আজ আরও একবার ‘গল্প হলেও সত্যি’, মানে আরও একবার আজ নিজের গল্প লিখব । ‘অভিনয়’-এর পর আবার নিজের কথা গুছিয়ে বা না গুছিয়ে, বলার পালা ।
১
ঝুম, মিত্তির বাড়ির ছোট মেয়ে, ছোট মেয়ে মানেই যে সবার আদরের তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না, তবে এ গল্প ঝুমের নয়, একথা প্রথমেই বলে নেওয়া শ্রেয়, এই গল্প সেই মানুষটার বা মানুষগুলোর, যাদের অস্তিত্বের দাম আমরা কেউ-ই দি না, অথচ তারাও যে আমাদের মতো রক্ত মাংসের মানুষ, সর্বোপরি সেই মানুষগুলোও যখন আমাদের আগলে রাখে ।
ঝুমের জন্মের আগে ঝুমের দাদা মারা যায়, তাই ঝুমের বেলায় বাড়ির সকলেই সজ্ঞান বা অজ্ঞানে একটা অদৃশ্য কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকে গেছিল, ঝুমের মা-ও ভয়ে নিজের বাপের বাড়ি অবধি যাননি, ঠিক করলেন সব ভালোয় ভালোয় মিটলে তবে যাবেন । ভাল কথা ।
ওদিকে, মাতৃজঠরে ঝুম-এর যখন থাকা সাঙ্গ, এবার এই পৃথিবীর মুখ দেখার পালা, তখন কলকাতা শহর আধো ঘুমে, ঝুমের বাড়ির বাকী সদস্যরাও, জেগেছিল আর সঙ্গে ছিল সেই মানুষগুলো, অবশ্যই ঝুমের বাবা ছাড়া, যাদের জন্য আজকের লেখা ।
ঝুমের মা যখন রাট দেড়টার সময় অসহ্য যন্ত্রনা আর ভরা শ্রাবনের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নার্সিং হোমের উদ্দেশ্যে বেরোলেন, তখন তো এই টেলিফোনের বাড়বাড়ন্ত ছিল না, তাই একরাশ দুশ্চিন্তা আর অনেক আশা চোখে নিয়ে বাড়িতে রয়ে গেলেন ঝুমের আদরের ঠাম্মি, আর সঙ্গে গেলেন বাবা আর সেই মানুষটা, ঝুমের মিনু পিসি । নাহ, এঁর সঙ্গে ঝুমের কোন রক্তের সম্পর্ক দূরদূরান্তেও নেই, কিন্তু, হ্যাঁ, আত্মার যোগটা মনে তখন থেকেই হয়ে গেছিল, সেই শুরু, মিনুপিসির কোলে করেই ঝুম পাড়ি দিয়েছিল নিজের আদরের দিদুনদের কাছে, দুইদিন বয়সে, বুকে আগলে মিনুপিসি পৌঁছতে গেছিল, আদরের ঝুমকে ।
**************
ঝুম ছোট থেকেই বড্ড ভোগে, জ্বর জ্বালা লেগেই থাকে, বড় বড় রোগের সাথে লড়াই করে ছোট্ট ঝুম পালোয়ানগিরি দেখালেও চেহারায় তা একদমই উল্টো । তা এই অসুখ বিসুখ বাঁধলেই দিদুন, ঠাম্মি মাথার কাছে ঠায় বসে থাকে, আসলে ঠাম্মি, দিদুনের ভালবাসাটাই এরকম, যারা পায়, তাদের থেকে ভাগ্যবান মনে হয় আর কেউ নেই, আর যারা পায় না, বা পেয়েও কদর বোঝে না, তাদের মতোন দুর্ভাগা কমই আছে ।
তা সেই সময়ও ঝুমের মাথার উপর আর যে একজনের হাত ছিল, সে আর কেউ নয় মিনুপিসিই । মিনুপিসির এককথায় পরিচয় ‘সাধারণ’ মানুষের চোখে মিত্তির বাড়ির রান্নার লোক, কিন্তু, ঝুমের কাছে মিনুপিসির পরিচয়টা এটা ছিল না আর, জন্মে থেকে যে শীর্ণ, ক্লান্ত হাতটার আঙুলকে কেন্দ্র করে নিজের কচি হাতের মুঠি পাকিয়েছে, জন্মে থেকে যে কোলটার উপর ওর অবাধ অধিকার, তার পরিচয় এত সাধারণ, এত ক্ষুদ্র হওয়া কি সম্ভব?
***************
রাত দশটা বাজলেই ঠাম্মির ঘরে দে দৌড়, ঠাম্মির আদর আর মিনুপিসির মুড়ি মাখা খেতে হবে যে, কিন্তু ঠাম্মি, দিদুন আর মিনুপিসির আদর ভালবাসার মাঝেই ঈশ্বর স্বয়ং নিজের মতো করে সবটা সাজাচ্ছিলেন, তা তো ছোট্ট ঝুম জানতো না ।
ঝুম ওর ঠাম্মিকে যখন হারায় তখন ক্লাস টেনে উঠবে । খুব কেঁদেছিল, খুব কষ্ট হয়েছিল ঝুমের, শুধু একটা কথাই মনে হয়েছিল, যদি ও বড় হতো তাহলে কি ও কিছু করতে পারতো? পারতো ওর ঠাম্মিকে আরও একটু কাছে রাখতে?
ঝুম মাধ্যমিক পাশ করে নিজের রেজাল্ট নিজের দিদুনকে জানাতে পারেনি, কারণ ঝুমের দিদুন তখন স্বাভাবিক বিচার বোধের ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছিল, আর তারপর হঠাৎ করেই….. নিজের ভালবাসার দুই মানুষকে বড় কম সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে ফেলেছিলো ঝুম, মনে হতো শুধু ওকে প্রকৃত ভালবাসার মানুষের সংখ্যা এই পৃথিবীতে একটু একটু করে কমে যাচ্ছে, বড্ড দ্রুতই কমছে সেটা ।
ঝুমের সেজ দিদুন যখন ঝুমকে ছেড়ে চলে গেলো, তখনও ঝুমের এই একটা কথাই মনে হচ্ছিল, কেন? এত কিসের তাড়া তোমাদের? তোমরাই তো চেয়েছিলে, তোমাদের নাতনি অনেক বড় হোক, সাফল্য পাক, নিজের পায়ে দাঁড়াক, তার আগেই তোমাদের যাওয়ার এত তাড়া?
নিজের পরম প্রিয় মানুষগুলোকে নিজে কিছু দেওয়ার, সে মানুষগুলোর জন্য কিছু করার সুযোগ পাওয়ার আগেই ঝুমকে ফাঁকি দিয়ে একে একে সকলে চলে গেল ।
২
ঝুম নিজের দাদুদের জন্মের আগেই হারিয়েছে, তাই ‘দাদু’ মানুষটা কেমন হয়, সে বোঝার সৌভাগ্য ওর হয়নি, আর এখন দিদু ঠাম্মির যাওয়ার পর ও নিজেকে একটা কথা দিয়েছিল….
**************
ঝুম আর আগের মতোন ছোট্টটি নেই, মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মানোর সুবাদে টিউশন পড়িয়ে হাতখরচ জোগাড় করাটা খুব সাধারণ একটা ঘটনা, কিন্তু ঝুমের বড় হওয়ার সাথে সাথে আর একটা মানুষও ৮০-এর কোটা ছুঁই ছুঁই যে, সেই বৃদ্ধ হাতে আর কত? তাই ছুটি চেয়েছিল ক্লান্ত হাত দুটো, কিন্তু হায় ভাগ্য, পেটের দায়ে সন্তান থাকা সত্ত্বেও, ও তাড়া সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও, মানুষটা আজ আবার শহরের রাস্তায়, কাজের খোঁজে, সঙ্গী ছোট্ট ব্যাগটা, চোখের চশমা, সাদা শাড়ী আর পায়ের চটি ।
চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়েছে, কমেছে শরীরের ক্ষমতা, খাটার ক্ষমতা আর নেই যে, জোর করে যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকু করে দিন গুজরান ।
নিজের টিউশনির টাকা থেকেই সরিয়ে কিছু টাকা যখন মিনু পিসির হাতে তুলে দিতে পারল ঝুম,”এটা তোমার জন্য” এইটা বলতে পারল যেদিন, সেদিন যে মনটা কী অপরিসীম শান্তি পেয়েছিল তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না ।
৩
আজ ঝুম চাকরি পেয়েছে, চাকরি পেয়ে মা, বাবা, সক্কলের জন্য কিছু না কিছু উপহার নিতে ভোলেনি, মিনু পিসির জন্যও । মিনু পিসিকে এই বৃদ্ধ বয়সে আর পরের দিন কী ভাবে বাজার করব সেই ভাবনা ভাবতে হয় না । এর থেকে বড় উপহার আর কী হতে পারে?
**************
এরকম অজস্র মিনুপিসি আমাদের সমাজে ছড়িয়ে, যারা গোটা জীবনটা আমাদের বাড়ির সদস্যদের জন্য, উৎসর্গ করে দেয়, কেউ রান্না করে, কেউ বাচ্চা সামলে, কেউ অন্যের সংসার সামলে, মাসিক কিছু টাকার বিনিময়ে, অথচ তাদের অবদান এই টাকার থাকে অনেক বেশী । এই মানুষগুলোর প্রতি এই সামান্য কর্তব্যটুকু তো আমরা করতেই পারি ।
আজ ঝুম ওর প্রিয় জানালাটার পাশে বসে শান্তিতে মন ভরে নিশ্বাস নিতে পারে, মা বাবার পর ওর প্রিয় একজন মানুষের জন্য সামান্য হলেও কিছু করার সুযোগ পেয়ে ।
“আমার মিনু পিসি ভাল আছে ।”- মনে মনে এটা বলেই শান্তিতে জানলার পাশে চোখ বুজল ঝুম । আপনারা কী ভাবলেন?