উড়ান (প্রথম পর্ব)

“তাড়াতাড়ি ওঠ বাবাই, রোজ রোজ এই সকালে তোকে ডাকা আমার আর পোষায় না। আজও কী ক্লাসে যাবি না নাকী? এবার বের করে দেবে কলেজ থেকে|” পেঁয়াজগুলো কুচিয়ে হাতটা ধুতে ধুতে হাঁক পারলেন, বিনতাদেবী।

সকালে উঠে ছেলের, স্বামীর ব্রেকফাস্ট টিফিন সব রেডী করে তাদের অফিসে, কলেজে পাঠানো, তারপর বাড়ির সব কাজ একা হাতে সামলানো, আর তার মাঝেই এই দুই মানুষের উদ্দেশ্যে চিৎকার, এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা মাত্র।

সুবিনয় বাবু সকালের চা-টা খেয়ে কাগজটায় চোখ বুলিয়ে বাজারে বেরবেন বলে তড়িঘড়ি করছেন, রোজ সকালে উঠে একবার বাজারে উনি যাবেনই। যতই বাড়িতে ফ্রিজ থাকুক, রোজের রোজ টাটকা খাবারের ব্যাপারই আলাদা, এটাই ওনার মত, সুতরাং পায়ে চটি গলিয়ে হাতে বাজারের থলি নিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে যখন বেরলেন, তখন সকাল ৭টা।

-“কীরে, উঠলি?” এবারের গলা খাঁকরিটা একটু জোরে, মানে এটা ফাইনাল সিগনাল। এই গলা খাঁকরিটা না শুনলে বাবাই ওঠেও না।

এবার চোখ কচলাতে কচলাতে উঠলেন নবাব-পুত্তুর।

বিনতাদেবী সবাই বেরিয়ে গেলে পুজোয় বসেন। বাড়ির ছাদেই খুব ছোট্ট একটা বাগান মতো আছে। নিজেই খেটেখুটে টবে ফুলের ছাড়া পুঁতেছেন, তাই ফুলগুলো ফুটলে বড্ড খুশি হয় মনটা। স্মার্টফোনের ওসব ক্যামেরা, ফটোর কেরামতি ওসব উনি পারেন না, তাই ফুল তুলে ওনার গোপালকেই দেন, ইনস্টাগ্রামে নয়।

ফুলগুলো তুলে সাজিতে সাজাচ্ছিলেন, তখনই বাবাই বসল এসে চেয়ারে, মা-র গা ঘেঁষে, মানে কিছু আবদার আছে।

-“মা, ও মা।”

-“বলে ফ্যালো কী লাগবে।”

বাবাই-এর কখন কী চাই মা-টা না সব বুঝে যায়। মাথাটা খানিক চুলকে বাবাই বলল,” মা কিছু টাকা চাই।”

-“অ্যাই, এই তো ক’দিন আগে টাকা নিলি, আবার কেন?”

-“প্লিজ, এখন কিছু জিজ্ঞেস কোরো না মা, হলে তোমায় এসেই জানাবো, দেবে মা? প্লিজ-প্লিজ-প্লিজ।”

-“তা কত টাকা?”

-“হাজার দুই দাও, বাকীটা আমি ম্যানেজ করে নেব।”

-“আচ্ছা। কিছু এখন বললেই তো তুই রেগে যাবি, কিন্তু না বলেও তো পারি না। দ্যাখ, নিজের শখ, হবি ওসব আমিও বুঝি, কিন্তু, সবার আগে তো লেখাপড়াটা, চাকরিটা। সেটাই তো আগে নাকী? খাতা, কাগজ ভরে ওসব না লিখে আগে নিজের পায়ে দাঁড়া, তারপর…কইরে,উঠে গেলি কেন? ব্যস, ওমনি, কিছুই বলা যাবে না বাবুকে। এই হয়েছে আমার জ্বালা, সবাইকে সামলাতে গিয়ে আমারটা কেউ বোঝে না।”

গজগজ করতে করতে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন বিনতাদেবী, বোধহয় বাবাই ততক্ষণে স্নানে চলে গেল, রোজ রোজ মা-এর এই এক কথা আর ভাল লাগে না।

*************

সকালে খাবার টেবিলে বাবা ছেলেকে একসাথে আর পাওয়া যায় না তেমন। সুবিনয়বাবু সকালে তড়িঘড়ি করে মাছেরঝোল-ভাতটা খেয়ে উঠে পড়লেন, ট্রেনটা পেরিয়ে গেলেই মুশকিল। বাবাই একটু ধীরে সুস্থে বেরোয়। মাছটা শেষ করে খেয়ে উঠতে উঠতেই বাবাই বলল,”বাবা, আমার আস্তে দেরী হবে আজ একটু।” 

সুবিনয়বাবু তেমন কোন উত্তর দিলেন না ছেলেকে,” রোজ পড়াশোনা না করে কী করছিস জানি না। এভাবে এখন সময় নষ্ট করছিস, পরে কূল পাবি না।।।।।” বলতে বলতেই ওদিকে হাত ধুতে চলে গেলেন সুবিনয়বাবু।

বিনতাদেবী চোখের ইশারায় ছেলেকে চুপ থাকতে বললেন। ঘড়ি মহাশয় সময়ের জানান দিতে দিতেই একে একে বেরিয়ে পড়ল সব, যে যার গন্তব্যে। বিনতাদেবী একা একা গুনগুন করতে করতে নিজের কাজে মন দিলেন। গানটা নিয়ে তো আর সেভাবে এগোতে পারলেন না, কেউ যখন থাকে না, তখন এই গানটাই থাকে ওনার সাথে। ক্লান্তি নেই এই ভালবাসায়। ঠাকুরঘরে চলে গেলেন বিনতাদেবী।

।।২।।

-“দ্যাখ, লেখা তোর কতটা ভাল এ নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু, বই বের করা এতটা সহজ নয় রে। অনেক পরিচিতি, টাকা এসব দরকার।

-“কিন্তু, তুমি বুঝতে পারছ না তপনদা, এই ইয়ারটা শেষ হলেই বাবা আমাকে সেই চাকরির ইঁদুর দৌড়েই দাঁড়াতে বলবে, আর আমি ওই একটা বদ্ধ ঘরে ১০টা-৫টার চাকরি করতে পারব না জানো তুমি। প্লিজ তপনদা, কিছু একটা ব্যবস্থা করো।”

-“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। দ্যাখ, পাবলিশার্সের সাথে কথা বলি, প্রথমে কিছু টাকা ইনভেস্ট করতেই হবে, সেটা ভেবে নে। এই কয়েক হাজারে কিন্তু কিচ্ছু হবে না।”, বলে বাকী সিগারেটটা শেষ করে নিজের ব্যাগটা নিয়ে উঠে পড়ল তপন। ওকেও টিউশন পড়াতে যেতে হবে আজ, এখনই না বেরলে দেরী হয়ে যাবে।

বাড়ী ফিরছিল বাবাই, ট্রেনে আজ জানলার ধারটা পেয়েছে। মুখে ঠান্ডা হওয়ার ঝলকটা বেশ লাগছিল, মাথাটা একটু হালকা লাগছিল যেন। ওর তো নিজের লেখাগুলো ছাড়া আর কিছুই নেই। আগে ভাবতো খুব ভাল লিখব, ব্যস আবার কী? এখন বুঝছে, শুধু ভাল লিখলেই হয় না। জীবনটা বড় জটিল, এখানেও তো সবাই ছুটছে। মনে প্রাণে যতই চেষ্টা করুক, নিজের সৃষ্টিগুলোকে সম্বল করে এগোনোর, তত যেন, ওর পা চেপে ধরছে অভাব, অসহায়তা, মা বাবার স্বপ্নপূরণের দায়, তাদের আশা আকাঙ্খাগুলো।

এত কিছু পেরিয়ে ও লিখবে কী ভাবে? এভাবে তো ও ভাবতেই পারছে না এখন। আগে, যখন মাথায় কোন চিন্তা ছিল না, কত ভাবত, স্বপ্ন জগতে, কল্পনার জগতে ও বিভোর থাকত। আর এখন, কল্পনাও ওকে ফাঁকি দিয়ে পালায়।

এসে গেছে স্টেশন, এবার নামতে হবে। উঠে পড়ল বাবাই।

*************

আজ সারাদিনে একবারও তিতলিকে ফোনই করেনি ও, ইচ্ছে করছিল না। তিতলিকে বড্ড ভালবাসে বাবাই, সেই কবে থেকে। তিতলি বরাবর বাবাই-এর পাশে থেকেছে, ওর লেখার প্রথম পাঠিকা তিতলিই।

সেই তিতলিকে যখন বাবাই বললো, আমি চাকরি করতে চাই না, নিজের স্বপ্নটাকেই ধাওয়া করতে চাই, ঠিক ধরে নেব একদিন, তুই পাশে থাকবি তো? তখন সেই তিতলিও বুঝিয়েছিল, চাকরির প্রয়োজনীয়তা কতটা, শুধু স্বপ্ন কে ধাওয়া করে তো সংসার চলবে না।

হয়তো সত্যিই কথাটা, হয়তো কেন, এটাই সত্যি।কিন্তু, নিজের জীবনের স্বপ্নটাকে যখন কবর দিতে হয় নিজে হাতে, কষ্টটা তখন সে-ই বোঝে। এখন আর তাই লেখালেখি নিয়ে কথা হয় না, প্রেম নিয়ে কথা হয় না, কথা হয় শুধু কী করবে, কবে করবে এই নিয়ে। তাই তিতলিকে এত ভালবাসলেও তিতলিকে বড় একটা আর ফোন করতে ইচ্ছে করে না ওর। তিতলি যখন করে করে, ব্যস।

**************

বাইরের ঘরে টিভিটা নিভিল, মানে দশটা বেজে গেছে, বিনতাদেবী দশটা অবধি টিভি দেখে তারপর খাবার বাড়তে ওঠেন। এখন বাবার সাথে একটু কথা বলার সময় পাওয়া যায়, বাবা পাড়ার ক্লাব থেকে ফেরে এখন, কিন্তু বাবাকে বলে আর কোন লাভ নেই। বাবা কোনদিনই এসব স্বপ্ন শখ এসব বোঝেনি। তাই মা-এর গানটাও।।।।।।

**************

-“জলটা এদিকে একটু দাও তো”, রুটি আর আলুরদমটা শেষ করে জলটা খাচ্ছেন সুবিনয়বাবু, তখনই বাবাই বলল, “বাবা, আমি ভাবছিলাম, এবার ফাইনালটা হয়ে গেলে সিরিয়াসলি লেখালেখিটা নিয়ে।।।।।”

-“ওসব মাথা থেকে বের করো, আমার রিটায়ার্মেন্টটা যে আর কয়েক মাসের মধ্যে, সে খেয়াল আছে? ওসব শখপূরণের অনেক সময় পাবে, আগে নিজের পায়ে দাঁড়াও, চাকরির চেষ্টাটা ঠিক করে করো। ওসব লিখে কিস্যু করতে পারবে না, আর টাকাটা যতই মা-র থেকে চাও, টাকাটা সংসারে কিন্তু আমিই দি। ওসবের জন্য আমি টাকাটা এত কষ্ট করে রোজগার করে আনছি না। একটা কোনো বিলাসিতা নেই, শখ আহ্লাদ নেই, কোথায় একটু বুঝবে তা না। রাত্রের মিষ্টিটাও বন্ধ করে দিয়েছি, ওটাও বিলাসিতা হয়ে গেছে এই মন্দার বাজারে। চোখটা একটু খোলো এবার।”

কিছু বলার আগেই সুবিনয়বাবু কথাগুলো বলে উঠে পড়লেন। 

বিনতাদেবী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, বাবাইকে বললেন,”চাটনি খাবি? একটু করেছি।।।।।” হাত টা নেড়ে বাবাই উঠে পড়ল।

**************

-“এইভাবে ছেলেটাকে না-ও বলতে পারতে।”

-“তুমি থামো তো, লেখালেখি করে কে কবে কটা টাকা জোগাড় করতে পেরেছে আর সংসার টানতে পেরেছে বলবে একটু? সামনেই রিটায়ারমেন্ট, কত ঠেলব আর? আর তাছাড়া লোকে কী বলবে? আপনার ছেলে কী করে? ও ওই শখের লেখালেখি? কী উত্তর দেবে তখন? একটু ভেবে চিন্তা কথা বলো বিনতা। এসব অবান্তর কথা বন্ধ করো এখন, অনেক রাত হয়েছে।”

বাইরের ঘরে মা বাবার কথাবার্তা কানে পরিষ্কার আসছিল বাবাই-এর, ফ্যানটা আস্তে চললে সবটাই শোনা যায়। বাবাই চুপচাপ শুয়েছিল, শুনছিল। সত্যিই, খুব ভুল কী বলছে বাবা? না তো। এসব স্বপ্ন দেখার জন্য, এইসব স্বপ্নগুলোকে সত্যিই করতে দৌড়ানোর জন্য যে ব্যাকগ্রাউন্ড, যে শক্ত মাটিটা দরকার, সেটা তো ওর সত্যিই নেই। এটা ওর কাছে স্বপ্ন হলেও, ওর পরিবার, ওর মা বাবার কাছে বিলাসিতা ছাড়া কী? ও জানে ও পারবে, কিন্তু, বাকী মানুষ ওর উপর আস্থা কীভাবে রাখবে? কেনই বা রাখবে?

লোক এ বলে ছেলেরা কাঁদে না, কিন্তু সবার চোখের আড়ালে আজ বাবাই-এর চোখ বেয়ে নোনতা জল। মধ্যবিত্ত ঘরের স্বপ্নগুলোতেও লাগাম লাগাতে হয়, হয়তো।

(কয়েকমাস পর)

-“তুমি কোন আক্কেলে এত বড় কাজটা করলে? একবার জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলে না?”

-“ছাড়ো, ভালো লাগছে না, কী করতাম আর? কতদিন হলো ঠিকঠাক স্যালারি নেই, তার মধ্যে অপারেশন, কী করতাম? মেডিক্লেমটাও করা হলো না।”

-“ভাগ্যিস দেখলাম, নয়তো এক হপ্তা ঘুরে গেছে তুমি আমাকে জানাওনি অবধি। কত কষ্ট করে গড়ানো।।। ইসসস।।।। মা গো।”

বাড়িতে সবে ঢুকে জুতো খুলতে খুলতে এই কথাগুলোই কানে এল বাবাই-এর। ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে ক’দিন হলো। নিজের চেষ্টায় চাকরি খুঁজতে শুরুও করেছে। এখনকার যুগে চাকরির যা হাল, ওর তো তেমন কোন চেনা জানাও নেই। ওর কিছু পরিচিত দাদাদের ও বলে রেখেছে। কী হবে কে জানে? এখন আর বাড়ির পরিবেশটা আগের মতন নেই-ও। কিছু না কিছু নিয়ে একটা কিছু চলেই। বাবার স্যালারিটা নিয়েও কোম্পানী প্রব্লেম করায় অশান্তিটা বড্ড বেড়েছে ইদানিং। নুন তেলের ফাঁকা কৌটো বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রায়ই। তার সাথে পাল্লা দিয়ে চারপাশের অজস্র ধার-বাকী, দেনাপাওনা। এই যুগে একা মানুষ টানবেই বা কত?

-“তোর বাবা গলার সোনার চেনটা বিক্রি করে দিয়েছে, শুনলি তুই?”

-“মানে?” হঠাৎ করে কিছুই বুঝতে পারছিল না ও। 

-“টাকা বাকী ছিল, সেসব মেটাতে চেনটা বিক্রি করে দিয়েছে, তোর বাবা।”

উন্মত্তের মতো চিৎকার করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেল মা, বাবা মাথা নীচু করে বারান্দার চেয়ারটায় বসে।

বাবাই কিছু না বলে নিজের ঘরটায় গিয়ে বসল। ঘর অন্ধকার, ইচ্ছে করেই আলো জ্বাললো না। আজ অন্ধকার ঘরেই বসতে ইচ্ছে করছে ওর। চোখের সামনেটা বড্ড ঝাপসা। এখন আর হাত দিয়ে লেখাও বেরোয় না। শুধু দুশ্চিন্তা, অশান্তি ব্যস, আর কিচ্ছু নেই ওর জীবনে, লেখার জন্য মনটাই আর নেই, শেষ হয়ে গেছে।

মা সন্ধ্যে দিচ্ছে, শাঁখ বাজলো, উঠে ঘরের আলোটা জ্বালালো। সামনের বারান্দাটায় এখন বেশ হাওয়া দেয়। পাখিগুলো দিনের শেষে বাসায় ফিরছে। উঠে পড়ল বাবাই। কিছু একটা এবার করতেই হবে। ড্রয়ার থেকে তালাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ও।

।।৩।।

-“এই অনির্বাণ, ফাইলটা পাস কর তো একবার।”

কিউবিকাল-এ বসে অনেকগুলো ব্যস্ত মুখের ভিড়ের মধ্যে একজনের মুখ, অনির্বাণ ওরফে বাবাই।

হ্যাঁ, সেইদিনই নিজের সমস্ত লেখা আর স্বপ্নগুলোকে ট্রাঙ্কে ভরে তালা মেরে এগিয়ে গেছিল, এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

এখন, মাসের ইলেক্ট্রিক বিলটা সময়ে জমা পড়ে, মাসকাবারি বাজার করতে টানাটানি পড়ে না, তেল নুনের কৌটো ফাঁকা হয়ে বিদ্রোহ শুরু করার আগেই ভর্তি হয়ে যায়। মা শাড়ী কিনতে আগের মত অতবার ভাবে না। বাবাই-এর স্বপ্ন জলাঞ্জলিতে যদি এতগুলো সমস্যার সমাধান হয়, তাহলে আর ক্ষতি কী? বাবাই-ও তাই করেছে।

না, লেখাটা আর আসে না। তিতলির সাথেও আর এখন তেমন কোন অশান্তিই হয় না, কথাই এত কম হয়। সারাদিনের ক্লান্তির পর বাড়ি ফিরে আর চিৎকার চেঁচামেচি নয়, একটু শান্তি পেলেই ও খুশী। আর কী?

**************

অফিসে কাজের ফাঁকে একটু কফি খেতে আসে বাবাই আর অভীক। অফিসে অভীকের সাথেই ও বেশি মেশে। অভীক এবছর অফিসের প্রোগ্রামের কালচারের দিকটা দেখছে। প্রতিবছরই পুজোর সময় একটা দিন অফিস প্রেমিসেসে অনুষ্ঠানটা হয়। গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি, ছোটখাটো মজার খেলাধূলো সবই হয় মোটামুটি। অভীক কফির সিপটা নিতে নিতে বলল, “তুই লেখ না কিছু একটা, নাটকটা তুইই দ্যাখ না।”

-“ধ্যুস, আমি ওসব পারি নাকী। ওসব আমার দ্বারা হবে না, আমায় ছাড়।” বলে কফিটা শেষ করে বিন-এ কাপটা ফেলল বাবাই। অফিসের এই করিডোরটা থেকে অনেকটা দূর অবধি দেখা যায়, সামনে অনেকটা সবুজ ঘেরা, বেশ লাগে।

-“তোর লেখার অভ্যাসটা এখনও যায়নি কিন্তু, ডায়েরীর পিছনের পাতায় লেখাগুলো কিন্তু আমি…”

-“মানে? তুই আমার ডায়রী খুলে কেন পড়েছিস? এগুলো কিন্তু ঠিক না, ধ্যুত।

-“থাম তো শালা, বেশ করেছি পড়েছি। তুই আসিসনি যেদিন তোর ড্রয়ার থেকে স্টেপ্লারটা নিতে গিয়ে ডায়েরীটা চোখে পড়ল, দেখলাম তারপর। দু-একটা লেখা, কিন্তু দারুন লিখিস তো ভাই। ঐজন্যই তোকে বললাম।”

জোর করে মুখে হাসিটা টেনে বলল বাবাই,”ওসব ছেড়ে দিয়েছি ভাই, ছাড়, আর না।” অভীকের উত্তেরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল বাবাই।”

**************

হ্যাঁ, বাবাই আর তেমন লেখে না। ঐ একদিন কিছুতেই কলমটা কথা শুনল না, লিখে ফেলেছিল, ওটাই দেখে ফেলেছে অভীক। আর লেখালেখিটা তেমন আসে না, ওসব কিছু ভুলে গেছে ও। এসব করে কোন লাভ নেই। তোমার যদি মোটা টাকা না থাকে, তোমার ঘরে যদি অভাব থাকে, তাহলে তোমার কবিত্ব কেউ ফিরেও দেখবে না। ওসব রেখে ভাত-কাপড়ের সংস্থান করতে ১০টা – ৫টা চাকরি কোনক্রমে জোটাতে পারলে ভাল, নয়তো ঘোর অভাব নিয়ে স্বপ্ন দেখার মূর্খামি করলে, কেউ তার পাশে এসেও দাঁড়াবে না। একদিন, দু’দিনের জন্য হয়তো ‘আহা’, ‘উহু’, ‘দারুণ প্রতিভা শেষ হয়ে যাচ্ছে’, এসব শুনতে পাবে, ব্যস, ঐ অবধিই।

সার সত্য টা বুঝে গেছে বাবাই, তাই আর…।

“আরেকটু ভাত নিবি বাবা, খাবার সময় অত তাড়াহুড়ো করবি না, কতদিন মানা করেছি, দাঁড়া… আরেকটু।” বিনতাদেবী হাতটা এগোতে যেতেই বাবাই বাধা দিল, তাড়াতাড়ি আর এক- দুগাল খেয়ে উঠে পড়ল। আজ অফিসে আবার সেই লেট্…। ধ্যুর।

**************

অফিস পৌঁছালো যখন, তখন, ঘড়ি বলছে লেট আজ ১৫ মিনিট। তাড়াতাড়ি পাঞ্চ মেরে সিট এ গিয়ে বসল বাবাই। গলদঘর্ম অবস্থা আজ, উফফ।

অভীক আজ আসেনি, এলেই আবার মাথা খারাপ করবে, যা শুরু করেছে ক’দিন ধরে।

অভীকের মামার পাবলিকেশন হাউস আছে, আর অভীকের বাড়ির অবস্থাও বেশ ভালই, তাই চাকরিটা বাবাই-এর কাছে যতটা অপরিহার্য, অভীকের কাছে ততটা কোনদিনই নয়। অভীক এই চাকরির বাইরে একটা বিজনেস স্টার্টআপ-এর প্ল্যানও করছে। ওই জন্যই আজ একটা মিটিং আছে ওর ক্লায়েন্টের সাথে, তাই-ই আজ আসেনি। যদি সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, চাকরিটা ছেড়ে দেবে ও।

অভীক মনে করে, বাবাই যদি কোনকিছু ভালভাবে পারে, তো সেটা লেখা। বহুবার বলেও, আবার লেখা শুরু করতে। বাবাই শুধু শোনে। খুব শিগগিরই তিতলির বাড়ি কথাবার্তা বলতে যাবে মা বাবা। বাবাই ভালই আছে, খুব একটা খারাপও নেই ও, বুঝিয়ে নিয়েছে ও নিজেকে। ফোনের আওয়াজে ভাবা বন্ধ হলো ওর। এই এক হচ্ছে ওর প্রব্লেম। সবসময় ভাবনায় হারিয়ে যায়। যাইহোক, ফোন সেরে কাজ শুরু করল।

**************

(কয়েকদিন পর)

আজ একটু কেনা কাটা করতে বেরিয়েছেন বিনতাদেবী। হাতিবাগানের দিকেই যাবেন আজ, বাবাই-এর বিয়ের জন্য এবার তো একটু একটু করে কেনাকাটা শুরু করতেই হবে। আজ বিনতাদেবীর ছোট বোন আসতে পারেনি, একাই আজ বেরলেন।

ফড়িয়াপুকুরের দিকে যাবেন…কিন্তু ওটা বাবাই না???? বাবাই-এর তো অফিসে থাকার কথা, বাবাই এখানে ঘুরছে কেন? স্টার এর মুখ থেকে শোভাবাজারের মেট্রোর দিকের রাস্তাটায় ঘুরে গেল ও। বিনতাদেবী নিশ্চিত, ওটা বাবাই-ই ছিল। কিন্তু, কিছু তো বুঝতেই পারছেন না। ফোন করবেন? ফোনটা বের করে ডায়াল করতে করতে ছেলেটা মিলিয়ে গেল, ফোনটাও বেজেই গেল, কেউ ধরল না। কিছু মাথায় ঢুকছে না বিনতাদেবীর, উনি ফড়িয়াপুকুরের দিকে হাঁটা লাগলেন।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

মুক্তি

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল, আকাশ তখন থেকে ঠায় বসেই রয়েছে ঘাটে। এখন বাঁধানো ঘাট থেকে করিডোর হয়ে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে পুজো দেওয়া অনেকটা সহজ

Read More »

বন্ধু হবি চল

বাক্সপেটরা নিয়ে স্টেশনেই বসে ছিল নয়না, বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মুষলধারায়। বাবা বলল আরেকটু অপেক্ষা করতে, এত বৃষ্টিতে তো ছাতাও হার মানবে, আর বেরিয়ে রাস্তাও অজানা

Read More »

ক্লিক

।।১।। -“মালিনী, কালকের মিটিংটা কখন ফিক্স করেছ? -“ম্যাম, সকাল ১১টা।” -“ওকে, কনফার্মেশন পেয়ে গেছ?” -“ইয়েস ম্যাম।” -“ওকে গুড। আর।।। এক মিনিট।।।” টেবিল থেকে ফোনটা তুলে

Read More »

শিক্ষা

।।১।। দাপুটে, বদরাগী, মেজাজি এই সব কটা বিশেষণই বেশ ভালো যায় মিসেস বোসের সাথে। রেণুকা বোস আর অমরনাথ বোস সানফ্লাওয়ার এপার্টমেন্টে ১২০০ স্কোয়ারফিটের ফ্ল্যাট 2c

Read More »

বিদায়

।। ১।। রীতিমত জোর করেই নন্দিনীকে পাহাড়ে নিয়ে এলো সঙ্গীতারা। আসার ইচ্ছে তো ছিল না ওর একদমই, শরীর সাথ দিলেও মনটা কোনোভাবেই সাথ দিচ্ছে না।

Read More »

মামাবাড়ি

।।১।। একবার নিজের ঘড়িটা স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়ির সাথে মিলিয়ে নিল মিনি, সময় তো হয়ে গেছে। উল্টো দিকের দুটো মেট্রো এসে গেল কিন্তু এদিকের মেট্রোর কোনো

Read More »

Share with