চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন (শেষ অংশ)

।।১।।

-“ম্যাম, আপনার কালকের মিটিংটা পোস্টপন্ড করে দিচ্ছি তবে।”

-“হ্যাঁ, আর শোন, খুব দরকার না হলে আমায় ফোন করো না কাল, ওকে? চলো, আমি বেরচ্ছি।”

ব্যাগটা নিয়ে অফিস থেকে বেরতে বেরতে দেরীই হলো খানিকটা। তারপর এই ট্র্যাফিক, চিকুটা একা এতক্ষন আছে আজ, খুব রাগ করবে। আবার তাকে বোঝাও, উফফ।

এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই বাড়ি পৌঁছলাম যখন তখন প্রায় পৌনে আটটা। খাওয়াও হয়নি কিছু। বাড়ি ঢুকতেই চিকু বাবু ছুটে এলেন, সারাটা দিন পর চিকু এই সময়টা আমায় পেলে আর ছাড়তেই চায় না, আসলে বড্ড ছোট তো। এই সময়টুকু শুধুই ওর। ওর স্কুলের গল্প শুনতে হবে, ওর বন্ধুদের সাথে কী কী হয়েছে শুনতে হবে, ওর খেলার গল্প, টিফিনের গল্প, টিচার-এর গল্প সব শুনতে হবে। ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবে একটু শান্তি।

ওর ঘুমোনোর পর ব্যালকনিটায় একটু বসলাম রাত্রে। ভাইজাগ এ থাকছি বছর পাঁচেক। কতদিন হলো নিজের শহর কলকাতার, গঙ্গার ঘ্রান নিই নি। ফাঁকা লাগে খুব। কাল আবার রঞ্জনের সাথে দেখা হবে। আবার সেই এক পরিস্থিতি, ভেবেই মনটা তেতো লাগছিল। আবার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা।

বসলাম না বেশীক্ষণ, উঠে পড়লাম। রাতের বেলা নিজের ছোট্ট লাইব্রেরীটায় কিছুটা সময় হলেও কাটাই, এই সময়টা একান্তই আমার।

পুরো ফ্ল্যাটটায় এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। ব্যালকনির ধার, ব্যালকনি থেকে দূরে সমুদ্রটা একধারে যেমন চোখে পড়ে, তেমনি আর একধারে পাহাড়টাও ধরা দেয়, আজ মনে হয় পূর্ণিমা, চাঁদের আলো সমুদ্রের উপর পড়েছে, এমন দৃশ্য দেখে সারাদিনের কাজের চাপে ভারাক্রান্ত মনটা যেন অনেকটা হালকা হয়ে গেল। লাইব্রেরী মানেই কী একটা বন্ধ ঘর? না, আমার কাছে তা নয়, যেখানে খোলা হাওয়া খেলে না, সেখানে বই পড়াই হয় শুধু। এই চেয়ারটাও নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলাম।

চেয়ারটায় বসে আজ গৃহদাহ পড়ছি, আর মাঝে মাঝেই ফিরে তাকাচ্ছি সমুদ্রের ঝিকিমিকি আলোর দিকে, মাঝে মাঝে দু-একটা জাহাজ অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, বইটার খাঁজে হলদে হয়ে যাওয়া একটা কাগজ। কী এটা? ওহ, এটা তো রঞ্জনের হাতের লেখা, তবে বহুদিন আগের, খুলে দেখতেই ধূসর অতীতটা চোখের সামনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল, বন্ধ করে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। 

রঞ্জনের আমায় লেখা প্রথম ও শেষ চিঠি। 

ভালো লাগছিল না আর মনটা, হাতে গৃহদাহর বই, আর আমার সংসারটাও তো।।।।।। আচ্ছা, সংসার কী আদৌ ছিল?

রঞ্জনকে শুধুমাত্র বারবার কেন দোষ দিই আমি? দোষী তো আমিও। ও মুখে বলেছে, আমি বলিনি। ও বাঁচতে চেয়েছে, আর আমি স্বেচ্ছায় বাঁচতে অস্বীকার করেছি। এটাকে তো বাঁচা বলে না। চিকুটা না থাকলে তো আমি কবেই।।।।

অ্যাট লিস্ট, রঞ্জন কাউকে তো ভাল রাখতে পারছে, নিজেকে ভাল না বাসলে তাকে কী ভাবে ভালো রাখবে, আমার ভাগ্যে তো সেটুকুও হয়নি। ভাবনার মাঝেই ঘড়ির ঘন্টা বাজলো, রাত দুটো বেজে গেল। 

উঠে পড়লাম, বইটা আর চিঠিটা পড়ে রইল ওখানেই, হাওয়ায় উড়ছিল হলদে হয়ে যাওয়া চিঠিটা, বই-এর পাতাগুলো, যেন সব ভেঙে গুঁড়িয়ে পালানোর তীব্র চেষ্টা।

।।২।।

-“ম্যাম, মিটিংটা তো আজ দুপুরে হওয়ার কথা, আমি ওনাদের মেইল করে দিয়েছি। লাঞ্চ-এর পর মিটিং স্টার্ট হবে।”

-“ওকে।”

ল্যাপটপ, ফাইল, মিটিং, ফোন কলস-এর ভিড়ে, আর চোখের কাজলে ঢাকা পড়ে যায় রোজ ক্লান্ত চোখদুটো। কিন্তু চোখ দুটোও তো বিশ্রাম চায়, চশমাটা খুলে একটু চেয়ারে শরীরটা হেলালাম। আজ আবার একটা মিটিং, হয়তো আজ আবার ফিরতে লেট। উফফ।

*************

মিটিং রুমে ঢোকার আগেই একটা বিশাল আয়না আছে। ওখানে নিজেকে একবার দেখে নেওয়া আমার বরাবরের অভ্যাস।

হাতের ঘড়িটা, কানের দুলটা, চোখের চশমাটা, কোর্টটা, সবটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই ঢুকে পড়লাম মিটিং রুমে। ঢুকতে খানিক দেরী হয়ে গেছলো, আলো আঁধারির খেলায় ওই মুখটা দেখেই থমকে গেছিল আমার চারপাশটা।

হ্যাঁ, বিক্রম, আমার প্রথম আর শেষ…, নিজেকে সামলে নিয়ে বসলাম চেয়ারটায়। 

সেই এক চাহনি, একই ভাবে বসার কায়দা, চোখে এখন চশমা হয়েছে, চেহারাটাও একটু ভারী হয়েছে, ফর্মাল ড্রেসে কখনো ওকে সেভাবে দেখিনি, বেশ লাগছে।।।।।

কখন যে এখনকার শাওন অতগুলো বছর আগেকার শাওনের কথা ভাবতে শুরু করেছে, বুঝতেই পারিনি।

বিক্রম আমার দিকেই তাকিয়ে, আমি তো জানতাম না ও এখানে থাকবে। ও কী জানতো? ওর চোখে মুখে আগের থেকে এখন অনেক বেশী পরিণত মনস্কতার ছাপ।

ওর দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম, আর বারবার মিটিং রুমে টেবিল, চেয়ার, লাইট পেরিয়ে পৌঁছে যাচ্ছিলাম ময়দানের মাঠটায়। যেখানে ওকে দেখতে অভ্যস্ত ছিল ওর শাওন।

*************

মিটিং-এর পর সৌজন্য বিনিময়টুকু করেই নিজের ঘরে চলে এসছি, আর না। ও এখানে আবার কেন এলো? এতগুলো দিন পর। ভীষণ অস্থির লাগছিল। চিকুটা কী করছে কে জানে? টিফিন খেলো? একটু পরেই তো ছুটি হয়ে যাবে। মনটাকে আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম দূরে সরাতে এসব কিছু থেকে। কিন্তু না, তখনই দরজায় নক। হ্যাঁ, বিক্রম, আবার, আরও একবার ও।

মুখোমুখি দুজন। বসল এসে আমার সামনে।

-“ভাল আছিস?”

-“হ্যাঁ, তুই?”

-“হুম। এখানে কতদিন আছিস?”

-“পাঁচ বছর হলো প্রায়, তুই?”

-“আমি সবে এসছি ট্রান্সফার হয়ে। তা’ বাড়ির সব ভাল?”

-“হুম, ভাল, তোর বাড়ির সব ভালো? কোথায় উঠেছিস এখানে?”

-“এই তো রামকৃষ্ণপুরম-এ ।”

-“আয় একদিন আমার বাড়ি, আমার ফ্ল্যাট তো ওখানেই।”

হাতের অস্থিরতায় যে কেউ বুঝতে পারবে আমার মনের ঝড় টা, চাইছিলাম না, চাইছিলাম না আমি চাপা দেওয়া কবরটা খুঁড়তে।

-“আজ একবার অফিসের পর দেখা করতে পারবি?”

আমি জানতাম বিক্রম চাইবে দেখা করতে। আমিও তো সেটাই চাইছিলাম। কিন্তু, এখন এসব করে কী লাভ? কিন্তু, তিক্ততা ভুলে কী আবার কথা বলা যায় না? না, যায় না, ভালবাসার মানুষকে ভাল না বাসার নাটক করা এত সহজ না। যতই সময় পেরোক, প্রথম প্রেমকে কী ভোলা যায়? আর এতে জটিলতা শুধুই বাড়বে, আর তো কিছুই হওয়ার নয়। আমার মনের মধ্যে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’-এর প্রবল যুদ্ধ চলছিল। শেষমেশ নিজের ইচ্ছেটাকে প্রতিবারের মত দমিয়ে দিয়ে উত্তর দিলাম, “না রে, আমার ছেলেটা তো একা থাকবে বাড়িতে, আমায় ফিরতে হবে।”

হ্যাঁ, বললাম, আর তার সাথে এটাও লক্ষ্য করলাম, বিক্রমের মুখটা মুহূর্তের মধ্যে যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

কেন বিক্রম? এত অধিকার বোধ এখনও? আমার সন্তান সংসার থাকবে, এটাই তো এখন স্বাভাবিক, আজও সেগুলো মানতে এত অসুবিধে কেন হচ্ছে তোর? কই আমি তো সবটা মেনে নিয়েছি। সব কিছু তো আমাদের ইচ্ছে মতো হয় না, সবকিছু তো আমাদের হাতে নেই, ছিল না এটা আমাদের ভাগ্যে। কেন মানতে অসুবিধে আজও?

-“ওকে, আজ তবে তোর বাড়িতেই দেখা হোক, তোর ছেলের সাথেও দেখা হবে। ওকে ডান।”

এটুকু বলেই আমার থেকে ঠিকানাপত্র নিয়ে চলে গেল বিক্রম। এভাবে ও চলে আসতে চাইবে আমার বাড়িতে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও।

*************

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মনটা নিজের অজান্তেই যেন আবার তার অপেক্ষায়, যেমন বহু বছর আগে ছিল। আমি জানি, আমি জানি এ অপেক্ষা অমূলক, এর কোন পরিণতি আজও নেই, কিন্তু মনটা তো অবুঝ, বারবার ঘড়ির কাঁটা দেখছি, তার প্রতীক্ষায়, অকারণেই।

চিকু আজ খুব খুশী, বাড়িতে গেস্ট আসবে। ওর খেলার নতুন সঙ্গী, বিক্রমের পছন্দের খাবার বানাতে পারতাম আমি, পাস্তা, কিন্তু না, কেন এভাবে ওকে আবার প্রশ্রয় দিচ্ছি। এতে তো নিজের কষ্টই বাড়বে। 

আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাজলো বেলটা। দরজাটা খুলতেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বিক্রম। মনের দরজায় দমকা হাওয়াটা আছড়ে পড়ল অবলীলায়, কিছু তো করার নেই। প্রেমকে কীভাবে জোর করে আটকাব।

-“আয়, ভিতরে আয়।”

বিক্রম সোফাটায় বসতেই চিকু দৌড়ে হাজির, নতুন অতিথিকে দেখতে, তার সাথে খেলতে। বিক্রমও কী সহজে মিশে গেল ওর সাথে খেলায়। আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম সেই দিকেই সব কাজ ভুলে।

এই দৃশ্যটা, এই জীবনটা তো আমারও হতে পারতো, রোজ চিকু এভাবেই যদি বিক্রমের কোলে…| নাহ কী ভুলভাল ভেবে চলেছি আমি, তখন থেকে।

ভাবনাকে বেশী প্রশ্রয় না দিয়ে নিজের কাজে হাত লাগলাম। স্যান্ডউইচটা নিয়ে সোফায় বসতেই বিক্রম বলল, “আবার এসব কেন?”

-“না না, এটুকু তো অতিথিকে আপ্যায়ন করতেই হয়।”

ইচ্ছে করেই অতিথি কথাটা জোর দিয়েই বললাম।

বিক্রমের মুখের দিকে তাকাতেই বলল,”বানালিই যখন, পাস্তা বানাতিস।”

মিথ্যে উত্তরটা গুছিয়েই রেখেছিলাম, “ওহ, তোর তো পাস্তা ভাল লাগে, তাই না! সরি রে, একদম খেয়াল ছিল না আমার।”

কোনদিন মিথ্যে বলে এত আনন্দ পেয়েছি কিনা জানা নেই, আজ যা পাচ্ছি।

ইচ্ছে করেই চুপচাপ ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়েছিলাম। বিক্রমের থেকে দূরে, দূরত্ব বজায় রাখাটা খুব দরকার। ও চিকুর সাথেই আছে।

আজও আকাশে ভরা জ্যোৎস্না, সমুদ্রে তার আভা। আবার সেই মায়াবী রাত। বিক্রম কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারিনি। খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “চিকুর বাবাকে দেখছি না কোথাও? রঞ্জন কোথায়? চিকুও তো ওর বাবার ব্যাপারে…”

জানতাম, আমি জানতাম ও এই ইস্যুটা নিয়ে নাড়াচাড়া করবেই, এগুলোই তো চায় ও। ওর চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, তোর লাইফে কী চলছে আমি কী তার ডিটেলস চেয়েছি বিক্রম? নিজের অধিকার কতটুকু সেটুকু বোঝ এবার।”

এই কটা কথা বলেই চুপ করে গেলাম। ভাঙছিলাম আমি একটু একটু করে, আর কতক্ষণ সহ্য করব? আর কতদিন? ক্লান্ত আমি সবাইকে এর উত্তর দিতে দিতে, আর আজ বিক্রমও।

জানি না, তখন রাত কটা, রাস্তাটা একটু শুনশান হতে শুরু করেছে, ঝাঁ চকচকে রাস্তায় স্ট্রিট লাইটের আলো আর হুহু করে বেরিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো ছাড়া আর কেউ নেই তেমন। ওদিকে সমুদ্রে ঘন কালো আঁধার – এর মধ্যে মুক্তোর ঝিকিমিকি। দূরে কটা জাহাজ বোধ হয়, আর একদিকে, ভুডা কৈলাসাগিরি, আঁধারে মুখ ঢেকেছে।

বিক্রম বলল,”একবার বীচে যাবি?”

আমি “না” বলতে এক সেকেন্ডও সময় নিলাম না।

-“প্লিজ, একবার চল, দ্যাখ, কী সুন্দর পরিবেশটা।”

-“বিক্রম, চিকু কী একা থাকবে? ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, আর অনেক রাত হয়েছে…।”

-“প্লিজ”

**************

চিকুকে কাবেরী মাসির কাছে দিয়ে এলাম সামনের রামকৃষ্ণ বীচে। সামনে উত্তাল সমুদ্র, বেশী কাছে যাওয়ার অনুমতি নেই। 

সমুদ্রের ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে এলোমেলো হচ্ছিলাম আমি, নিজেকে বিক্রমের সামনে সামলে নিচ্ছিলাম।

-“আগে তো আমার সাথে রাত ১০টায় ফিরতেও কোন অসুবিধা হতো না, আর আজ দ্যাখ।।।।।”

-“আগে তো তোর সামনে নিজেকে নিজের মতো করেই রাখতে পারতাম, মুখোশ পড়ার তো দরকার হতো না তখন, এখন তো আর আগের পরিস্থিতি নেই।”

বীচের সামনে রকটায় গিয়ে বসলুম দুজন। গুটি কয়েক লোক রয়েছে বীচে।

-“আগের সবকিছু তো আবার হতে পারে, আজও।”

না, আর আমি বিক্রমের দিকে তাকাইনি। জানি না, হয়তো লজ্জা, বা নিজের অনুভূতিকে লোকানোর তাগিদ। নিজের ভালবাসার মানুষের সামনে নিজেকে আড়াল করার তীব্র চেষ্টা করছিলাম আমি বারবার।

বিক্রম আবার বলল, “যদি তুই চাস, সব আবার আগের মতো হতে পারে, চিকুকে নিয়ে আমার কোনো…”

বিক্রমের কথা শেষ হওয়ার আগেই বললাম, “তুই তো অনেক দূর ভেবে ফেলেছিস, সব নিজে নিজেই, আমি কী চাই, আমি কী ভাবছি সেগুলো না জেনেই। তুই ভুলে যাচ্ছিস বিক্রম, আমি আর আগের শাওন নেই, আমি কারো মা, কারো…”

না ‘স্ত্রী’ শব্দটা বলে আর নিজের উপরই প্রহসনটা বাড়াতে পারলাম না।

“আর সব থেকে বড় কথা আমাদের আলাদা হতে হয়েছিল যে কারণে, সেই কারণটা তো আজও আছে।”

-“আমি মা বাবাকে, বাড়িকে ঠিক ম্যানেজ করে নেব, আর কোন অপমান হবে না, প্রমিস।”

-“বিক্রম, প্লিজ, যেটা তুই আট বছর আগে পারিসনি, সেটা আজ এখন এভাবে? আর খুব শিগগিরই আমার পোস্টিং ওড়িশা হয়ে যাবে।।।।”

-“ট্রাস্ট মি, আই উইল ম্যানেজ, আমি সব সামলে নেব, সেরকম হলে তুই চাকরিটা ছেড়ে দিবি, মাও খুশি হবে এতে। তুই ঘরটা সামলাবি, আমি বাইরেটা।”

-“আর আমার মা বাবা, তাদের দায়িত্ব তুই নিবি তো? পারবি? আর চাকরি তো তুইও ছাড়তে পারিস। আর সব থেকে বড় কথা, তুই একজন বিবাহিত মহিলাকে তার সংসার, তার সবকিছু ছাড়তে বলার কে?”

-“তোর কাছে আমার ইচ্ছের কোন দাম নেই?”

-“তোর কাছে আমার দাম ছিল আদৌ? থাকলে আমায় যেতে দিলি কী করে? তখন তো কিছুই বলিসনি। তখনকার মতো সিচুয়েশন তো আজও। শুধু বয়সের সংখ্যাটা চেঞ্জ হয়েছে। আর তো কিছু না।”

-“কী আছে তোর ঐ চাকরিতে? যে আমার জন্য সেটুকুও ছাড়তে পারবি না তুই? নাকি ওখানেও কেউ? আর এত সংসার সংসার করছিস, এত প্রেম? খুব ভাল লাগে না রঞ্জনের ছোঁয়া?”

-“ব্যস, বিক্রম, নিজের লিমিটটা ক্রস করিস না।”

-“কী লিমিট? কীসের লিমিট? আমি আজও অবিবাহিত, আর তুই তো সব ভুলে দিব্যি সন্তান-স্বামী নিয়ে সংসার করছিস।”

-“যখন জানিস ই করছি, তাহলে আমার সংসার ভাঙার ইন্ধন জোগাতে এসছিস কেন?”

সমুদ্রের গর্জন বাড়ছিল, বাড়ছিল রাত। আমরা তখন বসে। খুব কী প্রয়োজন ছিল আজকের এই ঘটনাটা ঘটার?

বিক্রমকে আমিই বললাম, “একটু হাঁটবি একসাথে, আগের মত।”

হুম, আমি ই বললাম, কারন নিজের বাইরের শক্ত আবরণটা ভাঙা দরকার ছিল, সবটা আরও একবার স্পষ্ট করে বলার দরকার ছিল খুব |

ভাল লাগছিল ওর পাশে হাঁটতে, ওর সাথে থাকতে, মিথ্যে বলব না। কিন্তু… সবকিছুর প্রথমেই যে অনেকগুলো ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘তাও’ যুক্ত হয়ে যায় আপনা আপনি।

আমি জানি তোর মনেরও একই অবস্থা, কিন্তু এটা তো রিল লাইফ নয়, শুধু প্রেমটাই যথেষ্ট নয় এটা তুই আজও বুঝলি না। আমার ভাবনার ঘোরেই বিক্রম হাতটা ধরল আমার। পূর্ণিমার রাত, সামনে সমুদ্র, আর আমার প্রথম ও শেষ প্রেম আমার সাথে, এত কাছাকাছি। কিন্তু, আজ ভাগ্যের পরিহাসে আমাদের মধ্যে আলোক বর্ষের দূরত্ব। বিক্রমের হাতের স্পর্শে আমি হয়তো ফিরে গেছিলাম আমাদের প্রেমের দিনগুলোয়। ওর চোখের দিকে তাকালাম। ওর চোখে নিজেকে খুঁজছি, কিন্তু শুধু নিজেকে পেয়ে কী হবে? সেখানে কী সম্মান আছে? নাহ, যেখানে আমার, আমার পরিবারের সম্মান নেই, সেখানে… নাহ হয় না। আরও একবার কষ্ট পেতে চাই না আমি। আরও একবার নিজেকে গুঁড়িয়ে যেতে দেখতে পারব না। 

এই তো কাছে এলি, আবার দূরে। আমাদের ভাগ্যে আমাদের সাথে থাকা নেই, আমি মেনে নিয়েছি, তুইও মেনে নে না। ভালবাসতে গেলে শুধু প্রেম না, সাহসটাও দরকার।

“তোর বাড়ির আমায় বা আমার পরিবারকে অপছন্দ হওয়ার প্রতিটা কারণ আজও একই রকমভাবে বর্তমান বিক্রম। তাহলে, কীসের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথাগুলো বলছিস? আবার তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে। সব জেনে বুঝে একটা অসম্ভবের পিছনে না ছুটে নিজের জীবনটা এবার গুছিয়ে নে না। সবার ভাগ্যে তো সবকিছু থাকে না বিক্রম। আমাদের এক হওয়া সম্ভব না। আর তুই আজ যা কিছু বললি…”

-“দ্যাখ, আমি যা বলেছি রাগের মাথায়।”

চাঁদের আলোয় মোহময়ী রাত। ওর কথা থামিয়ে হাতটা ধরলাম। হ্যাঁ, এবার হয়তো শেষবারের মতোই। আর হয়তো দেখা হবে না এভাবে কোনদিন, হয়তো এভাবে আর কখনো কথা বলা হবে না। 

ওর হাতদুটো ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বললাম, “তুই যা বলেছিস, তোর মনে ছিল বলেই বলেছিস, তবে যা বললি তা আদৌ ঠিক বলিসনি, আজ আমি ভীষণ ভাবে ফিল করছি যে সেদিন আমি কতটা ঠিক ছিলাম। প্লিজ আর আমার জীবনে এভাবে ঝড়ের মতো আসিস না বারবার। ভালো থাকিস।।।”

নাহ, তোকেই আজও ভালবাসি, এই শব্দ কটা অনুচ্চারিতই রয়ে গেল আবার। কী লাভ বলে? জটিলতাই তো বাড়বে শুধু। আর পিছন ফিরে তাকাইনি আমি, ঐ চোখ নয়তো আবার ভালবাসার টানে বেঁধে ফেলবে আমায়। পিছনে সমুদ্রের বিশাল গর্জনের মাঝেই হয়তো তুই দাঁড়িয়ে ছিলি অনেকক্ষণ, জানি না, জানতে চাই না।

না, রঞ্জন আমাকে কোনদিন ছোঁয়ও নি। রঞ্জনের সাথে ডিভোর্সের কেস চলছে, কিছুদিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে। রঞ্জন জোর গলায় এসে জানিয়েছিল, ও রিচেলকেই বিয়ে করতে চায়। আমি বাধা দিনি। বাধা দেবার কোন অধিকারও নেই আমার। আমার জীবনে একমাত্র আলো হলো চিকু। যেদিন ছোট্ট শিশুটাকে হোম থেকে নিয়ে এসেছিলাম, সেদিনই কথা দিয়েছিলাম তোকে ভালবাসতে কোন খামতি রাখব না।

**************

শুধুমাত্র একসঙ্গে লিভ ইন, বা বিয়েতেই কী প্রেমের সাফল্য? বাকী প্রেমগুলোর কী কোন মূল্য নেই। ঘা হাত থেকে সারা শরীরে ছড়ানোর থেকে হাতটা কেটে ফেলাই শ্রেয়। পুরো শরীরটাকে বাঁচানোর জন্য। তাই বলে কী হাতটা কাটতে কোন কষ্ট হয় না?? আমার আর তোর ভালবাসাও তো তাই। এই প্রেম পরিণতি পাওয়ার নয়। তোর আমার চিন্তাধারা, তোর পরিবার আমার পরিবার, আমাদের মানসিকতা সবটুকুই যে আলাদা, তাও তো ভালবেসেছি, কিন্তু আজ এত বছরেও তোর মানসিকতায় কোন পরিবর্তন নেই। আমি তোকে ছাড়াও যেমন ভাল নেই, তেমনি তোকে নিয়েও ভাল থাকব না রে। এ জন্মে না হোক, অন্য কোন জন্মে ঠিক এক হবো আমরা। আর কোন অপমান, লজ্জা, ঘৃণা দ্বেষ থাকবে না আর সেখানে। থাকবে শুধু ভালবাসা। অপেক্ষায় রইলাম, জানি দেখা হবে, অন্য কোথাও।।।।।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন

।।১।। উফফ, আমার কানের নীল ঝুমকোটা কোথায় রাখলে মা, খুঁজেই পাচ্ছি না, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।”- তাড়াহুড়োয় মা কে হাঁক দিলাম, ওদিকে লিপস্টিকের শেড আর

Read More »

বেনামী (শেষ অংশ)

।।৩।। ভাইজাগ শহরটা বেশ সুন্দর, পরিপাটি, সাজানো, একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম রামকৃষ্ণপুরমে। বাবা মা আমার সাথে এসে সবটা সাজিয়ে দিয়ে গেছল। জয়েনিং-এর প্রথম দিন স্বভাবতই

Read More »

বেনামী (প্রথম অংশ)

-“মুন তোকে কতবার ঠিক বলতে হবে, ব্যাগটা গোছাচ্ছি, আর কী কী নিবি তুই দেখে নিবি আয় ।” মা-এর গলা খাঁকারিতে নড়ে চড়ে বসলাম একটু, হাতের

Read More »

রাঙিয়ে দিয়ে যাও

।।১।। -“জবা, ছাদে জামা-কাপড়গুলো শুকলো কিনা দ্যাখ তো একবার, আর বড়িগুলোও দেখে আসিস ।” বিক্রমপুরে এলে বল্লভ বাড়ি চেনে না, এমন মানুষ খুব কমই আছেন

Read More »

Share with