আমার মতে তোর মতন কেউ নেই (শেষ অংশ)

সেই চোখ, সেই মুখ আর সেই হাসি। চোখের মণি যেন স্থির হয়ে গেছে ওর, বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে। হ্যাঁ, এ তো রেহানই! আজ পাঁচ বছর পর, এখানে এভাবে।।। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না তিতলির। ম্যামের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ও। কিছুতেই নিজের আবেগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে। চোখে মুখে জল দিয়ে আয়নার দিকে তাকালো ও। এখন এই মুহূর্তে আর কেউ নেই ওয়াশরুমে। একটু পরেই ব্রেক হবে। রেহান, সেই রেহান, যার জন্য ও নিজের ঘুম ছেড়ে সাত সকালে নীচের ঘরে ছুটত। সিরিয়াসলি! এরকমও হয়? এখানে এতদিন পর ওরই ক্লাসে এভাবে রেহানকে পেয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি ও। আচ্ছা ও স্বপ্ন দেখছে না তো? আচ্ছা রেহান কী ওকে দেখতে পায়নি? আচ্ছা ও কী এখনও ওরকম লাজুকই আছে? আগে তো কথাই বলত না, খালি হাসত। কী বলবে ও গিয়ে? আচ্ছা রেহান আদৌ জানে সেই কবে থেকে তিতলি ওর।।। না না, ধ্যুর, ও কী করে জানবে? আনন্দটা যেন গলা ছাপিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু স্কুলে এখন চেঁচাবেই বা কী করে? ভীষণ চেঁচাতে ইচ্ছে করছে আনন্দে, ভীষণ আনন্দে। ওর এখনও বিশ্বাসই হচ্ছে না। উফফ!!!

দরজা দিয়ে একটা মেয়ে ঢুকল। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বেরল তানিয়া সেন, ক্লাস টুয়েলভ, সেকশন এ, আর কে মিশনারি স্কুল, কলকাতা।

**********

-“এই ছেলেটাকে কী হেব্বি দেখতে রে! চল না গিয়ে কথা বলি।”

-“উফফ, হাসিটা তো পুরো কিলার, আমার তো মনে হচ্ছে পাগলই হয়ে যাব।”

-“আমি তো ওর চোখেই ফিদা ভাই লোগ। চোখ দুটো দ্যাখ জাস্ট, মনে হয়ে ওতেই ডুবে মরে যাই।”

তিতলির বান্ধবী মহলে মোটামুটি গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তিতলির বিরক্ত লাগছিল বইকী।

নেহাত জোর করেছে রোহিনী, কী পাগলামো করছে মেয়েগুলো।

তিতলি ওদের বাধা দিয়ে, একবার তাকালো রেহানের দিকে। সেদিনকার সেই লাজুক ছেলেটা আজ কোথায়? এর মধ্যেই ক্লাসের বাকী ছেলেগুলোর সাথে দিব্যি আলাপ জমিয়ে ফেলেছে রেহান। সেদিনকার মুখচোরা ছেলেটা আজ যথেষ্ট স্মার্ট, ঝকঝকে। তিতলির নিজেরই অবাক লাগছে। ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কোথা থেকে যে এত লজ্জা ওকে পেয়ে বসেছে কে জানে! ও কবে থেকে এতো লাজুক হয়ে গেল?

-“জানিস, আর।কে।বি-এর কাছেও এডমিশন নিয়েছে খবর নিয়ে এলাম, মেডিকেলের প্রিপারেশন নিচ্ছে।” সুতনুকা এসে বলল তিতলির কানের কাছে।

তিতলির মনের অজস্র জটিল পাক আরও যেন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আর তার মাঝে ইতিমধ্যেই যেন ও ক্লাসের মেয়েদের হার্টথ্রব হয়ে গেছে।

-“এই।।। চলললল না, কথা বলি, প্লিজ।।।”

-“না, কি পাগলামো করছিস একটা ছেলেকে নিয়ে।।।”

-“ছেলেই তো, এলিয়েন তো নয়, এতো লাজুক তুই কবে থেকে হয়ে গেলি রে?

টিফিনের ব্রেক শেষ হতে কয়েক মিনিক বাকী। সবাই একে একে ক্লাসের দিকে ফিরছে। ওর মধ্যে যে কী চলছে ও-ই জানে। এই কিছুক্ষনের মধ্যে যেন কত কী ঘটে গেল।  

রেহানের চুলটা ডানদিকে সিঁথে করা, হালকা বাদামী চুল। এখন চোখে চশমা হয়েছে। পকেটে রাখা এখন খেয়াল করল তিতলি। বেশ লম্বা হয়ে গেছে এখন। তিতলিকে যেন দেখেও দেখছে না।চিনতে পারেনি ও ওকে?

-“হ্যালো, আমি রোহিনী।”

-“হ্যালো, রেহান।”

-“আর ও হলো আমার বন্ধু।।।”

-“তানিয়া।”

-“এ কী তুমি জানো ওকে?”

-“প্লিজ, একই ক্লাস, তুইটাই ঠিক আছ।”

-“ওহ, সরি, তুই তানিয়াকে ।।।”

-“হ্যাঁ, আমি তো চিনি তানিয়াকে। কেমন আছিস তানিয়া?” বলে রেহান হাত বাড়াল তিতলির দিকে। হাত বাড়াল তিতলিও। অনেক কথাও বলল রেহান আর রোহিনী। তিতলির কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল। কোন কথাই যেন কান অবধি পৌঁছাচ্ছিল না, রেহানের সাথে হাত মেলানোর পর থেকে। শুধু রেহানকেই দেখে যাচ্ছিল ও। কিরকম ন্যাকা ন্যাকা, বোকা বোকা কথা বলছিল রোহিনী। বাড়ি ফিরেও ঘোরের মধ্যেই কেটেছিল দিনটা। রেহান যখন ওর হাতটা চেপে হ্যান্ডশেক করল, পেটের মধ্যে যেন হাজার হাজার প্রজাপতি উড়ছিল ওর । সেই শুরু, তারপর থেকেই ওর চেনা পৃথিবীটা যেন একটু একটু করে বদলে যেতে লাগল। হঠাৎ করেই যেন কেউ এসে ওর চেনা পৃথিবীটাতে একমুঠো লাল আবির ঢেলে দিয়ে গেল। সারাদিনের সমস্ত লেখাপড়া টেনশন, এক্সাম, ক্লান্তি শেষে যেন মন ভালো করা খোলা হওয়াটা নিঃশব্দে জায়গা করে নিচ্ছিল তিতলির জীবনে। আগের আলাপটা হয়তো ভালো লাগাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, এবারের দমকা হাওয়াটা যেন ভালোবাসার দরজায় ঘা দিয়েছে সজোরে। আর সেই দ্বার রুদ্ধ করার কোন ইচ্ছেই তিতলির নেই।

রেহান বুদ্ধিমান এটুকুই জানতো তিতলি, কিন্তু এত ব্রিলিয়ান্ট তা ওর ধারণার বাইরে ছিল। স্কুলে নতুন ভর্তি হওয়ার পর থেকে কিছুদিনের মধ্যেই সমস্ত শিক্ষকদের মন জয় করে নিয়েছে ও। ক্লাসের সমস্ত মেয়েরা ছেলেটার জন্য তো প্রথম থেকে পাগল। আর তিতলি? তিতলি তাহলে এরকম একজন, যাকে সে সেই ছোট থেকে।।। কীভাবে ভালো না বেসে পারবে?

**********

রেহান যে পিজিতে থাকে, সেটা তিতলির বাড়ি পেরিয়ে কিছুটা এগিয়েই পড়ে। রোহিনী, তিতলি, রেহান তিনজনের বাড়ির পথ একই, তাই একসাথেই ফেরে ওরা। প্রথম তিতলি, তারপর রোহিনী, তারপর রেহান।।। কিন্তু এখন গতি যেন খানিক বদলে গেছে। রোজই তিতলির কিছু না কিছু কেনার থাকে, যাওয়ার থাকে, রোহিনীকে বাই বলে এগোয় তিতলি। ইচ্ছে করেই।।। জানে ও নিজেও, আরেকজনও বুঝতে পারে। কিন্তু সে কই কিছু বলে না তো?

-“এখানে ভালো আঁকার জিনিস কোথায় পাওয়া যায় বলতো? কিনতে যাব । “

-“তুই আঁকতে শুরু করলি কবে থেকে?”

নিজের স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হেসে, “ছোট থেকেই। জানতিস না তুই?”

রেহানের কথার মধ্যেও যেন কিছু একটা আছে, ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়েই থাকে তিতলি। যেন চোখ ফেরাতে চায়ই না। ওর ফর্সা গালে হালকা দাড়ি গোঁফের আভা, রোগা, লম্বা গড়নে যেন আত্মবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। চশমাটা পড়লে ওর গভীর নীল চোখদুটো ঢাকা পড়ে যায়, ওটা একদম পছন্দ না তিতলির। কাঁধে একটা ব্যাগ, পায়ে চটি, হাতে একটা সস্তার ঘড়ি, চুলটা খানিক অগোছালো, একটু যেন ছন্নছাড়া, তাও যেন অনেকটা নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার প্রচন্ড তাগিদ। সবার সামনে তো পড়াশোনার বাইরে তেমন কথাই বলে না। আর আজ যে ওর আঁকার শখ বলল? তার মানে কী তিতলি স্পেশাল? ধ্যুর, কী যে ভাবে তিতলি। আচ্ছা, সবার সামনে এত যে কথা বলে, এখন তাহলে এরকম লাজুক মুখ করে মাথা নামিয়ে হাঁটছে কেন? তিতলির সামনে লাজুক সাজার এক্টিং করার কী মানে?

সামনের মোড়ে ঘন্টা বাজিয়ে দুলালদা ঘুগনি, চাট বিক্রি করছে। তিতলির বরাবরই এইসব খাবার খুব পছন্দের, তাই দুলালদাকে দেখে ওর চোখ মুখ উজ্জ্বল।

-“ক্ষিদে পেয়েছে, খাবি?” তিতলি কিছু বলার আগেই রেহানই বলল। এগোল ওরা দুলালদার গাড়ির দিকে। তারপরের মুহূর্তগুলো বড্ড প্রিয় তিতলির। একদিন না, প্রতিদিন। ঐ যে তিতলির জন্মদিনের আগের দিন, দুলালদার দোকানেই টিকিয়াচাট খেতে গিয়ে, তিতলির ঠোঁটের উপর লেগে থাকা খাবারের দানা যখন নিজের আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিল রেহান, কিংবা তিতলির জন্মদিনের দিন রঙিন কাগজে মুড়ে দেওয়া সুন্দর স্কার্ফটা, কিংবা স্কুল বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আঁকা তিতলির পোর্ট্রেটটা। অনেকেই অনেকের ছবিই এঁকেছিল, বয়ঃসন্ধিতে প্রেম তখন সবার জীবনেই অল্প-বিস্তর উঁকি দিচ্ছে। রেহান বন্দী করেছিল সেই মুহূর্তটা, যখন তিতলি জন্মদিনের দিন হঠাৎ বন্ধুদের আনা কেক কাটতে ব্যস্ত ছিল।

নীলজ স্যার রেহানের হাতে প্রাইজ দিয়ে বলেছিলেন, আমিই বললাম, তানিয়ার ছবিটাই আঁক। রেহান তো রোহিণীর ছবি আঁকতে গিয়েছিল।

সারা ক্লাস হো হো করে হেসেছিল সেদিন, রোহিনীও। তিতলি প্রথমে লজ্জা পেলেও খুব রাগ হয়েছিল ওর তারপর। রোহিনী? রেহান কী তার মানে? রাগে দুঃখে তারপর দু’সপ্তাহ কথা বলেনি আর।

স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানের রিহার্সাল উপলক্ষ্যেই তিতলি রোহিণীর থেকে জানতে পেরেছিল, রেহান নাকি দারুণ গানও করে। একটা মানুষ এতটা গুণী ভেবে তিতলির যতটা ভালো লেগেছিল, তার থেকে বেশী রাগ হয়েছিল| সারাটা ক্লাস, সব সময় রেহান তো তিতলির দিকেই দ্যাখে। তিতলি কী এতটাই ভুল বুঝল? এত ভুলও হতে পারে কারও? তাহলে রোহিনী ওর জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কই, তিতলি তো জানতো না।

সবার অনুরোধে রেহান সেদিন বলেছিল, জনসমক্ষে গান কখনো ও গায় নি, প্রথম নিজের প্রেমের জন্যই গাইবে। সেদিনও তো রেহান ওর দিকেই তাকিয়েছিল। নাকি ওর পাশে বসা রোহিনী? আজও জানে না তিতলি। কারো এত ভুল হতে পারে??

**********

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দোরগোড়ায়। আর কিছু ভাবার বোঝার সময় নেই। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন রাস্তায় বেরিয়ে দেখেছিল, রেহান রোহিণীর সাথে দাঁড়িয়েই কথা বলছে। ব্যস, আর কিছু ভাবেনি ও। জোর করে নিজের একটু একটু করে সাজানো সমস্ত স্বপ্নগুলো শিকড় সমেত উপরে ফেলে দিয়েছিল বাইরে।

কিন্তু রেহান?

হঠাৎই খবর রেহানের এক্সিডেন্ট হয়েছে। পরীক্ষার দিন আটেক পরে। রোহিনীই খবর এনেছিল। ছটফট করেছিল তিতলি, যেতে পারেনি। জীবনের চরম ভুলটা হয়তো সেদিনই করেছিল। যখন পৌঁছায় রেহানকে রিলিজ করে নিয়ে চলে গেছে বাড়ির লোক। পি।জি-ও ছেড়ে দিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছিল ওর রেহান, ওর স্বপ্নের রাজপুত্র, দ্বিতীয়বার। কে ভুল, কে ঠিক, কম বয়সের ছেলেমানুষি, জিদ, রাগ সবকিছু মিলেই শেষ হয়ে গেছল একটা অধ্যায়, তিতলির মনেই, যা হয়তো সম্পূর্ণ হতে পারত, হয়তো।

**********

নিঃশব্দে চোখের জলটা মুছে নিল তিতলি, ঐ স্কার্ফটা এখনো সদা সর্বদা ওর সঙ্গেই থাকে। ওর না হওয়া প্রথম ভালোবাসার চিহ্ন, হয়তো একতরফাই। রোহিণীর দিকে তাকাল একবার। ঘুমিইয়ে পড়েছে ওরা সবাই। রোহিণীর সাথে এরপর আর একটি কথাও হয়নি রেহানকে নিয়ে। হয়তো তিতলিই ভুল ছিল, হয়তো ঠিক, জানা নেই। কোনোভাবে ওদের বন্ধুত্বটা টিকে গেছল, কীভাবে কে জানে। রোহিনী এখানে এসেছে ফার্দার স্টাডিজের জন্য। চারপাশটা একবার দেখে ওর স্টাডির চেয়ারটায় গিয়ে বসল ও। রাত তখন প্রায় তিনটে… ও একা |

।।৪।।

-“গুড মর্নিং স্যার।”

-“কি ব্যাপার তানিয়া? মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?”

-“না স্যার, কিছু হয়নি তো।”

-“আর ইউ সিওর?”

-“ইয়েস স্যার, অ্যাম অ্যাবসোলুটলি ফাইন।”

-“ওকে দেন, ফ্রম টুমোরো ইউ আর ইন দ্য নাইট শিফ্ট। ওকে?”

-“উমম।।। ওকে স্যার, নো প্রব্লেম।”

কথা শেষ করে ওয়ার্ডে নিজের কেবিনে চলে গেল তিতলি। কাল রাত থেকেই মনটা অশান্ত হয়ে আছে। কেন তার যে কোন নির্দিষ্ট কারণ আছে এমনও না। আজ চাপ টা কম, কাল থেকে আবার নাইট শিফ্ট। ফোনটা নিয়ে এদিক ওদিক করতে করতে মাকে একটা ফোন করল তিতলি। সাধারণত কাজের সময়ে ফোন করে না ও। আজ তাই ফোন তুলেই মার প্রশ্নবাণ শুরু, “কীরে এখন ফোন করছিস? সব ঠিক আছে তো? শরীর খারাপ হয়নি তো? কিছু হয়নি তো?”

-“মা, আমি কী এমনি ফোন করতে পারি না? এমনি, মনটা খারাপ লাগছিল, মিস করছিলাম। কী করছো?”

মা হচ্ছে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র সেই মানুষটা যাকে যাই বোঝানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, তার চোখকে, কানকে, ষষ্ঠেন্দ্রিয়কে ফাঁকি দেওয়া কারো সাধ্য নেই।

-“গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন?”

-“কিছু না, এমনি, ঠান্ডা লেগেছে একটু।”

-“হুম, গার্গল করিস, তুই নিজেই ডাক্তার, মার কথা কেনই বা শুনবি। আচ্ছা একবার ফোনটা রাখ, আমি হাতের কাজটা সেরে নি।”

ফোনটা রেখে ওর কেবিনের জানলার দিকে গিয়ে দাঁড়ালো ও। বাগানে অজস্র ফুল, এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মনটা অনেকটা হালকা লাগে। যে ভাবনাগুলো ওর মনকে ভারী করে রেখেছে, সেগুলো নিয়ে যে ও আগে ভাবেনি তা নয়। কিন্তু যতবারই ভেবেছে, একটা অন্ধকার গলিতে গিয়ে আটকে গেছে। কোনো সদুত্তর পায়নি ও। রেহান আর ওর মধ্যেকার না হওয়া সম্পর্কের সমীকরণটা ঠিক কতটা জটিল, যে ও সেটার সমাধানই করতে পারল না। সেদিনকার ছেলেমানুষিগুলো যদি ও না করত। যদি সরাসরি রেহানকে জিজ্ঞেস করত, যদি নিজে নিজের মত করে সবটা বুঝে না নিয়ে রেহানকে কিছু বলার সময় আর সুযোগ দিত। একটা অপরাধ বোধ, একটা চূড়ান্ত আফশোসের জীবনভর দংশন থেকে হয়তো মুক্তি পেত। এই কথাগুলো কাউকে বললে সবাই ওকেই পাগল বলবে, উন্মাদ বলবে। কিন্তু ভাললাগা ভালবাসা কবে হলো, কীভাবে হলো, কখন হলো এসবের কী আদৌ কোন উত্তর হয়? সেই বর্ধমানের ছোট্ট মেয়েটা, নাকি সতেরোর স্কুলছাত্রী, নাকি আজকের পরিণত মেয়েটা – কে আদৌ ভালোবেসেছিল রেহানকে, সেটা তো তিতলিও জানে না। শুধু মনে হয়, একটিবার যদি রেহানকে সামনে পেত, একবার যদি কথা বলতে পারত। আদালতে তো আসামীর কাছেও তার শেষ ইচ্ছার কথা জানতে চাওয়া হয়, তাহলে তিতলি কী দোষ করেছিল যে এভাবে ছেড়ে চলে যেতে হলো? ও তো রেহানের এক্সিডেন্টের খবর পেয়েও ছুটে যায়নি, মিথ্যে খবর, মিথ্যে কথা এসব ভেবে যখন টনক নড়ল তখন।।। রেহান কী ওর ওপর রাগ করেই চলে গেছিল? উফফ, এই ছেলেটা কোনদিন ওর মন থেকে, মাথা থেকে কিছুতেই, কোনদিনও বেরবে না । মাথাটা অসহ্য যন্ত্রনা করছে। একটা কফি নিয়ে এল পাশের প্যান্ট্রি থেকে। শরীরটা যেন ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। বাড়ী চলে যাবে? তেমন হলে লাঞ্চের পর বেরিয়ে যাবে। ঘড়ির দিকে দেখল ও, রাউন্ডে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বেরিয়ে গেল তিতলি।

**********

আজ তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে এল তিতলি। কিছু ভাল লাগছে না আর আজ, রোহিনী ওর আগেই ফেরে, আজ ও-ই আগে ফিরে এসেছে। লক খুলে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ও। ওর প্রিয় দোলনাটায় বসল কানে হেডফোনটা গুঁজে। তনু, সাক্ষী, বার তিনেক ফোন করল, হঠাৎ ও বাড়ী চলে গেল কেন জানার জন্য। সব মিটিয়ে চোখ বুজে বসল ও। নিম্নচাপের দরুণ আজ আকাশ মেঘলা। শীতের মধ্যে নিম্নচাপ, বৃষ্টি মিলিয়ে ঠান্ডাটাও বেশ পড়েছে এখন। চোখ বুজে ওর প্রিয় গানটাই শুনছিল ও, তখনই ফোনটা এল। মার এতক্ষণে ফোন করার সময় হলো?

ফোনটা ধরতেই মা বলল, ” আর মনখারাপ করতে হবে না, পরশু পৌঁছচ্ছি। বিকেলের ফ্লাইট।

-“মানে? তোমরা আসছ? সত্যি?”

-“বাবা আসছে না, এখন শুধু মাকে দিয়েই কাজ চালাতে হবে। বাবা এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে। তারপর এখানে নেমে তোকে একটু।।। “

-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোন প্রব্লেম নেই। “

একমুহূর্তের মধ্যেই যেন বুকের মধ্যেকার জমা পাথরটা অনেকটা হালকা লাগছিল তিতলির। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, “আচ্ছা মা, যখন আসবে ঐ পশমিনা শালটাও সঙ্গে এনো, মনে করে।”

-“আচ্ছা বেশ, অনেক গোছগাছ, রাখি এখন।”

-“হ্যাঁ, টাটা।”

জোরে একটা শ্বাস নিল তিতলি, উঠে স্টাডি টেবিল থেকে বের করল নীল খাতাটা, ওর স্ল্যাম বুক সব। বসার ঘরে মেঝেতে ছড়িয়ে বসল সব। অসংখ্য সোনালী মুহূর্তগুলো ভরা আছে এতেই।

**********

মা কাল বিকেলেই আসছে তাই মনটা আজ বেশ খুশী খুশী তিতলির। আজ থেকে নাইট শিফ্ট, ঘড়ি দেখে রেডি হতে শুরু করল তিতলি। স্কার্ফটা আজ পাড়লো, অনেকদিন পর আজ এটা পড়তে খুব ইচ্ছে হলো। কোনদিনও এটা ব্যবহার করেনি ও সেভাবে। কাল কখন ঘুমিয়ে গেছিল, রোহিনী চাবি খুলে ঘরে ঢুকেছে কিছুই বুঝতে পারেনি ও। আচ্ছা রোহিনী যখন ওকে ঘুম থেকে তুলল, ওর হাতের ডায়েরী, রেহানের ছবি, ওর স্মৃতিগুলো সব কী দেখে ফেলল?”

-“কীরে আজ এখন।।।”

রোহিনী বাড়ী ফিরল এই।

-“হ্যাঁ, নাইট শিফ্ট, তোকে বললাম তো কাল।”

-“ও, হ্যাঁ।”

বেশী কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল তিতলি। ওর আবেগ, ওর অনুভূতি যেগুলো এতদিন ধরে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে, সেগুলো বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে বলে কী অস্বস্তিটা হচ্ছে? রোহিনী কী বুঝতে পারল কিছু? আচ্ছা, রোহির সাথে কী।।। ধ্যুর, আবার কী সব ভাবছে ও? ভুলভাল। বাসে উঠে পড়ল তিতলি।

*********

-“গুড ইভিনিং স্যার।”

-“গুড ইভিনিং। তুমি এসে গেছ ভালই হলো আমি থাকতে থাকতে, আজ তো প্রথম নাইট শিফ্ট, বুঝে নিও একটু, আর.এম বুঝিয়ে দেবে সব তোমায়। আমি তাহলে এবার বেরিয়ে যাব। এই হসপিটালে নাইট শিফ্টে থাকলে খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখতে পারবে। এক, এটাকে সেই বোরিং হসপিটাল মনেই হবে না। দুই, চারপাশের বাগানটা দিনের বেলা দেখেছ তো কত সুন্দর, এবার রাত্রের টা দেখবে।”

-“সরি স্যার, মানে, ঠিক।।।”

-“বুঝে যাবে, ডোন্ট ওরি, নিজের কাজটা মাথায় রেখো, আমি বেরোচ্ছি তাহলে। ঐ তো আর.এম এসে গেছে। এই রেহান এদিকে এসো একটু, এর আজ প্রথম নাইট শিফ্ট, একটু রুলস গুলো।।।”

চারদিকটা যেন আবার স্তব্ধ হয়ে গেছে। তিতলির চলার, কথা বলার, দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও যেন কেউ গ্রাস করে নিয়েছে। না চাইতেও চোখ দিয়ে কখন বইতে শুরু করেছে নোনতা জলের ধারা। এভাবে আবার একবার।।। সামনে দাঁড়িয়ে রেহান, ওর রেহান, যাকে ও হারিয়ে ফেলেছে বারবার। না, চিনতে এতটুকু ভুল হয়নি। শৈশব, কৈশোর, যৌবন – রেহানের সেই হাসি, সেই চোখ যে একই আছে। রীতিমত সুপুরুষ, চোখে রিমলেস চশমা, গালে হালকা দাড়ি, টকটকে ফর্সা রংটার জন্য যেন ঈষৎ লালচে আভা মুখের, কানের পাশে। পেশীবহুল শরীরে স্টেথোস্কোপ, এপ্রনে বেশ মানিয়েছে। আর এই সবের থেকেও সুন্দর এখন মুখে সেই সারল্য, চোখে স্বচ্ছতা, গভীর নীল চোখদুটো তিতলির দিকেই চেয়ে, সরাসরি। না, কোনো লুকোচুরি নেই, কোন রাখঢাক নেই। ডঃ রাও বেরিয়ে গেলেন যখন তখন টনক নড়ল তিতলির। রেহানকে কিছু একটা বলতে বলতে এগোলেন। ততক্ষণে তিতলি যেন বাস্তব জগতে এসে পড়ল। গলার কাছে একটা অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। কেমন সেই কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না। কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারছিল না ও। বারবার যেন সেই স্কুলের প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর মনে হচ্ছিল, আর কিছুতেই হারাতে দেবে না। যা হয় হবে, এবার বলেই দেবে। হয় এস্পার নয় ওস্পার। ছুটতে ছুটতে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজাটা লক করল ও। বাইরে মেঘের গর্জন, ঝিরঝির বৃষ্টি, আর বিদ্যুতের ঝলকানি।

এতদিনের পাথর হয়ে জমে থাকা, আত্মগ্লানি, অপরাধ বোধ, ফিরে পাওয়ার তীব্র আকুতি, হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনা, ওর যত্নে লালিত প্রথম প্রেম, ছেড়ে থাকার, না দেখতে পাওয়ার কষ্ট যেন উগরে বেরিয়ে এল গলা থেকে। কান্নায় ভেঙে পড়ল তিতলি, এমন কান্না ও কোনদিন কাঁদেনি।

**********

বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল নিজেকে সামলাতে। কী বলবে রেহানকে ও? কীভাবে এপ্রোচ করবে? আজই বলবে? হ্যাঁ, আজই। নয়তো আবার যদি হারিয়ে যায়। আর যদি দেখা না হয়? ভগবান ওকে বারবার সুযোগ দিচ্ছে, আর এ সুযোগ ও কোনভাবেই হারাতে পারবে না। নিজেকে সামলে, চোখে মুখ মুছে বেরল ও ওয়াশরুম থেকে। কিন্তু রেহান কোথায় গেল? কই নেই তো রুমে। আবার কোথায় গেল ও? ও এই হসপিটালেই নাইট শিফ্টে, ও-ও একজন ডাক্তার! এগুলো ভগবানের ইচ্ছে ছাড়া কী? বারবার এই সুযোগ ও আর হেলায় হারাতে দেবে না। কিন্তু কই কোথাও নেই তো ও। কোথায় গেল? হারিয়ে গেল ও? তন্নতন্ন করে খুঁজছিল এদিক ওদিক। রেহানের কী একবার মনেও হচ্ছে না ওর কথা বলা উচিত তিতলির সাথে? এতটা বদলে গেছে? নাকি তিতলি নিছকই ওর কাছে জাস্ট একটা মেয়ে, আর পাঁচটা মেয়ের মত? তিতলিই ওর জন্য পাগল হয়েছে, ওর কথা ভেবে ও এতগুলো বছর ধরে আর কারো হতে পারেনি, কারো হতে চায়ওনি। সত্যিই তো, পুরোটাই তো তিতলির মনে ছিল, একতরফা, রেহানের দিকটা তো রেহান কোনদিন বলেইনি। তাহলে তিতলির এই অনুভুতিটা রেহানের কাছে পাগলামো, বোকাবোকা ছাড়া আর কী মনে হবে?

যেটুকু সাহস নিয়ে কথা বলতে এসেছিল তিতলি, কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই যেন সবটা উল্টেপাল্টে গেল আবার। 

-“আর কতদিন তিতলি? নাকি তানিয়া? কী বলি বলতো তোকে?”

চমকে উঠল ও। এই গলার সুর ওর অচেনা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বরের গাম্ভীর্য্যও যে বদলে গেছে। আর এই শৈশব, কৈশোর, যৌবনের বদলের সময়গুলোতেই তো একে অপরকে দেখতেই পায়নি। উপস্থিতিটুকু শুধু মনেই ছিল, জোরালোভাবে, তাই।।।

ফিরে তাকালো তিতলি, উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে রেহান। নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়। তিতলির চোখে সরাসরি চোখে রাখতে যার এতটুকু অস্বস্তি নেই।

তিতলি নিজের চোখদুটো মুছে যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারছে কই? চোখের জল বড় অবাধ্য আজ।

-“কেমন আছিস? এখানে? কী বললি বুঝলাম না।”

রেহানের দিকে তাকিয়ে বা খানিক অবনত দৃষ্টি নিয়ে কথাগুলো বলল তিতলি।

-“আমি ভাল আছি, তুই কেমন আছিস, ডঃ তানিয়া সেন, ২০১৯ পাস্ আউট, গাইনোকোলোজি ডিপার্টমেন্ট, এস আর এন মেডিক্যাল কলেজ, রোল ৩?”

তিতলি রেহানের মুখে ওর সম্পর্কিত কথাগুলো শুনে হাঁ করে চেয়েছিল। রেহান, ওর সম্পর্কে সবকিছু।।। মানে এতদিন ধরে।।।

-“তুই এখনও বলবি ‘কী বললি বুঝলাম না’?”তোর কাছ থেকে এটা তো এক্সপেক্টেড নয় তিতলি। গলার স্কার্ফটা এখনো ফেলতে পারিসনি, আমি তোর চোখের সামনে দাঁড়িয়ে,এখনো?”

-“ওহ, তাই তো, তিতলি তো আজই।।। গলার কাছে স্কার্ফটায় হাতটা ছোঁয়াল তিতলি। আর কিচ্ছু বলার নেই ওর। কারো কাছে যেন একটা মুহূর্তের মধ্যে হেরে বসে আছে। নিজের ভালোবাসা, অনুভূতিগুলো একটানে বেআব্রু করে দিয়েছে সেই মানুষটাই, যার জন্য এতদিন ধরে পাগলের মতো একটার পর একটা দিন অতিবাহিত করেছে।

-“আমি তোর সবটা জানি, তুই আমার কতটুকু জানিস? কোনদিন শুনেছিস আমার কথা? বলতে পেরেছি তোকে কিছু? নাকি সেই সুযোগটুকু দিয়েছিস? বল? কী জানিস আমার সম্পর্কে, ক’টা খোঁজ রেখেছিস আমার তুই?”

সত্যিই তো, ও তো রেহানের সম্পর্কে কিছুই জানে না।।। জাস্ট নাথিং।

-“আমার এক্সিডেন্ট-এর খবর শুনে একবার এলি না তুই? এত ভুল বুঝলি কী করে? রোহিনী আমায় না বললে তো আমি কিছুই জানতে পারতাম না।”

তাল কাটলো তিতলির। রোহিনী? আবার রোহিনী? রোহিণীর থেকে সব জেনেছে মানে? রোহিণীর সাথে রেহানের দীর্ঘ এতগুলো বছর যোগাযোগ ছিল তার মানে? রেহান কি রোহিণীর জন্যই আজ এখানে।।।

তিতলির সন্দিহান দৃষ্টি অনুসরণ করেই রেহান বলল, “তুই সেদিনও ভুল করেছিলি, আজও ভুল করছিস, ভুল বুঝছিস। রোহিনী যেমন তোর বন্ধু, তেমনি আমারও খুব ভাল বন্ধু। আজ রোহিনী না থাকলে আমাদের আজ এখানে এভাবে দেখা হতো না।”

কথা বলতে বলতে রেহান তিতলির অনেকটা কাছে চলে এসেছে। এখন রেহানের কথা বলার সময় শব্দর সাথে শ্বাসপ্রশ্বাসগুলোও ছুঁয়ে যাচ্ছে তিতলির অগোছালো চুল, ঠোঁট।

-“মানে?” -তিতলির সামনে যেন একটার একটা পাজ্ল কেউ রেখে দিয়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রেহান। তিতলির চোখের অবিন্যস্ত চুল, তিতলির কানের ঝুমকো, গলায় জড়ানো সেই স্কার্ফ এই সবটুকুর দিকে একবার নিজের দৃষ্টি রাখল রেহান। কী ছিল সেই দৃষ্টিতে জানে না তিতলি, কিন্তু রেহানের তিতলির দিকে এভাবে দেখা, ওর চোখের কোণের কাজল চাপিয়ে ওর চোখ দিয়ে ভিতর অবধি পড়ে ফেলা, কী ছিল সেই পাগল করা দৃষ্টিতে? তিতলি যেন পুরোটাই হেরে গেল রেহানের কাছে। এভাবে হারতেই তো চেয়েছিল, একটা দমকা হাওয়ায়, রেহানের ভালবাসায়।

তিতলির চোখের উপর থেকে চুলটা সযত্নে সরিয়ে দিল রেহান। নাহ, কোই কোথাও তো কোন সঙ্কোচ নেই। তিতলির তাহলে কেন এত সঙ্কোচ…

-“রোহিনী আমার ভীষণ ভাল বন্ধু ছিল আর আগামীদিনেও থাকবে। আর তুই, আমার জন্য কী তা আর কীভাবে বলা যায় সত্যিই জানি না আমি। সেই ছোট্টবেলার বর্ধমানের দস্যি তিতলিকে যেদিন থেকে দেখেছিলাম, সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম নিজেকে যোগ্য করে তুলব, তোর সামনে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। তুই চলে গেলি বর্ধমান থেকে কলকাতা। ইচ্ছে থাকলেই খোঁজ রাখা যায়, যার খোঁজ তুই রাখতে চাস, তোর পিছু করতে করতে স্কুলে এডমিশন নিলাম। একটু দেরী হয়ে গেছিল আসতে, বাবাকে বুঝিয়ে, অভাবের সাথে লড়াই করে। সব ঠিকই চলছিল, তারপরই এক্সিডেন্ট। বাবা আর কিছুতেই কলকাতায় একা রাখতে রাজী ছিল না। তুইও একবার এলি না দেখা করতে। ভাবলাম, আমিই কী তাহলে ভুল ছিলাম? খুব রাগ হয়েছিল, ভীষণ অভিমান। বাবার কথা মেনে নিয়ে ছেড়ে দিলাম পিজি। ডাক্তারীতে চান্স পেলাম, দিল্লীতে এডমিশন নিলাম। আর স্কুল ছাড়ার পর থেকেই রোহিণীর সাথে যোগাযোগ ছিলই। ও-ই তোর খবর আমার কাছে পৌঁছে দিত। ওর মুখ থেকে শুনেই নিজেকে শান্ত রাখতাম। একদিন যোগ্য হয়ে তোর সামনে এসে দাঁড়াবো, নিজের উপর এটুকু বিশ্বাস ছিল। রোহিনী আমায় সব বলেছে, সব। তোর রোহিনীকে নিয়ে সন্দেহ রোহিনী কী জানত না? ও সব জানতো, আমিই ওকে ভুলটা শুধরাতে মানা করেছিলাম। আমি জানতাম তুই একদিন ঠিক বুঝবি। তোর পিছু পিছু দ্যাখ, এখানেও চলে এলাম, তোর সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলব বলে। তোর নীল খাতার ঐ সাদাকালো ছবির ছেলেটার থেকে বেরিয়ে,নিজের অপটু হাতে তৈরি তোকে দেওয়া পশমিনা সালের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে তোর সামনে দাঁড়াবো বলে। তোর সাথে… তোকে… জানি না আর কী বলতে হয়, কতটা বললে, কীভাবে বোঝালে তুই আমার ভিতরটা …”

কথা বলতে বলতে বড্ড কাছে এসে গেছিল রেহান তিতলির, অনেকটা কাছে, তিতলি ঠিক যতটা কাছে চেয়েছিল এতদিন, ততটাই।

-“আমার এর থেকে বেশী কিছু বলার, করার, বোঝানোর ক্ষমতা নেই তিতলি।”

তিতলির ভীষণ কাছ থেকে চোখে চোখে রাখল রেহান তিতলির চোখে। তিতলিও একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সেই চোখের দিকেই। বাইরে হঠাৎই বাজ পড়ল। কখন যে একপশলা বৃষ্টি হয়ে চারিপাশটা আর্দ্র, বুঝতেই পারেনি ওরা দুজন। নিজেকে সরিয়ে নিল রেহান, তিতলির সামনে থেকে এক ঝটকায়। তিতলি রেহানের হাতটা ধরতে গেল। পারল না, বেরিয়ে গেল রেহান। নিজের চোখ মুখটা মুছল তিতলি। আর মনে মনে আজ নিজের সবথেকে সুন্দর মুহূর্তটাকে পেয়ে যাওয়ার অনাবিল আনন্দটা উপভোগ করছিল। সবটা শেষ হয়ে যায়নি , বরং সবটা হারানোর আগেই ফিরে পেয়েছে ও। দুটো মানুষকে সরি বলতে হবে আগে।

**********

ডঃ রাও ঠিকই বলেছিলেন, এই হসপিটালে নাইট শিফ্টে কাজ করা একটা অন্যরকম প্রাপ্তি। পুরো বাগানটা আলোর মালায় সেজে উঠেছে রাত্রে, রোগীদের ঘুমের অসুবিধা না করেই। আর রোগীদের ঘুমোনোর আগে খুব ধীরে কোনও না কোনও মিউজিক বাজে। খুব মিষ্টি, শান্ত, স্নিগ্ধ, মন ভালো করা পরিবেশ। এটাই এখানকার বিশেষত্ব। রোগীরা যে যেমন পারে, বাগানে বসেও, নির্দিষ্ট নিয়মবিধি মেনে। অর্ধেক রোগ, জরা, ক্লান্তির ওখানেই অবসান।

বাগানে গিয়ে দাঁড়ালো তিতলি। রোগীরা ঘুমিয়ে পড়েছে। রেহান বাগানেই দাঁড়িয়ে ঐ দিকটায়। কতটা সময় নষ্ট হয়ে গেল। বড্ড দেরী হয়ে গেল, এটাই ভাবছিল তিতলি। এক ছুটে গিয়ে ইচ্ছে করছিল রেহানকে জড়িয়ে ধরতে। বাইরে বেশ ঠান্ডা হাওয়াটা, স্কার্ফটা আরেকটু ভাল করে জড়িয়ে নিল গলায়। আবার ওদিকে ফিরে তাকাতে আর দেখতে পেল না রেহানকে। কোথায় গেল, ওর চোখ যখন খুঁজছিল মানুষটাকে তখনই কানে এল রূপঙ্করের গানটা। এটা তো ওর খুব প্রিয় গান। কে গাইছে? এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল রেহান, গাইছে, চোখে বড় অচেনা সেই দৃষ্টি, যা তিতলি দেখতে চেয়েছিল এতদিন, যার অপেক্ষা করেছে এতদিন, যে দৃষ্টি ভাসিয়ে নিয়ে যায় প্রেমে, যে দৃষ্টিতে ডুবতে ইচ্ছে করে, সেই পাগল করা দৃষ্টি নিয়েই তাকিয়ে রেহান ওর দিকে, আর বাইরে মাতাল হাওয়া।।।

“কতবার তোর বাড়ী গিয়ে ফিরে, ফিরে এলাম…

আমার মতে তোর মতন কেউ নেই|

কতবার তোর জানলা দিয়ে গলে হলুদ খাম…

আমার মতে তোর মতন কেউ নেই।”

-“আর কত পিছু করতে হবে তোর? সেই ছোট থেকে।।।”

কথা শেষ হলো না রেহানের। সমস্ত সংশয়, দ্বিধা, লজ্জার আগল ভেঙে একলহমায় রেহানকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে নিল তিতলি, হাজার হাজার আলো আর তারাকে সাক্ষী রেখে। রেহানের বুকে মাথা রাখল তিতলি, একটা জোরে শ্বাস নিল রেহানও।

-“আমি তো বলেছিলাম শুধু নিজের ভালবাসার সামনেই গাইব গান, আজ গাইলাম।।। আর কিছু?”

কিছু বলল না তিতলি, মনে মনে শুধু ভাবল, অনেক করেছিস, তুই আর রোহিনী এই সম্পর্কটার জন্য। এবার আবার পালা, আমি বেঁচে থাকতে আর কোন কষ্ট পেতে দেব না তোকে। প্রমিস।আর জোরে রেহানকে জড়িয়ে ধরে নিজের উত্তরটুকু বুঝিয়ে দিল তিতলি। রেহানের বাহুডোরে আবদ্ধ হলো নিজেও। রাত শেষে ততক্ষণে ভোর হচ্ছে।

— **********—

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন

।।১।। উফফ, আমার কানের নীল ঝুমকোটা কোথায় রাখলে মা, খুঁজেই পাচ্ছি না, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।”- তাড়াহুড়োয় মা কে হাঁক দিলাম, ওদিকে লিপস্টিকের শেড আর

Read More »

বেনামী (শেষ অংশ)

।।৩।। ভাইজাগ শহরটা বেশ সুন্দর, পরিপাটি, সাজানো, একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম রামকৃষ্ণপুরমে। বাবা মা আমার সাথে এসে সবটা সাজিয়ে দিয়ে গেছল। জয়েনিং-এর প্রথম দিন স্বভাবতই

Read More »

বেনামী (প্রথম অংশ)

-“মুন তোকে কতবার ঠিক বলতে হবে, ব্যাগটা গোছাচ্ছি, আর কী কী নিবি তুই দেখে নিবি আয় ।” মা-এর গলা খাঁকারিতে নড়ে চড়ে বসলাম একটু, হাতের

Read More »

রাঙিয়ে দিয়ে যাও

।।১।। -“জবা, ছাদে জামা-কাপড়গুলো শুকলো কিনা দ্যাখ তো একবার, আর বড়িগুলোও দেখে আসিস ।” বিক্রমপুরে এলে বল্লভ বাড়ি চেনে না, এমন মানুষ খুব কমই আছেন

Read More »

Share with