শিক্ষা

।।১।।

দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c তে এসেছেন মাস চারেক হলো। আসার পর থেকে আশেপাশের মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে , তবে খুব বেশি হয়নি। প্রথম কারণ হলো চরম ব্যস্ততা, আর দ্বিতীয়ত ও মুখ্য কারণ হলো রেণুকা ম্যাডামের সাথে যুক্ত উপরের বিশেষণগুলি। কার সাধ্যি দাঁড়িয়ে কথা বলে। ব্যক্তিত্ব মারাত্মক, দেখতেও ভালো লাগে বৈকি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে দেখতেই ভালো লাগে, এর বেশি কিছু বোধহয় নয়। ওই যেমন টিভি সিরিয়েল গুলোতে দেখায় , দেখতেই ভালো , ওই রকম মানুষ আমাদের সাথে ২৪ ঘন্টা থাকলে তো জীবন বরবাদ। সেই রকমই জীবন বরবাদ হচ্ছে চণ্ডীর। চণ্ডী এই বাড়িতে ফাইফরমায়েশ খাটার কাজ নিয়ে ঢুকেছে দুমাস হলো , তার আগে যে ছিল সে ওদের ঘরের কাছেই থাকে। সে আগেও সাবধান করেছিল , কিন্তু পেটের দায়ে আর বেশি কিছু ভাবেনি ও , কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

এই তো আজকেই , ম্যাডামের ঘরের এসি খারাপ হয়ে গেছে সে কি চণ্ডীর দোষ? ও কি করবে? ও তো আর এসি চালিয়ে ঠান্ডা হাওয়া খায় না।

ম্যাডামের কথা অনুযায়ী ও কেন সার্ভিসিং এ খবর দিতে যায়নি যখনি বুঝতে পেরেছে?

প্রথমত , ও বুঝতেই পারেনি। বুঝতে গেলে চালানোর চেষ্টা করতে হতো, আর দ্বিতীয়ত, ও যদি এত লেখাপড়া জানতো তাহলে কি আর লোকের বাড়ি খেটে মরতো?

বিনা দোষে এরকম কথা শুনতে কার ভালো লাগে সাত সকালে?

এই তো কালকেই, ছুটির দিন ভর দুপুরে, একটা জিনিস এলো। এই প্রচন্ড গরমে ছেলেটা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল জিনিসটা নিয়ে, মানুষ দুপুরে বেরোতেই পারছে না, আর এই মানুষগুলো দুটো খাবার জন্যই তো এত কষ্ট করছে। জিনিসটা নীচে আনতে গেছিল চন্ডীই। সবসময় সবাইকে ঢুকতে দেয় না এখানে দারোয়ানগুলো, অগত্যা ওকেই যেতে হয়। ছেলেটার বয়স কম, চণ্ডীর ছেলের বয়সীই হবে। দেখে মায়া হলো , ঘামে সপসপ করছে, মুখ চোখ লাল, একটু জল খাওয়ালে ক্ষতি কি? কিন্তু ঢুকতে তো দেবে না, আর ছেলেটার জল টাও গেছে শেষ হয়ে, তাই দারোয়ানের ঘরে বসিয়েই উপর থেকে আরেকবার জল নিয়ে গেছিল চণ্ডী। ব্যাস ! ফেরার পরই কুরুক্ষেত্র শুরু। কার অনুমতি নিয়ে ও এটা করেছে? ভীষণ খারাপ লাগলো ওর, আচ্ছা এই মানুষগুলোর বুদ্ধি বেশি বলেই তো এই মানুষগুলো ভালো কাজ করে, এত বড়লোক। তাহলে এদের মনটা এরকম কেন?

মনটাও তো বড় হওয়ার কথা। না সব মানুষ একই তা নয় , কিন্তু এই যে এরা গরিব মানুষগুলোকে মানুষ বলেই মনে করে না, এইটা কেন ?

মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে চণ্ডীর। আগের কাজটাই ভালো ছিল। বেকার বেশি টাকার লোভ করতে গেল। কতদিন হয়ে গেল দেশেও যায়নি। ছেলেটার নতুন ক্লাস শুরুর আগে যাবে বলেছিল। মা মরা ওই একটি ছেলেই যা সম্বল। সামনের সপ্তাহেই যাবে। যা হয় হবে। এমনিও এখানে মন টিকছে না।

এত শত ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির দিকে তাকাল চণ্ডী, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে সব। হাতের কাজ সারতে লাগলো ও তাড়াতাড়ি।

*****

রেণুকা আর অমরনাথ দুইজনের একত্রে তৈরী কোম্পানির নাম ‘ এ বি আর প্রোডাকসন্স ‘। অনেক যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে শুরু করেছিল জার্নিটা , এতবড়ো ও হবে ভাবেনি। এখন এই প্রোডাকশন হাউসের কাজই ধ্যানজ্ঞান। এখন একটা শর্ট ফিল্মের কাজ চলছে, তার লোকেশন নিয়ে বেশ ব্যস্ত দুজনেই। নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। বাড়ি ফেরার সময়েরও ঠিক নেই। আজতাও একটু অন্যদিনের তুলনায় তাড়াতাড়ি ফিরতে পেরেছে। ঘরে ঢুকেই মুখটায় বিরক্তি ভরে গেল রেণুকা বোসের। এসিটা চালিয়ে যে একটু রেস্ট নেবেন তার ও উপায় নেই, অন্য ঘরে আছে এসি। কিন্তু নিজের ঘরটার মতো কি আর হয়?

চণ্ডী আড়চোখে দেখলো একবার , কিছু বলে কাজ নেই বাবা। ব্যাগগুলো নিয়ে ভিতরে চলে গেল ও। রাত্রের খাবারের ব্যবস্থা করতে।

স্যালাডটা কেটে থালায় সাজাচ্ছিল চণ্ডী , তখনি কানে এলো কথাগুলো। বেশ চিন্তিত ও বিব্রত সেটা কথার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, তা সে যতই ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলুক, এটুকু তো বোঝাই যায়। ও আবার কিছু করল না তো? নাহ, আজ তো কিছু করেছে বলে মনে পড়ছে না ওর। বেশ ভয়ে ভয়েই খাবার থালাগুলো টেবিল রাখতে এল চণ্ডী। মি : বোস সোফাটায় হাত পা ছড়িয়ে বসে আছেন একটু চিন্তিত মুখে, ম্যাডাম ঘর জুড়ে পায়চারি করছেন আর ফোনে কথা বলছেন কারো সাথে। মেজাজ যে সপ্তমে আছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। অমরনাথ বাবু আবার একটু বেশিই ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ, মানে একেবারেই উল্টো ম্যাডামের থেকে। কথাও বলেন বেশ ধীরে, ব্যবহার খুব ভালো, অধিকাংশ সময়ে চুপই থাকেন, বিশেষ কিছু বলেন না, চেহারা লম্বা, গড়ন একটু মোটার দিকে, শ্যামবর্ণ, মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। এখনও চুপই ছিলেন, চণ্ডীকে দেখে ইশারায় বললেন থালাগুলো নিয়ে পরে আসতে, খাবার পরে বাড়তে, এখন খাবার অবস্থা নেই।

চণ্ডী একটু অবাক হয়ে তাকাল ঘড়ির দিকে। এই বাড়িতে সাধারণত খাওয়া দাওয়াটা নিয়ম মেনেই হয়। ম্যাডামের আবার টাইমের এদিক ওদিক একদম পছন্দ নয়। প্রমাদ গুনলো চণ্ডী। স্যারের কথা শুনবে নাকি ম্যাডামের। উফফ ! কি সমস্যা। ভিতরে চলে যাচ্ছিল ও , তখন ম্যাডাম পিছু ডাকলেন। সে ডাক তো নয় , পিলে কাঁপিয়ে দিলো যেন। ব্যাস , আবার একচোট না শুরু হয়।

“কি হলো? ওকে ভিতরে যেতে বলছ কেন? কটা বাজে তাকিয়ে দেখেছ ঘড়ির দিকে?”

ফোনটা রাখতে রাখতে দুজনের দিকেই যেন অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কথাগুলো বললেন মিসেস বোস।

আর কোনো কথার অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি টেবিল সাজাতে লাগল চণ্ডী। কথায় নয়তো কথা বাড়বে।

“আরে, তুমিই তো ফোনে কথা বলছিলে? তাই ওকে পরে খাবার বাড়তে বলছিলাম। আশ্চর্য তো !”

” থাক, অত ভাবতে হবে না আর তোমায়। ভাবলে লোকেশনটার একটা ব্যবস্থা করতে। “

” আমি ভেবেছিলাম , দেখেও রেখেছিলাম , তোমারই পছন্দ হয়নি রেণু । “

“পছন্দ হওয়ার মতো হলে নিশ্চয় হতো। যে টুকু কাজ করবে ঠিক ভাবে করো অন্তত।”

ঘরের আবহাওয়া উত্তপ্ত হচ্ছিলো উত্তপ্ত কথাবার্তার আদানপ্রদানে। থালা বাটি চামচের শব্দ যেন তীব্র হচ্ছিল একটু একটু করে, অমরনাথ বাবু আর একটি কথাও বললেন না। ওনার মুখের দিকে চণ্ডী তাকাল একবার। সত্যিই তো এভাবে একটা বাইরের লোকের সামনে নিজের স্বামীকে বলাটা তো ঠিক নয় , চণ্ডী অশিক্ষিত তাও ওর এইটুকু বোধ আছে। আর না দাঁড়িয়ে ভিতরে রান্নাঘরে চলে এল ও , আর ওখানে না থাকাই ভালো। ঘড়িটা দেখল একবার , খেয়ে নিয়ে ছেলেটাকে একটা ফোন করবে। কিন্তু এনাদের খাওয়া দাওয়া না মিটলে চন্ডীও খেতে বসতে পারছে না তো।

*****

“তোমায় আগে থেকেই বলেছিলাম গ্রামের ভিতর অফবিট একটা লোকেশন চাই। যেখানে আমরা দুতিনদিন থেকে শুটটা করতে পারি। তোমার উপর ভরসা করে ছেড়েছিলাম পুরোটা, কি লোকেশন চুস করেছো তুমি? ওখানে হবে শুট?”

“তুমিই করো তাহলে পুরোটা, আমাকে এই প্রজেক্টের মধ্যে আর জড়িও না। “

অমরনাথ বাবুর গলাটা বেশ ভারী শোনাল, আরো অনেক কোথায় বলছিল ওরা , চণ্ডীর মাথায় ঢুকলো না কিছু , ও এটুকু বুঝেছে একটা জায়গা চাই গ্রামে, যেটা জোগাড় করতে পারেনি বলে এত ঝামেলা হচ্ছে। আচ্ছা ওর গ্রামের কথা বলবে কি? ওদের জমি বাড়ি সবই তো আছে গ্রামে, ওখানে দুতিনদিন থাকলে ক্ষতি কি? আর এই সুযোগে ওর দেশে ঘুরে আসাটাও হবে, ও তো যাবে ভাবছিলোই।

তড়াক করে উঠে পড়ল রান্নাঘরের মেঝে থেকে চণ্ডী, কি মাথায় ভর করল কে জানে ওর, আগু পিছে কিছু না ভেবে বেরিয়ে এসে বলে ফেলল কথাটা, ” আপনাদের অসুবিধা না থাকলে আমার গ্রামে আপনারা আসতে পারেন, আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি পারব সাহায্য করতে, দু তিনদিন আমার গ্রামের বাড়িতেই কষ্ট করে থেকে যেতে পারেন। “

একগাল হাসি নিয়ে আর নিষ্পাপ মুখে খুব আশা করে কথাটা বলল চণ্ডী, বেশি কিছু ভাবলে হয়তো বলতেই পারত না, কিন্তু বলে দিলো অবশেষে।

।। ২।।

চণ্ডীকে সঙ্গে নিয়ে অমরনাথ আর ওদের টীম যখন রওনা হলো তখন সকাল ৬ টাও বাজেনি বোধহয়। রেণুকা ম্যাডামেরও যে খুব একটা আপত্তি ছিল তা নয়, এই সুযোগে ওর বাড়ি যাওয়াটাও হচ্ছে। ছেলে তো শুটিং শুনে ভীষণ খুশি। গ্রামের সব লোকজন না জড়ো হয়ে যায়।

মানুষগুলো হয়তো এতটাও খারাপ নয় যতটা মনে হচ্ছিল, নয়তো ওর একবার বলায় এভাবে ওরা রাজি হয়ে যাবে ও তো স্বপ্নেও ভাবেনি, বিশেষ করে ম্যাডাম। যাক যে , যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। এই প্রথম ও গাড়ি করে যাচ্ছে , প্রতিবার ট্রেন বা বাসেই যায়। গাড়ি করে যাত্রাটাও খুব সুন্দর হবে নিশ্চয়। আচ্ছা ওখানে সব ব্যবস্থা তো ওই করেছে, এত গুলো লোকের থাকা খাওয়া, খরচের কথাটা এখনো বলতে পারেনি, কিন্তু ওদের কি বলতে হবে ? ও সব ব্যবস্থা করল ওরা তো জানে , নিশ্চয় দিয়ে দেবে। কর গুনে হিসেবে করলো চণ্ডী, বেশ অনেকটাই খরচ হয়েচে। মাস পড়তে ও দেরি আছে, ওর বাড়ি ফেরার আনন্দটা যেন একটু মিইয়ে গেল এই চিন্তাগুলোর জন্য।

যাক গে, নিশ্চয় দিয়ে দেবে, নয়তো তেমন হলে ও চাইবে খন। বেশি না ভেবে রাস্তার দিকে তাকালো ও। সূর্যের তেজ এখনো কম আছে, তাই আবহাওয়াটা এখনো ভারী সুন্দর আছে, প্যাচপ্যাচে গরম নেই। হু হু করে বাতাস বইছে , গাড়ি এগিয়ে চলল বাতাসিপুরের দিকে।

*****

এতটা চণ্ডী নিজেও ভাবেনি। এই জন্যই বলে হয়তো গ্রামের মানুষ বড় সোজা সরল। বাতাসিপুরে ঢোকার পর থেকে এখনো অব্দি চণ্ডী আর সমস্ত লোকজনের এমন অতিথি আপ্যায়ন হচ্ছে যেন এই দু তিনদিন গোটা গ্রামে বিয়ে লেগেছে কোনো। আসলে এই গ্রামে কখনোই কোনো শুটিং হয়নি , কেউ জীবনে এসব দেখেওনি। চণ্ডী নিজেও দেখেছে নাকি ! তাই মানুষজন হামলে পড়ছে চণ্ডীর বাড়ির সামনের একফালি জমিটায়। এতদিন পর ছেলেটাকে কাছে পেয়ে মনটাও খুব খুশি। এখন তো মনে হচ্ছে শুটিং ৩ দিন কেন ৩ সপ্তাহ চলুক !

এই গ্রামের রাস্তা পাকা, বিদ্যুৎ ও এখন ঘরে ঘরে, জলেরও কোনো সমস্যা নেই, নিজেদের যতটা সামর্থ্য তাই দিয়ে প্রাণপনে চেষ্টা করছে ওরা যাতে মানুষগুলোর কোনো সমস্যা না হয়। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা বিশেষ করে। দুই জায়গার খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস সম্পূর্ণ আলাদা, কিন্তু যতই হোক গ্রাম, এখানকার মুদিখানায় সব তো পাওয়া সম্ভব নয়। ওদিকে এখানে তো সব জলখাবারে মুড়ি চপ খেয়ে অভ্যস্ত, কিন্তু এদেরকে কি দেওয়া ঠিক হবে?

কাল রাত্রেও রুটি, দুই রকমের সবজি , পায়েস বানিয়েছিলেন চন্ডির ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধা মা। সবাই ভালো বললেও ম্যাডামের মুখে সেই তৃপ্তি চোখে পড়েনি ওর , বরং বিরক্তি ফুটে উঠছিল বেশি করে। খারাপ লাগলো চণ্ডীর, মায়ের জন্য।

আজ সকল থেকেই মা লেগে পড়েছে, চপ বেগুনি ভাজা চলছে , দোকান থেকে মুড়ি জিলিপি নিয়ে চলে এসেছে সকালেই। এই মানুষগুলো তো অত জানে না, যদি খাবার সময় কেউ ঝামেলা করে, তার থেকে একবার জেনে নেওয়া ভালো। আর দেরি না করে যেখানে কাজ চলছে সেখানে খালি পায়েই দৌড় দিলো চণ্ডী।

*****

“চলবে মানে? রীতিমতো দৌড়োবে ! কি তাইতো? “

চণ্ডীর দিকে একবার হেসে তারপর বাকি টিমের দিকে তাকালেন অমরনাথ। সবাই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে আর একগাল হেসে সহমত প্রকাশ করল।

“দেখো চণ্ডী, এখন আমরা এসেছি তোমার এলাকায় , তাই এখানকার যা কিছু সেটা আমরা এডপ্ট…মানে গ্রহণ করব আরকি। তুমি ওখানে তো আমরা যা খাই যেভাবে চলি, থাকি সেভাবেই থাকো। এবারে এখানে এসে আমাদের পালা। তোমার এত ভাবার কিছু নেই, নিশ্চিন্তে থাকো। আজ জমিয়ে মুড়ি মাখা খাব, আর সঙ্গে চা! উফফ! যাও যাও নিয়ে এস, আমার টিমের ডিঙ্কা আর মৃদুলকেও নিয়ে যাও সাথে ।”

*****

এই মানুষটা সত্যিই আলাদা , মনটা বেশ হালকা লাগছে এবার।

।।৩।।

দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল চোখের নিমেষে। আর একদিনের মধ্যে কাজ মিটে যাবে বলছে ওরা, চণ্ডী ভাবছিল আর দুদিনের ছুটি চেয়ে নেবে কি না ,আবার কবে আসা হয় না হয়। এখনো বলেনি কিছু। আজকের সন্ধ্যেতে বেশ ভালো হাওয়া ছেড়েছে , নয়তো প্রাণ ওষ্ঠাগত। লুচি করলে মন্দ হয় না, লুচি কার না প্রিয় ! ছেলেটাও খুব ভালোবাসে। কাল রাত্রেই বলছিল, ছেলে কিছু চাইলে না দিয়ে থাকতে পারেনা চণ্ডী। ঐটুকুই তো সম্বল, ছেলেটা চায় ও না তেমন কিছু।

আর দুবার ভাবেনি তাই চণ্ডী, সন্ধ্যা থেকেই ঢুকে গেছিল হেঁসেলে। আটাটা মেখে সবজি কুটতে শুরু করেছে সবে তখনই চেঁচামেচি এলো কানে। প্রথমটায় অত কান যায়নি, কিন্তু তীব্রতা বাড়তে আর থাকতে পারল না রান্নাঘরে। বঁটি রেখে ছুটে বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে।

“আমি অনেকক্ষণ ধরে নোটিশ করেছি বলেই বলছি। নয়তো এতগুলো টাকা তো আর উবে যেতে পারে না। “

“রেণুকা তুমি চুপ কর, আমায় বলতে দাও ব্যাপারটা। “

“না কেন চুপ করব? আর তুমি বলবেই বা কি ? কিভাবে যে এখানে আসতে রাজি হয়ে গেলে তুমি! আশ্চর্য!”

“আমি কি তোমায় জোর করে নিয়ে এসেছি? তুমিও রাজি হয়েছিলে। এখন কথা ঘোরাচ্ছ কেন ? আর আমার এখানে এসে এখনো অব্দি মনে হয়নি যে আমি কিছু ভুল করেছি। “

“তোমার বোধ আছে কিছু ? সব কিছু বড় বেশি সাদা চোখে দেখো তুমি , তাই লোকের কাছে বোকা বনে হেরে বসে থাকো। আমার তখনি সন্দেহ হয়েছিল যখন নিজে যেচে আমাদের এখানে আসার অফারটা দিয়েছিল। নিশ্চয় কোনো মতলব আছে। “

চণ্ডী বিন্দুবিসর্গ ও কিছু বুঝতে পারছিল না , কি হচ্ছে এসব। ওর তো সত্যিই কোনো মতলব ছিল না, মতলব একটা ছিল তবে সেটা নিজের বাড়ি আসার, এই সুযোগে, ব্যাস এটুকুই। এর বেশি তো আর কিছু না। বিগত তিনদিন ধরে চারবেলা উদয়স্ত খেটে চলেছে এই মানুষগুলোর যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তারপরেও কি এমন করলো যে এরকম অপবাদ দিচ্ছে ?”

এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল চণ্ডী, সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ঘটছিল যে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না, ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করে বলে যাচ্ছেন এসব উনি ? চণ্ডী তো এখানে ছিলই না। চোখ ঘোরাতে ঘোরাতেই দেখল একটু দূরে একটা বাড়ির দাওয়ায় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন অশীতিপর বৃদ্ধা , আর তাকে ধরে রয়েছেন তার নাতি। মানে চণ্ডীর মা আর ছেলে। মায়ের চোখ মুখ দেখে খুব একটা ভালো ঠেকল না চণ্ডীর, আর ছেলেটাও কেমন মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

তার মানে কি ! মাথাটা জ্বলে উঠল চণ্ডীর। ওর পরিবারের অসম্মান যদি হয় , ওর থেকে খারাপ আর কেউ হবে না , সে সামনেই যেই থাকুক!

নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত করে বলল চণ্ডী, “কি হয়েছে এত চেঁচামেচি হচ্ছে কেন ?”

ওর বলাটাই যেন বাকি ছিল , অমরনাথ বাবুর বাধা সত্ত্বেও যেন মারাত্মক ক্ষিপ্রতায় ওর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রেণুকা বোস , সঙ্গে বিষাক্ত বাক্যবাণ।

‘কি হয়েছে সেটা নিজে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর নিজের মা কে। এই বয়সে এসে কারো এত লোভ থাকতে পারে ভাবতে পারছি না !”

“মুখ সামলে কথা বলবেন ম্যাডাম। আপনি যা খুশি বলে যাবেন আর আমি শুনে যাবো নাকি? কি ভাবেন আপনি নিজেকে? মনে রাখবেন আপনি এখন আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন, তাই সেটা বুঝে কথা বলবেন। বড়োলোক বলে মাথা কিনে নেননি।”

এরকম একটা প্রতিক্রিয়া আশা করেনি রেণুকা বোস। মানুষকে যা খুশি বলে পার পেয়ে যাওয়া যায় এরকম টাই ভেবেছিল , কিন্তু এবারে বোধহয় তা হওয়ার নয়।

“ঠাকুমা আমার সাথে এই দিকে এসেছিল , খাবারের কথা জিজ্ঞাসা করতেই। তখন এখানে ব্যাগপত্র সব অগোছালো দেখে নিজের মনেই একটু সাজিয়ে দিছিলো। আমি তখন বারণ ও করেছিলাম একবার। শোনেনি , ওই সময়েই হয়তো ওনার ব্যাগ থেকে টাকাটা পড়ে যায় কোনোভাবে। পরে উনি খোঁজার পর আমি এদিক ওদিক দেখে টাকাটা পেয়ে ওনার হাতে দিতে গেলে উনি আমাদের চোর অপবাদ দেওয়া শুরু করেন। আমি নাকি ভয় পেয়ে টাকাটা নেয়ার পরে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। “

অমরনাথ বরাবরই চুপ থাকেন , বা ওনাকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এবারে জিনিসটা একটু অন্যরকম ঘটল, আর এটা আশাতীত।

“তুমি এখুনি ক্ষমা চাইবে এদের কাছে। “

বিস্মিত চোখে তাকাল চণ্ডী অমরনাথবাবুর দিকে। রেণুকা বোস খুব স্বাভাবিকভাবেই এটা আশা করেননি , তাই তাকালেন এমন ভাবে যেন এখুনি সব ভস্ম করে দিতে পারেন। একইরকম মেজাজ নিয়ে বলেন ,” কাকে কি বলছ ? মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?”

“তোমাকেই বলছি , আর এটা অনেক আগেই আমার করা উচিত ছিল, জল তাহলে এতদূর গড়াতো না, এমন কিছু কেউকেটা হয়ে যাওনি তুমি যে যাকে খুশি যখন খুশি অপমান করে পার পেয়ে যাবে। অন্যায় যখন করেছো তখন ক্ষমা তো চাইতেই হবে। “

চণ্ডী অমরনাথ বাবুর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, চুপ করিয়ে দিল অমরনাথ।

“অনেক বড় বড় কথা বললে। ফিরতে তো হবেই, তখন দেখছি এত রোয়াব কোথায় থাকে। ” দুজনের দিকে তাকিয়ে কথা কটা বলে ওখান থেকে বেরিয়ে আসছিল রেণুকা বোস, তার আগেই পিছু ডাকল চণ্ডী।

” ম্যাডাম আপনি অন্য কাউকে দেখে নিন, আমি আর আপনার বাড়ি কাজে ফিরছি না। গরীব হলেও আমাদের আত্মসমান আর মেরুদন্ডটা আছে। সেটা বিকিয়ে যাবে না কোনোদিন। আমার কাছে আমার নিজের আর আমার পরিবারের সম্মান আপনার ওই কাজের থেকে অনেক দামি। আমি আপনার বাড়ির কাজ ছেড়ে দিলাম। অন্য কাউকে দেখে নিন। “

মুখ চোখ খানিক বিকৃত করে কিছু অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করতে যাচ্ছিল রেণুকা বোস , চারপাশের পরিবেশ দেখে নিজেকে অতি কষ্টে সংযত করল ও। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে উদ্যত হলো।

“না ম্যাডাম, আপনার ওই টাকা আমি আর নেবো না, আপনাদের এখানে শুটিং শেষ না হওয়া অব্দি থাকতে পারেন, আবার ফিরতেও পারেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার। এই কদিনে আমার যা কিছু খরচ হয়েছে আমি আপনাদের দান করলাম। “

এইভাবে সপাটে চড় বোধহয় আজ অব্দি কেউ মারেনি রেণুকাকে। আজ তাই এতকিছু হজম করতে অসুবিধা হবারই কথা।

অমরনাথবাবু লজ্জিত মুখে চণ্ডীর হাত ধরে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন নত মস্তকে। স্ত্রীর এমন ব্যবহারে আজ স্বামীর মাথা হেঁট , পুরোটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না , চোখের দিকে না তাকিয়েই বললেন , “তোমার আর তোমার পরিবারের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি ওর হয়ে। যদি কখনো কোনো প্রয়োজন হয় , তুমি আমাকে জানাতে দ্বিধা কোরো না চণ্ডী। আর তোমার এই উপকার আমি কোনোদিন ও ভুলবো না। পুঁথিগত শিক্ষা না পেয়েও কেউ এমন শিক্ষিত হতে পারে আমি তোমায় দেখে জানলাম। শিক্ষিত অনেকেই হয়, সবাই মানুষ হয় না, মান আর হুঁশ সবার মধ্যে বেঁচে থেকে না আর। যোগাযোগ রেখো, তোমার মতো একজন এর সাথে দেখা হয়ে আমি সত্যিই আজ এটা বুঝেছি, মেরুদন্ড এখনো পুরোটা বিকিয়ে যায়নি এই পৃথিবী থেকে। ” খানিক থেমে আবার বললেন, “আর রেণুকা, তোমার ছবিতে তুমি তখনি ভালো কিছু দিতে পারবে যখন তোমার চিন্তার মধ্যে সেই ভালোটা থাকবে। মানুষ যেদিন তোমার এই রূপটা চিনবে, সেদিন তোমার ছবি কি, তোমার মুখদর্শনও আর করতে চাইবে কিনা সন্দেহ। সত্যি মিথ্যা তো পরে আসছে , একবার ভদ্র ভাবে তো জানার চেষ্টাটুকু করতে পারতে যে আদৌ কি হয়েছিল। আমার ওয়ালেটে খুচরো ছিল না বলে আমিই তোমার ব্যাগ থেকে টাকটা নিতে গেছিলাম, তাড়াহুড়োয় বলতে পারিনি। কিন্তু আর লাগেনি বলে বাইরেই রেখে দিয়ে চলে যাই, মৃদুলকে ছাড়তে। ব্যস্ততায় বলা হয়ে ওঠেনি কয়েকঘন্টার মধ্যে। ওই রেখে যাওয়া টাকাটাই চন্ডির ছেলে তোমায় খুঁজে দিতে এসেছিল। আর বাকি শুটিং এখানেই হবে, কোম্পানির ৫১ % শেয়ার আমার নাম আছে কিন্তু , তাই ডিসিশনটা আমিই নেব।”

*****

দম্ভ, অহংকার, আত্মকেন্দ্রিকতা এইসব কিছুর বেড়াজালে এতটাই জড়িয়ে গেছি আজ যে পাশের মানুষটাকে মানুষের চোখে দেখতেও ভুলে গেছি আমরা। সর্বদা নিজের সুখ, নিজের ভালোলাগা, নিজের ঠিক, নিজের সবকিছুর মাঝে উল্টোদিকের বা আশেপাশের মানুষগুলো ও যে মানুষ সেটা মাথায় রাখতে ভুলে যাই সবসময়। ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই তার মতন করে চেষ্টা করছে, কিছু না কিছু করার, তাদের মতন করে লড়াইটা লড়ছে , আর কোনো সাহায্য করতে না পারি, সামান্য সম্মান আর মানবিকতাবোধ তো দেখাতেই পারি আমরা।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

রক্ত

মালপত্র মোটামুটি সব নামানোই হয়ে গেছে, তাও আরেকবার দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে নিচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু। নতুন পাড়া, নতুন সব লোকজন , কালচার ও আলাদা। সাউথ থেকে সোজা

Read More »

Share with