।। ১।।
অনিয়ম, নিয়ম নিষ্ঠার অভাব, এসবকিছু কাননবালা দেবীর মোটে পছন্দ নয়। অথচ কদিন ধরেই দেখছেন যে যার তালে আছে। আশ্চর্য ! বড় বৌমা ও হয়েছে তেমনি। কাউকে একটু শাসন করতে শিখল না। বলে বলে উনি হয়রান। আরে শক্ত হাতে রাশ না ধরলে লোকে মানবে কেন? এটা বুঝিয়ে পারেন না উনি। কাজেই এখন কেউ মানছে ও না। উনি একা আর কত বলবেন। তাও অন্য বাড়ির থেকে এই বর্ধন বাড়ি অনেক ভালো। এখনো বড়দের কথা শোনার রেওয়াজটা আছে এই বাড়িতে। মান্যি করে গুরুজনদের।
কিন্তু এই কদিন যেন রাশ ছাড়া ভাব। সকালে ওঠার ঠিক নেই রাত্রে শোবার ঠিক নেই। দুপুরে খাবার ঠিক নেই। আশ্চর্য! আজ আর তাই চুপ থাকতে পারবেন না উনি। শরীরটি আসলে কদিন ধরেই বিগড়েছে, ব্যাস। এদের পোয়াবারো। আজ যে করেই হোক উঠতেই হবে। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। সকাল সকালই ওঠার অভ্যাস কাননবালা দেবীর। কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সকল ৭.৩০ টা বেজে গেছে। ইস! কতটা বেলা হয়ে গেল।
ওহ! বর্ধন বাড়ির ইতিহাসটা তো এখনো বলাই হয়নি। রতিকান্ত বর্ধন মানে কাননবালা দেবীর দাদাশ্বশুরের আমলের বাড়ি এটি। উত্তর কলকাতার বুকে অবস্থিত তিনতলা বাড়িটি এখনকার ফ্ল্যাট বাড়ির নিরিখে প্রাসাদোপম। চারতলার ঠাকুরঘরের মাথায় চিলেকোঠা থেকে শুরু করে চৌবাচ্চা দুর্গাদালান সব কিছুই আছে এই বর্ধন বাড়িতে। কালের নিয়মে অনেক কিছুই ধূলায় ঢাকা পড়ে গেছে বটে। দরজা সমান খড়খড়ির জানলা কয়েকটা ঘরে এখন কেটে ছোট জানলা হয়ে গেছে। টালি আর কড়িকাঠ সরে গিয়ে সিমেন্টের ছাদ হয়ে গেছে উপরতলার কয়েকটা ঘর। রঙিন কাঁচ আর লাল মেঝের জায়গায় এসেছে স্বচ্ছ কাঁচ আর পাথরের মেঝে।
সেই মেঝেতেই তো জল দেখতে না পেয়ে উল্টালেন কাননবালা দেবী। বুড়ো হাড়ে লাগল ঘা, ভাঙল পা টা। তার উপর এখন একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়। নার্সিং হোম এর ঠান্ডা কেবিন এ শুয়ে ধরে গেল নিউমোনিয়া। আর কি। তা সেই রতিকান্ত বর্ধনের আমল থেকে আজ অব্দি এই বাড়ি কিন্তু পরিপূর্ণ। বাকি সব বাড়িতেই এখন পরিবার ভেঙে যে যার ফ্ল্যাট কিনে চলে গেলেও এখনো অবধি সেই সব এই বাড়িতে হয়নি। এখনো কাননবালা দেবীর চার ছেলে বৌমা নাতি নাতনি সব এক ছাদের তলায়। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এ বাড়িতে দু দণ্ড একঘেয়েও লাগে না যেন কিছু। এতগুলো মানুষ একসাথে মিলেমিশে কখন যে সময় কেটে যায় কে জানে। ঘড়ির কাঁটা যেন দ্রুত চলে এই বর্ধন বাড়িতে। হৈহৈ চলতেই থাকে সারাদিন।
আগে বড় হল ঘরটায় টিভি ছিল, এখন যদিও সেটি পরিবর্তিত হয়ে শোবার ঘরে আলাদা আলাদা টিভি হয়ে গেছে। এটিতে অবশ্য কোনো আপত্তিও করেননি উনি। সত্যিই তো ! সবার তো একরকম ইচ্ছে না ও হতে পারে টিভি দেখার সময়। আর ওই জায়গাতেই খেতে বসে সকলে, খেতে খেতে টিভি না দেখাই ভালো। সারাদিনের শেষে ভাইয়েরা ও একটু গল্প করে ওই সময়টায়।
কাননবালা দেবী নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেন। এখন তো আর রান্নাবান্না করার ক্ষমতা নেই। বয়স তো আর কম হলো না। এই তো গেল আষাঢ়ে ৮৩ পেরিয়ে গেল। তাই রান্নাবান্নার দায়িত্ব বৌমাদেরই। চারজন মিলে মিশে করেও নয়। আর বড় বৌমার রান্নার যা হাত, সবাই চেটে পুটে খায়। কাননবালা দেবীরও শান্তি। সকল ৯ টার মধ্যে জল খাবার খেয়ে টিফিন গুছিয়ে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ে, দুপুর ১ টায় ভাত খেয়ে যারা বাড়িতে থাকল তারা বিশ্রাম নেয় একটু। কাননবালা দেবীর চোখে ঘুম নেই। ঘরের জানলার খড়খড়ি তুলে গল্পের বই পড়েন। বিকেল ৫ টার মধ্যে চা, সন্ধেবেলা অফিস ফেরত কিসব নিয়ে আসে সব ওরা একেকদিন একেকরকম কিসব চাউ পাস্তা রোল মোগলাই, কাননবালাদেবী ওসব খান না।
এহেন এই বর্ধন বাড়িতেই অনিয়ম। যেই না কিছুদিন উনি বিছানা নিয়েছেন অমনি সব সাপের পাঁচ পা দেখছে। আজ আর কাউকে ডাকলেন না। নিজেই ধরে ধরে উঠবেন ঠিক করলেন।খাটটা যে মেঝে থেকে বেশ উঁচু। তাই অসুবিধা একটু উঠতে নামতে। অনেক ক্ষণের চেষ্টার পর নামলেন অবশেষে। এদের কি আজ স্কুল কলেজ অফিস ও নাই নাকি? কোথায় গেল সব। ঘর ছেড়ে বেরোলেন ধীরে ধীরে, বেরিয়েই সামনে লম্বা দালান পেরিয়ে ঐদিকে রান্নাঘর। বড় বৌমা নিঃশব্দে কাজ করছে, মুখে কোনো কথা নেই। কেমন যেন ভার মুখখানা। কদিন ধরেই লক্ষ্য করছেন, কাননবালা দেবীর নজর যে সবদিকে, চোখ এড়ানো যায় না মানুষটার, নিশ্চয় কিছু হয়েছে, বড় খোকার সাথে আজকেই কথা বলবেন উনি। বারান্দার রেলিঙের কাঠটা ধরে ধরে এগোতে লাগলেন ধীরে ধীরে। ছেলেরা সব গেল কোথায়। ওবাবা, হল ঘরের সামনে দিয়ে পেরোনোর সময় দেখলেন, সকলে চুপচাপ আছে হল ঘরেই। ছেলেরা যদিও এখানেও নেই। নাতি নাতনি গুলো আছে, এরা কি ঠিক করে চুলটাও আঁচড়ায়না নাকি রে বাবা। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে সব কটাকে। মা গুলো শাসন ও করে না একটু। পেরিয়েই যাচ্ছিলেন, থমকে দাঁড়ালেন বড় নাতনির কথা শুনে। ছোট নাতিকে উদ্দেশ্য করেই ও বলছিল, ঠাকুমা দেখলে এখুনি ঝাড় খেতিস তুই। সোফার উপর বসে বসে খাওয়া? খুব বকত। নাম নীচে।
সমস্ত নাতিনাতনীর মধ্যে এই ছোট নাতি টিই একটু দুস্টুমি বেশি করে। যেটি করতে বলা হয় উনি ঠিক তার উল্টোটি করতে পছন্দ করেন। আসলে বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্য তো, একটু বেশি ই আদরের, কিন্তু আজ দিদিভাই যেই বললো অমনি সুড়সুড় করে সোফা থেকে নেমে মেঝেতে বসে খেতে শুরু করল কুট্টুস। যাক, তাও ভালো, ঠাকুমার কথা ভেবে অন্তত শুনেছে তো। হেসে ফেললেন কাননবালা দেবী আড়াল থেকে।
আর না দাঁড়িয়ে ঐদিকে এগোতে লাগলেন, রান্নাঘরের সামনেই নীচে নামার সিঁড়ি। নীচের স্নানঘরেই স্নান করেন উনি। উপরেও আছে, ছেলেরাই আলাদা করে একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিক পছন্দ হয়না কাননবালা দেবীর। নীচে স্নান করে তুলসীমঞ্চে জল দিয়ে তবে উপরে আসেন উনি। তারপর সোজা চারতলায় ঠাকুরঘরে। পুজো সেরে তবেই কিছু খাবেন উনি। এটা আজ বিগত ৭০ বছরের অভ্যাস প্রায়। সেই ১৪ বছর বয়স বিয়ে হয়ে এই বাড়িতে পা রেখেছিলেন। সেই তখনকার অভ্যাস। আর কি এই বয়সে এসে পাল্টানো যায়? তবে এখন পা টা ভেঙে আর পারবেন কি?
সিঁড়ির কাছটায় এসে দাঁড়ালেন, রান্নাঘরের দিকে তাকালেন একবার। বড় বৌমা শরবত গুলছিল। বাসি কাপড়ে কাননবালাদেবী রান্নাঘরে ঢোকেন না, আজ ও ঢুকলেন না। বাইরে থেকেই দেখলেন রান্নাঘরটা যেন আগের মতন ভরাভর্তি নেই। সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা। উনি আবার ভাঁড়ার ফাঁকা রাখতে একদম পছন্দ করেন না। সবজির ঝুড়িতে কটা মাত্র সবজি, গুটিকতক আলু পড়ে আছে। বড় বৌমা শুকনো মুখেই একটা বিস্কুট দিয়ে শরবতটা খেয়ে নিল। চা এর বালাই নেই। ছোট নাতি ও আজ খই দুধ খাচ্ছিল শুধু, যার সাত সকালেও ভালো মন্দ না হলে মুখে রোচে না। কি যে চলছে এদের। ফিরে এসে দেখবেন ক্ষণ। স্নান করতে নীচের কলতলায় চলে গেলেন কাননবালা।
*****
“ইজিচেয়ার টা বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে দিদিভাই, সব মিটলে ওটা সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। “
“হ্যাঁ আমি ও ভেবেই রেখেছি, এই বারান্দার ধারে বসেই মা নীচের দালান থেকে শুরু করে রাস্তার সামনেটা অব্দি সব দিকটা খেয়াল রাখতেন। কারো ফুটপাথ বা বাড়ির সামনে নোংরা ফেলার সাহস ছিল না,শুধু মা নজর দিয়ে রাখতেন বলেই। চেয়ারটা থাকলেই মনে হবে যেন এই ত বসে আছেন, এই আবার চেঁচিয়ে উঠবেন।”
“সত্যি তাই, আর ছেলেরা বাড়ি না ফেরা অব্দি যত রাতই হোক, ওষুধ খাবেন না তাও ভালো, তবু জেগে বসে থাকা চাই, ঠায় ওই চেয়ারটায়, ছেলেরা আসবেন তবেই ওষুধ খেয়ে শোবেন। “
“হ্যাঁ রে, একটা ছাতা সরে গেলো যেন, এই যে সামনে পুজো, দশমীর পরের দিন সব ননদরা, সমস্ত আত্মীয় স্বজন একসাথে আসত সকলে, পুরো বাড়ি গমগম করত একেবারে। আর কেউ আসবেও না। মায়ের জন্যই আসত সব, মা কে প্রণাম করতে। আর কেউ আসবেও না দেখবি, সব ফোনেই এবার বিজয়া সারবে। “
“ঠিকই, কালকেই তো বাজারে গেছি, দেখি ওল বিক্রি হচ্ছে, মা যেমনি ওল টা রাঁধত তেমনি ওল খেতে ও ভালোবাসত। শেষ বার ওল ওল করছিল, আর করাই হলো না। একটা আক্ষেপ রয়ে গেল গো।
“ধুর, না না, ওরকম ভাবিস না । কাল কি হতে চলেছে তা কি জানি আমরা। তাহলে আবার কি?”
“হুম তা ঠিক, আজ মায়ের যা কিছু পছন্দ সব দিতে বলেছি। আচ্ছা ভালো কথা, জানোতো কাল পিউ ও বলছিল, আমার ও মনে হয়েছে, সন্ধ্যেবেলা, ওই যখন সন্ধ্যে পড়ে ঠিক তার পর পরেই, কেমন যেন একটা লেগেছে পিউর। বলছে ঠাকুমাই নাকি এসেছিল সন্ধ্যে দেবার সময়, জানে ও। আমার ও মনে হচ্ছিল মা এখানেই আছেন কোথাও। “
সেটাই তো স্বাভাবিক বল, এত সহজে কি যায় মায়া কাটানো। আর এই বাড়ির সব কিছুই তো মাকে ঘিরেই, বাড়ির গিন্নী, আমার একদিন ও সন্ধ্যে দিতে দেরি হলে নিজেই তো উঠে চলে যেতেন, কারো অপেক্ষা করতেন না। যতই ওঠা নাম করতে কষ্ট হোক। সময়ের এতটুকু এদিক ওদিক হওয়ার জো ছিল না। ”
“তখন জানো তো সত্যি বলতে কি মাঝে মাঝে একটু রাগ ও হতো, সবসময় এত টাইম মেনটেনের কি আছে? একদিন দেরি হলেই বা কি হয়েছে। রাত্রে খিদে না পেলেও একটু পরে খাবার জো নেই। সেই তখনি খেতে হবে। বিরক্ত লাগতো। এখন সেটা খুব মিস করব। “
” হ্যাঁ, আর পিউ তো বড় নাতনি, খুব আদরের, সবসময় ঠাকুমা কে সেঁটে ই থাকত, ও বেচারি খুব কষ্ট পাচ্ছে। রোজই ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বলে আজ ও তো এসেছিল ঠাকুমা, দেখা করে গেছে আমার সাথে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছেন, হয়তো এখনই এখানেই দাঁড়িয়ে আছেন, শুনছেন আমাদের কথা, নয়তো বলো সেদিন বড়দি তো বললো, বড়দির পরিষ্কার মনে আছে দুধ গ্যাসে বসিয়ে জ্বেলে রেখেই নেমেছিল নীচে। মনে আছে বলেই তাড়াহুড়ো করে উপরে ছুটল, কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকে দেখল দুধ ফুটিয়ে ঠিক জায়গায় রাখা রয়েছে, গ্যাস ও বন্ধ। অথচ সবাইকেই জিজ্ঞাসা করা হলো কেউই তারপর থেকে রান্নাঘরে ঢোকেনি। “
” হ্যাঁ সত্যি সেদিন ওটা যে ঠিক কি ঘটল আমাদের কারো মাথায় ঢুকল না। “
” তোমার দেওর তো রোজ রাত্রে বলছে, তার মেঝেতে শোবার অভ্যাস একেবারেই নে, ওর তো ঘুমই আসে না, অথচ একদিন ও আজ অবধি অসুবিধে হয়নি, বলে মনে হয় যেন মা মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। কি ভালো ঘুম হচ্ছে। “
” তারপর দেখ না, কুট্টুস তো সেদিন ওই উঁচু খাট থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে পড়ছিল, মুখ থুবড়ে পড়ত পুরো,আমি তো অনেকটা দূরে ছিলাম, ধরতে পারতাম না ওকে। কিভাবে যেন আটকে গেল ও, একটু ও লাগেনি। বলছে মনে হলো কেউ যেন আমায় ধরে নিলো, পড়তে দিল না। ‘
*****
আকাশে মেঘ জমছে, খুব জোর বৃষ্টি আসছে মনে হয়, বাড়ির সামনে ফুটপাথটা ঘিরে আর ছাদের খানিকটা অংশ ঘিরে প্যান্ডেল হয়েছে, ছাদের খানিকটা খোলা অংশে জামাকাপড় শুকাচ্ছ, বৃষ্টিতে সব ভিজবে এখনই না তুললে, তুলে দিলেন কাননবালা দেবী। ওদের এখন হাত জোড়া, দৌড়ে আসতে আসতে দেরি হতো। আসলে হঠাৎ করেই যে হয়ে গেল সবটা। পা ভেঙে ভর্তি হয়ে যে নিউমোনিয়া হয়ে প্রাণ খোয়াবেন তা তো নিজেও ভাবতে পারেননি উনি। তাই কিছুতেই যেন মায়া কাটাতে পারছে না কাননবালাদেবী। ভুলেই যাচ্ছেন উনি যে আর বেঁচে নেই, কিন্তু যেতে তো হবেই, ছেলেরা আজ ব্যস্ত, বাড়িতে এত বড় কাজ, বৌমারা উনার বাঁধানো ফোটোটাতেই চন্দন ফুল দিয়ে সাজাতে সাজাতে এতক্ষণ কথা বলছিল যেটা উনি এক কোণায় দাঁড়িয়ে চুপ করে শুনে হাসছিলেন নিজের মনেই। সাজানো সংসারটার মায়া কাটানোর সময় এসে গেছে। লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে, আর কিছুক্ষণ পর শ্রাদ্ধের কাজ শুরু হবে, সারাবাড়িটাকে একবার প্রাণ ভরে দেখে নিলেন কাননবালা, শেষবার, যাওয়ার আগে।