প্রায়শ্চিত্ত

||১||

(বছর খানেক আগের কথা )

রোজকার মত সেদিনও সাতসকালে নাকে মুখে গুঁজে অফিসের পথেই দৌড়াচ্ছিলাম | মেট্রোটা ধরতেই হবে, চারদিকে তাকানোর সময় কোথায়, ভিড় ঠেলে সবাইকে সরিয়ে মেট্রো স্টেশনের দিকে দ্রুত পা চালাচ্ছিলাম, তখনই কান্নাটা কানে এসছিল | কানে আসতেই তাকিয়েছিলাম ফিরে, ছোট্ট একটা দুধের শিশু চিলচিৎকার করে কাঁদছে |

(এখন)

সেদিনকার সেই ছোট্ট শিশু আজ বছর খানেকের বড়, পিপাই | সেদিনকার সেই ছোট্ট শিশুটাকে দেখে চলে আসতে পারিনি | গলার ভিতর একটা কষ্ট বড্ড দলা পাকিয়ে আসছিল | অতীতের ধূসর স্মৃতিগুলো বারবার চোখের সামনে আসছিল, ঐ জন্যই পা-টা আটকে গেছিল সেদিন |

*************

সেদিনের সেই ছোট্ট পিপাইকে নিজের ঘরে তুলে এনেছিলাম, ওর আধো আধো কথা, ওর হামাগুড়ি, খেলাধুলা, দুস্টুমি, আর খাওয়া সবকিছুর অভ্যাস হয়ে গেছে আমার | এখন ওকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না | আমি, আবীর সেনগুপ্ত, আজ ছোট্ট পিপাইকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না, এটা ভাবলেই কেমন অদ্ভুত লাগে | হয়তো সেদিনের ভুলটা না করলে আমার নিজের পিপাই-ও আমার কাছে থাকত |

||২||

আমার সাথে মৌ-এর সম্পর্ক বহুদিনের, বছর পাঁচেকের বেশি হয়ে গেছিল | আমাদের মধ্যে ভালবাসার কোনদিন কোন অভাব ছিল না | হঠাৎ কি হলো কে জানে, মৌ যখন বিয়ের আগেই জানিয়েছিল ও মা হতে চলেছে, কী করব বুঝতে পারিনি | সেদিন ভুল করেছিলাম, অনেক বড় ভুল | আমি তাকে অ্যাবর্ট করতে বাধ্য করেছিলাম | রাগে, দুঃখে সেদিন বড্ড কেঁদেছিল ও | কিন্তু আমার চোখে সেদিন জল ছিল না | চলে গেছিল মৌ, সেটাই তো স্বাভাবিক | এ জীবনে আমাকে ক্ষমা ও করবে না, করা উচিতও না | তখন বুঝিনি, চাকরি, জীবন এসব সামলাতে সামলাতে দৌড়েই যাচ্ছিলাম, নিজের ভালবাসাও হারালাম | যখন বুঝলাম অনেক দেরী হয়ে গেছিল তখন | তারও বেশ কিছুদিন পর আমার জীবনে কোথা থেকে এল পিপাই |

**************

পিপাইকে ছোট্ট থেকে বড় করার এই যাত্রাটা বড় মধুর | ওর বড় হওয়ার সমস্ত মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্দি করি আমি, দেখি আর হাসি | ওর সাথে যেন আবার মাটির কত কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, যেন আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছি আমি, এতদিন পর | পিপাইকে আমি আইনগত ভাবে দত্তক নেব খুব শিগগির, মনস্থির করেই ফেললাম | গ্রামের বাড়িতে মা, বাবা, দাদা, বৌদি কেউই ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নেননি | সম্পর্কের সমীকরণটা নড়বড়ে হয়ে গেছিল যদিও সেদিনই যেদিন আমার সাথে মৌ-এর ব্রেকআপটা হয়েছিল | মৌ-ই সেনগুপ্ত বাড়ির বৌ হবে, এমনটা প্রায় ঠিকই হয়ে গেছিল, মা বাবাও আমাদের প্রেমটা খুব ভাল মনে মেনে নিয়েছিলেন | তারপর কী যে হলো….

||৩||

(কয়েকবছর আগের কথা)

-“আবীর, প্লিজ, এরকমটি করো না | তোমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না?”

-“না, মৌ, এটা ভাল খারাপ লাগার ব্যাপার না, আমার পক্ষে এই মুহূর্তে এত বড় দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয় | আমার কেরিয়ার সবে শুরু হয়েছে, আমি এখনই বিয়ে, বাচ্চা এতকিছু ! আর ইউ ক্রেজি?”

-“আমরা পারব সবটা সামলে নিতে, দ্যাখো না | কিন্তু এটা আমাদের ভালবাসার প্রথম চিহ্ন, এভাবে শেষ করে দেওয়া যায়?”

অজস্র কথা কাটাকাটি, লড়াই, ঝগড়া, অশান্তি, চোখের জল এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে ছোট্ট কচি প্রাণটা আর পারেনি লড়াই করে বাঁচতে | মাত্র তিনমাসেই শেষ হয়ে গেছিল ঐ কচিপ্রাণটা, মৌ আর আমার লড়াই-এর বলি হয়ে |

…..চোখ খুলে দেখলাম অনেকটা দেরী হয়ে গেছে সন্ধ্যে নেমেছে | স্মৃতির ধূসর পাতা ওলটাতে ওলটাতে কখন সন্ধ্যে নেমেছে খেয়ালই করিনি,…সবকিছু বদলে গেল তারপর | আমাদের সম্পর্ক, বাড়ির সাথে সম্পর্ক সবকিছুই | নিজেকে নিয়ে এতটাই মত্ত ছিলাম যে টনক যখন নড়ল, সব শেষ, মৌ-ও ওর জীবনে এগিয়ে গেছে | মৌকে বড্ড মিস করি, কিন্তু এখন তো নতুন ভাবে শুরু করার সব রাস্তা বন্ধ | পিপাই-এর কান্নায় অতীতের ভাবনায় ছেদ পড়ল |

||৪||

সাতসকালেই দরজায় বেলটা বাজল | এই সময় সাধারণত আমাদের কেউ আসে না, বেরনোর তাড়া থাকে এখন | দরজা খুলতেই তাল কাটল | ………..

****************

মাথায় বাজ ভেঙে পড়লে যে অবস্থা হয়, অনেকটা সেরকমই অবস্থা আমার | পিপাইকে আইনত দত্তক আমার নেয়ার কথা ছিল কিছুদিন পরই… তার মধ্যেই এই অঘটন |  পিপাই-এর খোঁজে এতদিন পর পুলিশ, লোকজন, ওর মা বাবা আজ হাজির আমার বাড়িতে | আমার কোল থেকে আমারই পিপাইকে কিছু আইনি কাগজ-এর জোরে নিয়ে চলে গেল কত সহজে ওরা | এতদিন, বছর খানেক কোথায় ছিল ওরা, পিপাইকে যেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, রাস্তা থেকে তুলে এনে বুকে করে মানুষ করেছিলাম | আজ যখন ও আমার প্রাণ, তখনই ওকে নিয়ে এভাবে চলে গেল? আইনের এত জোর যে মায়া মমতার সুতোর টান টুকুও অকেজো আজ ওদের সামনে?

***************

ঘর অন্ধকার করে বসেছিলাম, আজ সব হারিয়ে | অন্ধকার ছাড়া আর আছেই বা কী? আজ খুব মৌ-এর কথা মনে পড়ছে,….খুব | মৌ যখন বলেছিল আমাদের ভালবাসার চিহ্ন কিছুতেই মুছতে দেবে না, তখন শুধু নিজের কেরিয়ার, নিজের জীবন, আনন্দ উল্লাস ছাড়া কিছুই ভাবিনি | সেদিন বুঝিনি সন্তান হারানোর যন্ত্রনা কিরকম? মৌ হেরে গেছিল সেদিন আমার কাছে | কিন্তু মৌ যেন হেরে গিয়েও কোথাও জিতে গেল, ও আজ নিজের স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী | আর আমি? আমি তো আজ সব হারালাম | এভাবেই হয়তো এই জন্মের পাপের ফল এভাবেই পেতে হয়…..আজ পিপাইকে হারিয়ে আমি আমার প্রথম সন্তানকে খুনের ফল পেলাম হয়তো…..

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

Share with