-“তিতলি খাবারের ব্যাগে কিন্তু সব দেখে শুনে সাজিয়ে নেবে, আর ওখানে তো অনলাইন ডেলিভারি দেয়ই, তাই শেষ হওয়ার আগেই অর্ডার করবে। খেয়াল রাখতে হবে এগুলো।”
-“মা প্লিজ, আমি কী এইটুকু এখনও? আই উইল ম্যানেজ, ডোন্ট থিঙ্ক টু মাচ।”
-“তুই থাম, এর আগে কবে এতদূরে একা থেকেছিস যে বেশি কথা বলছিস? আচ্ছা, এবার খেয়ে নে, আমি আবার রাত্রে কল করছি। বাবাও কথা বলবে তখন। রাখ।”
ফোনটা রাখল তিতলি।
পুরো ফ্ল্যাটে এই করিডরটাই সব থেকে পছন্দ হয়েছে তিতলির, এখান থেকে সামনে একদিকে পাহাড়, আর একদিকে সমুদ্র। সমুদ্রের বুকে ঝিকমিক করছে কিছু আলো, জাহাজ চলছে। হু হু করে হাওয়া বইছে সমুদ্রের দিকটা দিয়েই। এখানটায় এসে দাঁড়ালে যেন সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমেষে হাওয়া। বারান্দাটায় একটা ছোট্ট দুধ সাদা দোলনা আছে। ব্যস, এর থেকে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে? বড় করে একটা শ্বাস নিল তিতলি। তানিয়া সেন, সদ্য পাস আউট, জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে সবে জয়েন করেছে আর কে জি হসপিটালে। রান্নাঘর সমেত পুরো ফ্ল্যাট আজ সারাদিন ধরে সাজিয়ে সাংঘাতিক ক্লান্ত, কিন্তু কখনো কখনো শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত হলেও ঘুম আসে না। আজও সেরকমই। সারাদিনের এত ধকলের পরও যেন চোখে একটুও ঘুম নেই। রান্নাঘর থেকে রুটি, স্যালাড, সবজি নিয়ে খেতে বসল। একা থাকতে কেমন লাগবে, কীভাবে থাকবে ভাবছিল ও। কিন্তু এই মুহূর্তে খারাপ না, বরং বেশ ভালই লাগছে ওর। এর আগে সেভাবে মা বাবাকে ছেড়ে থাকার প্রয়োজন হয়নি, এই প্রথম। মা তাই স্বভাবতই বেশ চিন্তিতই। ও মুখে যাই বলুক, চিন্তা যে ওরও হচ্ছিল না সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। সব পারবে তো সামলাতে? এটাই ভাবছিল। তাও ভাল ওর সাথে শেষ মুহূর্তে রোহিনীও থাকবে ঠিক করল। একসাথে থাকলে আর তেমন চাপ নেই। রোহিনীটা শুয়ে পড়েছে, কিন্তু তিতলির চোখে ঘুম নেই। খেয়ে উঠে নিজের টেবিলে গিয়ে বসল ও, একটু নিজের মত করে। স্টাডি টেবিলটা বারান্দার দরজার কাছেই রেখেছে, ওখান থেকে সামনের আঁধার পেরিয়ে সমুদ্রের বুকে অস্পষ্ট আলো আঁধারি চোখে পড়ছে। পর্দাগুলো উত্তাল হাওয়ায় উড়ছে। বেশ লাগছে তিতলির। স্টাডি টেবিলের দিকে তাকাতেই নীল খাতাটা চোখে পড়ল ওর। ছোট থেকে স্ল্যাম-বুক, ডায়েরি, লেখা, বা পুরোনো গ্রিটিংস কার্ড যত্নে গুছিয়ে রাখাটা ওর স্বভাব। এই নীল খাতাটা সেই কোন কচি বয়সের, যখন ওরা বর্ধমানে থাকত। সেই ছোট বেলায় ডায়েরি না পেয়ে খাতাতেই লিখত হাবিজাবি, কত কী। নিজের মনেই হাসতে হাসতে পাতা ওল্টাতে লাগল ও।
**********
“তিতলি, অ্যাই মেয়ে, হতভাগী, দাঁড়া বলছি, কী রে?” স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে পিছনে ছুটতে ছুটতে আসছে সন্ধ্যামাসি। সাত আট বছরের রোগা লিকপিকে, দুদিকে দুটো বিনুনি বাঁধা, স্কুল ড্রেস পড়া মেয়েটা তীরবেগে ছুটছে মেনগেট পেরিয়ে রুদ্ধশ্বাসে। দালান, সিঁড়ি পেরিয়ে সোজা ঠাকুমার ঘরে গিয়ে শ্বাস নিল ও।
ওদিকে সন্ধ্যামাসি ব্যাগ, বোতল নিয়ে গজগজ করতে করতে উঠছে, “ও বৌদি, কী গো, কোথায় গেলে?”
তিতলির মা, সেন বাড়ির ছোট বৌ, ললিতা এত হাঁকডাক এতক্ষণ শোনেনি। সন্ধ্যের মধ্যে সবাই বাড়ি ফিরে আসে, আর সন্ধ্যেবেলায় জল খাবার বানানোর দায়িত্ব ওঁর। তাই রোজকার মতো আজও তাতেই ব্যস্ত ছিলেন ললিতা। ময়দা মাখতে মাখতেই এতো হাঁকডাকে বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। প্রণতা, বড় বৌ তখন সন্ধ্যা দেওয়া হয়ে গিয়ে ঠাকুর ঘর থেকেই নামছেন। তিনিও দাঁড়িয়ে গেলেন উঠোনে।
-“কী করেছে জানো আজ তোমার মেয়ে?”
চোখে মুখে প্রশ্ন, সঙ্গে খানিক আতঙ্কও। সন্ধ্যা মাসি আর উত্তেজনা না বাড়িয়ে সরাসরি নালিশ জানিয়ে দিল, স্কুলের সারাদিনের ইতিবৃত্ত।
-“ঐ মেয়েটার মা তো আজকেই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিল, সে কী মেজাজ গো তার, তেড়েফুঁড়ে এসেছে। আমিও বলেছি ছোট বাচ্চা মারপিট করবে না কো? এত অশান্তির কী আছে। তারপর দেখলাম মেয়েটার চোখের নীচে কালশিটে। আর কিছু বলার সাহস পেলাম না, কালকেই তোমায় আর ঐ মেয়ের মা, দুজনকেই স্কুলের বড়দিদি ডেকেছেন গো। তোমরা এবার বকাবকি করবে, তাই প্রথম থেকেই ঠাকুমার ঘরে সেঁধিয়ে বসে আছে। ঐ ঘরে থাকলে কারো সাধ্যি নেই কিছু বলে, বুঝেছ? চলো মেলা কাজ পড়ে।” – সন্ধ্যা মাসি তখনকার মতো বিদায় নিল। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।
সে রাত্রে ঠাকুমার কৃপায় মা বাবার কাছে মারধর খেতে হয়নি। কিন্তু পরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে, ” তোকে এই জন্য স্কুলে পাঠাই?”
-“ও আগে মেরেছিল, তাই আমি মেরেছি।”
-“তুই তা বলে চশমার বাক্স ছুঁড়ে ওর চোখে মারবি? ওর চোখে জোরে লাগতে পারত, বড় ক্ষতি হতে পারত, এইটুকু সেন্স হয়নি এখনও?”
মাথা নীচু করে চুপচাপ হাঁটছিল তিতলি। বাড়ির সামনের মোড়ে বুধবার করে ফুচকা বসে, আজ মনে হয় না জুটবে।
মা-এর হাত ধরে চুপচাপ ফিরছিল তিতলি, না মুখে আর কোন কথা ছিল না। সব পাখিরা ঘরে ফিরছে, আকাশটা উজ্জ্বল সোনালী, খালি পশ্চিম দিকটা কেমন দুধে আলতা। দুধে আলতা রঙের ছাপ পড়েছে যেন চারিদিকে। পাখিদের কিচির-মিচির মায়ের বকাবকিকে যেন ফিকে করে দিচ্ছিল, পাশে মাঠে খেলা শুরু হয়ে গেছে, গলির মোড়টায় বাঁক নিতেই আচমকাই দেখা। আবদুল কাকা, মাসে একবার করে সমস্ত পশরা নিয়ে আসে। কোথা থেকে আসে কে জানে। তিতলি অতো বোঝে না। প্রতি মাসে এসে, এখানে আত্মীয়র বাড়িতে ওঠে। এখানে সমস্ত জায়গায় মালপত্র দিয়ে অর্ডার নিয়ে ফিরে যায়। তিতলি অত জানে না বোঝে না কোন জায়গা। আবদুল কাকাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল তিতলি, “আচ্ছা তোমরা এত ফর্সা, এত সুন্দর, একদম কাশ্মীরিদের মতন, তোমরা কী কাশ্মীরে থাকো?” আবদুল কাকা হেসে বলেছিল, না অতদূরেও থাকে না, কিন্তু পূর্বপুরুষরা কেউ হয়তো কাশ্মীরে ছিলেন। না আবদুল কাকা একা আসে না। তার সাথে থাকে আবদুল কাকার ছোট্ট ছেলেও। একদম তিতলির মতই বয়স। রোগ ফর্সা, হালকা বাদামী চুল, হাসলেও যেন মুখে গালে সমস্ত রক্তবিন্দু জমা হয়ে রক্তিম আভা সৃষ্টি করে। আর সমুদ্রের মতন নীল, গভীর দুটো চোখ।
আবদুল কাকা বেশী কথা বাড়ান না আর। কাল ভোরবেলা নিজের পশরা সাজিয়ে আসবে ওদের বাড়ি, জানে তিতলি। শনি রবিবার করেই কাকা আসে। তাই তিতলির স্কুল ছুটিই থাকে।
**********
খুব সকাল সকালই আসে কাকা। তিতলি অন্যদিন স্কুল না থাকলে অত সকাল সকাল ওঠে না। কিন্তু এই দিনটা বিশেষ অবশ্যই। তিতলি ওদিন দুধ কর্নফ্লেক্স খেয়ে খুব ঝটপট চলে আসত নীচের বসার ঘরের উঠোনে। অন্যদিন যার খেতে এতো সময় লাগত তার ঐদিনকার সুমতি দেখে মা, ঠাকুমাও বলতো। তিতলি চুপটি করে গিয়ে বসত মায়েদের সাথে বসার ঘরের চেয়ারটায়।
কী সুন্দর সুন্দর সূক্ষ্ম কাজের জিনিস বের করত আবদুল কাকা। সূক্ষ্ম কাজ করা শাল, সূক্ষ্ম জরির কাজে ভরা কত রকমের পোশাক, বাহারী কাজের কাঠের কত রকমের কত মাপের কৌটো, আর কী দুর্দান্ত সব পোট্রেট। তিতলি দেখত আর মুগ্ধ হয়ে যেত। কত রকমের শোপিস, কতরকমের ব্যাগ, কত কত জিনিসের পশরা। মা জ্যেঠিমারা পছন্দ করে করে কিনত, আবার বলে দিত পরের বার কী রকম কী চাই। কাকা সেইমতো জিনিস নিয়ে হাজির হত আবার পরের মাসে। কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে যে তিতলির সবটা ঘিরে থাকত ঐটুকু বয়সেই, সেই ছোট্ট ছেলেটা, তার গভীর নীল চোখের স্বচ্ছ সরল দৃষ্টি, কোনদিনও ভুলতে পারবে না তিতলি। মন্ত্রমুগ্ধ-এর মত অতক্ষণ ঐ দস্যি, বিচ্ছু মেয়েটা একভাবে যদি কারো জন্য সত্যিই বসে থাকত, অপেক্ষা করত, তাহলে সে আর কেউ না, রেহান, আবদুল কাকার ছেলে। খুব মুখচোরা, লাজুক। মাথা নীচু করে বাবার পাশে বসে বাবার কথামতো কাজ করত শুধু। এইটা দেখা, ওইটা বের কর, এইসবই। এত কাজের মধ্যে কোন কাজ ঐ হাতেরও কীনা তা জানা ছিল না তিতলির।
বাবার পাশে বসে খুব বেশী কথাও বলত না রেহান। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ততটুকুই। তিতলিও কোনদিন কথা বলেনি। কেন কে জানে এই মারাত্মক দস্যি, দুরন্ত মেয়েটা ওর সাথে কথা বলতেই কেন এত জড়তা অনুভব করত। রেহানের হাসিটাও বড্ড মিষ্টি ছিল। মাথা নীচু করে কয়েকবার কোন কারণে ওকে হাসতে দেখেছিল তিতলি। সেই হাসি চোখ অবধি পৌঁছায়, লজ্জা মেশানো নির্মল সেই হাসির দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুধু চেয়ে থাকত তিতলি। ধীরে ধীরে এমন হলো, মাসের ঐ দিনটার জন্যই যেন অপেক্ষা বাকী দিনগুলি। ঐ একটি দিনের কিছুক্ষণের সাক্ষাতের জন্য যেন অধৈর্য্য হয়ে পড়ত তিতলি।
শুধু দেখাটুকুই হতো, ব্যস। আর কিছু না। কোন কথা না, কোন গল্প কিচ্ছু না। তাতেই যেন আরও একটা মাস অপেক্ষা করার রসদ পেয়ে যেত ও। ভীষণ ভাল কাটছিল দিনগুলি। দিন, মাস, বছর ঘুরল। তিতলি বড় হচ্ছিল, রেহানও। আবদুল কাকাই গল্প করত, রেহানের নাকি খুব ভাল মাথা, পড়াশোনায় খুব ভাল। তিতলি চুপিসারে দেখত আর হাসত, ভাবত, বাব্বাহ, লাজুক হলে কী হবে, ছেলে বুদ্ধিমান আছে।
যেবার জ্যেঠু ক্যামেরা কিনল নতুন, পূজোর আগে আগে, সেবার যখন আবদুল কাকারা এসেছিল, নতুন ক্যামেরা বলে সবাই মিলে ফটো তোলা হয়েছিল, প্রিন্ট করিয়ে তারপর যখন আসে ফটোগুলো, একটা ফটো রেখে দিয়েছিল তিতলি। সে ফটোটার মাধ্যমেই একমাত্র রেহান রয়ে গেছে তিতলির জীবনে। ভাগ্যিস ফটোটা তোলা হয়েছিল নয়তো কোন স্মৃতিই থাকতো না ওর কাছে। প্রথমবারের মতন দ্বিতীয়বারও যখন হারিয়ে গেল ও… ফোনটা বাজছে, মা। বহু পুরোনো সাদাকালো ছবিটা নীল খাতায় জায়গা নিয়েছে বহুদিন, সেটা রেখে ফোনটা রিসিভ করে বারান্দায় গেল তিতলি।
সেই ছবিতে জ্বলজ্বল করছে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার মুখটা। হারিয়ে ফেলা মেয়েটার মুখটাও। স্নিগ্ধ, সরল, অনাড়ম্বর, খাঁটি সেই হাসি। বর্ধমানে তিতলিদের আদি বাড়ি, তিতলির গোটা পরিবার। এইসবকিছু ছেড়ে তিতলির বাবার কাজের সুবাদে চলে গেছিল ওরা কলকাতায়। রয়ে গেছিল এই বাড়ি, পরিবার, মানুষজন, মুহূর্তরা। হারিয়ে গেছিল সেই ছেলেটা, রেহান।
।।২।।
-“গুড মর্নিং স্যার।”
-“ভেরি গুড মর্নিং,” করমর্দন করে একবার ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলেন ডঃ রাও, এনার আন্ডারেই আপাতত থাকবে তিতলি।”
**********
হসপিটালের পরিবেশটা আর পাঁচটা হসপিটালের থেকে একদম আলাদা। হস্পিতালটা ঘিরে বেশ বড় একটা বাগান আছে, সারা বাগানে অসংখ্য ফুল গাছ। একটুখানি বাগানটায় গিয়ে দাঁড়ালেই মনটা ভাল হয়ে যায়। এছাড়াও দোলনা, ফোয়ারা, বসার সুন্দর জায়গা সবই আছে। সন্ধ্যে নামলে যখন আলোগুলো জ্বলে, তখন ভীষণ সুন্দর লাগে চারপাশটা। রোগীরা যেখানে চিকিৎসা করাতে আসে, সে জায়গাটা যদি সুন্দর হয়, পরিবেশ যদি সুষ্ঠ হয়, অর্ধেক রোগ ওখানেই সেরে যায়, ডঃ রাও এটা বলেন সবসময়ই। তাই সবার দায়িত্ব এই সুন্দর পরিবেশটাকে রক্ষা করা। কথাটা তিতলিও মনে প্রাণে মানে। এখানে জয়েন করার পর থেকে মোটামুটি একমাস হতে চলল। ভাইজাগ শহরটাও ভারী সুন্দর, গোছানো, পরিপাটি। আর সঙ্গে রোহিনীও আছে। তাই বাড়ি ফিরেও ভালই কেটে যায় সময়টা। ওর সঙ্গে আরও তিনজন জয়েন করেছে। ওদের মধ্যে দুটো মেয়ে রাজস্থানি, ছেলেটা সাউথ ইন্ডিয়ান। সাক্ষী মেয়েটাকে যখন তিতলি বাংলায় উচ্চারণটা করে শুনিয়েছিল, সে তো হেসেই কুটোপাটি। এই সাকসী (আদপে সাক্ষী) আর তনু-র সাথে তিতলির ওয়েভলেংথটা ভালোই ম্যাচ করে। আর ছেলেটার নাম সিদ্ধার্থ। ওর বাড়ি কেরালা। এই সব মিলিয়ে মোটামুটি ভালই কাটছে তিতলির। মা এখন একটু কম টেনশন করে। কিন্তু মাকে নিয়ে তিতলির সবথেকে বেশী চিন্তা। বাবার কথা তো শোনে না, তিতলির কথা যাও বা শুনতো, এখন তিতলিও নেই। রোজ ন’টা থেকে মাকে ভিডিও কল করে তিতলি। ঐসময়টা যেন বাড়তি অক্সিজেন দেয় ওকে। এখানে যে খুব একটা ঠান্ডা পড়েছে তা না। ওয়েদারটা সত্যিই দারুন। এখানে এসে থেকে সেভাবে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি, অথচ মাসখানেক হতে চললো ও এসেছে। আজই আলোচনা হচ্ছিল আরাকু, বোরাকেভস এগুলো ঘুরতে যাওয়ার। মাকে এখুনি বললেই মা হাজারটা টেনশন শুরু করবে। কীভাবে মাকে এপ্রোচ করবে সেটাই ভাবছিল তিতলি, ওর প্রিয় করিডরটায় দাঁড়িয়ে।
এখানকার সবই ভালো শুধু খাবারদাবারটা তিতলির একদম পছন্দ নয়। ছোট থেকেই সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশের তেমন ভক্ত নয় ও। কিন্তু এখানে ক্যান্টিনে বা বাইরের খাবারের দোকানে যা পাওয়া যায়, তার কোনোটাই…এসব দুঃখের কথা বাবা জানে। মাকে বললেই বেকার মনখারাপ করবে, কষ্ট পাবে। এই যেমন আজ জুটেছে ভাত, রুটি, ডাঁটার ঝাল, সেটা ঝাল না টক ঝাল ঈশ্বর জানেন, টক দই, মিষ্টি। এই টক দই আর মিষ্টি ছাড়া আর কিছুই মুখে দেওয়া যায় না। এই একটাই দুঃখ ওর। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদিকে ভুডা কৈলাশগিরি আর একদিকে সমুদ্র দেখছিল তিতলি। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। বড্ড সুন্দর লাগছে দূর থেকে সমুদ্রটা। একটু আগে ম্যাগি খেয়ে নিয়েছে তাই আপাতত ক্ষিদে নেই।
ঘরে ফোনটা বাজছে। ঘর থেকে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করল বারান্দায় এসে। আজ মাকেও এই সুন্দর পরিবেশটা দেখাবে, মারও ভাল লাগবে। ফোনটা রিসিভ করতেই দেখল মা গায় শাল জড়িয়েছে। কলকাতায় নাকি এবার বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আর ওদের বাড়িটা তুলনামূলকভাবে একটু বেশীই ঠান্ডা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই খেয়াল করল এটা সেই শালটা না?
-“মা, এটা ঐ পশমিনা শালটা না?”
-“হ্যাঁ রে, তোর মনে আছে? খুব ভাল দিয়েছিল এই জিনিসটা। এই একটু আগে বেরিয়েছিলাম, আর তোলা হয়নি।।। মার কথাগুলো কানে ফিকে হতে শুরু করল তিতলির।
**********
-“মা ঐ কালোর উপর কমলা হলুদ শালটা কী সুন্দর বলো।”
শীতের সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে বাইরের উঠোনে। মা জ্যেঠিমার সাথে প্রতিবারের মতন তিতলিও বসেছে সুন্দর সুন্দর জিনিস বাছতে। তখনই চোখে পড়ল শালটা। তিতলির কথা শুনে আব্দুল কাকা বলল, “এটা অরিজিনাল পশমিনা শাল, প্রচন্ড গরম হয়। এখানে তো অত ঠান্ডা পড়ে না। ঐ পাশের পাড়ার ঘোষগিন্নী আনিয়েছেন এটা।”
কথাটা শুনে তিতলির উজ্জ্বল মুখটা একমুহূর্তের জন্য কালো হয়ে গেছিল। কিন্তু কেউ একজন হয়তো সেটা খেয়াল করেছিল, নিশ্চিত না। কিন্তু সেদিনের পর একমাসের মধ্যে একেবারে একরকম,কোনো একজনের জোরাজুরিতে আবদুল কাকা আরেকটি পশমিনা শাল তুলে দিয়েছিলেন তিতলির মা-এর হাতে। বহু জোরাজুরিতেও কিছুতেই টাকা নেননি। সেই দিনটার কথা তিতলি কোনদিন ভুলবে না। নেহাতই সাধারণ ঘটনা, কিন্তু তিতলির জন্য সেটা বিশেষ কিছুই ছিল। কোথাও যেন জিতে যাওয়ার আনন্দ, একসাথে অনেকটা ভাল কিছু পাওয়ার আনন্দ। যাইহোক, ভীষণ ভীষণ ভালোলাগা ঘিরে ধরেছিল সেদিনের দস্যি মেয়েটাকে। তখন তিতলির ক্লাস সিক্স। লজ্জা তখন বেশ ভালভাবে ওর মধ্যে গেড়ে বসতে শুরু করেছে। বয়ঃসন্ধির প্রভাব হয়তো। কাউকে কিছু না বলে ছাদে দে দৌড়। ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে দেখেছিল সেদিন মেয়েটা। ছেলেটা চলে যাওয়ার আগে লজ্জার আগল ভেঙে একবার ফিরে তাকিয়েছিল প্রথমবার। আর মেয়েটা সেদিন থেকে নিজেকে মুড়ে নিয়েছিল লজ্জায়, প্রথমবার।
।।৩।।
-“ফুড ওয়াজ জাস্ট অসাম ইয়ার।” খেয়ে উঠে বলল রোহিনী।
আজ ভোর থেকে ও, রোহিনী, ওর বাকী তিনটে বন্ধু সবাই মিলে বেরিয়েছিল বোরাকেভস, আরাকুর উদ্দেশ্যে। শীতের শুরুতে যাওয়ার দরুণ, সারাটা দিন দারুণ কেটেছে বলাই বাহুল্য। একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছিল ওরা। ট্রেনে করে গেলে আজ ফেরা সম্ভব হতো না, তাই। যাই হোক, খাওয়াদাওয়া, ঘোরা, ফটোশ্যুট, সব মিলিয়ে আজ অনেকদিন পর দিনটা দুর্দান্ত কাটল।
আজ বাইরে থেকে ছোলা বাটুরা নিয়ে এসছিল ওরা। কুয়াশা চিরে ঘন সবুজের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাঁক নিয়ে এগোচ্ছিল ওদের গাড়ি। প্রতিটা স্পট দারুণ। আজ তনুরা ওদের ফ্ল্যাটেই রয়ে গেছে। রাত হয়ে গেছল বলে ওদেরকে এখানেই রয়ে যেতে বলল, আর ওদের ফ্ল্যাটটা এমনিতেই বেশ বড়।
-“এই তানিয়া। চল না একটা গেম খেলি। আজ মাথাটা হালকাও আছে, আর মুডটাও ভাল আছে। তনু অবাঙালী হলেও কলকাতায় থাকার সুবাদে বাংলাটা ভালই বলে।
“গেম?” -সাক্ষী।
“কি গেম?” -তিতলি।
-“ডাম্ব শারাড? “-তনু |
-“ওকে ডান।” -রোহিনী।
খানিক জোরাজুরির পর বোতল ঘুরিয়ে খেলা শুরু হলো। খেলতে খেলতে কোথা দিয়ে যে সময় যেতে লাগল!আজ তিতলির মাকে ফোন করার কথাও খেয়াল নেই। বহুদিন পর যেন সেই ছেলেমানুষিটাকে ফিরে পেয়েছে আবার। তিতলির সামনে বোতল আসতেই তনুর প্রশ্ন, “এই তুই তোর প্রেম নিয়ে কোনদিন কিছু বলিসনি। ক্রাশ, ফার্স্ট লাভ, ফার্স্ট ছেঁকা, কিচ্ছু জানি না, আজ বল, আজ ছাড়বো না। ওকে… একটাই প্রশ্ন, প্রথম কিস করেছিস কোন ক্লাসে? আর কাকে?”
থতমত খেয়ে গেল একটু তিতলি। দেওয়ালে টাঙানো স্কার্ফটার দিকে চোখ গেল। ভেসে উঠতে লাগল ছবিগুলো।
**********
-“রোল 31”
-“ইয়েস ম্যাম।”
-“রোল 32”
-“ইয়েস ম্যাম।”
-“অ্যান্ড রোল 33, আওয়ার নিউ স্টুডেন্ট রেহান মালেক।”
-“ইয়েস ম্যাম।”
নামটাই যথেষ্ট ছিল তিতলির ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকানোর জন্য।