।।১।।
উফফ, আমার কানের নীল ঝুমকোটা কোথায় রাখলে মা, খুঁজেই পাচ্ছি না, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।”- তাড়াহুড়োয় মা কে হাঁক দিলাম, ওদিকে লিপস্টিকের শেড আর ছোট না বড় ব্যাগের ধাঁধায় তখনও উদ্ধার পাইনি আমি। আর দেরী করলে এবার আর পৌঁছতে পারব না পাঁচটায়। ইসস, হাতের ঘড়িটা এখনও পরিনি।
“ও মা…”
*************
আমি, শাওন, শাওন মুখার্জী, আপাতত লেকটাউনে নিজেদের ফ্ল্যাটে আমি মোটামুটি দাপাদাপি করছি। বিক্রম একদম লেট পছন্দ করে না, আর আজ এতদিন পর, আজ আমি লেট করতে ও চাই না, সুতরাং….
*************
গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবীতে আজ তোমায় একটু বেশীই হ্যান্ডসাম লাগছে। আর আমার দেওয়া রিস্ট ওয়াচটা, ওটা পরে দিব্যি মানিয়েছে। বিক্রমের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের এই বিকেলের কিছুটা সময় সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো খুব খুব মিষ্টি। কলেজে থাকতে একসাথে ফুচকা খাওয়া, সিনেমা দেখা, এই সবকিছুরই সাক্ষী এই সোনালী বিকেলগুলো। মন খারাপের মেঘলা দিন হোক, বা বৃষ্টিভেজা সবুজ, তোর প্রথম চুমু বা প্রথম আমাদের কাছে আসা, সবটুকু জুড়ে এই বিকেলটা। আজও তাই, তবে, আজ আমার যত্ন করে সাজার কারণটাও বড় বিশেষ। চাকরি সূত্রে দূরে যাওয়ার পর এই প্রথম বাড়ি এসেছে বিক্রম, আর আমাদের দেখা করার সাথে সাথে দুটো পরিবার ও বসবে একসাথে। তাই সব মিলিয়ে মনটা বড্ড বড্ড খুশী।
।।২।।
দূরে চলে যাওয়ার পর রাত্রে ফোনের কথাটুকুই ভরসা। বেশ কয়েক মাস পর আজ তুই আমার কাছেই আছিস, এই তিলোত্তমা-তেই, জানি হাত বাড়ালেই পাবো তোকে।
বিক্রমের সাথে ফোনে গল্প করতে করতেই শুনছিলাম মা বাবার টুকরো কথাগুলো। মা-র আমার বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন, আমি কী রঙের বেনারসী পরবো, আমার গলার হারের ডিজাইনটা, আমার তত্ত্বের শাড়ী কোন দোকান থেকে কেনা হবে, সব আমার মায়ের ভাবা হয়ে গেছে।
-“বিক্রম তো ভাল ছেলে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর বাড়ির সাথে তো এখনও পরিচয়ই হয়নি, অত বড় লোক, সব ঠিকঠাক হবে তো?”
-“আরে তুমি বৃথাই এত চিন্তা করছ, আমাদের মেয়ে কী ফেলনা নাকী? কত বড় চাকরি করে ও। বিক্রমের থেকে কম কীসে?”
মা আশ্বস্ত করছিল বাবাকে। বিক্রমের ফোনটা রেখে আমার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিটায় দাঁড়ালাম গিয়ে। সত্যিই তো, বিক্রমের বাবা মার সাথে আজ এতগুলো বছরে কোনদিন সামনা সামনি পরিচয় হয়নি আমারও, সব ঠিকঠাক ভাবে হবে তো? মা-র ডাকে খেতে গেলাম। কিন্তু মনটা সেই দোলাচলেই রইল। রাত্রে, বিক্রমকে গুড নাইট করে জানলা দিয়ে আকাশটার দিকেই চেয়েছিলাম। আমার মা বাবা, আমার ভালোবাসা, আমার ভালোলাগার এই ছোট্ট জগৎটা আসতে আসতে পালটাতে চলেছে। ওরা তো অনেক বড়লোক, আমার এই সাধারণ ঘরটাই আমার কাছে খুব দামী, ঘরে দামী কার্পেট নেই, দামী ফুলদামি নেই, কিন্তু ছিমছাম সাধারণ এই সাজানো ঘরটা দেখে ওরা সব ঠিক ভাবে মেনে নেবে তো?
অজানা এক আশঙ্কায় বারবার মনটা উচাটন হচ্ছিল, কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না মনটা। আকাশের রাতজাগা তারাগুলোও ছিল আমার সাথে, সামনের অজানা পথটা কেমন, কে জানে?
।।৩।।
-“আচ্ছা, তুই আজ কী রঙের শাড়ী পরবি?”
-“কেন? তোর কী?”
-“না, মার তো কমলা রঙ খুব প্রিয়, পারলে কমলা পরিস, মা-র ভাল লাগবে।”
-“ইসস, কমলা আমার একদম পছন্দ না, তুই জানিস না সেটা?”
-“জানি, কিন্তু আজকের দিনটা পর না…”
-“আচ্ছা, বাবা, ঠিক আছে, উফফ। তুই আসবি তো?”
-“হুম, দেখতে আসতে হবে না, খেঁদী, পেঁচী, কাকে বিয়ে করব, দেখতে হবে তো।”
-“বাঁদর, ভাগ এখন থেকে।”
খুনসুটি মাখা সেই কলেজ প্রেমটা বড্ড সজীব আমাদের মাঝে, আজও। এতদিন শুধু তোর জন্য সেজেছি, আজ তোর পরিবারের জন্য। নাহ, কমলা আমার পছন্দ না, একদম, তবে…। আপত্তি নেই আমার। তোর জন্যই তো, ব্যস। হ্যাঁ রে, সব ঠিক ভাবে হয়ে যাবে তো?
*************
বিক্রম, বিক্রমের মা, বাবা, কাকী, পিসি, পিসে এদের সবার জন্য আমাদের ফ্ল্যাটের ঘরটা বোধ হয় একটু ছোট হয়ে গেছে। ওর মা, কাকীর মুখের বিরক্তিটা হাসিকে চাপিয়ে যেন বেশী প্রকট, আর সেটা আমার চোখ এড়াচ্ছিলো না। আশঙ্কাটা ছিলই, কেমন যেন তীব্র হচ্ছিল ঝড়টা। প্রথম দিনেই আমার চাকরি, আমার বাবা কী দেবেন না দেবেন, ওনাদের কী কী ইচ্ছা এসব নিয়ে অনেকগুলো কথা উঠে গেল।
বোধহয় কালবৈশাখী, আকাশটা ঘন কালো। আমার মনেও আঁধার নামছিল, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। বিক্রমের দিকে তাকাচ্ছিলাম বারবার। ও বারবার আমায় ইশারায় চুপ করতে বলছিল, যেন, এখন চুপ থাক, সব ঠিক সামলে নেব। আমার মা বাবা অপ্রস্তুত হচ্ছে চোখের সামনে, মেয়ে হয়ে কীভাবে মানবো? বিক্রম বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু বিশেষ লাভ হচ্ছিল না।
*************
বিক্রমের বাড়ির লোক চলে গেছে অনেক ক্ষণ। কেমন যেন সবটা গুলিয়ে যাচ্ছে, মনটা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, খেই হারিয়ে ফেলেছি সবটার। আজ বাবার চোখ দুটোর দিকে দেখছিলাম বারবার। আর তাই, জানি, বাবার মনের কথা।
বিক্রমের বাড়ির লোক কত অবলীলায় বলে দিলেন আমি তাহলে যেন এবার চাকরীটা ছেড়ে দি। ভুলে গেলেন, আমিও তো আমার মা বাবার একমাত্র অবলম্বন, আমারও তো দায়িত্ব আছে মানুষ দুটোর প্রতি। অথচ, একটু এডজাস্ট করলেই আমরা দুজনেই পারি সবটা সামলাতে। বিক্রম, তুই কতক্ষন চুপ থাকবি? তোর কী কিছু বলার নেই?
ক’দিনের মধ্যেই ডেট ফিক্স করে জানাবে ওরা।
বারান্দার মানিপ্ল্যান্টটা বাইরের প্রবল ঝড়ে কাঁপছে। বন্ধ জানলার কাঁচে তার আবছায়া, কাঁচ বেয়ে নামছে বৃষ্টির ধারা, আলোর ঝলকানি, বড় দুর্যোগ চলছে বাইরে। তার সাথে আমার মনেও।
-“এখনই এতো ডিমান্ড? এরপর কী হবে বলোতো।”
ড্রয়িং রুমে বসা মানুষ দুটোর কথা কানে আসছিল টুকরো টুকরো। যথারীতি আমার নিজেকে দেওয়ার মতোও কোন উত্তর ছিল না। বিক্রম বারবার আমায় চুপ থাকতে বলছে, কিন্তু, আমার চোখের সামনে আমার মা বাবার মাথা হেঁট আমি কিছুতেই হতে দিতে পারি না। সামনে সামনি একবার কথা হলে কী সব মিটবে? কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সামনের রাস্তাটা বড় অনিশ্চিত যেন, কেমন যেন অন্ধকার ঠেকছিল। কই আগে কখনো তো এমন হয়নি। চোখের পাতায় ঘুমপরী পালক বোলালেও দুশ্চিন্তা আমার পিছু ছাড়ছিল না।
।।৪।।
“তুই এত চাপ নিচ্ছিস কেন? দ্যাখ, মা তো তোকে প্রথম দেখল, এরকম হতেই পারে, এতও ভাবিস না। মা-র তোকে খারাপ লাগেনি।”
“বলছিস? কিন্তু তুই তো অন্তত সবটা জানিস…”
“দ্যাখ, এখন যেমন যে যা বলছে, বলতে দে, পরে আমি ঠিক ম্যানেজ করে দেব। মা-এর সামনে একটু মা-র মতো করেই থাক না।”
*************
আমরা এক হবো, এটা ভেবে আনন্দের থেকেও চিন্তাগুলো মনে উঁকি দিচ্ছিল বড্ড বেশী। বারবার ওর মা বাবার তোলা কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন, আমার জীবন যাত্রা নিয়ে করা অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য, বিয়ের পর আমার চাকরি, আমার পোশাক নির্বাচন সবকিছুতেই যখন প্রশ্ন চিন্হটা বসতে লাগল, মানতে পারছিলাম না কিছুতেই। এর মধ্যে বার দুয়েক দেখাও হয়েছে, কিন্তু আমার আর কোন পজিটিভ ভাইব অনুভূত হয়নি। মা বাবাকে কিছু বলার মতো মুখটাও যেন নেই, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। কিন্তু, সেদিনকার কথাটা…
হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল সবটা।
**************
-“আমার মা বাবার পক্ষে এত ডিমান্ড ফুলফিল করা সম্ভব না বিক্রম, তোর মাকে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব তো তোর।”
-“আমি মাকে বোঝাব, তুই জানিস মা একটু অন্যরকম, প্লিজ, একটু বোঝ।”
-“না বিক্রম, আজ আমার চোখের সামনে আমারই বাবা মার দুর্বল জায়গাটা বারবার খোঁচাচ্ছিলেন তোর মা। আমার বাবার মাথাটা হেঁট হয়ে যাচ্ছিল, আর আমি সেটা মেনে নেব? গয়না, খাট, আলমারি, সোফা, টেবিল, প্রণামী শাড়ী, তত্ত্ব, শেষ আছে লিস্টের? আর আমার মা বাবা আমায় পড়াশোনা শেখানোর পর উনি চান বলে আমায় আমার চাকরিটাও ছেড়ে দিতে হবে, কেন বিক্রম?
সমস্ত দেওয়ার দায়, ছাড়ার দায়, স্যাক্রিফাইস করার দায়িত্ব আমার ওপরই কেন? আর এখনও বলবি তুই চুপ কর।
আজ যা হলো, তাতে আর কোনদিনও দুটো পরিবারের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক হবে কী? আর ‘এখনকার দিনের মেয়ে, কেমন হবে…।” এসব কথাগুলোর কী মানে বিক্রম? আর নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের অপমান করতে পারছি না আমি, এতকিছুর পর আর যাই হোক, কোন সম্পর্ক তৈরী করা যায় না।”
*************
বিক্রম আটকানোর অনেক চেষ্টা করলেও চলে এলাম আমি। আজ মা বাবার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছিল, মানুষ দুটো আমার জন্য আর কত সহ্য করবে? কেনই বা সহ্য করবে? ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট সময় পেরোলেও বিক্রম আর ফোন করেনি।
মা বাবার অনেক আপত্তি সত্ত্বেও ফোনটা আমি করেই দিলাম, বিক্রমের বাড়িতে। এই বিয়ে আর সম্ভব না। তারপর বিক্রম এখনও অব্দি আর ফোন করেনি, আজ নিজের মাথাটা পুরো হেঁট। বাবা প্রথমে রাজী না থাকলেও রাজী করিয়েছিলাম এটা বলেই, ‘ভাল ছেলে, ভাল পরিবার, ভাল শিক্ষা’।
************
নিজের উপর নিজেই হাসছিলাম। এরপর আর আমার কিছু কখনো বলার মুখই নেই। ঘরে একটা নাইট বাল্ব জ্বলছে শুধু, কেউ নেই আর ধারে কাছে, কত রাত জানি না।
পাড়ার ভুলোটা ডাকছে নিজের মনে, আমি ব্যালকনিটায় গিয়ে রাস্তাটার দিকে তাকালাম – শুনশান ফাঁকা, স্ট্রীটল্যাম্পের হলুদ আলোয় আর আঁধারে মিলেমিশে যেন আরও খানিকটা রহস্যময়ী, মোহময়ী। এই রাস্তাটা ধরেই বিক্রম কতবার ছেড়ে দিয়ে গেছে আমায়, কলেজ থেকে ফেরার সময়। কত ঝাল মুড়ি খেয়েছি সামনের ফুটটা থেকে। আচ্ছা, ওর দেওয়া ওই দুলটা আছে? যেটা আগের বার পুজোয় অষ্টমীতে পড়লাম। আচ্ছা, আমরা দুজনে মিলে কত স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম একসাথে সংসার করার। কী হবে ওগুলোর ? ওগুলোও তবে রান্নাবাটির খেলা খেলা সংসার ছিল! আচ্ছা আমাদের মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিলাম যে, সেটার কী হবে? তোর পাঞ্জাবীর সাথে ম্যাচিং আমার শাড়ীর রঙ, আমাদের স্বপ্ন সব যে শেষ হয়ে গেল রে দেওয়ার নেওয়ার হিসেবে করতে গিয়ে। এমন হিসেবে কষলো যে এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল? চোখের জলটা বহুক্ষণ চোখের সীমানা পেরোতে পারেনি, কিন্তু এবার আর ধরে রাখতে পারলাম না, নিজের সবটুক উজাড় করে ভেঙে পড়লাম কান্নায়।
আজ যখন সবটুকু শেষ, তখন কী একবারও থমকে দাঁড়াসনি তুই? একবারও ডায়েরীর পাতায় লুকোনো আমার দেওয়া গোলাপের শুকনো গন্ধটা তোকে টানেনি? একবারও মনে পড়ছে না, আমাদের একসাথে চলার দিনগুলো?
আজ আমাদের একসাথে স্বপ্ন দেখার শেষ তবে? আচ্ছা, পারতিস না কী তুই আটকাতে? কিন্তু, কেন আটকালি না, আমার পাশে আমার হয়ে একবারও তো এলি না।
**************
আমি মা বাবাকে কী উত্তর দেব জানি না? কিছু বলার মতো মুখ আর নেই যে। সব মা বাবার মতো আমার মা বাবাও যে চায় মেয়ে এবার থিতু হোক। সংসারটা হোক মেয়েটার।
জানিস, আমি প্রাণপনে চাইছি ‘না’ বলতেই, এ কী ভাবে সম্ভব? কিন্তু, কোন উত্তর দিতে পারছি কই? মা বাবার চোখ মুখে এতটুকু হাসি নেই ঘটনাটার পর থেকে। আজ মা কতগুলো পাত্রের ছবি দিয়ে গেছে, এটাই বোধ হয় বাকী ছিল শেষ পর্যন্ত। কী করব আমি?
নিজের মনের মাঝে আঁকা ছবিটা যে আষ্টেপৃষ্টে শিকড় গেড়ে বসেছে। আজ এত বছর, আজ তোকে উপড়ে দেব? নাহ, থাক সে পাশে, যেমন ছিল। পাশে আরেকটা চারার জায়গা দরকার, পারব দিতে তাকে জায়গা? জানা নেই।
।।৫।।
ফোন করেছিলাম আজ বিক্রমকে। ধরেছে ও, এতদিন পর। হয়তো খবর পেয়ে গেছে কোথাও থেকে। তাও আমার থেকে সিওর হতে চাইছিল। হ্যাঁ, ওর গলার সুরের মাঝে লুকোনো সেই প্রেমটা, যেটা শুধু আমি খুঁজে পেতাম, সেই প্রেমটাকে আজ মনে প্রাণে অগ্রাহ্য করেই উত্তর দিয়েছি, “হ্যাঁ, বিয়েটা আমার ঠিক হয়ে গেছে রে।”
না, কোন বাড়তি কথা ও আর বলেনি, আমি বোধহয় চাইছিলাম, আজ উঠুক আবার একটা ঝড়, এলোমেলো হয়ে যাক সবটা। এলোমেলো হোক ইগো, সমস্ত অমিল, মনোমালিন্য সব…সব। কিন্তু হলো কই? তোর প্রেমে এলোমেলো হওয়া আর হলো না।
**************
কষ্ট, ভীষণ কষ্ট, নিজের ভালোবাসাকে হারানোর যে কী জ্বালা, যার হয়, সে-ই বোঝে। লাল বেনারসী আর গয়নার ভিড়ে চোখ শুধু তোকেই খুঁজছে। তুই কী আসবি? পারবি দেখতে আমায় অন্য কারো হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা? তোর রোমকূপও এবার শিহরিত হবে অন্য কারো আদরে। আমার ছোঁয়া আর নেই তাতে।
**************
হ্যাঁ, বিয়েটা আমার হয়েই গেল, তুই আসিসনি।
ভালো হয়েছে আসিসনি, তোর চোখে যদি আবার হারাতে চাইত তোর শাওন, সেই শাওনকে কেমন করে সামলাতাম। সারা বাড়ী আলোয় সাজলেও, আজ আমার মনের ঘরে আঁধার নেমেছে। আর কী সত্যি কখনো দেখা হবে না? এখানেই সব শেষ?… ভালো থাকিস।
আমিও আজ থেকে নাম নেব অন্য কারো, বিক্রমের বদলে অন্য কেউ।
দমবন্ধ লাগছিল আমার, আর ঠিক তখনই…। হ্যাঁ ঠিক তখনই এক ঝলক বাতাসের মত, তুই এলি, আবার।
-“কেন এলি বলতো? চোখের সামনে সবটা মেনে নিতে পারবি তো?”
-“পারব, নিজেকে পোড়াবো বলেই আজ পুড়তে আসা।”
-“কেন করলি? খুব কী দরকার ছিল সবটা এভাবে শেষ করার?”
-“আর কী আমার হাতটা ধরা যায় না শাওন?”
চারপাশে আলো, সানাই।।।। আর একলা ঘরে আমি আর বিক্রম। না, দেবদাসের মতো কোন দৃশ্য ছিল না এখানে।
বাবা মা-ও জানত সবটাই, ও আসবে, সুতরাং ও এসেছে।
-“এইসব কথাগুলো বলতেই কী তুই এখানে এসেছিস?”
আমার শাড়ির কুঁচিটা সামলে নেওয়ার মিথ্যে ভ্যান করতে করতে কথাটা বললাম। ওর চোখের দিকে যে তাকাতে পারছি না, যদি…। না, না।
-“কেন তুই এভাবে দুই বাড়ির মধ্যে এরকম ঝামেলা করলি বলতো?”
-“ওহ, তুই তার মানে আজও আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে আমার ওপর দোষ চাপাতে এখানে এসেছিস?”
-“সব তো ঠিকই হচ্ছিল…।”
-“এক মিনিট বিক্রম, আমার বিয়ের জন্য বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে, আর তুই যখন এই অবান্তর প্রসঙ্গটা তোলার জন্য এই সময়টাই বেছে নিলি তবে শোন, ঠিক কিছুই চলছিল না। তোর বাড়ির জন্য আমার মা বাবা বারবার অপমানিত হচ্ছিল। আমি অপমানিত হচ্ছিলাম, এটাকে কী ঠিক থাকা বলে? তুই চোখে দেখতে পাচ্ছিলি না তখন যে সবটা শেষ হয়ে যাচ্ছে? তখন কী একবারও প্রতিবাদ করেছিলি? আমার জন্য তো একটা শব্দও উচ্চারিত হয়নি তোর মুখ থেকে। তোর মা যখন আমার বাবাকে বলেছিল, ‘সারাজীবন সব টাকা মেয়েকে লেখাপড়া শেখাতে খরচ করলেন নাকী যে এইটুকু টাও এত মনে হচ্ছে? তাও বুঝতাম বিলেত ফেরত মেয়ে…।’ তখন কোথায় ছিল তোর ভালোবাসা? সর, যেতে দে আমায় বিক্রম।”
চোখের সামনে এভাবে হুড়মুড়িয়ে নিজের কল্পনায় বানানো স্বপ্নের সংসারটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাচ্ছে, আমি পারছিলাম না এই কঠিন সত্যিটাকে মেনে নিতে।
শেষ তখনই আমার হাতটা ধরেছিল বিক্রম।
অকারণেই, এমনিই। জানি এখন আর এ হাত ধরে কোন লাভ নেই, সিনেমার মত এখানে হঠাৎ করে কোন মিরাকেল ঘটতে পারে না।
রক্তক্ষরণটা তীব্র হচ্ছে। আমি জানি তোরও কষ্ট হচ্ছে, খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখন তো অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর যে সময় নেই। সময় থাকতে কেন শক্ত করে ধরতে পারলি না হাতটা। আমি তো করেছিলাম তোর অপেক্ষা। ঝড়ের সময় তো ছেড়ে দিয়েছিলি হাত, তবে আর এখন কেন?
**************
নাহ, গোটা বিয়ের সময় বিক্রমকে আর আমি কোথাও দেখতে পাইনি। মুখের মেকী হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছিলাম আমি, কিন্তু পারছিলাম না।
শুভদৃষ্টি, মালাবদল, সিঁদুরদান সবটুকু সময় জুড়েই আমার চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তোকে। কোথায় গেলি? চলে গেলি? নাকী আড়াল থেকে দেখছিস? কী জানি।
তুই তো কাঁদতে পারছিস, আমি তো সেটাও পারছি না। বিয়েটা করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু “নিজে পছন্দ করে তো এই হলো, আমাদেরও তো তোকে নিয়ে কিছু স্বপ্ন আছে, সেটুকুও পূরণ করবি না।”- এ জাতীয় কথাগুলো শোনার পর আর কী বলতাম? কোন মুখে বলতাম? আর যে আমার প্রতিবাদ করার জোরটুকুও ছিল না।
জানি না তোর সাথে আর দেখা হবে কী না। কেমন যেন একটা লাগছে। একজন মানুষ যখন নিজের সবকিছু বন্যায় ভেসে যেতে দেখে, তখন যেমনটা হয় ঠিক তেমন।
কোথাও কোন তীর নেই, কূল নেই, সম্পূর্ণ একা। আমার স্বামী মানে রঞ্জন তাকে নিয়েও বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার।
বহু কষ্টে নিজের চোখের জলকে বেঁধে রেখেছি, এত আলোর রোশনাই-এ ক্যামেরার লেন্স ধরা পড়ে যাবে না তো আমার চোখে তোর ছবি?
**************
রাত বাড়ছে, তার সাথে বাড়ছে অন্ধকারের ঘনত্ব। সানাই, গানের শব্দগুলো আস্তে আস্তে স্তিমিত হচ্ছে, তার সাথে আঁধার নামছে আরো গাঢ় হয়ে আমার মনে। নিকষ কালো আঁধার। হারিয়ে গেলি তুই, হারিয়ে গেলাম আমি, আর ডাকা হবে না তোকে আমার দেওয়া নামগুলো ধরে, আর রাতগুলো কাটবে না হাজার কথায় মেতে, আর ফোনের দিকে তাকাতে হবে না বারেবার তোর ফোনের আশায়।
ময়দানের ঘাসগুলো আর দেখবে না আমাদের একসাথে, হারিয়ে যাব আমরা, সবার স্মৃতি থেকে, কিন্তু একে অপরের স্মৃতিতে? আর হয়তো কখনো তোকে দেখতে পাব না… বা হবে… হয়তো।
গল্পের শেষ অংশ পড়তে ক্লিক করুন-
চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন (শেষ অংশ)