অশরীরী

।।১।।

কলকাতার বাইরে এই প্রথম পা রাখল ঈশা। মা বাবার একমাত্র আদুরে মেয়ে, তার উপর বাড়ির সব থেকে ছোট সদস্য, একটু বেশিই আদরের। কিন্তু চাকরির পোস্টিং যেখানে, ছাড়তে তো হবেই, তাই অবশেষে মা বাবার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আজ সুদূর পশ্চিমগামী ঈশা। পশ্চিমগামী বলতে পশ্চিম ভারতের স্বপ্নের নগরী, মুম্বাইয়ের কথা হচ্ছে।

৩৫ ঘন্টার জার্নি শেষে ঈশা যখন পূর্ব নির্ধারিত ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছাল, তখন বেলা ২টা। বাড়ির ল্যান্ডলর্ড-এর সাথেও পরিচয় হল। ভদ্রলোক চাকরি করতেন দক্ষিণে, রিটায়ারমেন্টের পর নিজের ভিটেয় ফিরে এসেছেন। একটা ফ্ল্যাট ছিলই, আরেকটা বৈবাহিক সূত্রে পেয়েছেন। সেই ফ্ল্যাটেই ভাড়া নিয়ে এল ঈশা।

বাপি আর মাকে সঙ্গে নিয়েই এসেছে ও, মাকে নিয়ে আসার প্ল্যানটা ওর ছিলই কারণ প্রথমেই একটা ফ্ল্যাট সাজানো ওর একার কম্ম নয় তা ও জানত। কিন্তু বাপি যে এভাবে ছুটি নিয়ে চলে আসবে ভাবতে পারেনি। যে মানুষটা খুব দরকার না হলে কোনওদিন অফিস থেকে ছুটি নেয়নি, সেই মানুষট… ভাবতে পারেনি ঈশা। ও জানে আসলে বাপির ওর জন্য ঠিক কতটা মন খারাপ, তাই যখন বাপিও বলল সঙ্গে যাবে, ও মা-র দিকে তাকিয়েছিল শুধু। বাবা তো আর সামনে কিছু বলবে না, কিন্তু বাপির ছলছল চোখ দেখে ঈশার ও মন খারাপ হচ্ছিল বৈকি। তাই আর বাপিকে আসতে মানা করেনি।

মিঃ শর্মা হাতে চাবি নিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন চারপাশটা। ফ্ল্যাটটা মোটামুটি ঈশার জন্য বড়। কনস্ট্রাকশন চলছে এখনও, তাই ভাড়াটা এখন কম। ঢুকেই একটা মাঝারি মাপের ঘর, ডানদিকে খাওয়ার জায়গা করা যেতে পারে। প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে ডানদিকে রান্নাঘর, প্যাসেজের বাঁদিকে একটা বেডরুম, পাশে একটা বাথরুম আর নাক বরাবর প্যাসেজ ধরে সোজা গিয়ে যে দেওয়ালে ধাক্কা খাবে, তাতে আর একটা বেডরুম, অ্যাটাচড বাথরুম, ব্যালকনি। সামনে সমুদ্রও দেখা যায়, অসাধারণ একটা ভিউ! এই বেডরুমটাও বড়, ঈশা ঠিক করল এটাতেই থাকবে, মা বাবা এলে আর একটা বেডরুম তো থাকলই।

*****

দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া সেরেই এসেছিল ওরা, সেই তখন থেকে শুরু করে এতক্ষণে মোটামুটি মিটল গোছগাছ ,ভাগ্যিস কাল রবিবারঅশরীরী ,কালকের দিনটা রেস্ট নিয়ে সোমবার থেকে জয়েনিং। কাল একটু বেরোবে, আশেপাশে দোকানপাট গুলো ও দেখে নিতে হবে ,বাপি ইতিমধ্যেই দুবার বেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে দেখে ফেলেছে। ল্যান্ডলর্ড বেশ ভালো মানুষ, ওনার স্ত্রী ও বেশ ভালো, আজ রাত্রে অনেকবার করে ওদের খেতে বলল, এত খাটাখাটনি পর রান্নাবান্না তো আর সম্ভব না। ওরাই রাজি হলো না কিছুতেই ,তখন খানিকটা জোর করেই কিছুটা খাবার মি; শর্মার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। ঠিক হলো আগামীকাল রাত্রের ডিনার মি: শর্মাদের বাড়িতেই সারা হবে, আর সঙ্গে ঈশার মা ও স্পেশাল চিকেন কষাটা বানিয়ে নিয়ে যাবেন।

*****

সব সেরে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসল যখন ওরা, রাত প্রায় ১১  টা, আজ বাপি কাছের একটা দোকান থেকে অনেক কষ্টে খুঁজে পেতে রুটি কিনে এনেছে, কিন্তু যা দাম ! এই প্রথম এই শেষ, বাড়ির রুটি ভাতই ঠিক আছে, আর রুটি কিনে কাজ নেই।  রুটি,পনির, ডিম কারি দিয়ে ডিনার সেরে উঠেই সোজা খাটে শরীরটা এলিয়ে দিল ঈশা। সারাদিনের ধকল শেষে চোখে ঘুম নামা এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।

।। ২।।

এক ঘুমে সকাল ! কতদিন পর যে এত গাঢ় ঘুম হলো !

ঘুম থেকে উঠে ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে সামনের সমুদ্রের গর্জন চোখ বুজে শুনছিল ঈশা। ভোরের আলোয় হালকা হালকা রোদের আঁচ লাগতে শুরু করেছে, ঘড়ি বলছে ৬ টা। বারান্দাটায় একটা ছোট্ট বেতের চেয়ার টেবিল আছে, এটা আগে থেকেই ছিল এখানে, ওটাই ঝেড়ে ঝুরে নিয়ে বসার মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে ঈশা। কালকেই ভেবে রেখেছিল আজ সকালের চা-টা এই সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়ার সামনে বসেই খাবে। বাপি এখনো ওঠেনি, এতটা ধকলে শরীরটা ক্লান্ত, মা উঠে পড়েছে যদিও। মা যতটা পারছে গুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, একটু পরে বাজারে বেরোবে ওরা , আগামী পরশু ই ফিরে যাবে মা বাপি, তখন তো ওকেই করতে হবে সবটা। মা বাপি কে ছেড়ে এই প্রথম একা থাকবে ঈশা, ব্যাপারটা প্রথমে খুব রোমাঞ্চকর লাগলেও এখন বেশ মন খারাপ ই লাগছে। মায়ের গন্ধটা, ওর পরিচিত নরম পাশ বালিশটা, ওর ছোটবেলার নরম কচ্ছপ পুতুলটা, ওর লেখা পড়ার টেবিলটা, ওর মন খারাপের অলস দুপুরের নরম সরম বিছানাটা, এগুলোতো আর এখন নেই ওর সাথে। তাই এইগুলোকে সত্যিই এবার মিস করবে ও। বারান্দাটার রেলিংটা সাদা রঙের, আঙ্গুল ছোঁয়ালো ও, এবার এই অজানা শহরটাকেই আপন করে নিতে হবে, জোরে একটা শ্বাস নিল ঈশা।   

*****

জীবনে প্রথম সব কিছুই স্মরণীয় হয়। আজকের দিনটাও ঈশার কাছে বিশেষ, ওর প্রথম চাকরি, প্রথম অফিসে নিজের সিট, প্রথম কাজ , প্রথম সবকিছুতেই একটা অন্যরকম অনুভূতি, অন্যরকম ভালোলাগা ছড়িয়ে আছে। বাড়ি ফেরার পর, মানে ওর এই ভাড়া ফ্ল্যাটটাই এখন ওর বাড়ি, সেখানে ফেরার পর মা বাবা কে সারাদিনের সমস্ত খুঁটিনাটি বলছিল ঈশা। কাল সকালেই মা বাবা চলে যাবে, তার আগে যতটা সময় সম্ভব মা বাবার সাথে থাকতে চায় ও। আজ অফিসে থেকে ফিরে ঘরটা দেখে অবাক ই হয়ে গেছে ঈশা। কি সুন্দর করে এরমধ্যে সাজিয়ে ফেলেছে মা ঘরটা। এই জন্যেই বোধহয় বলে মায়েদের হাতে জাদু আছে। ওর ঘরটার লাগোয়া বারান্দাটায় কত ছোট্ট ছোট্ট টব, তাতে নাম না জানা কত গাছের চারা।  নাহ, আর একা থাকতে কষ্ট হবে না ঈশার। রেলিং টার সাথে জড়িয়ে বাহারি রঙিন ঝিকিমিকি আলো, আলো গুলো জ্বলবে না হয় সারারাত, পাহারা দেবে গাছগুলোর সাথে, আর বেড এর সামনের দেওয়ালটা জুড়ে একটা ফটো, মা বাপি আর ও। যে বছর সিমলা বেড়াতে গেছিল তখনকার ছবিটা, বরফের মাঝে ওরা তিনজন, এই ছবি টা খুব প্রিয় ওর। না , আর তো একা থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ওর জীবনের স্তম্ভ দুটো হাসি মুখে চেয়ে থাকবে সর্বক্ষণ ওর দিকে। মা ওর পছন্দের জিনিসপত্র বানাচ্ছে রান্নাঘরে, যাতে অন্তত কালকের দিনটা ও চলে যায় আর ওকে হাত পুড়িয়ে রাঁধতে না হয়। বাবা প্যাকিং এ ব্যস্ত , কাল সকালেই ফ্লাইট। মা বাবাকে নিজের ঘর থেকে বসে চুপচাপ দেখছিল ঈশা, তখনই বাজল ফোনটা। প্রিয়াঙ্কা। যাক, এতদিনে মনে পড়ল তাহলে।   

।। ৩।।

(পরের দিন )

অফিস থেকে ফিরে এক মুহূর্ত বসার সময় নেই ঈশার। ফ্রেশ হয়েই রান্নাঘরে ঢুকতে হবে যে। চটপট বেসিনে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিল ও। আজ অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি ও হয়েছে।  মা বাবা এতক্ষণে বাড়ি ঢুকে গেছে এটাই নিশ্চিন্তি! অফিস থেকে প্রথমে বাস তারপর অটো ধরতে হয় ঈশা কে, সব মিলিয়ে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা। আজ বেরোতেও দেরি হয়েছে আর রাস্তায় একটু জ্যাম ও ছিল, সব মিলিয়ে বাড়ি ঢুকল যখন তখন প্রায় ৮ টা। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকল ও। চপিং বোর্ডটা আর ছুরিটা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসল ও। সামনে মোবাইলটা নিয়ে ভিডিও চালিয়ে দিল একটা, পুরো ফাঁকা ফ্ল্যাটে কথা বলার তো আর কেউ নেই। পাশের ফ্ল্যাটে একটা ফ্যামিলি থাকে তবে এখনো আলাপ হয়নি, বেশির ভাগ সময়েই তালা বন্ধ থাকে। রাত্রে ফেরে আবার সকালে ও তাড়াতাড়ি বেরোয়, তাই এখনো আলাপের সুযোগ ও হয়নি।

আলুর খোসাটা ছাড়িয়ে টুকরো করতে করতেই মার ফোনটা এল। হাতের কাজ রেখে তাড়াতাড়ি মায়ের ফোন ধরল ঈশা।

*****

ঈশার ফ্ল্যাটটা একদম জনবহুল এলাকাতেই, আর সমুদ্রটাও সামনে। তাই রাত হলেও বোঝার উপায় নেই, লোকজন সবসময়ই রয়েছে ,আর এত সুন্দর পরিবেশটা , বসলে কখন যে সময় পেরিয়ে যায় বোঝাই মুশকিল। মার গলাটা আজ একটু কাঁপছিল, ও বুঝতে পারছিল মা ওর সামনে ঠিক থাকার চেষ্টা করছে ,ঈশা ও আপ্রাণ নিজেকে ধরে রেখেছিল , মা ফোন টা রাখার পর চুপচাপ ব্যালকনি তে বসেছিল ঈশা, বারান্দার আলো গুলো নিজের তালে জ্বলছে নিভছে ঝিকমিক করে। নাহ , অনেকটা সময় চলে গেল ফোন এ গল্প করতে গিয়ে। রান্নার এখনো কিছুই হয়নি, রান্না সেরে খেয়ে শুতেও হবে তাড়াতাড়ি , কাল আবার সকাল সকাল ওঠাও আছে। উঠে পড়ল ঈশা। ডাইনিং টেবিলে এ গিয়ে একটু থমকাল ও। ও তো সবজি কাটতে কাটতে উঠে গেছিল মায়ের ফোনটা আসায়, পুরো সবজি কাটা তো শেষ হয়নি ওর। তাহলে টেবিলে তো সব সবজি কাটাই রয়েছে। কিন্তু ওর তো মনে পড়ছে না। কয়েক সেকেন্ড হতবম্ভের মতন তাকিয়ে রইল ঈশা । না ,কিছুতেই মনে পড়ছে না তো। কোথায় এত বিভোর ছিল আজ ও? কি জানি। ওর এত ভুল হলো? মনের মধ্যে সন্দেহের নিরসন হল না, তবে আর দেরি না করে কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল ঈশা।   

*****

(সপ্তাহ খানেক পর)

এই কদিনেই অফিসের লোকজন, এই ফ্ল্যাটের লোকজন, ওর প্রতিবেশী সবার সাথেই ভালোই মিশে গেছে ঈশা। যে ভয়টা ছিল, আদৌ মানুষগুলোর সাথে ভাবনা চিন্তা মিলবে কিনা, মিলে মিশে থাকতে পারবে কিনা সেই পথটা অনেকটাই সহজ হল। আজ প্রথম স্যালারি পেল ঈশা। মনটা যারপরনাই আনন্দে ভরে আছে। আজ অফিস থেকে ফেরার পথে ঠিক করল মাংস নিয়ে যাবে। নিজেই রাঁধবে আজ। মা তো  ফোনের ওপারে আছেই, ঠিক বুঝে নেবে মার থেকে। কিন্তু কখনও তো মাংস কিনতে যায়নি, তাই মনটা একটু দোনামোনা করছে। যাক গে, সব কিছুই তো জীবনে একদিন প্রথম হয়, তাই আর বেশি না ভেবে বাজারে ঢুকে পড়ল ঈশা।

*****

ইস! প্রিয়াঙ্কাকে ফোনটা করাই হচ্ছে না, সেইদিন ও ও যখন ফোনটা করেছিল বাপি ডাকল বলে আর ধরা হলো না। তারপর থেকে দু তিনবার করেছে, কিন্তু ফোন করব বলেও আর করা হয়নি। আজ আবার করেছিল, আজ আবার মাংস রান্না করতেই তো সময় কাবার হবে, তাও আজ ফোনটা করবে, কাল তো ছুটি আছে। রাত করে শুলেও কোনো অসুবিধা তো নেই।

ওকে চিকেন কিনতে দেখে ওর দুজন কলিগ জোর করে নেমন্তন্ন আদায় করে নিল। ও ও আর বেশি বাধা দিল না, ভালোই, কেউ এলে ভালোই লাগবে, নয়তো ওই অফিস থেকে ফিরে একলা ফ্ল্যাটে একটু তো বোর লাগেই। ওরা বলল ৯ টা নাগাদ চলে আসবে, ওরা বলতে গুঞ্জন আর অর্জুন। গুঞ্জন এর বাড়ি পাঞ্জাব, আর অর্জুন কেরালার ছেলে। প্রথম দেখায় যে কোনো মেয়ের মাথা ঘোরাতে যথেষ্ট ওর হাসিটাই। প্রথমদিন ওকে দেখেই ঈশা র বেশ ভালো লেগেছিল । কিন্তু ওই অব্দি ই, এর বেশি আর কিছু না। ইনফ্যাক্ট ও তো আগে ভাবতো গুঞ্জন আর অর্জুন ই হয়তো কাপল, কিন্তু পরে জানল গুঞ্জন এর এনগেজমেন্ট আগেই হয়ে গেছে। পরে বছর বিয়েটাও হয়তো সেরে ফেলবে। একটু যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ঈশা। আর তারপর  অর্জুন ও ওর সাথে একটু বেশি ই কথা বলছে দেখে মনটায় বেশ ভালোই ফুর্তি হয়েছে। ওর কলেজ গ্রুপের বন্ধুদের সাথে এই নিয়েই গ্রুপ চ্যাট করতে করতে অটোটা এসে থামল ফ্ল্যাটের সামনে। পৌঁছে গেছে ও , ভাড়া মিটিয়ে লিফটে উঠে গেল ঈশা। লিফটটা এসে থামল চারতলায়, এবার ঈশার নামার পালা। এতক্ষণ লিফটে ওর সাথে যারা ছিলেন তাদের কারোর সাথেই আলাপ হয়নি তেমন , ওই মুখোমুখি যা একটু কথা। একজন দোতলার মিসেস মিত্তল, আরেকজন টপ ফ্লোরে থাকেন , নামটা খেয়াল পড়ছে না এখন। ঈশার মুঠোফোনে এতক্ষণ অর্জুন এর সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া নতুন ছবিটা খোলা ছিল, পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে , ওর রয়্যাল এনফিল্ডটা নিয়ে, চোখে সানগ্লাস, পরনে লেদার জ্যাকেট। সেটার দিকে একবার  আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন উপরের ফ্ল্যাটের মহিলা, হাসি পাচ্ছিল ঈশার, লিফ্ট ওর ফ্লোরে চলে আসতেই নেমে পড়ল ও। লিফ্ট থেকে ওর ফ্ল্যাটের দরজা অব্দি যেতে সময় লাগে ৫-১০ সেকেন্ড মতো, লিফ্ট থেকে নেমেই সামনেই ,কিন্তু আজ লিফ্ট থেকে নেমেই যেন একটা শব্দ এল কানে। জলের ট্যাপ খোলা বন্ধ করার শব্দ। কিন্তু ওর পাশের ফ্ল্যাটটা তো তালা বন্ধ, তাহলে কি ওরাই ভুল করে ট্যাপ খুলে রেখে চলে গেছে? তাও হতে পারে। কিন্তু তাহলে খোলা বন্ধ হবে কেন। তাহলে কি ওদের ফ্ল্যাটে কেউ ঢুকেছে? তাই বা হবে কি ভাবে। তালা বন্ধ তো। বেশ অদ্ভুত তো ব্যাপারটা। দরজার কাছে এসে তালা খুলতে খুলতে এবার বেশ ভয় পেয়ে গেল ঈশা। শব্দ টা পাশের ফ্ল্যাট থেকে নয় ,ওর ফ্ল্যাট থেকেই আসছে। ওই কি তাহলে ট্যাপ বন্ধ করতে ভুলে গেছিল সকালে। কিন্তু তাহলে ট্যাপ টা খোলা বন্ধ হচ্ছে কিভাবে। গা টা শিরশির করে উঠল এবার। এই ফ্লোরে এখন সম্পূর্ণ একা ও। লিফ্ট ও অন্ধকার। ওর লন টাও অন্ধকার। ও এসে জ্বেলে দেয় লনের আলোটা। নীচের ফ্লোরে লোকজন আছে অবশ্য। কিন্তু ওর ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করলেই তো ও একা। আর নীচের কোনও শব্দ পৌঁছায় না কানে। তাড়াতাড়ি করে লনের আলোর সুইচটা টিপল ঈশা। উফফ ! এবার একটু শান্তি। ফ্ল্যাটের তালা টা খুলল এবার অবশেষে। বুকের ভিতরটা অজানা কারণে হাতুড়ি পিটছে। হয়তো ও বেশি ভাবছে, ফ্ল্যাটের দেওয়াল গুলো তো সংলগ্ন, হতেই পারে নীচে কেউ খুলছিল জলের ট্যাপ। মনে সাহস আনার চেষ্টা করল ও, একটা জোরে শ্বাস নিয়ে দরজাটা খুলল ঈশা। কিন্তু… কিন্তু দরজাটা খুলেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। এসব কি ? কি করে সম্ভব ? ফ্ল্যাটের সব কিছু বন্ধ করে লক করে অফিস এ গেছিল ও।  অথচ ফ্ল্যাটে আলো পাখা সব কিছুই জ্বলছে, রান্নাঘরের দরজা খোলা কিন্তু দরজা বন্ধ করে গেছিল ও। ওর বেশ মনে আছে থালা বাসন গুলো খেয়ে রেখে চলে গেছিল ও কিন্তু এখন সেগুলো সব রান্নাঘরের তাকে সাজানো। কিন্তু ও তো ধুয়ে তোলেনি ওগুলো। এত ভুল তো হওয়ার কথা নয়। জামাকাপড় গুলো ও অগোছালোই ছিল , এভাবে গোছানো তো ছিল না। কি হচ্ছে এসব ? মনে হচ্ছেই না এতক্ষণ ধরে ফ্ল্যাটটায় কেউ ছিল না। মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে এবার ভয়ে, কিছু তো একটা গোলমাল হচ্ছেই। আচ্ছা কেউ কি এক্সেস পাচ্ছে ওর ফ্ল্যাটে আসার? কিছুই তো বুঝতে পারছে না ঈশা। আর কাকেই বা বলবে? কি বা বলবে? লোকে তো ওকেই পাগল বলে চুপ করিয়ে দেবে। কিন্তু ওর মনে আছে ও সব বন্ধ করে গেছিল। জুতো খুলে ব্যাগপত্র টেবিলে নামিয়ে রাখল। বাথরুমে ঢুকল ফ্রেশ হতে।

*****

রাত্রে ওদের খাওয়া দাওয়া ভালো ভাবেই চুকে গেল। ও চিকেন করেছিল, মা বলে বলে দিয়েছিল ,খুব একটা খারাপ করেনি। ওরা যখন গেল রাত্রে , তখন রাত প্রায় ১০.৩০ টা। এইসব কিছুর মাঝে ঈশার মনেও নেই আর বিকেলের কথা। ওরা বেরিয়ে যেতে মাকে ফোনটা করবে বলে বারান্দায় এসে বসল ঈশা। ওর মনের মধ্যে একটা ভালোলাগার রেশ ছড়িয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে ,আকাশ এ ঝলমল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। ওর মনের এই খুশির কারণ আসলে অর্জুন। আজ অর্জুনের ওর দিকে তাকানো, হাসি, ব্যবহার সব কিছুই একটা দিকেই ইঙ্গিত করছিল। তাই আজ মনটা বড্ড ভালো আছে। মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে নিজের খোলা চুলটা নিয়ে খেলছিল ঈশা। হঠাৎ করেই যেন মনে হল পিছনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কাজ কর্ম সেরে ঘর অন্ধকার করেই বসেছিল ও। শুধু বারান্দার আলো টা ঝিকমিক করে জ্বলছে, কারো একটা উপস্থিতি যেন অনুভব করতে পারছিল ও। ফিরে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে। যথারীতি কিছুই নেই। নিজের মনটাকে ঐদিকে না দিয়ে অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল ও, বেশি ভাবলেই মনে আরো ভুলভাল চিন্তা জাঁকিয়ে বসে। মা কে বাপিকে গুড নাইট করে ফোনটা রাখল ঈশা। সঙ্গে সঙ্গে ফোনে মেসেজ ঢুকল অর্জুনের। বাড়ি পৌঁছে গেছে । লজ্জা মাখা একটা হাসি খেল গেল ঈশা র মুখে। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। একটা বিকট শব্দ করে রান্নাঘরের স্ল্যাবে রাখা ধোয়া বাসন গুলো আছড়ে পড়ল মাটিতে। হৃদপিন্ডটা খুলে বেরিয়ে এল যেন ঈশার। এমনিই মনে একটা ভয় কাজ করছিলই,  তারপর এরকম হঠাৎ করে একটা শব্দ, ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। পিছন ফিরে তাকাল ঈশা। কিন্তু এবার তাকিয়ে আর ভয় না পেয়ে উপায় নেই যে। বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটতে শুরু করল, সামনের বারান্দা দিয়ে ঝাঁপিয়ে যাওয়া যেন মনে হচ্ছে ভালো এখানে থাকার থেকে। দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে ও, একটু আগেও তাকিয়ে দেখল সব অন্ধকার, এখন তাকিয়ে দেখল রান্নাঘরের আলো জ্বলছে দিব্যি। ওর পরিষ্কার মনে আছে একটু আগেও সব আলো নেভানো ছিল। না, আর উঠে রান্নাঘরে যাওয়ার সাহস নেই ওর। কোনোক্রমে ঘরের ভিতর ঢুকতে পারলে হয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ঈশা, বারান্দা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল। লোকজন আছে এখনো রাস্তায় ,একটু যেন মনটায় একটা ভরসা জুটল। আচ্ছা পাশের ফ্ল্যাটের দুজন কে কি একবার ডাকবে? ওখানে তো এক দম্পতিই থাকেন, এই ভাবে ভয় নিয়ে রাত টাই বা কাটাবে কি করে? এখন এই ঘর রান্নাঘর পেরিয়ে দরজা খুলে পাশের ফ্ল্যাটে ডাকতে যাওয়াও তো মুশকিল। কেন যে ফোন নম্বর নিয়ে রাখেনি। আচ্ছা সিকিউরিটির কাছে তো থাকবেই নম্বর। আর দেরি না করে সিকিউরিটি কে ফোন লাগাল ঈশা। মিনিটখানেক পর কথা হলে ফোনটা নামিয়ে রাখল ও, কোনো লাভ হলো না তেমন, উল্টে ওর মনের টানাপোড়েন আরো বেড়ে গেল খানিকটা। সিকিউরিটি জানালো আজ রাত্রে ওরা ফিরবে না, দুদিন পর ফিরবে। মানে আজ রাত্রে এই পুরো ফ্লোরে ও একাই।  আবার একটা শব্দ। কেঁপে উঠল এবার ঈশা। চারতলার বারান্দায় রেলিং টার সাথে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে এখন ও, ঘরে ঢোকার থেকে এখানে থাকা বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছে। এখন আর রান্নাঘরে আলো জ্বলছে না, অন্ধকার সবকিছু। কিন্তু ট্যাপ থেকে জল পড়ার শব্দ ভেসে আসছে পরিষ্কার বাথরুম থেকে। পুরো ফ্ল্যাটটা এখন অন্ধকার। শুধু বারান্দায় আলো গুলোই ভরসা। ঘামে ভিজে গেছে ঈশার শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ। তাও এক পা ও নড়তে পারবে না ও এখান থেকে।

কিন্তু এই মানসিক শান্তি টুকুও বেশিক্ষণের জন্য স্থায়ী হলো না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বারান্দার আলোগুলো নিভে গেল ঝুপ করে। একটা নিকষ কালো অন্ধকার যেন সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরছে ঈশাকে। একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার চোখের সামনে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না এক হাত দূরের ব্যবধানেও। রেলিংটা ধরে কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে ছিল ঈশা, ভয়ে মাথা ও কাজ করছে না যেন আর। হঠাৎ করেই যেন মনে হল সামনে কুন্ডলীকৃত ধোঁয়া যেন, এত অন্ধকারেও বেশ বোঝা যাচ্ছে সেটা। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ছাড়া আর কোনো আলোর উৎস ও নেই। হঠাৎ মাথায় এল মোবাইলের আলোটা তো আছে ,সেটা ফেললেই তো হয়। কিন্তু মাথায় এলেও সেটা করার সাহস হলো না ঈশার। এটাই মনে হলো সামনের অন্ধকার চিরে কি বা কে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর সামনে, না জানি কি অপেক্ষা করছে ওর সামনে তা তো ও জানে না। যদি সেই সত্যের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তার থেকে যেন এই ভালো। ধোঁয়াটা একটু একটু করে যেন রং বদলাচ্ছে, যেন একটা ঘন নীলচে রঙের ধোঁয়া, একটু একটু করে কুন্ডলি পাকিয়ে যেন আকার নিচ্ছে কিছু একটা। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারল একটা মানুষেরই অবয়ব তৈরী হচ্ছে ওর সামনে, খুবই অস্পষ্ট। চারপাশের বাতাস চলাচল ও যেন থমকে গেছে , এই ছায়ামূর্তির সামনে যেন কোনো কিছু চলাচলের কোনো অনুমতি নেই। কোনোক্রমে শ্বাসটা চলছিল ঈশার। যে কোনো মুহূর্তে সেটা ও বন্ধ হয়ে যেতে পারে, চারপাশের গুমোট ভাবটা যেন বেড়েই চলেছে একটু একটু করে।বুকটা ভারী হয়ে আসছে যেন , বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল ঈশা সামনের ছায়ামূর্তিটা যেন একটু একটু করে স্পষ্ট আকার নিচ্ছে। আর এই অবয়ব যেন ওর খুব চেনা ,অথচ এই মুহূর্তে ভয়ে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। কিন্তু ভীষণ রকম চেনা যেন কেউ। রাস্তায় লোক চলাচল কমতে কমতে এখন প্রায় শূণ্য । জনমানব নেই আর বলতে গেলে। সবাই এখন ঘুমের দেশে। কতক্ষণ এভাবে কাটল মনে নেই, কিন্তু মনে হলো যেন গুমোট ভাবটা কেটে যাচ্ছে একটু একটু করে। আর সামনের অবয়ব টা স্পষ্ট হচ্ছে আরো। কোনো এক অজানা আশ্চর্য শক্তি যেন কাজ করছে ,ভয় কেটে তার জায়গায় যেন দখল নিচ্ছে বেশ খানিকটা ভরসা। যেন কেউ নিঃশব্দে ওর কানে কানে বলে যাচ্ছে আমি আছি তো। কিন্তু এ কি দেখছে ও? যে অবয়বটা ওর সামনে স্পষ্ট হচ্ছে সে যে ওর ভীষণ কাছের । কোথা থেকে এই গুমোট ভাবটা কেটে একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগল ওর মুখে। যেন কেউ ছুঁয়ে দিয়ে গেল ওকে। একটা দুটো বৃষ্টির ফোঁটা লাগল এসে মুখে। মানে বৃষ্টি আসছে। তাই জন্যই হয়তো ঠান্ডা হওয়ার ঝলক। কিন্তু না,এ যেন কেউ ওর ধরে কাছেই আছে, তারই ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছুঁয়ে চলেছে ওকে। কিন্তু সে মানুষ নয়। মানুষের নিঃশ্বাস ত এত বরফশীতল হতে পারে না। বৃষ্টি বাড়তে লাগল একটু একটু করে, একটা মিষ্টি সুবাস যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিকে। না না ,মাটির সোদা গন্ধ এটা নয় , এই গন্ধটা ওর খুব খুব চেনা। হঠাৎ দেখল এবার, সামনের ছায়া শরীরটা যেন মিলিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। ভেঙে যাচ্ছে আসতে আসতে যেন একটা শক্তির প্রভাব চারপাশ থেকে। সেটা বেশ অনুভব করতে পারল ঈশা। কিন্তু ও যে টা ভাবছে সেটা কি ঠিক? মিলিয়ে গেল শরীরটা, একটু একটু করে। চারপাশটা যেন একটা থমকে যাওয়া জগৎ ছিল, সেটা কেটে যাচ্ছে যেন ধীরে ধীরে। আশ্চর্যজনক ভাবে জ্বলে উঠল বারান্দার লাইট। মানে কারেন্ট চলে এসেছে। কিন্তু এই রাত্রে আর ঘুমোনো সম্ভব নয় ওর পক্ষে। কাল ভোর হলেই আগে ওকে দুটো ফোন করতে হবে।     

।। ৪।।    

মুখে জলের ছিটে লাগতে চোখ দুটো খুলল ঈশা। কাল রাত্রে এই ব্যালকনিটাতেই কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। ঘুম ভেঙে দেখল ভোর হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় সারা আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢাকা। বেশ বড় কোনো দুর্যোগ আসছে। বৃষ্টিও শুরু হয়েছে অল্প। খানিকক্ষণ সময় লাগল ঈশার সবটা মনে করতে। ও এই ব্যালকনিতে কেন, কাল রাত্রে কি কি হয়েছিল একটু মনে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল ও। তাড়াতাড়ি পাশে মুঠোফোনটা কে খুঁজল, ফোনটা চার্জ আউট হয়ে সুইচ  অফ হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি প্লাগ ইন  করল ঈশা। একেই মেঘ করেছে এত, বৃষ্টি শুরু হয়ে কারেন্ট গেলে ও চাইলেও আর যোগাযোগ করতে পারবে না। ফোনটা চার্জ এ বসিয়ে আলমারি থেকে ওর বানানো পুরোনো স্ল্যাম বুক কাম অ্যালবামটা বের করল ও। মনটা একটা অজানা কারণে দুরু দুরু করছে। কালকের রাত্রের ভয় ছাপিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে আজ যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। খুব কাছের কিছু একটা চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয় যেন।ও যা ভাবছে তা যেন কখনো সত্যি না হয়। স্ল্যাম বুকটা খুলে পাতা গুলো উল্টাচ্ছিল ও। তখনি বৃষ্টিটা নামল ঝমঝমিয়ে। কিন্তু তাতে যেন ঈশার কোনো খেয়ালই নেই। ব্যালকনির সামনে খোলা দরজাটা দিয়ে জলের ঝাপ্টা আসছিল। তাও দরজা তা বন্ধ করল না ও। পাথরের মতন বসে রইল এক জায়গায়। এলোমেলো চুল, অবিন্যস্ত পোশাক। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা যেন গুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দিন রাতের হিসেব। ছবিগুলোর উপর হাত বুলিয়ে অতীতের দিন গুলোয় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিল যেন ও। ওদের তিনজনের ছবি , তিন প্রিয় বন্ধু সেই ছোট্টবেলা থেকে। একসাথে স্কুল, কলেজ সব। ফোনটা খানিক চার্জ হয়ে গেছে নিশ্চয় এতক্ষণে।    

সুইচ অন করে প্রথম ফোনটা লাগাল ল্যান্ডলর্ডকে। ও জানে এই ফ্ল্যাট কনস্ট্রাকশন পিরিয়ডে, ওই-ই প্রথম ভাড়া নিয়ে এসেছে। এই নতুন ফ্ল্যাটে এর আগে আর কারো থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাও একবার পুরোটা জেনে নেওয়া দরকার। বার দুয়েক ফোন করার পর গলায় খানিকটা বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরলেন মি: শর্মা। এত ভোরে এটাই খুব স্বাভাবিক ব্যবহার।  মিনিটখানেক পর ফোন কাটল ঈশা। ল্যান্ডলর্ড ওর প্রত্যাশিত উত্তরটাই দিল। আর এক সেকেন্ড দেরি না করে এবার ও ফোন লাগাল প্রিয়াঙ্কাকে। টানা তিনবার ফোন করে যাওয়ার পর ফোনটা ধরল প্রিয়াঙ্কা। ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল ঈশা। ভোর ৪ টা ৪৫ এখন। এখন এভাবে মানুষ কে ফোন করা ঠিক না কিন্তু ওর পক্ষে আর অপেক্ষা করাও সম্ভব নয়।

“হ্যালো “

“হ্যাঁ হ্যালো, প্রিয়াঙ্কা। ঈশা বলছি রে। “

ওইপাশে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। খুব স্বাভাবিক সেটা। ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে একটু সময় লাগবে বৈকি।

“তুই এখন? এত সকালে? কি হয়েছে? বল।”

“হ্যাঁ বাধ্য হয়েই এত সকালে ফোনটা আমি করেছি। আমায় জাস্ট আগে এটা বল অরিন্দম কেমন আছে ?”

“মানে? তুই জানিস না ?”

“মানে? কি জানব? কি হয়েছে ওর ?”

বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে। ও যেটা আশঙ্কা করছে সেটাই যদি ঠিক হয় ও কিছুতেই নিজেকে আর পারবে না ঠিক রাখতে। ওই পাশে কয়েক সেকেন্ড চুপ। অধৈর্য হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করল ঈশা ,” আরে বল না। কি হয়েছে অরিন্দমের? ও ঠিক আছে তো?”

“তোকে তো কদিন ধরেই ফোন করছিলাম, ধরছিলি না। এটা বলার জন্যই ফোন করছিলাম। তুই যেদিন গেলি, তার পরেরদিনই ঘটেছে ঘটনাটা। অরিন্দম এর বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছে রে, স্পট ডেড। তোকে জানানোর চেষ্টা করেছি বাট তুই ব্যস্ত ছিলিস তাই বার বার ফোন করেও বলতে পারিনি। আমি গেছিলাম ও। যাই হোক। কেন বলতো? হঠাৎ করে এই ভোরবেলা এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন? কি হয়েছে?” কাঁপা কাঁপা গলায় কোনোক্রমে কথা গুলো বললো প্রিয়াঙ্কা। কিন্তু আর কিছু বলার মতো অবস্থা ছিল না ঈশার। শুধু “রাখছি রে এখন” বলে ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই রেখে দিল ফোনটা ও। তার মানে ওর চিনতে কোনো ভুল হয়নি। ও কাল যা দেখেছে তাতে কোনো ভুল নেই। ছোট্টবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে ওরা তিনজন। অরিন্দম এর পরিবার কয়েক বছর আগে ফ্ল্যাট কিনে চলে যায় সাউথ কলকাতায়। কিন্তু তাও দূরত্ব বন্ধুত্বের মাঝে পারেনি চিড় ধরাতে। কিন্তু শেষ এক বছরে চিড় ধরেছিল বৈকি। অরিন্দম যেদিন মনের কথা জানিয়েছিল ঈশাকে। সরস্বতী পুজোর দিন। ঈশা ও অরিন্দমকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত,বাসেও, কিন্তু ওর ছোটবেলার সবথেকে প্রিয় বন্ধু বিল্টু হিসেবেই। তাই অরিন্দমকে কোনোদিন ওই রূপে ভাবতে পারবে না ও, জানিয়ে দিয়েছিল এটা পরিষ্কার ভাবেই। তারপর অরিন্দমই ওর থেকে দূরে সরে গেছিল। কিন্তু এই নিখাদ বন্ধুত্বটাকে তো হারাতে চায়নি ও। চেষ্টাও করেছিল অনেক অরিন্দমের সাথে কথা বলার। লাভ হয়নি। অদ্ভুত ভাবেই নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য বেড়াজাল তৈরী করে নিয়েছিল অরিন্দম। কোনোভাবেই আর কোনো কথায় সাড়া দিতে রাজি নয় যেন। ওর ভালোবাসাকে কোনোদিন ও অপমান করেনি ঈশা, সম্মান ই করত, কিন্তু ঈশার দিকটা একবার ও বুঝল না অরিন্দম। অভিমানে ঈশা ও ধীরে ধীরে যোগাযোগ, সমস্ত চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার থেকে সমস্ত খবর ও নিতো অরিন্দমের। এরকম একটা পরিণতি অপেক্ষা করে আছে তা তো ও স্বপ্নেও ভাবেনি। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না ঈশা। কান্নায় ভেঙে পড়ল ও এবার, সঙ্গে বাইরে আজ ভেঙে পড়ছে যেন আকাশটাও।

আজ ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে প্রিয় বন্ধুটাকে। কাল অরিন্দমের উপস্থিতি বুঝতে ভুল করেনি ও একটু ও। অরিন্দম ও তো ওকে দেখতেই এসেছিল। ওদের তিনজনের একসাথে একটা ছবি নিয়ে আঁকড়ে ধরল ঈশা।যুক্তি তর্ক সম্ভব অসম্ভব বিশ্বাস অবিশ্বাস বাস্তব অবাস্তবের মাঝে দাঁড়িয়ে আজ ঈশা। হাউ হাউ করে পাগলের মতো কাঁদছে ও আজ একলা ঘরে। তখনই একটা ঝোড়ো হাওয়া ওর চারপাশটায় ঘিরে ধরল যেন ওকে। এই তো… এই তো সেই গন্ধটা, অরিন্দম এলেই বরাবর এই ডিওটার গন্ধই পেত ওরা। এ নিয়ে অনেক খেপাতো ও ওকে। একটা ঠান্ডা বাতাস যেন ছুঁয়ে দিয়ে গেল ওকে। আর একটু ও ভয় করছে না ঈশার। বরং আদ্র চোখ দুটো যেন পাগলের মতো খুঁজছিল অরিন্দমকে। একবার দেখার জন্য। ঝোড়ো হাওয়াটা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে গেল অরিন্দম আর ওর একটা ছবি। এটাই কি তবে শেষ সাক্ষাৎ? ঈশা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল সেই চলে যাওয়ার দিকে, একা।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with