আমরা যখন সুপারিপুরের এই বাগানবাড়িতে ঢুকলাম ,তখন বেলা ১১ টা বেজে গেছে। ফরচুনারটা বাগান এর সাথেই লাগোয়া পার্কিং লট এ পার্ক করিয়ে রাখল পার্থ , আমার স্বামী। আমি অনু, মানে আমাদের ছোট্ট অনন্যাকে কোলে নিয়ে ঢুকলাম ভিতরে, আরেক হাতে আরেকটা ব্যাগ। ট্রলিটা নিয়ে ঢুকছে এখানকার কেয়ারটেকার। আপাতত এখন একমাসের জন্য আমাদের ঠিকানা এই সুপারিপুরের ‘মাধবীলতা’। পার্থকে লোকাল সাইট সার্ভে করতেই বেশি যেতে হবে কাল থেকেই, ইঞ্জিনিয়ার হলে যা হয় । আমি ও ভাবলাম কটা দিন একটু ঘুরেই আসি। অনু হওয়ার পর থেকে এই প্রথম ঘুরতে বেরোনো আমাদের। নয়তো উনি যা ভোগেন এবং আমাদের সকলকে যা ভোগান, তারপর আর কি ঘুরব ! এখানে ঘরের মতোই সবকিছু। ইচ্ছে হলে বেরোব না হলে বারান্দায় বসে সামনে পাহাড়ের কোলে মেঘ দেখব, আবার কি ! দরজা ঠেলে ভিতরে রিসেপশনে ঢোকার আগে এক মুহূর্ত দাঁড়ালাম বাইরে, চারপাশটা রোদে ঝলমল করছে। এই রোদে গা পোড়ে না। বরং মনটা আনন্দে ভরে যায়, ঠিক যেন পুজোর আগে শরতের রোদ ঝলমলে আকাশ, পেঁজা তুলোর মতন মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে পরিষ্কার নীল আকাশটায়, তফাৎ বলতে শুধু যোগ হয়েছে হালকা ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি, একটা শিরশিরানি, সেটাও বেশ লাগছে। আর দূরে দাঁড়িয়ে পাহাড়, আমাদের অপেক্ষায়।
*****
এই বাড়িটা আগে একটা জমিদার বাড়ি ছিল। এখন বাড়ির সদস্যরা ছড়িয়ে গেছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ,এমনকি বিদেশেও। জমিদারি গেছে বহুদিন। তাই এখন জমিদারি না থাকলেও জমিদারি ঠাটবাট, থাকা খাওয়াদাওয়ার সুব্যবস্থা বজায় আছে , অতিথিদের জন্য, উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে। বছরের বিভিন্ন সময়ে বহু মানুষ শহরের সিমেন্ট কংক্রিট আর ধূসরতা থেকে মুক্তি পেতে, ছুটি কাটাতে চলে আসে এখানে। এখানকার জমিদারি হালচাল আর সঙ্গে অপরূপ সুন্দর এই মালভূমি অঞ্চলের পরিবেশ, যেন মনে হয়এখানেই থেমে যাক সময়। এই জমিদার বাড়ির আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা কত শত ইতিহাস , এই কদিনে কি সম্ভব সব জানা? তাই যখন এই জমিদারি হালচাল প্রায় এক মাস ধরে উপভোগ করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পেলাম তখন আর দু’বার ভাবিনি। পার্থর দৌলতে আমার আর অনুর এখানে ভালোই সময় কাটবে। মালপত্র নিয়ে এসে ঘরে নামিয়ে দিয়ে গেল শঙ্কর। ঘরটা বেশ বড়। একদিকে স্টাডি টেবিল ও আছে। আর একদিকে খাট, জামাকাপড় রাখবার দেয়াল আলমারি ,ঘরের সাথেই এটাচ্ড বাথরুম। ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে দেখা যাচ্ছে সামনে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়, সূর্যের আলোর ছটা প্রতিফলিত হচ্ছে ঘরের ভিতরের বিশাল আয়নাতে। আর ঘরের ভিতরের প্রতিটি আসবাবই পালিশ করা, সেটা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে আরো। খাট টাও আগেকার দিনের ছতরি দেয়া মেহগনি কাঠের তৈরী, কি সুন্দর সেই কাঠের কারুকাজ।ঘরটায় বেশ ব্রো একটা ঝাড়বাতিও আছে দেখলাম। সূর্যের আলোয় মনে হচ্ছে যেন কাঁচ নয় হিরে লাগানো আছে ওতে।
*****
গোছগাছ করতেই আজ সারাটা দিন চলে যাবে। তার মধ্যে অনু আছে। পার্থ তো নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকবে। তাই আজ হাতে সময় একদম নেই। ঘরে ঢুকে মিনিটখানেক দাঁড়িয়েই কাজে হাত লাগালাম। ঘড়িতে বেলা ১২ টা প্রায়। এখানে আবার খাওয়া দাবার একটা সময় আছে এদের, সবাই খাবার ঘরে বসেই খায়। খুব প্রয়োজন না হলে কেউই ঘরে খাবার আনায় না। আসলে খাবার ঘরটাও এত্ত সুন্দর, কত জায়গা থেকে কত লোকজন আসে, যে ঘরকুনো র মতো একা ঘরে খেতে ভালো লাগার কথাও নয়। দুপুর দেড়টায় ভাত খাবার সময়। তাই তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সারতে লাগলাম।
*****
অনু এখন আগের থেকে অনেক বুঝতে শিখেছে। কবে মা বাবা খুব ব্যস্ত আর কবে মা বাবার একদম সময় নেই এখন সেটা ও বুঝতে পারে। তাই শান্ত লক্ষ্মীটির মতোই থাকে আমার মেয়েটা। আজ যেমন বুঝতে পেরেছে মায়ের হাতে সময় নেই ,আর বাবার ব্যস্ততা এই শুরু হলো ,তাই একটু ও জ্বালায়নি। স্নান করতে জামা পরতে আজ কোনোরকম নখড়া করেননি ম্যাডাম। অনুর বয়স এই অক্টোবর এ দেড় বছর হল। ছোট্ট টুকটুকে ফর্সা মুখখানা, একরাশ কোঁকড়া বাদামি রঙা চুল, লাল টুকটুকে ঠোঁট, নাদুসনুদুস চেহারা, তার মধ্যে পরিয়ে দিয়েছি একটা লাল ফ্রক। এখন আধো আধো গলায় কথাও বলে ভালোই। দেখতে সকলে বলে নাকি আমার মতোই হয়েছে, কিন্তু আমার তো মনে হয় ওর বাবার মতোই হয়েছে। চোখ দুটো অবিকল পার্থর মতোই। আমার খোলা চুল নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে টানাটানি শুরু করেছেন তিনি। ওকে মাথায় দুটো ঝুঁটি বেঁধে দিয়ে লাল ক্লিপ গুলো খুঁজতে লাগলাম আমি। ছোট থেকেই সাজগোজের প্রতি টনটনে জ্ঞান মহারাণী। সাজ ঠিক হয়নি মনে হলেই চিল চিৎকার জুড়বে। কিন্তু ড্রেসিং টেবিল থেকে আরেকটা সাজের ব্যাগ নিয়ে ক্লিপটা খুঁজে অনুর কাছে আসতেই দেখি ঘর ফাঁকা! খাটের উপর অনু নেই। বুকটা ধড়াস করে উঠল আমার। কোথায় গেল মেয়েটা? খাটের এধার ওধার দেখলাম। না, কোথাও নেই তো। ঘরটা বিশাল, এদিক ওদিক তাকালাম কোথায় গুড়গুড় করে হেঁটে পালাল আবার। বাথরুমে ঢুকে গেল না তো ? তাড়াতাড়ি বাথরুমটা দেখলাম একবার। কিন্তু না এখানেও নেই। ও কি বেরিয়ে গেল নিজে নিজে ঘর থেকে? তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে ভিতরের দিকের বারান্দায় এলাম আমি। কিন্তু কোথায় কি। সুবিশাল বারান্দার অপর প্রান্ত অব্দি যতদূর চোখ যায় নেই অনু। পাশের ঘর বন্ধ। মানে আর কারো ঘরে ঢুকে যেতেই পারে। কিন্তু আমাদের ঘরের দুপাশের ঘরেই এখনো অব্দি কোনো বুকিং নেই। তাহলে গেল কোথায় ?এবার আমার চিন্তা হচ্ছে। প্রায় ৫ – ৭ মিনিট হয়ে গেল অনু আমার দৃষ্টির আড়ালে। এখন যা দিনকাল, এই সময়টুকুই যথাযত একটা বাচ্চার কোনো বিপদ ঘটার ক্ষেত্রে। পার্থ এখন কোথায় আছে? আর কিছু ভেবে সময় নষ্ট করার দরকারই নেই। তারাত্রই ফোনটা নিয়ে ডায়াল করলাম আমি।
*****
“খুঁজে পাচ্ছ না মানে ? কি বলছ? এই তো এসছ এক বেলাও হয়নি। মেয়েটা তো কিছুই চেনে না সব নতুন, এর মধ্যে তাহলে যাবে আর কোথায় ?”
“আরে সে আমি কি করে জানব? আমি কি খুঁজিনি। না পেয়েই তো ফোন করছি। প্লিজ তুমি এস আগে। “
ফোনটা রেখে দিলাম আমি। ওইটুকু একটা মেয়ে, কোথায় যাবে, কিভাবেই বা যাবে দূরে। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার টেনশনে। এই তো কয়েক ঘন্টা হল এসেছি। এই টুকু সময় ও নিজের মেয়েটাকে সামলে রাখতে পারলাম না ? কেমন মা আমি? বাড়িতে কি বলব? আর অনু তার যদি কোনো বিপদ হয় তাহলে…না না না , বেশি ভাবছি আমি। কিছু হবে না ওর। একবেলাও হয়নি এখানে এসেছি ,এসেই কি অঘটন। কে জানে সারাটা মাস কি যাবে ?আমার মন টা একটা জানা আশঙ্কায়…ওই তো পার্থ এসে গেছে ।
“কি ব্যাপার বলতো ?এরকম জায়গা থেকে অনু কোথায় যাবে? সম্ভবই নয় যাওয়া। বাইরে সিসিটিভি আছে সিকিউরিটি আছে, অসম্ভব বাইরে বেরোনো। তুমি বলো ঠিক কি হয়েছিল।”
পার্থ আসতে একটু যেন ভরসা পেলাম, আসলে কি করব কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এরকম অজানা অচেনা পরিবেশ, বাড়ি থেকে এত দূরে, কিছু হয়ে গেলে করবই বা কি। আর অনুর কিছু হলে তো আমি নিজেই শেষ হয়ে যাব।
পার্থ কে ঠিক কখন থেকে অনু কে দেখিনি কি কি হয়েছিল সব বিস্তারিত বললাম। পার্থ আর দেরি না করে কেয়ারটেকার কে ডেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল খুঁজতে। আমায় বললো এই দিকটা খুঁজতে। খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠেছে। আগে মেয়েটা কে পেতে হবে। আমি ও আর দেরি না করে সঙ্গে এইখানকার একজন স্টাফ কে নিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম।
কিন্তু এত্ত বড় একটা প্রপার্টি, খোঁজা কি চাট্টিখানি কথা। অন্দরমহল, বাহির মহল, বৈঠকখানা, খাজাঞ্চিখানা, কত শত যে শোবার ঘর, বাগান, নীচের দালান, গ্যারেজ, কোনো কিছু বাকি রাখলাম না। তন্ন করে খুঁজছি এক একেকটা ঘর, আর যতবারই খুঁজছি মনে হচ্ছে এইবার বোধহয় পেয়ে যাব আমার অনুকে।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে চলল এই অনুসন্ধান পর্ব। চোখ ফেটে জল আসছে আমার। কি কুক্ষণে এই সুপারিপুরে অনু কে নিয়ে আসতে গেলাম আমি। কোনোদিন ওকে নিয়ে বেরোয়নি এই প্রথম ,আর প্রথম বারেই… বেজে উঠল ফোনটা। পার্থ ফোন করছে। তাড়াতাড়ি ধরলাম ওর ফোন।
“হ্যালো। পেলে কোন খোঁজ। “
“হ্যাঁ পেয়েছি ,কিন্তু তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি একবার মৃণালিনী মহলে এস।”
“কেন কি হয়েছে অনুর? ও ঠিক আছে তো নাকি?”
“তুমি এস সব বলছি তারপর। তাড়াতাড়ি এস।”
আমায় আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল পার্থ। বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করতে শুরু করল আমার। পার্থ এভাবে কথা বলল কেন? কি হলো অনুর ? আমার সঙ্গের স্টাফটির নাম সমীর , তাকে বললাম মৃণালিনীমহলে যেতে হবে। ওখানেই পাওয়া গেছে অনুকে। কিন্তু তাকে কথাটা বলার পরই তার মুখে ভাবভঙ্গির পরিবর্তন স্পষ্ট চোখে পড়ল আমার।
আমি আর তখন কথা না বাড়িয়ে সমীরের সাথে দৌড় লাগলাম মৃণালিনীমহল এর দিকে।
*****
আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকে মৃণালিনীমহল দৌড়ে পৌঁছাতেও সময় লাগল দশ থেকে বারো মিনিট , মাথায় তখন একটাই চিন্তা চলছে, অনু কে যেন সুস্থ অবস্থায় পাই ঠাকুর! এই জমিদারবাড়িতে বিভিন্ন মহলের বিভিন্ন নাম আছে দেখে প্রথমে একটু আশ্চর্যই হলাম। পরে জিজ্ঞাসা করতে সমীর ই বলল, কথিত আছে এই মহলটি বৌ ঠাকুরানী মানে এই বংশের শেষ জমিদার গিন্নির মহল ছিল। তারপর আরো একটা প্রজন্ম রাজ করেছে বটে, তবে প্রভাব প্রতিপত্তি, আধিপত্য ছিল পড়তির দিকে। আসল ঠাটবাট জমিদারি প্রথা ছিল এই জমিদার গিন্নির আমল অবধিই, মানে জমিদারমশাই শ্রী প্রতাপ নারায়ণ মুকুটির আমল অব্দিই। তবে এই মহলটি অতিথির জন্য খোলা হয় না ,বন্ধই থাকে। এই বন্ধ মহলের দরজা পেরিয়ে একটা বাচ্চা এখানে এল কি করে সেটার জন্যই সমীরের মুখে চিন্তার ভাঁজ। আর সমীরের কথা শুনে আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল আরো কয়েক গুণ। পার্থকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দৌড়ালাম ঐদিকেই। হাঁপাতে হাঁপাতে গেলাম ওর কাছে।
“কি গো অনু কোথায়? কি হয়েছে ?ফোন এ কিছু বললে না যে? আমায়…”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাতের ইশারা করে সনের দিকে দেখাল পার্থ। ওর হাত অনুসরণ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম আমি ! এ কি করে সম্ভব? আমার নিজের চোখকে অবিশ্বাসই বা করব কি করে ?
বিরাট হলঘরের মতো একটা ঘর, ঘরে ঢাকা দেওয়া অজস্র আসবাব, তার উপর ধুলোর আস্তরণ ,ধুলো জমেছে মেঝেতেও, ঘরের দরজা জানলা বহুকাল বন্ধ সে বোঝাই যাচ্ছে, মাথার উপর ঝুলছে ঝাড়বাতি, এই অজস্র আসবাবের মধ্যেই একটা দোলনা মতন আসবাব, ধুলোয় মাখা ওর উপরের ঢাকাটা মেঝেয় লুটোপুটি খাচ্ছে ,,আর সেই দোলনাতেই বসে খিলখিলিয়ে নিজের মনে হাসছে অনু। হাতে একটা বহু পুরোনো ভেঙে যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া তুলি, সেটা নিয়েই খেলতে ব্যস্ত অনু। এতক্ষণ ধরে মা বাবাকে ছেড়ে এরকম একটা ঘরে আটকে পড়েছে বলে চোখে মুখে ভয় বা কান্নার লেশমাত্র নেই। আমি হতবাক ! এ কি ভাবে সম্ভব? তাকালাম পার্থ র দিকে ,একই জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে ও ও, ততটাই হতবাক শঙ্কর আর সমীর ও।
।। ২।।
অনু কে ঘরে নিয়ে এলাম যখন কোলে করে, তখন প্রায় বিকেল ৪ টা বাজছে। না ,অনু সম্পূর্ণ সুস্থ ,আধো আধো গলায় হাত পা নেড়ে অনেক কথা বলতে বলতেই এলো ও। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, মাম্মা বলে ডাকে ও আমায় ,শুধু সেটুকুই বুঝছিলাম ,আরো কারো একটা কথা যায় বোঝানোর চেষ্টা করছিল বলতে, কিন্তু ওর ভাষা বোঝার মতো মানসিক ও শারীরিক শক্তি ও অবশিষ্ট ছিল না আমার। আমি শুধু ওকে সুস্থ ভাবে ফিরে পেয়েই শান্তি পেয়েছিলাম, কিন্তু তখন ও যে অশান্তির আরো বড় কারণ বাকি কে জানতো। ঘরে ফিরে ওর হাত পা পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে ওকে নিয়েই খেতে গেলাম আমরা। আর এক মুহূর্ত ও ওকে আমার চোখের আড়াল হতে দেব না আমি ঠিক করে নিয়েছি। এখানকার খাবারের ব্যবস্থাও রাজকীয়। ভাত, ডাল, সুক্তো, ভাজা মাছ, মাংস, চাটনি দিয়ে সাজানো ছিল দুপুরের খাবারের থালা। যতই মন তা কে ঘোরানোর চেষ্টা করি চারপাশের মানুষজনদের সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করি না কেন, এত সুস্বাদু খাবার, এমন মনোরম পরিবেশ ,অনু কে পেয়েও মনটা খচ খচ করছিলই। কিছু একটা যেন গোলমাল লাগছে বড়।
*****
এই জমিদারবাড়ি আর গোটা জমিদারি মনে হয় হাজার খানেক বিঘে নিয়ে। বহু বিস্তৃত, এরাই সন্ধ্যেবেলা নাচ গানের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। পার্থ, আমি আর অনু সন্ধ্যেবেলা গেলাম সেখানে। ওখানে গিয়ে মনটা সত্যি ভালো হয়ে গেল। আর যেন কোনো দুশ্চিন্তা ই গেড়ে বসতে পারছে না মনে। এখানকার লোকাল মানুষজন, গ্রামবাসীরা, এদের মুখের সরল হাসিটা, এদের সরল জীবন যাপন দেখে সত্যি খুব ভালো লাগছিল মনটা। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গেছিলাম দুপুরের ঘটনাটা। সারা বাড়িটা সন্ধেবেলা আলোয় ঝলমল করছে, যেন মনে হচ্ছে নববধূ সেজেছে , অজস্র রঙিন ঝিকমিক আলোয় ঝলমল করছে গোটা বাড়ি, চারিপাশ। এত আলোয় মন খারাপ থেকে নাকি কারো। বাড়িতে ভিডিও কল করলাম, এই অপরূপ সাজ দেখে বাড়ির লোকজন ও আপ্লুত, ওদের আর দুপুরের ঘটনা বললাম না কিছু। রাত্রের খাওয়া সেরে আমরা যখন ঘরে ঢুকলাম তখন প্রায় ১০ টা । সারাদিনের এত ধকল, এত ঘটনার ঘনঘটা, শরীরের আর কি দোষ। নরম বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই চোখে নেমে এলো ঘুম।
*****
রাত মনে হয় দুটো কি তিনটে হবে, জানি না ঠিক। ঘুম ভাঙার পর দুটি ঘন্টা পড়ল, তার আগে আর একটা ঘন্টা পড়েছে কি না জানি না। ঘুম টা ভেঙে গেলো, বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া, কয়েক মুহূর্ত লাগলো চারপাশটা দেখে বুঝতে আমি কোথায়। চারপাশটা তাকিয়ে মনে পড়ে গেল আমি তো সুপারিপুরে। জমিদারবাড়িতে একটা বিশাল মাপের ঘড়ি আছে, যার ঢং ঢং আওয়াজ পেলাম কানে, এটা নাকি সেই তখন থেকেই চলছে, নিরলস। কোনোদিনই খারাপ হয়নি আজ অবধি। উঠে বসলাম।
ঘরের লাগোয়া খোলা ব্যালকনিটা থেকে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের দাবার ছক মেঝেয়। চারপাশের গাছগুলোয় একটা দুটো জোনাকি ও চোখে পড়ল। চারপাশে সমস্ত গাছপালা যেন মনের আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে চাঁদের জ্যোৎস্নায় , সে এক অপরূপ দৃশ্য। সামনে বিশাল বাগান ,আর দূরে দাঁড়িয়ে পাহাড়। গিয়ে দাঁড়ালাম ওই জ্যোৎস্না মাখা ছোট্ট ব্যালকনিতে। উফফ ! মন প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল, ভাগ্যিস ঘুমটা ভাঙল। নয়তো রাতের এমন দৃশ্য তো অধরাই থেকে যেত। ঘরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে বাপেতে মেয়েতে, সেদিকে দেখলাম একবার। প্রাণ ভরে প্রকৃতির এই অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম ,তখন ই চোখে পড়ল জিনিসটা।
সামনের ডানদিকের কোণ করে আর একটা যে বিল্ডিং, যেটার নাম মৃণালিনীমহল বলে জানলাম, সেই মহলে তো কারো যাওয়া আসার বালাই নেই। তাহলে ওই মহিলা কে? চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখলাম, খোলা চুল, সাধারণ ভাবে পরা শাড়ি, আঁচলটা একটু বেশিই লম্বা, মাটিতে লুটোচ্ছে, এর থেকে বেশি কিছু এত দূর থেকে বোঝা সম্ভব ও নয়। আমি হাঁ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ, কে এই মহিলা?এই রাত দুপুরে এই রকম বেশে? ওই বারান্দায় তো কারো থাকার কথা নয়। অজানা কারণেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন ঢিপঢিপ করতে লাগল। এই বুঝি জোরে একটা হাতুড়ির ঘা দেবে বুকে, ,বারান্দার ওই প্রান্ত থেকে এই প্রান্ত হেঁটে বেড়াচ্ছে মহিলা, পুরো মহলটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাহলে কি ভাবে সম্ভব? না ,কেমন যেন লাগছে এবার জায়গাটা।
হঠাৎ করেই ওই মহিলার চলা গেল থেমে, বারান্দার থাম ধরে দাঁড়াল এই দিকেই ফিরে , আর তারপরেই… তারপরেই ওই দূর থেকে ও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, অস্বাভাবিক সাদা গায়ের রং , একে ফর্সা না বলে ফ্যাকাশে বলা উচিত। মনে হলো দেহে অলংকার আছে বেশ কিছু , কারণ চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল , কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম সে ওই দূর থেকেও আমার দিকেই চেয়ে রয়েছে।আমি ওই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও ঘামতে শুরু করলাম রীতিমতো, কি ভয়ঙ্কর সেই দৃষ্টি ,চোখ দুটো যেন জ্বলছে ভাটার মতো , দূর থেকেও স্পষ্ট সেই চাহনি, এলো চুল , একটু একটু করে যেন এগিয়ে আসছে ওই মহিলা আমার দিকে। কিন্তু এ কি করে সম্ভব। ভেসে আসছে সে, হাওয়ার মতন উড়ছে যেন ওর শরীরটা, চোখ দুটোয় চরম ক্ষিপ্রতা ,যেন এখুনি শেষ করে ফেলবে আমায়। আমার হাঁটা চলার ক্ষমতা টুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছি , গলা দিয়ে আওয়াজ ও বেরোচ্ছে না, অথচ আমার স্বামী সন্তান তো আমার কাছেই আছে। তও যেন নড়ে একটু গলা দিয়ে আওয়াজ বের করে তাদের ডাকতে পারছি না আমি। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে , একেবারে অন্ধকার হওয়ার আগের মুহূর্তে কানে এলো খুব কাছেই কোথাও নুপুরের শব্দ !