||১||
“আততা বাপি, মা আবাল কবে তালা থেকে মানুত হবে?”, নিজের শিশুসুলভ ভঙ্গিতে অবুঝ হিয়া প্রশ্ন করে নিজের বাবাকে | বাবা তাকে বলেছে মা তারা হয়ে গেছে, তাই মা তার কাছে আর নেই, আকাশে থাকে | হিয়া আর দিয়া যমজ বোন, এই বছর পাঁচে পা দিল ওরা |
সমর দত্ত মানে দিয়া হিয়ার দাদু মানা করলো, বাবা তো এখন ব্যস্ত তাই ডিস্টার্ব না করতে | ছোট্ট দিয়া হিয়া চুপচাপ কর্নফ্লেক্স খেতে লাগল | বাবা, দাদু, ঠাকুমা, মামাবাড়ির দাদু দিদা, পিসি, মাসি, সবার আদরে আহ্লাদে একটু একটু করে ওরা বড় হচ্ছে | একজন মানুষের ভালোবাসার খামতি মেটাতে সকলে তাদের বুকে আগলে রেখেছে সর্বক্ষণ, কিন্তু মায়ের খামতি কী পূরণ করা সম্ভব কোনদিন?
||২||
“বাপি আদ তোমায় দেখাতেই হবে | ও বাপি মামমাম-এর একটা ফতো দাও না, দাও না “, রাত্রে রাহুল, দিয়া হিয়ার বাবা বাড়ি ফিরতেই ওদের আবদার শুরু হলো | “কোনদিন মামমামকে দেখিনি, আততা বাপি মামমাম কী খুব সুন্দল ছিল?”, দুটো কচি কচি স্বরের দুস্টুমিতে আহ্লাদিত হওয়ার জায়গায় খানিকটা বিরক্তই হলো রাহুল |
“আহ, এখন যাও, বাপি পরে কথা বলবে |”, ধমকে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল রাহুল |
ওরা যে বড্ড ছোট, এত হিসেব কী ওরা বোঝে | কচি কচি হাত দিয়ে দুই বোন একে অপরের চোখের জল মোছাচ্ছিল, ঠাম্মা এসে ওদের নিয়ে গেল, ওদের ফেভারিট নুডলস পেয়ে খানিকটা শান্ত হলো দু’জন |
****************
-“আচ্ছা এভাবে আর কতদিন চলবে বলতে পারো? ওরা তো বড় হচ্ছে |”
-“আমি আর কী বলব বলো, এইটুকু বাচ্চাকে কী-ই বা বলা যায়? ওরা কী বোঝে কিছু?”, স্ত্রী মিনতি দেবীর প্রশ্নের উত্তরে খানিকটা চিন্তিত হয়েই উত্তর দিলেন সমরবাবু |
-“কোথায় এখন ওরা?
-“ওই কার্টুন দেখছে, খেলছে, নিজের মত আছে “, হাতের কাজ সারতে সারতে উত্তর দিলেন মিনতি দেবী,”এই জন্য বলেছিলাম, বিয়ে করতে আর একটা, এখন সমস্যাটা কিন্তু বাড়ছে, কতদিন ওদের এসব বোঝাবে?”
কথার মাঝেই হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকল রাহুল |
ছেলেকে জল খাবার বেড়ে দিতে দিতেই ছেলে প্রশ্ন করল,”কী নিয়ে কথা বলছিলে?”
“বলব আর কী, যা এতদিন ধরে বলছি, বিয়েটা করলে এই ঝামেলা হতো না, কতদিন এভাবে চলবে?”- মিনতি দেবী |
“মা প্লিজ, বারবার এক কথা বোলো না তো |”, খেতে লাগল রাহুল |
“তোমার ছেলেকে বোঝাও, আমারও বয়স হচ্ছে, আমি পারি একা সামলাতে?”, বলেই গজগজ করতে করতে রান্না ঘরে ঢুকে গেলেন মিনতি দেবী |
অন্যমনস্ক ভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাহুল, “সত্যিই তো এভাবে আর কতদিন?”
||৩||
-“পিপি, পিপি, তুমি মামমামকে দেখেছ?”
ইদানিং দিয়া হিয়ার মামমাম সংক্রান্ত প্রশ্নে জেরবার বাড়ির এবং বাড়ির বাইরের বহুমানুষ | কেউ কোন উত্তর না দেওয়ায় ওদের জিদ যেন আরও বাড়ছে | এই তো সেদিন মামাবাড়ি গিয়ে সেই এক কান্ড, হয় ‘মামমাম-এর ফটো’, নয়তো ‘মামমাম-এর গল্প’ অথবা ‘মামমাম কবে আসবে?’ ইত্যাদি ইত্যাদি | এখন রাহুলের বোন পিয়ালীকেও একই ভাবে ওদের স্পষ্ট কিন্তু অস্বস্তিজনক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে |
পিয়ালী খুবই স্পষ্ট বক্তা, আর মিথ্যেটাও ওর অপছন্দের, সেই জন্য বাড়ির বাকি সদস্যের সাথে ওর মতামত কখনোই প্রায় মেলে না | কিন্তু সত্যি বলার উপায়ও নেই, তাই চুপই থাকে ও |
ল্যাপটপে কাজ করতে করতে অন্যমনস্ক ভাবেই উত্তরটা বলে ফেলেছিল পিয়ালী, যে হ্যাঁ ওদের মামমামকে দেখেছে | ব্যস, আর যায় কোথায়, একটা প্রশ্নের শেষ তো হাজারটা প্রশ্নের শুরু | কিভাবে সামলাবে এই দুই গুণধরকে?
মাঝে মাঝে খুব মায়াও হয়, এইটুকু দুধের শিশু, ওদের তো কোন দোষ নেই, ওরা তো ওদের মা কে জানতে চাইবেই | পিয়ালী ওদের কথা দিল, ওরা যদি কাউকে না বলে, তাহলে চুপি চুপি ওদের মায়ের ফটো ওদের দেবে, কিন্তু প্রমিস করতে হবে, যে কেউ যেন কিছু জানতে না পারে |
****************
দিন যেতে লাগল, কচি মন দুটো বড্ড উতলা আজকাল, কিন্তু সিক্রেট, তাই কাউকে কিছু বলতেও পারছে না |
কিছুদিন পর পিয়ালী ওদের দেওয়া কথা মতো ওদের বাবা মা-র বিয়ের একটা ছবি স্টোর রুমে রাখা অ্যালবাম থেকে বের করে ওদের দিল | ঐটুকু পেয়েই কত্ত খুশি কচি কচি প্রাণ দুটো | ছোট্ট ছোট্ট ঝুঁটি দুলিয়ে দুটিতে মিলে মা পাপার ফটোয় হামি খেয়েই যাচ্ছে | এই নিষ্পাপ শিশু দুটোকে, দেখতে দেখতেই চোখে নিজের অজান্তেই কখন জল এসে গেছিল পিয়ালীর |
||৪||
সময় নিজের নিয়মে এগোতে থাকে, দিয়া হিয়া এখন ক্লাস ফোর | আগের থেকে এখন অনেক বুঝদার হয়েছে ওরা, ওদের লুকিয়ে যে কিছু কথা হয়, আর ওরা এলেই সবাই চুপ করে যায়, সেটা এখন ওরা বেশ বোঝে |
*****************
উইক এন্ডে দাদু দিদা পিপিদের সাথে প্রায়ই বেরোয় ওরা, আজ অনেকদিন পর পাপাও বেরিয়েছে ওদের সাথে | তাই ভারী মজা | সবাই মিলে একটা নতুন আইনক্সে সিনেমা দেখতে এসেছিল | সিনেমা দেখে খেয়ে ওরা সবাই বাইরে এসে দাঁড়ায়, রাহুল পার্কিং থেকে গাড়ি আনতে যায় | হঠাৎই হিয়া চেঁচিয়ে ওঠে, “ওই দ্যাখ মামমাম |”
কিছুক্ষনের হিম শীতল নিস্তব্ধতা, চারপাশটা যেন হঠাৎ করেই একদম থমকে গেছে, বাতাসেরও যেন বইবার অনুমতি নেই | একদিকে হিয়া দিয়া, একদিকে বাড়ির লোকজন, একদিকে রাহুল, আর একদিন অয়নিকা, হিয়া দিয়ার মা |
||৫||
বাড়িতে থমথমে পরিবেশ, বাড়ি ফেরার পর থেকেই | দিয়া হিয়া এখন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, ওদের নিজেদের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে ঠাকুমা | পিপিকে সবাই খুব বকছে, কেন, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না | আচ্ছা তারা থেকে কী সত্যিই মানুষ হওয়া যায় তাহলে ? মামমাম তো তারা ছিল, পাপা বলত, মানুষ হলো কী করে? আর মামমামের সাথে কেউ কথাও বলতে দিল না | মামমামও কথা বলতে এলো না | ওরা যে মামমামকে দেখার জন্য কবে থেকে ওয়েট করে আছে, মামমাম কী তা জানে না? মামমাম তো একটা কারোর সাথে গটগট করে চলে গেল, একবার ওদের আদরও করলো না | এরকম হাজারটা প্রশ্ন দিয়া হিয়ার মনে উঁকি দিতে লাগল, যার উত্তর না পাওয়া অবধি ওরা কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না | ওদের ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ওরা যতটা সম্ভব সবার চোখ বাঁচিয়ে দেখছিল বাইরে কী হচ্ছে, শোনার চেষ্টা করছিল সবাই এত রেগে কী বলছে |
****************
ঘড়ির কাঁটা রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই
“ওরা অয়নিকাকে চিনলো কী করে আমি জানতে চাই |”- প্রশ্নটা ড্রয়িং রুমে সবার মাঝে ছুড়লো রাহুল |
পিয়ালী স্পষ্টভাবে নিজের কথাটা বলে দিল যে ও-ই অয়নিকার ফটো দেখিয়েছিল |
রাহুল ধপ করে সোফায় বসে পড়ল, বলল,”কেন করলি এটা? আজ ওরা অয়নিকাকে না চিনলে এই এম্ব্যারেসিং সিচুয়েশনটা তো হতো না | ওরা তো আর ছোট নেই, কী বোঝাব ওদের?” মাথা নীচু করে বসে রইলো রাহুল, চোখের কোণে জলও ছিল হয়তো, কেন জানে না | হঠাৎ করে মনের ভেতর লোকানো বিশ্বাসঘাতক প্রেমটা এভাবে বেআব্রু হয়ে যাবে ভাবেনি |
পিয়ালী রাহুলের পায়ের কাছে বসে বলল, “কেন দাদা? ওদেরকে সত্যিটা কতদিন না বলে থাকবি?”
চোখের কোণের জলটা মুছে রাহুল বলল,”জানি না, যতই হোক, অয়নিকার আসল রূপটা ওদের সামনে আসুক, আমি কখনোই চাইনি |”
মিনতি দেবী বললেন,”কেন বাবু? ওই মেয়ে তো তোকে ছেড়ে, বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে ঐ লোকটার সাথে চলে গেল, কই ও তো ভাবেনি একবারও? তুই কেন তবে? তুই যদি আজ নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতিস আর একবার তাহলে তো সবাই ভাল থাকতো |”
রাহুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”হয়তো ঠিকই বলেছ, এভাবে কাউকে বেঁধে রাখা যায় না | যেখানে টান নেই সেখানে কেন ফিরে আসবে সে?” বলে অন্যমনস্ক ভাবে নিজের ঘরে চলে গেল রাহুল |
সমরবাবু বললেন মিনতি দেবীকে,”রাহুল যদি এখনও চায় ডিভোর্সটা হোক, তাহলে দেখো, ও-ও ভাল থাকবে | এভাবে আর কতদিন?”
****************
রাত দুটো, সব ঘর অন্ধকার, দুটো ঘরের আলো জ্বলছে শুধু | একদিকে রাহুল, যে একদিন নিজের প্রেমকে এবাড়িতে স্বীকৃতি দিয়ে এনেছিল, নিজের প্রেমই এভাবে পিঠে ছুরি মারবে স্বপ্নেও ভাবেনি | “কী দিনি তোমায়, বলতে পারো? নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালবেসেছিলাম, তাও কম পড়ে গেল? নিজেদের মেয়েদের কথা একবারও মনে পড়ে না তোমার? তুমি কেমন মা?” অনেকদিন পর ধুলোয় ঢাকা ফটো অ্যালবাম e টুপটুপ করে কয়েক ফোnটা চোখের জল দাগ কাটল |
আর একদিকে, দিয়া হিয়া, ছোট দুটো শিশুমন এখনও এতো কিছু শুনে বুঝে উঠতে পারছে না কী হচ্ছে? তাই ওদের চোখেও আজ ঘুম নেই, একরাশ বিস্ময় শুধু |
||৬||
আজ রাহুল অয়নিকা মুখোমুখি | রাহুল এতদিনে সার-সত্যটা বুঝেছে যে জোর করে কাউকে ধরে রাখা যায় না, আর সত্যি লুকোনোও যায় না | আর অয়নিকা ওর প্রেমিক সুরজিতের সাথে বিয়ের জন্য অনেক আগে থেকেই ডিভোর্স-এ রাজি ছিল |
“আমি মেয়েদের আমার কাছে নিয়ে যেতে চাই |”- অয়নিকা |
“প্লিজ নাটক বন্ধ করো তোমার, ওদের আটমাস বয়স যখন তুমি ওদের ছেড়ে চলে গেছিলে, তোমার লজ্জা করছে না বলতে?”- রাহুল |
“তাতে কী? এখন আমার মনে হয়েছে মেয়েদের আমার কাছে রাখা উচিত, ওদের ওপর আমার অধিকার আছে |”- অয়নিকা |
দু’পক্ষের বিবাদে পরিস্থিতি চরমে উঠল | বাড়ি ফিরে দত্ত বাড়ির সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ | এরকম ভাবে আবার সমস্যা তৈরি করবে অয়নিকা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি | মানে আবার মামলা মোকদ্দমা, উফফ |
“এই মেয়েটা কী আমাদের পরিবারকে এতটুকু শান্তি দেবে না?”, মিনতি দেবীর গলায় একরাশ বিরক্তি |
****************
এই কদিনে দিয়া হিয়া যেন অনেকটা বড় হয়ে গেছে, বুঝতে পারছে একটা বড় কিছু ঘটছে বাড়িতে | কী সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারছে না দুটিতে | শুধু এটুকু বুঝে গেছে যে, যে মামমামের জন্য ওরা এতদিন ধরে উতলা, সেই মামমাম ওদের কথা ভাবেনি একবারও | ওরা মামমামকে দেখার জন্য কত চোখের জল ফেলেছে, কিন্তু মামমাম ওদের মিস করেনি |
*****************
মামলা কোর্টে উঠেছে, দিয়া হিয়ার কাস্টডি নিয়ে | ঠিক যেটা রাহুল চায়নি সেটাই আজ হচ্ছে | আজ শুধুমাত্র রাহুলের এkটা ভুল নির্বাচনের জন্য ওর নিজের গোটা পরিবারের সাথে সাথে ছোট বাচ্চা দুটোকে আজ কোর্টে হাজিরা দিতে হলো | যে দুর্ভোগ থেকে এতদিন আগলে এসেছে ওদের, আজ তার আঁচই লাগছে, কিন্তু রাহুল নিরুপায় |
*****************
(কিছুদিন পর )
মামলার শেষ দিনে কাঠগড়ায় অবধারিত প্রশ্নটা অবশেষে উঠলই, “তুমি কার কাছে থাকতে চাও?”
– “মামমামকে খুব ভালবাসি, মামমামকে কতবার দেখতে চেয়েছি, কেঁদেছি, মামমাম ষ্টার থেকে আমাদের কাছে আসবে ওয়েট করেছি | মামমাম আসেনি তো তখন,তাহলে আজ কেন এসেছে?যেদিন মামমামকে প্রথম দেখলাম মামমাম সেদিনও আসেনি ,ওই যে ওই কাকু তার সাথে চলে গিয়েছিল |পাপা তো আমাদের ছেড়ে কোথাও যায়নি, তবে আজ কেন পাপাকে ছেড়ে আমরা চলে যাবো? পাপার কাছেই থাকবো তাই |”
অয়নিকার বাড়ির লোকজনও সাক্ষ্য দিলেন রাহুলের পক্ষেই | যে মা এতদিন সন্তানকে দেখতে আসেনি, আজ হঠাৎ শিকড় ছিঁড়ে নিয়ে চলে যাবে, এমন অন্যায়কে কেউই প্রশ্রয় দিতে পারলেন না | আর অয়নিকাও কোন মমতার টানe নয়, আরও একবার রাহুলকে একা করতে চেয়ে কেসটা ঠুকেছিল….এইটুকুই উদ্দেশ্য ছিল, তাই ওর চোখে কোন জলও ছিল না, সারাটা সময় শুধু ঔদ্ধত্য আর ক্রুরতার ছাপ |
*****************
অয়নিকার মুখ নীচু আজ তবে অনুতাপে নয়, সর্বনাশ করতে চেয়ে সক্ষম না হওয়ার লজ্জায় |
কোর্ট থেকে হাসি মুখে বেরলো দিয়া হিয়া বাবার হাত ধরে |
“পাপা হ্যাপি মাদার্স ডে “- দিয়া |
হঠাৎ রাহুলের মনে পড়লো যে আজ দিনটা তো ১৩ই মে, মাদার্স ডে | হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে নোনতা জলের ধারা নামল রাহুলের, তবে কষ্টের না, শান্তির |
***** ***** ***** ***** *****
গল্পটি কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন |
ঘুরে দেখুন muktodhara.online . এখানে রয়েছে আরো অনেক গল্প. মুক্তধারার সাথে থাকুন ভালো থাকুন.