প্রাণভরে শুষে নিচ্ছিল যেন। আর যদি কখনো সুযোগ না আসে।

-“সরি এই জন্য না যে সেদিন আমি সব ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলাম। ঐ ডিসিশনের জন্য কোন দুঃখ আমার নেই। সেদিনও না আজও না। সরি এই জন্য যে তোকে আমি আমার কাছে আসা থেকে আটকাতে পারিনি। দুর্বল হয়ে গেছিলাম। আমি জানতাম এই সম্পর্কটা… তোকে বলেওছিলাম। কিন্তু পারিনি তাও। তাহলে তোকে বৃথা কষ্টটা পেতে হতো না আমার জন্য। রিয়েলি সরি।” এটুকু বলে রানার দিকে তাকাল ও। রানার মুখে হাসি, কিন্তু চোখের কোণের জলটা চোখ এড়াল না ঝিমলির। আজ ঝিমলির চোখও তো আর্দ্র।

-“আর সত্যি? সত্যি আসলে কী হয় বলতো? তোর কাছে তোর ভাবনাটা সত্যি, আমার কাছে আমার ভাবনাটা। সত্যিটা সবার জন্য তো এক হয় না। কখনো হয় না। তোকে যতটা ভালবেসেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশী ভালবেসেছিলাম আমার স্বপ্নটাকে। আর আমার কাছে এটাই সত্যি।”

নামল বৃষ্টিটা। চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছিল ওরা, এই প্রথম একসাথে, হয়তো এই শেষ।

*****

(দু’দিন পর)

-“আমি যতটা ভেবেছিলাম তার থেকে খুব তাড়াতাড়ি ইম্প্রুভ করছেন উনি। কালকের দিনটা দেখি। আশা করি নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হবে না আর।” বাবার ঘর থেকে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে গেল ঝিমলির জ্যেঠুর সাথে কথা বলতে বলতে।

পরশু এসে থেকে বাবার ঘরে গিয়ে বসতে পারেনি ঝিমলি। কোথায় যেন একটা আটকাচ্ছে। দূর থেকেই দাঁড়িয়ে দেখেছে। বাবা কাল থেকে একটু সুস্থ। মা আজ জানিয়েছে যে ঝিমলি এসছে। এখন সাবিত্রী মাসি বলে গেল, “তোমায় ওঘরে বৌদি ডাকছে, যাও এক্ষুণি।”

মা আছে তার মানে। কিন্তু ওর এত অস্বস্তি হচ্ছে কেন? নিজের বাড়ি, নিজের লোক, নিজের মা বাবা।

ঘরে ঢুকে দেখল মা বাবাকে একটু সুজি খাইয়ে দিচ্ছে। এই অবস্থায় ওর বাপিকে কখনো দেখতে চায়নি ও। বুকের ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখ ফেটে জল আসছে। নিজেকে শান্ত রাখতে জোরে একটা শ্বাস নিল ঝিমলি। মা ইশারায় বাবার খাটের পাশের চেয়ারটায় বসতে বলল, কিন্তু বসতে গিয়েই এক নিদারুণ হোঁচট খেল ঝিমলি। গত পরশু থেকে এই ঘরে ঢোকেনি ও, বাইরে থেকেই বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখেছে শুধু। নিজের বাড়িতেই নিজের মানুষগুলোর সাথে মানাতে সময় লাগছিল বৈকি। মাঝের সময়সীমাটা যেন এক আলোকবর্ষ দূরত্ব ঘনিয়ে দিয়ে গেছে নিজেদের মধ্যে। সারা ঘরে এখন আলোয় আলো। সকাল বেলার মিঠে রোদ বড় বড় তিনদিক খোলা জানলা গলে ঢুকে পড়েছে ঘরে, সে আলোতেই ঝলমল করছে বিশাল ঘর। আর সেই ঘরের দেওয়াল জুড়ে শুধুই ঝিমলির ছবি। কোনোটা ওর তোলা বিখ্যাত ছবি, আবার কোনোটা ওর পুরস্কার নেওয়ার মুহূর্ত, এরকমই অসংখ্য ছবি ফ্রেমবন্দী আজ।

সেই তখন থেকে এখন অবধি, একটু একটু করে ওর চারা থেকে মহীরুহ হওয়ার প্রতিটা মুহূর্ত সযত্নে বাঁধিয়ে রাখা পুরো ঘরটা জুড়ে। কিছু বলতে পারেনি ঝিমলি। মাথাটা নীচু করে নিজের চোখের জলটা লুকোনোর চেষ্টা করছিল শুধু। বাবার শীর্ণ, কোঁচকানো চামড়ার আঙুলটা ধরতে ইচ্ছে করছিল খুব, যে আঙুলটা ধরে স্কুল থেকে ফিরত ও।

-“আমাদের মত নিতান্ত সাধারণ পরিবারে জন্মানো মেয়ে, ছোট থেকেই মেধাবী, এত ভাল রেজাল্ট, এত উজ্জ্বল যার ভবিষ্যৎ, ভাল লেখাপড়া, একটা ভাল চাকরী, তারপর বিয়ে, ব্যস, আর কী। বুঝতে পারিনি এইসবের থেকেও আরও বড় কিছু হতে পারে। অনেক বড় কিছু। এসবের থেকে যার মাত্রা বহু বহু গুণ বেশী। ভুল ছিলাম আমি, আর সেটা বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছে আমার। কিন্তু এই ভুল প্রমাণিত হয়ে আমি গর্বিত।”

বাবার কথাগুলো শুনে পারল না আর নিজেকে আটকাতে ঝিমলি। এর আগেই যদি বাপি ডাকত, ও তো আগেই চলে আসত। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, বয়ে যাক সমস্ত অভিমান। বাবার শীর্ণ আঙুলটা ধরল নিজের আঙ্গুল দিয়ে, ঠিক যেরকম করে ধরে ও বাবার কথা শুনতে শুনতে স্কুল থেকে ফিরত।

-“এই ঝিমলি, একবার আসবি, আমাদের পাড়ার আর পাশের পাড়ার কিছু জন এসছে তোর সাথে দেখা করতে। কী বলছে একবার ডাকতে। অটোগ্রাফ নেবে, দেখা করবে, এরকম রোজ লোকজন আসতে শুরু করলে তো… বাব্বাহ, আয় আয়।”ছোড়দা বলে এগিয়ে গেল। ঝিমলি তাকাল বাপির দিকে। বাপি হেসে চোখের ইশারায় বলল, যা। একটা জোরে শ্বাস নিয়ে এগোল ঝিমলি। এ অনুভূতি, এই মুহূর্তটার মূল্য বলে বোঝানোর নয়। আজ, আজ অবশেষে জিতলো ঝিমলি, ওর বাপির ঝিমলি, দ্য শিবানী রয়। 

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

রক্ত

মালপত্র মোটামুটি সব নামানোই হয়ে গেছে, তাও আরেকবার দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে নিচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু। নতুন পাড়া, নতুন সব লোকজন , কালচার ও আলাদা। সাউথ থেকে সোজা

Read More »

Share with