মালপত্র মোটামুটি সব নামানোই হয়ে গেছে, তাও আরেকবার দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে নিচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু। নতুন পাড়া, নতুন সব লোকজন , কালচার ও আলাদা। সাউথ থেকে সোজা নর্থে। তাও অতি কষ্টে একটু মনমতো ফ্ল্যাট পাওয়া গেল, কারণ নর্থ কলকাতা মানেই তো সব অলিগলি, সরু, ঘিঞ্জি রাস্তাঘাট। পুরোনো আমলের সব বাড়ি। ওর আবার এইসব নিয়ে খুব একটা নস্টালজিয়া নেই, প্রবাসী বাঙালি, চিরকাল বাইরেই কেটেছে, বড় হওয়া জন্ম সবই বাইরে , বাবা মা-র দৌলতে বাংলা লিখতে পড়তে ভালোই জানে। তাই এখন করে খাচ্ছে। বাংলার কালচার, কাজ, শিল্প এইসব সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল কৃষ্ণেন্দু , তাই কাজ করতে পারে এত ভালো ভাবে। এখানে ভাড়া নিয়ে আসাও তো সেই কারণে। ওর নেক্সট প্রজেক্টটার জন্য নর্থ কলকাতা ইজ এ মাস্ট থিং। তাই এত গোছগাছ তোড়জোড়…
“এই একটু ধীরে ধীরে তোলো, প্রচুর দামি দামি জিনিস আছে ওতে, একটা ও যেন না ভাঙে।”
যারা মালপত্র তুলছে তাদেরকে আরেকবার বলে ফোনটা হাতে নিয়ে একটু সাইডে গিয়ে দাঁড়াল কৃষ্ণেন্দু , কালকের শুটের টাইমিং গুলো চেক করছিল ও। ওর শুটিং লোকেশনগুলো থেকেও বেশ কাছেই জায়গাটা, ওর যাতায়াতের সময়টা বেঁচে যাবে, কাজে আরেকটু সময় দেওয়া যাবে। আর ওই ফিল টার ভিতরেও থাকা হবে। এতসব ভেবেই এখানে আসার ডিসিসিন নিলো ও। নয়তো ওর সাউথ সিটির ফ্ল্যাট ছেড়ে এই গিরিশপার্কে আসার কি দরকার ছিল?
*****
এই আবাসনটা বেশ বড়োসড়ো, জায়গাটাও বেশ সুন্দর ,সামনেই একটা চা সিগারেটের দোকান আছে, সেই দিকে এগোল কৃষ্ণেন্দু।
ওর পছন্দের ব্র্যান্ড ছিল না, বাধ্য হয়ে একটু সস্তার ব্র্যান্ড নিলো ও। পকেট থেকে লাইটারটা বের করে সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়াটা ছাড়ল ও , তখনই খেয়াল করল লোকটা কে। একটা লোক কিরকম অদ্ভুত ভাবে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই চেয়ে। ফ্যান ফলোয়ার্সরা দেখলে সেটা আলাদা ব্যাপার, সেই দৃষ্টি চেনে কৃষ্ণেন্দু। একটা উন্মাদনা থাকে সেই দৃষ্টিতে। কিন্তু এই দৃষ্টি অন্যরকম। কেমন যেন ভিতর অবধি পড়ে নেয়। মুখে কেমন একটা আবছা বাঁকা হাসি, যেন একটা তাচ্ছিল্য জড়িয়ে আছে। খানিক ক্রুরতা ও। লোকটার পরনে একটা হাফ হাতা ফতুয়া, পাজামা , দুটোই সাদা। গালে দু চারদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি, চোখে চশমা, গায়ের রং পরিষ্কার, মাথায় কয়েক গাছি পাকা চুল, রোগা শুকনো চেহারা, চোখমুখ খানিক বসা, গালটা তুবড়ে গেছে, মাঝারি হাইট। লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে ও, কিছুতেই খেয়াল করতে পারছে না। এখনো একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, এবার বেশ বিরক্ত লাগছে কৃষ্ণেন্দুর। আর না দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিজের আবাসনের দিকে পা বাড়াল ও।
*****
(দিন কয়েক পর )
এখানে আসার পর থেকেই ফ্ল্যাটে দেখা করতে আসার লোকজনের লাইন লেগেই থাকে। আজ তাই আগে মৃদুল কে বলে দরজার বাইরে লেখাটা দেওয়ার ব্যবস্থা করল কৃষ্ণেন্দু। সবার সাথে দেখা করতে বসলে তো কাজ কর্ম মাথায় উঠবে। আর এসেছে তো কাজ করতে, দেখা করতে তো নয়। তাই এক প্রকার বাধ্যই হলো এটা করতে।
সকল থেকে ল্যাপটপের সামনে বসেছে, একবার জাস্ট স্নান খাওয়া করতে উঠেছিল। বসার সেটআপটা করেছে কাঁচ দিয়ে ঢাকা ব্যালকনিটার ঠিক পাশেই। ওর ফ্লোরটাই টপ, তাই এখান থেকে কলকাতার ভিউ টাও দারুন। এই জায়গাটায় বসলেই গড় গড় করে হাত থেকে বেরোতে থেকে লেখা গুলো। মাথা খুব ভালো চলে। আজ স্ক্রিপ্টের কাজ অনেকটাই এগোল। চোখ থেকে চশমাটা খুলল এবার কৃষ্ণেন্দু। টানা ল্যাপটপের দিকে তাকানোর কারণে চোখ দুটো বেশ টনটন করছে। এক কাপ চা করতে বলে উঠল কৃষ্ণেন্দু। আসার পর থেকে এই আবাসনের ছাদটায় যাওয়াই হয়নি ওর। আজ সূর্যাস্তের পর আকাশটা ভয়ঙ্কর সুন্দর দেখাচ্ছে। লাল কমলা আর সোনালী আলোয় মিলে মিশে আকাশটা থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না যেন। সূর্য অস্তগামী, এখনো খানিকটা দেখা পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমাকাশে , টকটকে লাল টিপ পরে সেজেছে যেন আকাশ। গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে লাল রঙা শাড়ি , সোনালী গয়নায় যেন ঝলমল করছে নববধূর মতো। ছাদে উঠে নিজের মোবাইল থেকে একটা ফটো তুলল কৃষ্ণেন্দু। মৃদুমন্দ বাতাস ও বইতে শুরু করেছে , মন ভরে শ্বাস নিলো ও । রাস্তায় স্ট্রিট ল্যাম্প এবার জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে, ধীরে ধীরে আঁধার নামতে শুরু করেছে। আকাশে দেখা হচ্ছে চাঁদের উঁকিঝুঁকি। ফোন টা বাজল কৃষ্ণেন্দুর , চা হয়ে গেছে।
চা টা দিয়ে যেতে বলে একটি চেয়ার নিয়ে গুছিয়ে টেনে বসল ও।
*****
কতক্ষণ বসে আছে কে জানে। এখন সন্ধ্যেটা পুরোপুরি মুড়ে নিয়েছে চারিপাশটা। অনেকটা সময় গেল, এবার ওঠা দরকার। আজকে কাজ টা শেষ করতেই হবে। কিন্তু ছাদটা ভারী পছন্দ হয়েছে ওর। যেতেই ইচ্ছে করছে না। তখনি কানে এলো একটা গলা খাঁকারির শব্দ। কেউ যেন কাছেই রয়েছে। ফিরে তাকাল কৃষ্ণেন্দু। কই কাউকে তো উঠতে দেখেনি ও। অন্ধকারের মধ্যে এরকম কিছু শুনলে একটু তো গা ছমছম করবেই। ওর ও করল। চারপাশটা কেমন যেন গুমোট একটা ভাব। রাস্তার আলো খানিকটা ছাদটাকে আলোকিত করলেও পুরোটা তো আর দেখা যাচ্ছে না। আর ছাদের আলোটা কোনদিকে তাও জানে না ও। হঠাৎ করেই হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার হল শব্দটা।
না এভাবে বসে থাকলে চলবে না। উঠে দাঁড়াল কৃষ্ণেন্দু, সশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে।
“কে ওখানে?”
বেশ ভারিক্কি গলায় প্রশ্নটা ছুঁড়ল কৃষ্ণেন্দু। কিন্তু না, কোনো উত্তর পেলো না ও। তাহলে? মনের ভুল তো নয়। এটা ও নিশ্চিত। তাহলে কি কোনো বড় মতলব আছে? থাকতেই পারে। সফল মানুষের তো আর শত্রুর অভাব হয় না। না আর এখানে থাকার দরকার নেই। নেমে গেলেই তো হয়। মোবাইলের আলোটা জ্বালিয়ে না হয় নীচে নেমে যাবে। আবার কি? মোবাইলের ফ্ল্যাশ টা মারতে গিয়েই দেখল ফোনটা চার্জ আউট হয়ে অফ হয়ে গেছে কখন। এইবার একটু অস্বস্তি হতে শুরু করল কৃষ্ণেন্দুর। না আর এত ভাবার দরকার নেই। একটাই তো ফ্লোর কোনোক্রমে নীচে নেমে গেলেই হচ্ছে। এগোতে গেল কৃষ্ণেন্দু। কিন্তু পারলো না এগোতে। কিছু একটা যেন পিছন থেকে আটকে রেখেছে ওকে। ঘাড়ের কাছে কেমন যেন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ওর পরনের পাঞ্জাবিটা যেন কোথাও আটকে রয়েছে। বেশি টানতে গেলেই ছিঁড়বে এরকম অবস্থা। হাতটা বাড়িয়ে পাঞ্জাবি টা টানতে গেল ও ,আর এক মুহূর্ত ও এখানে থাকার দরকার নেই। শরীর রীতিমতো অসুস্থ লাগছে। কি হচ্ছে তা জানে না, তবে ওর বিচার বুদ্ধির বাইরে কিছু একটা ঘটছে এখানে।
পাঞ্জাবিটা টেনে খুলতে যেতেই যা ঘটল তাতে শুধুমাত্র ওর হার্ট ফেল হওয়াই বাকি ছিল। একটা তরল লাগল ওর হাতে। নাকের কাছে নিয়ে গিয়েও কিছু বুঝতে পারল না ও। তখনি হঠাৎ করেই আকাশে অদ্ভুত বিদ্যুতের চমক। অথচ একটু আগেও আকাশ পরিষ্কার ছিল। আর সেই বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখল ওর থেকে মাত্র কয়েক মিলিমিটার দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ওই সেদিনকার লোকটা ,একই রকম পোশাক। কিন্তু লোকটার সাদা ফতুয়া রক্তাক্ত। মাথা ফেটে গলগল করে বইছে রক্ত! চোখ দুটোয় সেই এক দৃষ্টি। উফফ ! কি হচ্ছে এসব? আর এক মুহূর্ত ও দাঁড়াতে পারল না কৃষ্ণেন্দু , মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এবার। কোনোক্রমে দৌড়ে প্রাণ বাঁচাতে হবে ওকে। রুদ্ধশ্বাসে দৌড় লাগাল ও।
******
“কি হলো কৃষ্ণেন্দু দা? এখন ঠিক আছ? খোলো চোখটা, কোনো ভয় নেই।”
আশিষের কণ্ঠস্বর কানে এল, একটু একটু চোখ মেলে তাকাতে চেষ্টা করল কৃষ্ণেন্দু। প্রথমেই চোখে আলো পড়তেই কুঁকড়ে গেল চোখ দুটো, একটু ধাতস্থ হতে সময় লাগল ওর। তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুলল ও। নিজের ঘরেই শুয়ে রয়েছে ও। ঘরে আশিষ, সবসময়ের কাজের ছেলে ভোলা, আর ওদের ইউনিটের অরুণদা, আর সমরদা। ঘরে আলো জ্বলছে, ওর সামনে ঘড়িটার কাঁটা এখন ৯ এর ঘরে। মানে সেই বিকেল থেকে এই রাত ৯ টা অবধি ও এভাবে…তাড়াতাড়ি উঠতে গেল কৃষ্ণেন্দু , কিন্তু সারাশরীরে যেন অজস্র সুচ একসাথে ফুটছে, এরকম ব্যাথা হাত পায়ে।
“তুমি ছাদের পিছনদিকে কেন গেছিলে কৃষ্ণেন্দু দা? আর কি হলো হঠাৎ, তোমার প্রেসার ও তো খুব লো নয়। “
কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। মাথায় কথা গুলো পৌঁছাতে খানিক সময় নিলো। তারপর বললো , “আমি তো এমনি ছাদে উঠে বসেছিলাম, কোনদিকেই যাইনি। কিন্তু কি যে হলো কিছুই তো মাথা মুন্ডু বুঝতে পারছি না।”
নিজের সাথে ঘটা ঘটনাটা পুরো বলল সবাইকে কৃষ্ণেন্দু, অসহায় ভাবে তাকাল সকলের দিকে, সকলের দৃষ্টি দেখে এটা বুঝল লোকজন এর চোখে সমবেদনার থেকেও বেশি অবিশ্বাস। ভাবখানা এমন যেন কি সব ভুলভাল বকছে রে বাবা। পাগল নাকি। নিজেকে সামলে নিয়ে চুপ করে গেল তাই কৃষ্ণেন্দু। ওদের কে বাইরে যেতে বলল। একটু পর খেতে দিতে বলল।
ওরা দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে যাওয়ার পর চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল একটু ও। একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে। যেটা কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। লোকটার এরকম অবস্থা দেখে গা শিউরে ওঠে। ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কিন্তু লোকটাকে দেখে বার বার এটাই মনে হচ্ছে লোকটাকে ও কোথাও দেখেছে। আর এই দেখা কোনো ক্ষনিকের দেখা নয়, তা ও জানে। কিন্তু কবে কোথায় কিভাবে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাচ্ছে না কিছুতেই। একটা অদ্ভুত শ্বাসকষ্ট হচ্ছে যেন। চোখ দুটো বুজে ফেলল কৃষ্ণেন্দু।
*****
“কৃষ্ণেন্দুদা তুমি জানো তুমি কি বলছ? আমরা আরেকটু ওয়েট করে নি, আমাদের তো লাগতে পারে বলেছে, লাগবেই তা তো বলেনি। পেয়ে যাব ব্লাড। কিন্তু ওই পার্টিটা তো আগে এসেছে , আর ওদের পেশেন্ট এর যা অবস্থা দেখে এলাম তাতে ও ব্লাডটা না পেলে…”
“আমার তো অত ভাবার দরকার নেই আশিষ। যদি বাই চান্স দরকার পড়ে তখন এই রেয়ার ব্লাড জোগাড় করতে পারবে তো?”
“কিন্তু ওদের তো বেশি দরকার ,আর ওরা তো আমাদের অনেক আগে থেকে…”
“এত কথার দরকার নেই, আচ্ছা এই যে এত ক্ষমতা, সেসব কখন কাজে লাগবে? এই ব্লাড প্রয়োজনে লাগুক না লাগুক ,আমি যে জোগাড় করে এনেছি এটাই ডি. কে স্যারের কানে গেলে চলবে। তারপর না লাগলে না লাগুক, এদের ফেরত দিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু এই সুযোগ আমি ছাড়তে পারব না, একবার ওনার মনে নিজের জায়গাটা পাকা করতে পারলেই নেক্সট প্রজেক্ট টাও আমার। আর অত বড় প্রজেক্ট এর জন্য এইটুকু করাই যায়। আমি তো কাউকে খুন করছি না রে বাবা। “
*****
চোখটা লেগে গেছিল। মনে পড়েছে। এই লোকটাকে ও ওই ব্লাড ব্যাংকের বাইরেই দেখেছিল। অসহায় দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল , ওর পরিষ্কার মনে আছে। সম্ভবত ওই লোকটার ছেলে বা মেয়ে কেউ একজন ভর্তি ছিল এক্সিডেন্ট এর পর। তবে ও যে কারণে এত ঝুট ঝামেলা করে এত ব্যবস্থা করেছিল , সেটা কোনো কাজেই লাগেনি। কিন্তু লোকটাকে এখন তাহলে এভাবে দেখল কেন? এটা তো বেশ কয়েকমাস আগের কথা, তারপর লোকটার কি হয়েছিল তা অবশ্য জানে না ও। লোকটাকে কি কোনো ভাবে কেউ হায়ার করেছে ওর পিছনে… হতেই পারে , অসম্ভব তো কিছু নয়। ওকে কালকেই একবার বেরোতে হবে। আশিষ কে বলতে হবে সমস্ত ডিটেলস বের করতে , ও তো সবটাই জানে। আর এক মুহূর্ত ও দেরি নয়।
*****
একটা অদ্ভুত গোঙানির শব্দে ঘুমটা ভাঙল কৃষ্ণেন্দুর। অন্ধকার ঘরে একটা নীল আলো জ্বলছে শুধু। ওর এই ভাবেই ঘুমোনোর অভ্যাস। একটা নীল নিভু আলো না জ্বালালে ঘুম আসে না ওর। আর আজ এমনিতেই যা ধকল গেছে। কিন্তু এইরকম অদ্ভুত শব্দ আসছেই বা কোথা থেকে। ঘুম চোখ খুলে হাতড়িয়ে নিজের মোবাইলটা হাতে নিল কৃষ্ণেন্দু। ঘড়িতে রাত আড়াইটা প্রায়। মোবাইল স্ক্রিন সরিয়ে নিতেই চোখ গেল ঘরে খাটের সামনের ফাঁকা অংশটায়। ঘরটা বেশ বড়। আসবাব বলতে শুধু খাট আর এটার সঙ্গে সাইড টেবিল। আর দেওয়াল আলমারি। আর কিছুই নেই। কিন্তু ওই ফাঁকা অংশ টা যেন আর ফাঁকা নেই একটা যেন ছোটোখাটো সিনেমার মতন কিছু চলছে সেখানে। অন্ধকারেও যেন কিছু বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন বলার কোনো প্রয়োজনই নেই এখানে। বাস্তবের মতোই যেন এই সিনেমা। আসতে আসতে কিরকম যেন একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কৃষ্ণেন্দু। অবশ হয়ে যাচ্ছে ওর সারাশরীর। কিন্তু চোখ দুটো খোলা। প্রতিটি মুহূর্ত পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও। ওই তো ওই লোকটা, হ্যাঁ ওই লোকটাই তো, বার বার ফিরে ফিরে আসছে ওর চোখের সামনে। সেই মুখ দেখলে যেমন গা শিউরে ওঠে, তেমনি ঘিরে ধরে অদ্ভুত এক অনুভূতি। সেই অনুভূতি কিরকম তা ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয় , কিন্তু সে যে যন্ত্রণার অনুভূতি, ভীষণ যন্ত্রণার। বুকের ভিতরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে , কিছুতেই শান্তি নেই যেন। ওই লোকটার চোখ দুটোর দিকে কখনো এত ভালো করে তাকায়নি , আজ এই প্রথম দেখল, সমস্ত ভয়াবহতা, ক্রুরতা, সব কিছুর উর্দ্ধে একটা অসহায়তা জড়িয়ে রয়েছে চোখ গুলোয়। যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে, ভেসে যাচ্ছে সব, অথচ কিছুই করার ক্ষমতা নেই মানুষটার।
“ডাক্তারবাবু , আমার ছেলেটা এবার মরে যাবে, আমায় তো সেই কখন থেকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। বললেন ব্যবস্থা হয়ে গেছে, তাহলে আবার কি হলো? ছেলেটা তো আর বাঁচবে না ডাক্তার বাবু।”
“কিছু হবে না তোমার ছেলের। সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্লাড ও পেয়েই যাবে। কোনো অসুবিধে নেই, তুমি একটু শান্ত হও।”
“মানে? এখনো জোগাড় হয়নি? এই যে ওরা বলে গেল পেয়ে গেছে?”
“না না ,তুমি ভুল শুনেছ , এখনো পাওয়া যায়নি , তবে পাওয়া যাবে।”
“আমি গরিব মানুষ, অত লেখাপড়াও জানি না ,তার মধ্যে আমার এই অসুখ, ছেলেটা ছাড়া আমার কোনো সম্বল নেই, একটু দেখবেন ডাক্তারবাবু। “
কান্নায় ভেঙে পড়ার ঠিক আগের অবস্থায় বৃদ্ধ মানুষটা। ডাক্তার আশ্বাস দিয়ে চলে গেল। মানুষটা শুন্য দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে রইল , মনে তখন ও একটা আশা, ছেলে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে।”
*****
ফোনের শব্দে ঘুমটা ভাঙল কৃষ্ণেন্দুর। ধড়মড়িয়ে উঠল ও , তার মানে এতক্ষণ ও ঘুমিয়ে ছিল? স্বপ্ন ই দেখছিল। কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন!
সকাল হয়ে গেছে। মনটা যেন ভোরের আলো দেখে আশ্বস্ত হলো একটু। এলার্ম টা বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠল কৃষ্ণেন্দু। শরীরটা বেশ দুর্বল। সাথে মস্তিস্ক ও। কি আর দোষ এদের?যা হচ্ছে কাল থেকে। আশিষ কে এস এম এস টা করে বাথরুমে ঢুকল ও।
*****
শরীর মোটামুটি চললে , মানে একেবারে শুয়ে না পড়লে সাধারণত শুট বন্ধ করে না কৃষ্ণেন্দু , কারণ ভালো লাগার জায়গা তো এটাই। আজ ও তাই দেরিতে হলেও পৌঁছে গেছে স্পট এ। কাজের মধ্যে থাকলে মনটা ও ভালো থাকবে, ওসব কোনো চিন্তা ও আসবে না মাথায়। নিজের কাজেই ডুবে ছিল কৃষ্ণেন্দু। আশিষ এখনো অব্দি কিছু জানাল না , কিছুক্ষণ আগেই জিজ্ঞাসা করল বলল বাড়ি খুঁজছে। পেলো কি না কে জানে।
ল্যাপটপের ভিতর ডুবেই গেছিল কৃষ্ণেন্দু , এসি চলছে , নিস্তব্ধ ঘর , লোকজন সেট রেডি করতে ব্যস্ত, হঠাৎ কোথা থেকে টপটপ করে জল পড়ার শব্দ আসছিল , এখানে আর জল কোথা থেকে পড়বে , এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে আবার নিজের ল্যাপটপে মুখ গুজঁল ও। কিছুক্ষণ সব ঠিক, আবার সেই একই শব্দ। কি যে হচ্ছে ,খানিক বিরক্ত হয়ে ওদের স্পট বয় কে খানিক ডাকাডাকি করল কৃষ্ণেন্দু , কিন্তু কোনো শব্দ নেই। ঘড়িটা দেখল একবার। এখন ওদের খেতে যাওয়ার সময়, খেতে গেছে হয়তো। পাশে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল ঢালল গলায়, আবার তাকাল স্ক্রিনের দিকে। কিন্তু এবার যা হলো টা কৃষ্ণেন্দুর চিন্তার বাইরে। ওর একেবারে মাথার উপর জল পড়ল এবার, মাথায় হাত দিল আর সঙ্গে সঙ্গে ছাদের দিকে।
গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না , প্রাণবায়ু টা কোনোক্রমে বুকের ভিতর হাঁকপাঁক করছে, যে কোনো সময় বেরিয়ে যাবে , মাথার উপর বা চারপাশে যাকে জলবিন্দু ভেবে বিরক্ত হচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু , তা জল নয় রক্ত বিন্দু! টকটকে লাল তাজা রক্তের ফোঁটা পড়ে রয়েছে চারপাশে।
সারা ঘর ভরে যাচ্ছে একটু একটু করে সেই রক্তে। আর গোটা সিলিং জুড়ে রক্তের দাগে তৈরী একটা অবয়ব!
চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হল কৃষ্ণেন্দুর। গলা দিয়ে আওয়াজ ও বের করতে পারছে না, কিন্তু এ কে? ওর সাথে এসন কেন হচ্ছে, এ তো সেই লোকটারই অবয়ব, সে আর তার ছেলে, কি মানে এসবের? চেয়ার থেকে উঠে দরজা খুলে দৌড়ে বেরোতেই যাবে, তখন ই গেল ঝুপ করে সব আলো নিভে। আর পারছে না কৃষ্ণেন্দু। গোঙাতে গোঙাতে কখন জ্ঞান হারাল জানা নেই।
*****
“তুমি আগে একটু সুস্থ হও কৃষ্ণেন্দুদা, তারপর এই সব বলছি। কিন্তু তুমি আগে বিশ্রাম করো। আমি বাইরেই আছি।”
“আমি সব না শুনে পারব না বিশ্রাম নিতে, আগে সব টা বল। আমার জানা দরকার।”
বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ক্ষীণ অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে বলল কৃষ্ণেন্দু।
বাধ্য হয়ে পাশে বসল আশিষ, “আমি গেছিলাম তোমার কথা মতো ঐখানে, একটা অন্ধ গলির মধ্যে, তাই অনেক খুঁজতেও হলো। যাই হোক, পেলাম ফাইনালি বাড়িটা। কিন্তু গিয়ে দেখলাম ওখানে এখন অন্য লোক থাকে, যিনি থাকতেন মানে যাকে আমরা হসপিটালে দেখেছিলাম সে কো ইন্সিডেন্টলি এই ফ্ল্যাটের ই সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। তবে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে ক্যান্সার এ ভুগছিলেন ,তারপর ছেলে… “
“থামলে কেন, বল?” অধৈর্য হয়ে বলল কৃষ্ণেন্দু।
“সেদিনকার পর ছেলেটি মারা যায়…” কয়েক সেকেন্ড এর নিস্তব্ধতা। তারপর আবার বলল আশিষ, “আর ছেলে ছাড়া আর কেউ ছিল ও না ভদ্রলোকের। আর ক্যান্সার এ অলরেডি ভুগছিলেন বলে ছেলেই সংসারটা টানত, ডেলিভারি বয় এর কাজ করত ছেলেটি, আরো কিছু কাজ করত হয়তো জানি না ঠিক। চিকিৎসার বিপুল খরচের জন্যই নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে এখানে ভাড়া নিয়ে থাকছিল। ছেলের এক্সিডেন্ট এর পর একেবারেই ভেঙে পড়েন উনি, মানসিক আর শারীরিক দু দিক থেকেই। না তো কাজ করার ক্ষমতা ছিল না মানসিকতা। বাঁচার রাস্তা বন্ধ হয়, ক্যান্সার এ তিলে তিলে মরার যন্ত্রনা আর নিতে পারছিলেন না হয়তো , আর ছেলেটাও… উনি সুইসাইড করেন কিছু মাস আগেই। এই বিল্ডিং এর ছাদ থেকেই। তখন এই ফ্লোরটা কনস্ট্রাকশন চলছিল।” কিন্তু তুমি প্রায় বছর খানেক ঘুরে যাওয়ার পর হঠাৎ এই ব্যাপারটা নিয়ে পড়লেই বা কেন? আর কি অদ্ভুত কো ইন্সিডেন্স… ও এই বিল্ডিং থেকেই… “
আশিষের কোনো কথা আর কানে যাচ্ছিল না কৃষ্ণেন্দুর। এবার সবটুকু মিলিয়ে নিতে পারছে ও। প্রতিটা বাক্স যেন নিজের নিজের জায়গায় বসে যাচ্ছে এবার।
শুধুমাত্র তোষামোদ করে উপরে ওঠার জন্য, সাফল্যের সিঁড়ি পার করার জন্য নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেইদিন ওই রক্ত যার বেশি প্রয়োজন তার কাছে পৌঁছাতে না দিয়ে নিজে নিয়ে নিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। কিন্তু তারপর ওই মানুষগুলোর কি হলো একবার ও জানতে ও চায়নি। খোঁজ নেওয়ার বা সাহায্য করার চেষ্টা ও করেনি। কিন্তু ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস ! ওই রক্ত শেষ অবধি কোনো প্রয়োজন হয়নি ডি.কে স্যারের। আর না তো উনি ওনার পরের অত বড় প্রজেক্টটায় কৃষ্ণেন্দুকে চান্স দিলেন। মাঝখান থেকে শুধুমাত্র ক্ষমতা, যশ, অর্থের লোভে একটা অসহায় মানুষের গোটা সংসার টা কে শেষ করে দিলো ও। খুন করল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দুজন মানুষকে। যেভাবেই মৃত্যু হয়ে থাকুক না কেন, মৃত্যুর কারণ তো কৃষ্ণেন্দু মুখার্জিই। তাহলে ও খুনী ছাড়া কি? আর কোনোদিন নিজেকে ক্ষমতা করতে পারবে ও? নাকি আর নিষ্কৃতি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে? বাড়ি বদলে ফেললেই কি আর সহজে পিছু ছাড়বে ওই অসহায় মানুষটার অতৃপ্ত আত্মা? না মনে হয়। এভাবেই একটু একটু করে ভয়, ঘৃণা, আত্মগ্লানিতে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে একটা গোটা জীবন। আর এটাই মনে হয় সব থেকে বড় শাস্তি।
*****
মানুষের আদালতে বিচার না হোক, সেখানে মানুষের মেরুদন্ড, মান, হুঁশ টাকা আর ক্ষমতার নীচে চাপা পড়ে থাকুক, উপরওয়ালার আদালতে সব বিচার হয়। আজ কৃষ্ণেন্দু মুখার্জির ঠিকানা ‘সূর্যোদয় মেন্টাল হসপিটাল’, পরিচয় পেশেন্ট নম্বর ৬৩।