।। ১।।
সকাল থেকে বাঁশি বাজিয়ে মাথা খারাপ করে দেবে এবার বাচ্চাগুলো, “বলতে বলতেই স্বামী দীপককে চা-টা দিয়ে গেল শর্বরী। আজ রথ, সকাল থেকেই আশপাশের বাড়ির বাচ্চাগুলো শুরু করেছে ভেপু বাজানো, তার শব্দে কান পাতা দায়।
“তাও ভালো, আজ থেকে শ্যামলীটা আবার কাজে আসবে,”ভাবতে ভাবতেই নিজের কাজে মন দিল শর্বরী। আজ অফিস ছুটি আছে, তাই একটু বেলা করেই উঠেছে শর্বরী।
শর্বরী আর দীপকের বিয়ে হয়েছে আট মাস মতো, নতুন বিয়ের গন্ধ এখন বিদ্যমান তা বলাই বাহুল্য। সাবেকী উত্তর কলকাতার শ্বশুরবাড়িতে জমিয়ে সময় কেটে যায় ছুটির দিনগুলোয়। সারা সপ্তাহ কাজের সূত্রে বাড়ি থেকে দূরেই থাকতে হয়, কিন্তু সপ্তাহান্তে শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দেওর, খুড় শ্বশুর-শাশুড়ি, সবাইকে নিয়ে জমজমাট কাটে ওর, একসাথে খেতে বেরনো, সিনেমা দেখা, ঘোরা সব মিলিয়ে হৈ হৈ করে কেটে যায় ছুটির দিন।
****************
শর্বরী আর দীপকের দেখাশোনা করেই বিয়ে, কিন্তু দু’জনের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং-টা প্রবল, অফুরন্ত ভালবাসায়, সোহাগে, আদরে দুটি মানুষ বেশ ভালোই আছে।
শ্যামলী এবাড়িতে কাজ করে, শর্বরী বিয়ে হয়ে আসা থেকেই দেখছে ওকে। ও মাসখানেক ধরে অসুস্থ ছিল, আজ এতদিন পর কাজে আসছে। শর্বরী বেশি বাড়িতে না থাকায় খুব বেশী আলাপটা জমেনি।
।। ২।।
ইতিমধ্যেই খুড়শ্বশুরের মেয়ে, মানে শর্বরীর ননদের বিয়ে ঠিক হয়েছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে, সুতরাং ব্যস্ততা এখন চূড়ান্ত। খুব বড় বাড়িতে বিয়ে ঠিক হয়েছে, তাই সবাই খুব খুশিও, কিন্তু শর্বরীর মনে তেমন উচ্ছ্বাস কোনোভাবেই জাগ্রত হচ্ছে না, তার প্রধান কারণ, বিয়ে ঠিক হওয়া ইস্তক, ওরা অনেকটা টাকা পণ চেয়েছে আর শর্বরী পণ প্রথার সম্পূর্ণ বিরোধী। ও ওর নিজের বিয়েতেও একটা টাকা পণ দেয়নি, সেখানে কাকাবাবু এত বিচক্ষণ মানুষ হয়ে কি করে ‘বড় বাড়ির জামাই’ পাওয়ার লোভে এত টাকা পণ দিতে রাজী হলো নিজের ক্ষমতার ঊর্ধ্বে গিয়ে, সেটা ভেবেই খুব খারাপ লাগছে শর্বরীর।
যাই হোক, জল খাবার খেতে বসে গেছে সকলে, ছুটির দিনগুলোয় সবাই থাকে, তাই একসাথেই ওদের বিশাল টেবিলে বসে খাওয়া হয়।
ওদের বাড়িটা পুরোনো আমলের বাড়ির ঐতিহ্য এখন ধরে রেখেছে, ভোল পাল্টে এখনও আধুনিকতার মোড়কে নিজেকে মুড়ে নেয়নি, তাই দাবার ছকের মেঝে আর গরাদ দেওয়া জানলার খড়খড়ি এখনও শোভা পায় অজস্র ফ্ল্যাটের ভিড়ের মাঝে।
ছুটির দিনে লুচি আলু চচ্চড়ি জলখাবার হয়েছে। এই যৌথ পরিবারের একটাই হেঁশেল, মা কাকীমারা খেতে দিয়ে খেতে বসলেন খানিক দেরীতে, বাবা মানে শ্বশুর মশাই-ই কথাটা পাড়লেন,”বৌমা, তোমায় একটা কথা বলব বলে মনস্থির করেই ফেললাম, সবার সামনেই বলছি, তোমার অসুবিধা থাকলে বলবে, নির্দ্বিধায় বলবে। “
খেতে খেতে মুখ তুলে একটু অবাক হয়েই তাকাল শর্বরী। শ্বশুর মশাই তো এরকম ফরম্যালিটি করে কথা বলে না। “বাবা বলো না, কি বলবে? তুমি বলো। “, শর্বরী বাবাকে একটু সহজ করে দিয়ে চাইল বাবার দিকে।
-“আসলে ছুটকির বিয়েতে পণ-এর জন্য তো বেশ খানিকটা টাকাই লাগছে, এই মুহূর্তে আমার বা তোমার কাকাবাবুর হাতও খালিই প্রায়, কিন্তু এখনই কিছু টাকা লাগবে, তো এই মুহূর্তে দীপুও যতটা সম্ভব দিচ্ছে, তুমি যদি এই পরিস্থিতিতে…”
বাবাকে কথাটা শেষ করতে দিল না আর শর্বরী, “বাবা এই টুকু কথার জন্য এতো কিন্তু করছিলে তুমি? আমি তো ছুটকিকে দিতেই চাই, তোমরাই প্রথমে নিতে চাওনি, বলো তুমি, আমি আছি, তোমাদের চিন্তা নেই। “
-“আগে শুনে তো নাও কত টাকা লাগবে? টাকার পরিমানটা নেহাত কম নয়, প্রায় ৮৫ হাজার মতো লাগবে, পারবে তুমি?”
টাকার অঙ্কটা শুনে খানিকটা হলেও থমকাল শর্বরী। একটু একটু করে অনেকদিন ধরে টাকা জমিয়েছিল ও, ও আর দীপক ঘুরতে যাবে বলে। টাকাটার থেকেও বড়ো, অনেকটা আশা ঘিরে আছে এটা নিয়ে, মধ্যবিত্ত পরিবারে টাকাটা যথেষ্টই বড় মাপের। ওদের হানিমুনটাও খুব একটা ভাল করে হয়নি, তাই একটা ভালো ট্রিপ প্ল্যান করছিলো ওরা দুজনেই। কয়েকমুহূর্ত এগুলো একবার ভাবলো শর্বরী, কিন্তু মনের কথাটা মুখে একটুও প্রকাশ করলো না। যতই হোক, ননদের বিয়ে, ট্রিপটা না হয় পরেই হবে, সম্মতি জানিয়ে দিল শর্বরী, একমুহূর্তেই। দীপক হাঁ করে তাকিয়েছিল শর্বরীর দিকে,”এজন্যই তোমায়, তোমার মনটাকে এত ভালোবাসি”, মনে মনে বলল দীপক, দীপকের চোখ দুটো তৎক্ষণাৎ পড়ে নিতে অসুবিধা হলো না, শর্বরীর।
।। ৩।।
“নীচে শ্যামলীর গলা না?”দীপকের সাথে বসে একটু নির্জন নিভৃতে দুজনে সময় কাটাচ্ছিল,শ্যামলীর গলা পেয়ে ঘর থেকে উঁকি দিল শর্বরী।
গলব্লাডারে স্টোনের অপেরেশনের পর এই এলো কাজে। শ্যামলীর সাথে একটু কথা বলছিল শর্বরী। মুখটা এখনও কী শুকিয়ে আছে মেয়েটার, এদের এত সামর্থই বা কোথায় যে অপেরেশনের পর ভালো খাবে। খুব খারাপ লাগছিল শর্বরীর বলেই ফেলল,”মুখটা তোমার এত শুকনো লাগছে কেন গো, শ্যামলী? শরীরটা ঠিক নেই?”
একগাল হেসে ফেললো শ্যামলী, বলল,”গরিবের আবার এইসব, কি যে বলো বৌদি। এই তো এতদিন ছুটি নিলাম, এখনও কাজে না বেরলে খাব কী? ওসব কিছু না, বেরবার আগে ছেলেটার সাথে কথা কাটাকাটি লাগল, দিলাম দু ঘা বসিয়ে, এখন নিজেরই খারাপ লাগছে গো, কাঁদছিল খুব ছেলেটা, ছোট তো, বোঝে না এখনও, রথ টানবে ও, তেলেভাজা খাবে, পাঁপড় খাবে। এখন বাজার যা আগুন, আর এই এতো খরচ হলো, আমি কী পারি?” কথা কটা বলে আবার বাসনগুলো মাজতে লাগল শ্যামলী। খুব কষ্ট হচ্ছিল শর্বরীর, অন্যমনস্ক ভাবে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
**************
-“না বৌদি, আমি পারব না নিতে, এমনিই এতদিন কামাই করেছি, মাইনে কাটনি এটা তোমাদের অনেক দয়া, আর না। “
শ্যামলীর কথা শুনে শর্বরী বলল, “তেমনি তোমার দুঃসময়ে কিছু তো দিতে পারিনি, আজ সব বাচ্চা আনন্দ করছে, আর তোমার ছেলেটা ঘরে বসে কাঁদবে ওর মা গরিব বলে? কেন? তুমি নাও এটা, ওর যা চাই কিনে দিও, আমার খুব ভাল লাগবে তুমি এটা নিলে”, বলে শর্বরী শ্যামলীর হাতে দিতে চাইল।
-“কিন্তু বৌদি, বস্তিতে তো আরও বাচ্চা আছে, ওরা যখন দেখবে আমার ছেলেটা একা রথ টানছে, ওদের তো আরও কষ্ট হবে গো, আমরা তো সব একটা পরিবার, কী করে নিই বলো?”
কোন উত্তর দিতে পারল না শর্বরী, সত্যিই তো, এটা তো ও ভেবে দেখেনি।
।। ৪।।
-“এসব কী ধরনের পাগলামি বৌমা? এতগুলো টাকা খরচ করে এত রথ, তেলেভাজা, পাঁপড়, ফুল, ঠাকুর, মিষ্টি এত কিছু তুমি এভাবে কিনে নিয়ে চলে এলে? একেই তো খরচা চলছে, তোমার কী কোন আক্কেল নেই। “
শাশুড়ির কথায় ধর্য্যের বাঁধ ভাঙল শর্বরীর, “কেন মা? এতে যদি ওরা খুশি হয়, তাহলে ক্ষতি কী?”
শাশুড়ি মা ততোধিক রাগত স্বরে বললেন,”আরে, সবার ভালোলাগার কথা ভাবতে বসলে নিজে পথে বসবে, আমার ছেলেকেও বসাবে। অদ্ভুত মেয়ে তো, এরকম বেহিসেবী মেয়ের দ্বারা সংসার হয় না। “
কথার উপর কথা বাড়ছিল।
“পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটাকে আপনাদের ন্যায্য মনে হলো, তখন সেটা টাকা নষ্ট নয় কী? পণ-এর টাকাটা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠছে, তবু হাসিমুখে পাত্রপক্ষকে টাকা দিয়ে চলেছেন, আর গরিব মানুষগুলো যাদের সত্যিই নেই, তাদের মুখের হাসির কারণ হতে এত আপত্তি? পণ-এর টাকার জন্য যখন এতগুলো টাকা দিতে বৌমা রাজী হয়ে গেল, তখন বাহবা, আর এখন বেহিসেবী? আমার যতটা সামর্থ্য ততটাই তো খরচ করব, বেহিসেবী টা কে তাহলে?”, শর্বরী আর চুপ থাকতে না পেরে কথাগুলো বলল শাশুড়িমাকে, “আমি আপনাকে দুঃখ দিতে চাই না, কিন্তু সত্যি তো এটাই”, থামল শর্বরী।
শাশুড়িমার মুখে বলার মত কোন শব্দ ছিল না, আসলে ভাবতে পারেননি, বাড়ির নতুন বৌ হক কথাটা এভাবে বলতে পারবে।
।। ৫।।
বাচ্চাগুলো নতুন রথ পেয়ে খুব খুব খুশী, একেক জনের রথ একেক রকম ভাবে ফুল দিয়ে সেজে উঠছে, ঠাকুর সাজিয়ে মিষ্টি দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে দড়ি দিয়ে যখন বাচ্চাগুলো রথ টানছিল, ওদের মুখের হাসিগুলো দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে শর্বরী ভাবছিল, ‘আজ তোদের এইটুকুতেই এত খুশির কারণ হতে পেরে সত্যিই ধন্য, তোরা অল্পেতেই কতটা খুশী, আর বাকিদের দ্যাখ, আমরা তো খুশি হতেই পারি না, অনেক চাই আমাদের, অনেক। তোদের মত করে হাসতেই পারি না, রথযাত্রা সফল হলো তোদের মুখে হাসি ফুটিয়ে। ‘
ছুটন্ত রথে তখন জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রাও যেন হাসছেন কচি মুখের হাসি দেখে।