।। ৩।।
সকালে যখন ঘুমটা ভাঙল তখন বেশ শিরশির করছে শরীরটা, মানে সকালে এখনই বেশ ভালোরকম ঠান্ডা। গা থেকে ব্ল্যাঙ্কেটটা সরে যাওয়ায় কুঁকড়ে শুয়ে ছিলাম। ঠান্ডা লাগছে বলেই ঘুম টাও ভেঙে গেল। ঘরটার এদিক ওদিক তাকালাম, পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল কালকের ঘটনাগুলো। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। কাল রাত্রে তো আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম লাগোয়া ব্যালকনিতে। তাহলে আজকে আমি বিছানার উপর কি ভাবে এলাম। পাশে দেখলাম পার্থ আর অনু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মানে ওদের দেখে ও তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না যে রাত্রে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে বলে। তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখেছি? সত্যি কি কিছুই হয়নি? তা কি করে হতে পারে। প্রতিটা সেকেন্ডের কথা পরিষ্কার মনে আছে আমার। তাহলে এটা কি করে স্বপ্ন হতে পারে? তড়াক করে নামলাম মাটিতে। পা টা যেন এক চাই বরফের উপর পড়ল, এত টাই ঠান্ডা মেঝেটা। তাড়াতাড়ি করে পা টা সরিয়ে নিলাম। ওই তো ঘরে পরার চটিটা পাশেই পড়ে আছে, পায়ে করে টেনে নিয়ে পরে নিলাম তাড়াতাড়ি চটিটা। তারপর গেলাম লাগোয়া ব্যালকনিটায়,যেখানে কাল রাত্রে… কিন্তু একি! মহলটা তো এই দিক থেকে বেশ অনেকটা দূরে। অথচ রাত্রে মনে হচ্ছিল না এত দূরে, এত দূর থেকে কাউকে তো ভালোভাবে দেখতে পাওয়ারই কথা নয়। কিন্তু আমি দেখতে পেয়েছি পরিষ্কার, আর মহলটা এতটা দূরে সেট একবার ও মনে হয়নি। এটা কি করে হতে পারে? আর মহলে যে বহুযুগ লোকজনের পা পড়েনি সেটা ওর অবস্থা দেখেই বোঝা যায়। তাহলে কাল যাকে ঘুরতে দেখলাম সে… সজোরে টেবিলে রাখা স্টিলের জগটা পড়ল মাটিতে। আচমকা শব্দে যেন কেঁপে উঠলাম আমি। চারপাশের সবকিছু কেমন যেন লাগতে শুরু করেছে আমার। এত সুন্দর একটা সকাল, দূরে কুয়াশাবৃত পাহাড়, পাখির কুহুতান, চারিধারে সবুজে তো মনটা ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু আমি কিছুতেই বের করতে পারছি না মাথা থেকে রাত্রের ঘটনা টা, কালকে অনুর সাথে ঘটা ঘটনাটা। কোনো মানেই তো খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ অর্থহীন হলেও ঘটনা গুলো সত্যি, আর ঘটছেও। এর ব্যাখ্যা কি?
পার্থ উঠে পড়েছে, আমি আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম না, দূরের মহলটা যেন আমায় গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে একটু একটু করে, ঢুকে গেলাম ঘরের ভিতর।
*****
(সেই দিন সন্ধ্যায় )
আজ আর সারাদিনে সেরকম কোনো অঘটন ঘটেনি, মনটা তাই একটু হলেও শান্ত আছে। অনুটা কে সারাদিন কাছছাড়া করিনি। আজ সকাল থেকেই ভেবে রেখেছি পার্থ ফিরলে ওর সাথে আগে কথা বলব, তারপর এখানকার স্টাফ কে জিজ্ঞাসা করব। পার্থর ফিরতে রাত হবে। তাই এখনই ওদের কে কিছু বলতে ইচ্ছে নেই আমার।
রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি বলে নাকি কে জানে, আজ সারাদিনই খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। দুপুরবেলা আবার একপ্রস্থ রাজকীয় খাওয়া দাওয়ার পর, আর সারাদিন অনুর দৌরাত্মে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামছে বুঝতে পারছি কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছি না। ঘুম চোখে একবার দেখলাম অনু চুপচাপ ঘুমোচ্ছে আমার পাশে। নিশ্চিন্ত ! চোখ বুজলাম আবার। একটু পর উঠব ক্ষণ।
*****
কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভাঙল আমার। চোখ খুলে দেখলাম ঘর অন্ধকার। ইস! কতটা সন্ধ্যে হয়ে গেল তারমানে। ধুর ! তেমনি ঠান্ডা টাও পড়েছে জাঁকিয়ে। ঘরটা যেন অস্বাভাবিক ঠান্ডা লাগছে, কালকেও এতটা ঠান্ডা ছিল না। আজ আরো বেড়েছে। এমনিতেই আমি শীতকাতুরে। লেপটা আরো খানিকটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে কোনোক্রমে উঠে বসলাম খাটের উপর। ঘুম এখনো যায়নি চোখ থেকে, হাতটা বাড়িয়ে পাশে অনুর গায়ে হাত রাখতে গিয়েই দেখি, অনু পাশে নেই ! ধড়াস করে উঠল আমার বুকটা। এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম খাটের চারধারে। না, নেই তো ও। ঘর টা ও অন্ধকার। আলোটা জ্বালাতে হবে, কিন্তু কেমন যেন দিক ভ্রম হলো আমার। অন্ধকারের মধ্যে না তো কিছু দেখতে পাচ্ছি, না বুঝতে পারছি কোন দিকে কি আছে। যেদিকেই হাত বাড়িয়ে এগোতে যাই বিছানা শেষই হচ্ছে না, আমি খাট থেকে নামতেও পারছি না। অনু কে ডাকতে গেলাম কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোলো না আমার। কেউ যেন কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দিয়েছে আমার! কান্না পাচ্ছে আমার জাস্ট, এ আমি কোথায় এসে ফেঁসে গেলাম। না তো ফোনটা পাচ্ছি হাতে, না কাউকে ডাকতে পারছি, না নিজে বেরোতে পারছি, না কিছু দেখতে পাচ্ছি। একটা অন্ধকার কূপের মধ্যে যেন কেউ আমায় আটকে দিয়ে চলে গেছে নির্মম ভাবে। পাগলের মতো এখান থেকে বেরোনোর জন্য ছটফট করছি আমি। এদিক ওদিক করতে করতে কত সময় কাটল কে জানে, কিছুক্ষণ পর যেন মনে হলো জমাট বাঁধা অন্ধকারটা একটু সয়ে গেছে চোখের সাথে। ঠাহর করতে পারছি এবার সব একটু একটু করে, কিন্তু অনু টা কোথায় গেল? খাট থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল? এসব ভাবতে ভাবতেই সামনের অন্ধকারে ওই অবয়ব দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে গেল প্রায়! হৃদস্পন্দনের হার এত দ্রুত হয়ে গেছে যেন মনে হচ্ছে এখুনি স্তব্ধ হয়ে যাবে তার চলন।
খাটের পাশে খানিকটা দূরে একটা বেশ বড় আরামকেদারা, সেই আরাম কেদারা তেই বসে একটা ছায়া শরীর। আর আঁধারেও এটা স্পষ্ট সেটা কোনো নারী শরীর। এক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝলাম এ আর কেউ নয়, আমার কালকের রাত্রে দেখা সেই মহিলা! হে ভগবান ! এবার আমি কি করে বাঁচব? খোলা চুল, লুটিয়ে পড়া আঁচল, ঘরের ঘন অন্ধকারের মধ্যে শুধু দেখতে পাচ্ছি ওই ভাটার মতন চোখ দুটো, কেমন অদ্ভুত ভাবে দুলছে সে। এক জায়গায় বসেই দুলছে, আর কি যেন একটা বলছে ! না না বলছে না, গান গাইছে যেন, কি ভয়ঙ্কর সেই কণ্ঠস্বর, যেন বহু দূরের কোনো অচেনা অজানা জগৎ থেকে, কোনো এক গভীর গিরিখাদ থেকে যেন উঠে আসছে সেই কণ্ঠস্বর, তীক্ষ্ণ অথচ কি গভীর ! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝলাম এটা কোনো এমনি গান নয়, এটা ঘুমপাড়ানি গান এর মতন কিছু একটা। যেটা শুনিয়ে আমি অনুকেও ঘুম পাড়াই, তারপরই বুঝলাম ওই ছায়া শরীর শুধু দুলছেই না, ওর হাতে কিছু একটা নিয়ে এক জায়গায় বসে দুলছে আর গাইছে। আমি যে এখনো বেঁচে আছি এটাই আমার কাছে আশ্চর্যের। কিংবা হয়তো বেঁচে নেই, জানি না। সব কিছুই তো এখন বিচার বোধের উর্ধে ! কিন্তু এটা তো একটা বাচ্চার শরীর, খুব ছোট বাচ্চাকে মায়েরা যেভাবে ঘুম পাড়ায় সেইরকম টা। এই আমার অনুর মতোই হবে। দপ করে উঠল আমার মাথাটা ! এই কি তারমানে আমার অনুকে কেড়ে নিয়েছে? ওটা তো অনুই, হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝতে আমার কোনো ভুল হয়নি ওটা অনুই! চিৎকার করতে চেষ্টা করছি!গলার শিরা ফুলিয়ে আওয়াজ বের করার চেষ্টা করছি অথচ গলা দিয়ে একটি শব্দ ও বেরোচ্ছে না। প্রচন্ড ভয়ের সাথে সাথে একটা অসহায়তা ঘিরে ধরল আমায়। আমার চোখের সামনে আমার বাচ্ছাটা কে নিয়ে কি সব হয়ে চলেছে অথচ আমি কিছু করতে অপারগ। গয়নার টুংটাং শব্দ, নুপুরের শব্দ, আর ওই গান। ওই ছায়া শরীরটার কোলে আমারই সন্তান, চোখ দিয়ে জলের ধারা বইছিল আমার। নিজের অজান্তেই তার সামনে জোর হাত করেছি কখন খেয়াল ই করিনি। কিন্তু অনু কোনো শব্দ করছে না কেন। ও তো মা ছাড়া আর কারো কোলে…তার মানে কি ! আমার মাথা আর কাজ করছিল না, ওই আগুনে দৃষ্টির সামনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না আমি। জ্ঞান হারাচ্ছি মনে হচ্ছে, নাকি এও আমার মনের ভুল? ‘মাম্মাম ‘ এইটুকুই শুধু কানে এলো আমার।
।। ৪।।
“কি বকে যাচ্ছ বলতো আবোলতাবোল? “
পার্থ একটু জোরেই বলল কথাটা।
“মানে? আমার এতক্ষণ ধরে বলা কথা গুলো তোমার গল্প মনে হচ্ছে? “
“অবশ্যই। সুন্দর আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে উঠলে। আর বলছ ঘরে একা ছিলে। অনু কে কে নিয়ে চলে যাচ্ছে বলছ। তো এসব আবোলতাবোল ছাড়া কি? কোনো ভিত্তি আছে কি কথা গুলোর?”
“ঘুমিয়ে উঠলাম মানে? “
“আরে আশ্চর্য ! তোমার তো দিন রাতের হিসেবটাও মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে দেখছি। দেখো তাকিয়ে চারপাশটা। ঘড়িটার দিকে তাকাও। “
সত্যিই তো। চারপাশে রোদ ঝলমল করছে। ঘড়ি বলছে সময় সকল ৯ টা। তাহলে কাল সন্ধ্যে থেকে আজ সকাল অবধি…পুরো গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? পাগলের মতন করছি তো আমি এবার।
“কিন্তু অনু কোথায়? “
“নিজের পাশটা তাকিয়ে দেখ, ঘুমোচ্ছে মেয়েটা, তোমার পাশেই আছে। কি হয়েছে বলতো তোমার? যদি তোমার কথা মেনেও নি কই আমার সাথে তো কিছু হচ্ছে না। তাহলে? তুমি কি স্পেশাল নাকি যে বেছে বেছে তোমাকেই স্পেশাল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে? অদ্ভুত! চলো চলো ওঠো। আমায় বেরোতে হবে। আর প্লিজ আজ ঠিক ভাবে থেকো। “
কথা গুলো বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে পার্থ, আমি বসে রইলাম হতভম্বের মতন। কি যে হচ্ছে আমার সাথে কোনো ক্লু নেই আমার কাছে। দু হাত দিয়ে মাথার দুপাশে রগ ধরে বসে রইলাম আমি। আমি জানি আমি সম্পূর্ণ সুস্থ, আর আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। সবটা আমায় জানতেই হবে এবার।
*****
আর একমুহূর্ত ও দেরি না করে ছুটে এসেছি ওই অবস্থাতেই, আমার সাথে কি হচ্ছে, আমার মেয়ের সাথে কি হচ্ছে এর উত্তর আমার জানার দরকার আর সেটা এই মূহুর্তেই। পার্থ যাই বলুক না কেন।
*****
“আমি জানি আপনিই বলতে পারবেন বা আমায় সাহায্য করতে পারবেন, প্লিজ বলুন ওই মহলের নাম শুনে আপনি ওরকম আশ্চর্য হয়েছিলেন কেন?আমি কিন্তু এটা দেখেছিলাম, আর অনুর ওই খানে যাওয়া ওকে ঐভাবে পাওয়া এইগুলো মোটেই স্বাভাবিক নয় আপনি সেটা জানতেন। আমার sathe যা কিছু হচ্ছে তা না হয় ছেড়েই দিলাম .” থামলাম আমি এবার। সমীর আর শঙ্করকেই একমাত্র চিনেছি একদিনে। তাই সাহায্য যদি কেউ করতে পারে ওরাই পারবে তা আমি জানি। তাই এখন ওদের সাহায্য প্রার্থী হয়ে আমি এখানে ওদের সামনে করজোড়ে, নয়তো এরকম চলরে থাকলে খুব শিগগিরই পাগল হয়ে যাব আমি।
*****
“এই হোটেলটা জমিদারবাড়ি থেকে হোটেল হয়েছে ধরুন বছর ১৫ হলো। তার আগে বহুদিন এই বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থাতেই পড়ে ছিল। আমি চাকরিতে ঢুকেছি অবশ্য মাত্র বছর চারেক। শঙ্কর দা তাও ৫ -৬ বছর হয়ে গেল মনে হয়। তাই না? “
সমীরের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল শঙ্কর। আবার বললো সমীর,
“প্রথম প্রথম সব ঠিক ই চলছিল, মানে তখন আমি জয়েনও করিনি তখনকার কথা এটা। শোনা কথা। কাস্টমারদের থেকে এরকম একটা দুটো করে নাকি অভিযোগ আসতে শুরু করে। তবে সরাসরি কারো ক্ষতি হয়নি। একটা দুটো থেকে সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় ১০ হয়ে যায় সংখ্যাটা। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সেই ফ্যামিলি গুলোই কমপ্লেইন করছিল যাদের ঘরে ছোট বাচ্চা ছিল। একবার একজনের বাচ্চা মিসিং হয়, তাকে পাওয়া গেছিল কিন্তু বহু কাঠ খড় পুড়িয়ে, এটা সামনে আসার পর ই বহুদিন বাচ্ছাদের এখানে এলাও করা হতো না। এভাবে কেটে যায় বহুবছর। আর তারপর থেকে আর একবার ও কিছু হয়নি। কি আশ্চর্য ! তারপরে এভাবেই চলছিল। আমি যখন জয়েনও করি তখন ও বাচ্চাদের প্রবেশ নিষেধ। তারপর হোটেল অথরিটিই সিদ্ধান্ত নেয় আবার চালু করা হবে, বাচ্ছাদের নিয়ে আসার ব্যাপারটা। তারপর শুরু ও হয়ে গেল। এই তো আগের বছর থেকেই শুরু হয়েছে আবার নতুন করে। কিছু আর সেরকম কিছু হয়নি। আমরাও ভাবলাম তাহলে বোধহয় ঝামেলা মিটল। এটাই প্রথম। আমরা নিজের ও তাই সেদিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে অবাকই হয়েছিলাম। তবে আপনার সাথে যা কিছু হয়েছে তার ব্যাখ্যা নেই আমাদের কাছে। তবে অনু র সাথে… “
“বলুন অনুর সাথে ঘটা ঘটনা গুলোর ব্যাখ্যা টা কি? কি প্রব্লেম আছে ওই মৃণালিনী মহলে? আমি সেটাই জানতে চাই। ” আমি অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম।
গলাটা ঝেড়ে নিয়ে সমীর বলল, ” দেখুন জমিদারবাড়িতে কম বেশি এরকম ঘটনা জড়িয়ে থাকেই, সময়ের সাথে সাথে চাপা পড়ে যায় শুধু। কিন্তু কিছু জিনিস চাপা পড়ে না। যেমন এটা। মৃণালিনী দেবী ছিলেন এই বাড়ির জমিদারি শেষ হওয়ার আগের প্রজন্মের বৌ ঠাকুরানী। এই জমিদার বাড়ির সর্বময় কত্রী। এবার যা শোনা যায় আর কি, স্বামী, সন্তান, জমিদারি সব কিছু নিয়ে ঠিক ই চলছিল। প্লেগে নাকি মৃণালিনী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র মাত্র ৬ বছর বয়সে মারা যায়। আর তারপর থেকেই সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষটা আগাগোড়া বদলে একটি অন্য মানুষ হতে শুরু করে। ছোট ছেলেকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু স্বামী সাথ দিলেন না। জমিদারমশাইয়ের সাহায্য পেলে হয়তো জীবনের মূলস্রোতে ফিরতে পারতেন, কিন্তু তা হলো না। দিনের এমনকি রাত্রের বেশিরভাগ সময়, জমিদারি, বাগানবাড়ি, নাচ গান, নারীসঙ্গ এইসবে জড়িয়ে পড়লেন জমিদারমশাই, আর মৃণালিনী দেবী হয়ে গেলেন আরো একা।
একটু একটু করে শেষ হয়ে যেতে লাগলেন তিনি। একমাত্র সম্বল দুই বছরের ছোট ছেলে। স্বামীর সাহে অশান্তি একদিন চরম পর্যায়ে পৌঁছালো। আর অবশেষে একদিন এই মানুষটা রাগে দুঃখে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন, পরমাসুন্দরী হয়েও নিজের সৌন্দর্য্যকে নিজে হাতেই পুড়িয়ে শেষ করে দিলেন। গায়ে আগুন লাগালেন, ছেলে কে রেখেই অপঘাতে মৃত্যু হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন উনি।”
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, তারপর আবার বলল সমীর,
“তবে এখানেও অনেক রকমের মতভেদ আছে। কেউ বলে, ওটা নাকি আত্মহত্যা ছিল না। উনি শুধুমাত্র আত্মহত্যা করার ভয় দেখাতে গেছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে আর সামলাতে পারেননি, আগুন ধরে যায় সারা শরীরে। কেউ বলে ষড়যন্ত্র ছিল এর পিছনে, মৃনালিনী দেবীকে মারতেই চেয়েছিলেন জমিদার মশাই। তাই আসলে মরতে না চাইলেও ষড়যন্ত্রের জালে ফেঁসে আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয় রানীমার। সত্যি টা আসলে কি কেউ জানে না। তবে এটা ঘটে, আর মৃণালিনী দেবী মারা গিয়ে ও এই মৃণালিনী মহল, নিজের ছোট ছেলে, এই সংসার এইসব কিছুর মায়া পারেননি ত্যাগ করতে। এখানে বাচ্চাদের সাথে যত ঘটনাই ঘটেছে কোনোটিতেই কোনো বাচ্চার ক্ষতি হয়নি, উল্টে যেন অনেক বিপদ ঘটতে পারত কিন্তু অদ্ভুত ভাবে রক্ষা পেয়েছে তারা। নিজের মাতৃত্বের অস্তিত্বকে মারা গিয়ে ও শেষ করতে পারেননি মৃণালিনীদেবী। শেষদিন অনুর সাথে ঘটা ঘটনা টাও তাই। আর আপনার কোনো চিন্তা নেই, আর যাই হয়ে যাক, অনুর কোনো ক্ষতি হবে না।”
এতক্ষণ বলে চুপ করল সমীর, আমি ও চুপচাপ বসে ছিলাম, কথা গুলো শোনার পর আর বেরোতে পারছিলাম না ঘোরটা থেকে।
আবার বললো সমীর, “উনি শুধু রূপবতীই না, গুণবতীও ছিলেন বটে। এই বাড়িতে টাঙানো এমন অনেক গুলো পেইন্টিং আছে যেগুলো মৃণালিনী দেবীর নিজের হাতে আঁকা। অসাধারণ আঁকার ক্ষমতা ছিল, আপনি নীচে খাবার জায়গাটায় গেলেই দেখতে পাবেন। “
এতক্ষণে শঙ্কর বলল, “আসলে মাতৃত্ব ভারি বিষম বস্তু, পৃথিবীর কোনো শক্তিই মাতৃশক্তির সাথে পেরে ওঠে না। মাতৃত্বের টান এড়ানো এত সহজ নয়। “
আমি আর কোনো কথা বলতে পারছিলাম না, ইচ্ছে ও করছিল না কথা বলতে। বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। সমীর ও এলো আমার সাথে, আমার ঘরে জলটা পৌঁছে দিতে। নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে হোঁচট খেলাম, তাড়াহুড়োয় দরজাটা খুলেই বেরিয়ে গেছলাম, আর নিজে নিজে দরজা বন্ধ হয়ে ভিতর থেকে লক হয়ে গেছে, চাবি ঘরের ভিতর, আর ঘরে খাটের উপর অনু একা ঘুমোচ্ছে। আর একটা এক্সট্রা চাবি পার্থ নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এবার যদি ঘুম ভেঙে অনু আমায় না দেখতে পায়, তাহলে তো… আর যদি খাট থেকে নামতে গিয়ে গড়িয়ে যায়…
” কিছু চিন্তা করবেন না, অনুর কোনো ক্ষতি হবে না, হতে দেবেই না। আপনি একটু শান্ত হন। “
আর সত্যি সত্যিই সমীরের কথায় শান্ত ও হয়ে গেল মনটা অদ্ভুত ভাবেই। সত্যি ই যেন কেউ বলল কোনো ভয় নেই।
*****
আমার সাথে ঘটা ঘটনাগুলোর কোনো ব্যাখ্যা, কোনো উত্তর পাইনি আমি। হয়তো দুই মাতৃত্বের মাঝে অসম সংঘাত, কিংবা হয়তো সত্যিই আমি হালুসিনেট করেছিলাম, হয়তো সত্যিই স্বপ্ন বা মনের ভুল। ?
সত্যি ই অনুর কোনো ক্ষতি হয়নি সেদিন। যতক্ষণে দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছিলাম, খাটের একেবারে ধার অবধি চলে এসেছিল ও, কেউ যেন অদৃশ্য হাত দিয়ে আগলে রেখেছিল ওকে।
যাই ঘটে থাকুক, আমি আর এখানে না থাকারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ আমি চলে যাচ্ছি এই সুপারিপুর থেকে। যাওয়ার আগে সকলকে বিদায় জানানোর পালা, গাড়িতে অনু কে নিয়ে ওঠার আগে কি মনে হল একবার জিজ্ঞাসা করলাম সমীর কে, “আচ্ছা মৃণালিনীদেবীর কোনো ছবি পাওয়া যাবে কি?”
জানি না কেন জিজ্ঞাসা করলাম, হয়তো একটু বেশিই জড়িয়ে গেছি, জানি না।
এক সেকেন্ড ভেবে নিয়েই সমীর বলল, ” হ্যাঁ কেন থাকবে না? উনি ইনফ্যাক্ট নিজেই নিজের একটা অসাধারণ ছবি এঁকেছিলেন, কিন্তু সেটা কে ঠিক ভাবে সংক্ষরণ না করার জন্য অবস্থা খুব খারাপ। “
“তুমি আমায় পরে হলেও ছবিটার একটা ছবি তুলে পাঠিও। “
*****
মাধবীলতা ছেড়ে চলে আসি আমি, মাধবীলতা ও আমার মধ্যে থেকে মুছে যাচ্ছিল একটু একটু করে। কিন্তু সেদিন সমীরের পাঠানো ছবিটা আরেকবার ভাবিয়ে দিয়ে গেল আমায়। ছবিটা অবিকল আমার দেখা সেই রাত্রের ছায়াশরীর এর মতোই, সেই একই রকম পোশাক, একই রকম খোলা চুল, গয়না, কপালে টিপ, এমনকি পায়ের নূপুরটাও। মানে আমি হালুসিনেট করিনি! সেই রাত্রের ঘটনা কোনো স্বপ্ন ছিল না, আমি একদম ঠিক দেখেছিলাম! কিন্তু আমি ই কেন? মৃণালিনী দেবী কি আমার কাছে বার বার কিছু বলতে চেয়েছিলেন? কিছু জানাতে বা বোঝাতে চেয়েছিলেন? এর উত্তর আজ ও আমার কাছে নেই।
।।সমাপ্ত।।