।।৩।।
ভাইজাগ শহরটা বেশ সুন্দর, পরিপাটি, সাজানো, একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম রামকৃষ্ণপুরমে। বাবা মা আমার সাথে এসে সবটা সাজিয়ে দিয়ে গেছল। জয়েনিং-এর প্রথম দিন স্বভাবতই নার্ভাস। এইচ আর থেকে ফর্মালিটিজ-এর জন্য যে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল, সে আর কেউ না, রুদ্র। একমুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল আমার মনটা, সেই চেনা, পরিচিত মানুষটা আজ এতগুলো বছর পর আমার সামনে। আবার, সেই চোখ, সেই হাসি, সেই ব্যাকব্রাশ করা চুল, মিঃ হ্যান্ডসাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার আশপাশটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছল, সময়টা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেছল সেই জায়গায় যেখানে কিশোরী মুন প্রেমের প্রথম স্বাদ পেয়েছিল এই মানুষটার দিকে তাকিয়েই…
(প্রথম অংশের পর)
**********
নতুন শহর, নতুন কাজের জায়গা, আর সেখানে এভাবে রুদ্রকে পাওয়া সর্বোপরি পরিচিত কাউকে পাওয়া – বন্ধুত্বটা আবার জমে উঠছিল ওর আর আমার মধ্যে। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, নিজের জগৎ ছেড়ে এত দূরে রুদ্র আবার এই নতুন জগতে আমার অজান্তেই কীভাবে যেন ঢুকে পড়ছিল, আবার পুরোনো ভাল লাগায় ভাসতে শুরু করেছিলাম একটু একটু করে। না, রুদ্রর সাথে so called relationship বা সম্পর্ক, সেসব কিছুই কোনদিন ছিল না আমার, তাও। আর নিজেও নতুন একটা জগতে গিয়ে মানিয়ে, গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় নিজের জন্য প্রয়োজন ছিল অর্চিরও, আমারও তাই, অর্চির ছবিটা যেন একটু একটু করে আবছা হচ্ছিল। দূরত্বটা আমার মনটাকে ছুঁয়ে ফেলেছিল কখন বুঝতেই পারিনি, তখন আমি ব্যস্ত ছিলাম রুদ্র সাথে আড্ডা, ইয়ার্কি-ঠাট্টায়।
************
ভাইজাগে মাস কয়েক দিব্যি কাটিয়ে ফেলেছিলাম, তখনই মা জানালো – দুই বাড়িরই ইচ্ছে অর্চি আর আমার বিয়েটা এবার তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার। মিথ্যে বলবো না, এক মুহূর্তের জন্য হলেও হোঁচট খেয়েছিলাম। যে আমি অর্চির সাথে সংসার সাজানোর স্বপ্ন দেখতাম পাগলের মতো, সেই আমি-ই দোনামোনা করছিলাম, আর এরকমই একটা সময়ে, রুদ্র, হ্যাঁ, রুদ্র আমায় প্রপোজ করে, একেবারে বিয়ের জন্য প্রপোজ।
আমার জীবনের প্রথম পুরুষ, যাকে ঘিরে একটা কিশোরী প্রথম স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল, যাকে কোনদিন নিজের মনের কথা বলতে পারেনি, সেই মানুষটাই আজ সামনে দাঁড়িয়ে, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। হ্যাঁ, একমুহূর্তের জন্য সব ভুলে গেছিলাম, ভেসে গেছি আমি আবেগে, আমার প্রথম প্রেম আমার সেই কোন ছোটবেলার রাতজাগা স্বপ্নগুলো আজ চায় তার ভালবাসায় আমায় বাঁধতে। ভাসতাম না তো কী করতাম, এই প্রেমের প্লাবনে? আমি তো রুদ্রকেই চেয়েছিলাম, সেই কবে থেকে, বরাবর। আজ যদি রুদ্র না যেত বাইরে পড়তে, তাহলে তো অর্চি আমার জীবনেই আসতো না। ব্যস, ঠিক এই মুহূর্তটাতেই ধাক্কা লেগেছিল সমস্ত ভাবনায়। অর্চি, অর্চির কী হবে? ওকে কী বলবো? বাড়িতে কী বলবো আমি? গুলিয়ে যাচ্ছিল আবার সবকিছু, মনে হচ্ছিল সাজানো ঘরটা অগোছালো হচ্ছে, আবার মনে হচ্ছে সাজানো ছিলই কবে, অগোছালোই তো ছিল। পারছিলাম না আর ভাবতে আমি। ফায়ার এসেছিলাম সেদিন, উত্তর দিতে খানিকটা সময় চেয়ে নিয়েছিলাম রুদ্রর থেকে।
।।৪।।
অনেক ভাবনা চিন্তার পর অবশেষে রুদ্রকেই হ্যাঁ বলব ঠিক করলাম। নিজের প্রথম ভালবাসাকে কবর চাপা দেওয়াটা কী এতই সোজা? না, আমিও তাই পারিনি। রুদ্র সাথে একটা কফিশপে দেখা করলাম, সামনে সামনিই কথাটা বলা ভাল ভেবে আর বলিনি কিছু ফোনে। অপেক্ষা করছিলাম কফিশপটায়, ওর আস্তে খানিক দেরী হয়েছিল। রুদ্রর জন্য অপেক্ষা করতে কোন প্রব্লেম নেই আমার, জানলার বাইরে তাকিয়েছিলাম। সবাইকে কীভাবে এরপর ফেস করব, এসবই ভাবছিলাম। অর্চিকে আমি এখনও অবধি একটা কথাও বলতে পারিনি। কীভাবে ওকে বলব, কীভাবে ফেস করব, কিছুই জানি না, এসব অগোছালো ভাবনার মাঝেই আমার মোবাইলটা বেজে ওঠে, অর্চির ভিডিও কল। ওতো এখন আর সচরাচর ভিডিও কল করে না, আমিও করি না, আর এই সময়ে! বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত। আমার কী অর্চিকে সবটা জানিয়ে দেওয়া উচিত? অর্চিকে তো আমি ঠকাচ্ছি, এটা কী আমি ঠিক করছি? আর পাঁচটা চিটারের সাথে তাহলে তফাৎটা কী? রুদ্র তো অর্চির কথা জানত, তবু আমায় প্রপোজ করে। কিন্তু অর্চি তো পুরোপুরি অন্ধকারে।। এতদিনের সম্পর্কে অন্তত এইটুকু সততা, এইটুকু বিশ্বাস তো ওর প্রাপ্য অন্তত। ভাবনায় দাঁড়ি দিলাম। আমি অর্চিকে এক্ষুনিবলব। আর কোনো ভূমি নয়, বলতেই হবে, এভাবে আমি অর্চিকে ঠকাতে পারি না, ভিডিও কলটা রিসিভ করলাম। আর প্রথমেই হোঁচট খেলাম, অর্চির হাতে প্লাস্টার, মাথাতেও অল্প ছোট, মুখে অবশ্যই সেই হাসিটাই, অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, “কী হয়েছে তোর? এরকম অবস্থা কী করে? কই কিছু বলিসনি তো।”
ততোধিক অবাক করে ও উত্তর দেয়, আমায় সারপ্রাইজ দিতে দিল্লী থেকে ভাইজাগ আসছিল, এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে অ্যাকসিডেন্ট। হাতে চিড়, মাথায় অল্প ছোট, তেমন কিছু না, কিন্তু ওর মনটা খুব খারাপ, কারণ,এই প্রথমবার ও আমার সাথে আমাদের love anniversary তে থাকতে পারল না।…। হ্যাঁ, ঠিক ২৫শে জুন, আজকের এই তারিখটাতেই তো, আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে অর্চির মুখে সেই হাসিটা দেখেছিলাম, আমার হ্যাঁ বলার পর। আজ ওর এতটা যন্ত্রণার পরও আমায় হাসিমুখে যখন ভিডিও কল করছিল, তখন জানি না আমার কী হলো। আমি ওর হাসির দিকে, ওর চোখের দিকে অনেকদিন পর এভাবে তাকালাম, আর তাকাতেই দেখলাম ওর হাসির আড়ালে ওর চোখের কোণের জলটা। যতই চেষ্টা করুক, পারেনি সেটা লোকাতে।
আমার চিন্তা ভাবনা, আমার চারপাশের গোটা পৃথিবীটা একলহমায় ঘুরে গেছল। একটা তীব্র টান অনুভব করছিলাম, অসম্ভব তীব্র। অনেকদিনপর, ওর চোখের কোণের লুকিয়ে থাকা কষ্ট, ওর মেকী হাসি সবটুকু আমার সামনে সবটা পরিষ্কার করে দিয়েছিল এক নিমেষে। এই টানের তীব্রতা, রুদ্রর প্রতি আমার আকর্ষণের থেকে বহু বহু বহু গুন বেশি। আমি তখন অনুভব করেছিলাম, রুদ্র আমার জীবনের প্রথম পুরুষ হতে পারে, হতে পারে আমার প্রথম পছন্দ, আমার স্বপ্নের রাজপুত্র হতে পারে, কিন্তু আমার জীবনের সব থেকে বড় সত্যি অর্চি, এটা আমি বুঝে গেছিলাম। কী করতে যাচ্ছিলাম আমি, এই মানুষটাকে কষ্ট দিতে যাচ্ছিলাম, অর্চিকে? যার মুখের মিষ্টি হাসিকে উজ্জ্বল রাখতে চেয়েছি আমি সবদিন, সেই অর্চিকে ভুলতে বসেছিলাম, ভালবেসে প্রথম যার কাঁধে নিশ্চিন্তে মাথা রেখেছিলাম, আজ তার জীবনটাই অনিশ্চিত করে দিতে যাচ্ছিলাম আমি। ‘আজকের দিনটা’র কথা অবধি মনে ছিল না আমার।
রুদ্রকে না বলতে আর দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি আমায়, এতটাই সিওর ছিলাম আমি আমার ডিসিশনটায়। ইনফ্যাক্ট, এতটা সিওর আমি আগে বোধ হয় আগে কখনো ছিলাম না।
রুদ্র আমার সামনে আর কোনদিন আসেনি, কোনদিন না। ওর আঘাত লেগেছিল জানি, রুদ্রকে আঘাত করার ক্ষমতা আমার ছিল, কিন্তু, অর্চিকে…। আজ আবার একটা ২৫ শে জুন, আজ অর্চি আমার বাড়ির দরজায়, বরবেশে। মা-এর হাতে বরণের থালা, চারিদিকে উলুধ্বনি, সানাই, আলোর মাঝে আমি আজ লাল বেনারসীতে।
রুদ্র-র প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, ও না আসলে আমি বোধ হয় বুঝতেই পারতাম না আসলেই আমি অর্চিকে ঠিক কতটা ভালবাসি। অর্চির মুখের হাসিটুকু দেখলেই আমার মনটা শান্তি পায়।
আর অর্চি? আজ ভীষণ খুশি ও, শুভদৃষ্টির আগেই ঠিক লুকিয়ে দেখে নিয়েছে ওর মুনকে। এটা যদি প্রেম না হয়, তাহলে আর কী?একটা বেনামী সম্পর্কের জন্য আমি আমার আসল সম্পর্কটার কদর বুঝেছিলাম। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে মুগধ হতাম, কিন্তু অর্চির মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি পাই। অর্চি কিছুই জানে না, কিচ্ছু না। হয়তো কোনদিন বলব, হয়তো বা না। কী যায় আসে? ভালবাসায় কিছু গোপন রাখতে নেই, এসব যারা বলে, তারা ভুল বলে, কিছু কথা না বলা থাকলেই ভালো। অর্চিকে ভালবেসে ভালো থাকতে চাই দুজন একসাথে, আজীবন। এর থেকে বড় সত্যি আর কী হতে পারে, আপনাদের শুভ কামনা আর আশীর্বাদের অপেক্ষায় রইলাম।