১-২-৩ স্মাইল প্লিজ… প্রথম অংশ

।।১।।

“ফিরতে রাত হবে, খেয়ে নিও” বলতে বলতেই পা-এর চটিখানা গলিয়ে বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট থেকে সাগ্নিক। মোবাইলে টাইমটা দেখলো, সময় তখন ৮টা। সিগারেটটা ধরিয়ে হাঁটা লাগালো, সামনের গলিটা পেরিয়েই ডান দিকে বসন্ত-দার দোকান, ওখানেই বসবে কিছুক্ষণ । ক্লাব খুলতে খুলতে রোজ বুড়ো-দা ৮:৩০টা বাজিয়ে দেয়।

সিগারেটে টান দিতে দিতে এগোতে লাগল ও আপন মনে, ফোনটা আর এখন ধরবে না। ধ্যুর, ভালো লাগছে না আর রোজকার এই অশান্তি। ও না বলতে পারে, না অপর পক্ষের মানুষটা বোঝে কিছু।

সিগারেটটা অর্ধেক-এর উপর শেষ প্রায়। বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। দুপুরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল তাই ওয়েদারটা ঠান্ডাই আছে।

” আর বেরোতেই ইচ্ছে করে না ওর, একটু যে আড্ডা দেবে বেশী করে তা না। বলতে বলতেই দেখল, ওদিক থেকে দুলকি চালে হাফপ্যান্ট পরে বাবু আসছেন।

-“কী ভাই, মুখটা আমসি কেন?” বলতে বলতেই হাতের বেঁচে থাকা সিগারেটটা নিয়ে সুখটান দিতে লাগল বাবলু। সাগ্নিকের মুখটা ততক্ষণে বিরক্তিতে ভরে গেছে , “তুই আর বকিস না তো, তোর আর কী? আমি মরছি আমার জ্বালায়, এখনো কিছু বলতেও পারিনি।”

“তুই আর পারবিও না, কী রে তুই? একটা প্রপোজ অবধি করতে পারিস না, তুই আমার বন্ধু? আমায় দ্যাখ, ৬বছর প্রেম করে দু’মাস হলো বিয়েও করে নিলাম, আর তুই এখনো প্রপোজেই আটকে।”

-“থাম তো শালা, ওকে দেখলেই বুকে হাতুড়ি পিটতে শুরু করে আমার, প্রপোজ তো অনেক দূর।”

-“দ্যাখ, এভাবে আর কতদিন, এবার এসপার নয় ওসপার তো করতেই হবে, ভালবাসিস, অন্যায় তো করিসনি, কতদিন ঝুলে থাকবি, এভাবে বাঁচা যায় নাকী? আমি বলছি তুই এবার বল। অত ভাবিস না।”

ঐ গালের টোল পড়া মিষ্টি হাসিটা, ঐ বড় বড় মায়াবী চোখ দুটো, ঘাড়ের কাছের তিলটা, ভ্রু-এর উপর কাটা দাগটা, সারাদিন বকবক করা ঐ পাগলী মেয়েটাকে কবেই তো ভালোবেসে ফেলেছে ও। কিন্তু, সাগ্নিক-এর কাছে এলেই ওর বকবক যেন এক নিমেষে বন্ধ হয়ে যায়, কেন? সাগ্নিকের কী ওর বন্ধু হওয়ারও যোগ্য নয়? খুব ইচ্ছে করে ওর, বীথির ঘাড়ের কাছের তিলটাকে কাছ থেকে দেখতে, ওর চুলের সুবাসে মাতাল সাগ্নিকের ইচ্ছে হয় বইকী ঐ ঘন কালো মেঘে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে। কিন্তু না, নিজের ভালবাসার কথা এখনোও বলতে পারেনি বীথিকে। আর বীথি? সবসময় নিজেকে গুটিয়েই রাখে, ওর দিকে কখনো ভাল করে ফিরে তাকিয়েছে আদৌ বীথি? ওর তো মনে পড়ে না। বন্ধুরা বলে, “বলে দে”, কিন্তু, যে বন্ধুর জায়গাটাই দিল না, তাকে কী করে বলবে এসব ও?

বীথিকে কচি কলাপাতা সবুজ রঙটা খুব মানায়, সাগ্নিকের চোখ এসব ভালোই বোঝে। ফটোগ্রাফার বলে কথা। আর ফটো যে নেহাত খারাপ তোলে না, তা ও নিজেও জানে। নয়তো ইঞ্জিনিয়ার এর চাকরি ছেড়ে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার-এর কয়েক বছরের জীবনে এখনই বাড়ির নীচে অফিস, মাসান্তে আর্থিক স্বচ্ছলতা, এসব হতো না। তা সেই ফটোগ্রাফারের চোখেই আলো ছায়ার খেলা বেশী ধরা পড়ে। পড়েও ছিল। বীথির হাসিতেই তো চোখ আটকে ছিল সাগ্নিকের। আর সেই থেকেই ওর রাতের ঘুম উড়ে গেছে।

*************

ক্যারামটা জাস্ট জমেই উঠেছিল, তখনই পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করল, একবার, দুবার, তিনবার, ধ্যুর… বিরক্তি নিয়ে ফোনটা বের করে দেখেই খানিক বিষম খেল সাগ্নিক। মোবাইলের স্ক্রিনে নাম উঠছে ‘মুন’। ইনি তো সচরাচর ফোন করেন না, আজ হঠাৎ কী হলো?

-“কী রে, দানটা দিবি কী?”, বাবলুর ঘ্যাঁতানিতে ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরল সাগ্নিক।

“নাহ, তোরা খেল, আমায় বাড়ি ফিরতে হবে” বলেই ফোনটা কানে দিয়ে কথা বলতে বলতে পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল সাগ্নিক।

“বউ ফোন করেছে নির্ঘাত, বউকে এত ভয় পায় – এর কী হবে?”, বলে বাকীরা খেলায় মন দিল।

************

সাগ্নিকদের গ্রুপ টা পঞ্চপাণ্ডব, ছোট থেকেই একসাথে ওরা। সেই স্কুল থেকে শুরু, HS-এর পর কলেজ, কেরিয়ার আলাদা হয়ে গেছে কিন্তু, রোজ রাত ৮টা থেকে এক হওয়া চাই-ই, সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি, গ্লানি, বিষাদ সব একনিমেষে হাওয়া হয়ে যায় এই ক্লাবে এলেই।

সাগ্নিক, বাবলু, প্রিয়ম, অনীক আর ঋতম – এই পাঁচজনই হলো পঞ্চপাণ্ডব। প্রথম তিনজনের বিয়ে হয়ে গেছে আর বাকী দুজনের হবো হবো। কিন্তু, আর পাঁচটা বিয়ের মতো সাগ্নিকের বিয়েটা নয়। মুন আর সাগ্নিক একই ছাদের তলায় একই ঘরে থাকলেও, বাইরের লোকের কাছে স্বামী স্ত্রী হলেও, আদতে তা নয়।

।।২।।

“রোজ রোজ রাত ১২টা ১২:৩০টা অবধি ডিনার আগলে বসে থাকা যে কোন মানুষের পক্ষেই কষ্টকর। মা-র শরীরটাও এখন ভাল নেই, প্লিজ রোজ রোজ এতটা রাত কোরো না”, বলেই মুন চলে গেল শোবার ঘরে।

টেবিলে ঢাকা দেওয়া রুটি, মাছ, গলাধঃকরণ করে ঘরের সামনের বারান্দাটায় এসে দাঁড়াল সাগ্নিক। আজ মনে হয় পূর্ণিমা, বড্ড সুন্দর আজ চাঁদটা। সামনেই কৃষ্ণচূড়া গাছটা হাওয়ায় নিজের লাল আবিরে ঢেকে দিচ্ছে সামনের রাস্তাটা। তার ওপর চাঁদের মায়াবী আলোয় ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে সামনের জায়গাটা।

আগের রোজ ১০টা-৫টার চাকরির থেকে নিজের প্যাশনটাকে নিয়ে এখন বেশ ভালই আছে সাগ্নিক। কাজটা করে ওর কোন ক্লান্তি আসে না কোনদিন। ফটোগ্রাফির শখ ছিলই, তবে সেই শেখ পূরণ হতো বন্ধুদের ক্যামেরায় ছবি তুলেই, নিজের অত টাকা দিয়ে ক্যামেরা কেনার মত সঙ্গতি ওর বা ওর পরিবারের কোনদিনই ছিল না।

চাকরি পাওয়ার পর মা বাবার জন্য কিছু কেনার পর নিজেকে সবথেকে প্রিয় জিনিসটা গিফ্ট করেছিল ও, DSLR ক্যামেরাটা ওর চাকরির টাকায় কেনা নিজের জন্য প্রথম উপহার।

বীথিকে প্রথম দেখা ঐ ফটোগ্রাফির সুবাদেই তো।

।।৩।।

………তখন………

-“আপনি মেট্রো স্টেশনের গেটের কাছেই দাঁড়ান, ২নং গেটের পাশেই দোকানটা, আপনি দাঁড়ান, আমি এসে গেছি।”

ক্লায়েন্টকে দাঁড় করিয়ে রাখা সাগ্নিক একদম পছন্দ করে না, তাই বরাবরের মতো এবারও সময়ের খানিক আগেই এসে গেছে। মিট করবে, ক্লায়েন্টের বাড়ি বেশ দূরে, তাই বাড়ির বাইরেই মিটিং।

মিনিট ৫-৭ এর মধ্যেই একটা কচি কলাপাতা সবুজ রঙা কুর্তি পড়ে সামনে এসেছিল বীথি। বৃষ্টির জন্য খানিক ভিজেও গেছিল, কানের উজ্জ্বল মুক্ত, আর তার সাথে সঙ্গত মুক্তোর মত উজ্জ্বল হাসিতে সেদিন-ই সাগ্নিকের মনটা চুরি করে নিয়েছিল বীথি। চোখের হালকা কাজলে আর মুখের উপর জমা বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির জলে এত্ত সুন্দরী লাগছিল বীথিকে, সাগ্নিক কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেছিল বীথির বিয়ের জন্যই ওর এখানে আসা। বীথির ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হিসেবে।

সাগ্নিকের বহু বারণ সত্ত্বেও কোল্ড ড্রিংক অর্ডার করেছিল সেদিন বীথি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি নিয়ে কথাবার্তা বলে অ্যাডভান্স নিয়ে সেদিন ফিরেও এল সাগ্নিক কিন্তু, কিছুতেই মন থেকে নামাতে পারছিল না ও বীথিকে। রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার সময়, সকালে ঘুম থেকে উঠে, বা কাজের মধ্যে অন্য যে কারও মুখে ঐ একটাই হাসি। এভাবে আর কতদিন? বন্ধু মহলও বিধান জানিয়েই দিল – তুই প্রেমে পড়ে গেছিস ভাই।

কিন্তু, মনের মধ্যে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলা বা পেটের মধ্যে প্রজাপতি ওরা কোনটাই হয়নি সাগ্নিকের।

প্রেমে পড়লো কীনা জানা নেই কিন্তু, বীথি আর ওর বরের ফটো ওকেই তুলতে হবে, এটা ভেবেই ওর মনটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিল রোজ।

কী করবে ও? ইচ্ছে করে তো করেনি কিছু, ওর কী দোষ? বীথির ওয়েডিং ফটোগ্রাফির দায়িত্বটা কিভাবে সামলাবে? এর মধ্যে আর দেখা হয়নি। দেখা না হলে আর জিনিসটা এগোবে না, ও ঠিক নিজেকে সামলে নেবে। কিন্তু, তা না হলে, নিজেকে কীভাবে সামলাবে ও? এসব-ই যখন ভাবছে, তখন বীথি আরও একবার দেখা করলো আর এবার ওর উড বি-র সঙ্গে।

‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’-এ বিশ্বাসী নয় সাগ্নিক কোনদিনই কিন্তু, ওর সাথে যা কিছু হচ্ছিল, তার কোন ব্যাখ্যা ওর কাছে ছিল না। বীথিকে দেখে ও কিছুতেই শান্ত থাকতে পারছিল না। এটা যদি প্রেম না হয়ে ক্রাশও হয়, তাহলে তাই, কিন্তু, কিছু একটা হচ্ছিল। আর সেজন্য ওর চারপাশের জগৎটা মাত্র কয়েকদিনেই, ধূসর থেকে রঙিন হয়ে উঠেছিল। কখন, কীভাবে, ও জানে না। বিরক্তির কাজগুলোও ভালই লাগতে শুরু করেছিল। আর তারপরই বীথি আর প্রবালের সাথে দেখা হলো। সাহস করে বীথির ফোন নং থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন কোন কল বা মেসেজ করেনি সাগ্নিক।

*************

আজ প্রবালকে বীথির পাশে দেখে একদম ভাল লাগছিল না ওর, খুব খুব রাগ হচ্ছিল, রাগটা কার ওপর কে জানে, কিন্তু হচ্ছিল। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ, বর্ধমান আর কলকাতার মধ্যে এই সম্বন্ধটা হয়েছিল ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট থেকেই। প্রিওয়েডিং-এর টাইম, লোকেশন সবই ঠিক হলো সেদিনই। বাড়ি ফিরে,নিজের ঘরে একাই বসেছিল সাগ্নিক। সচরাচর এরকম দিন আসে না, যে ওরা পঞ্চপাণ্ডব, ক্লাবে খেলতে যাবে না। কিন্তু, সত্যিই কিছু ভাল লাগছিল না। 

প্রবালকেও বিরক্ত লাগছিল আজ ওর। ওরা যখন হাতে হাত ধরে পোজ দেবে, কী ভাবে শ্যুটটা করবে ও? ধ্যুর, পারবে না ও।

অনেক ভেবে হাতে ফোনটা নিয়ে whatsapp-এ মেসেজটা লিখেই ফেলল এবার। ওর পক্ষে এই শ্যুট করা সম্ভব না, তার থেকে ও না হয় পুরো টাকা ফেরত দিয়ে দেবে। চূড়ান্ত ইমপ্র্যাক্টিক্যাল হবে এটা, জানে ও এটা।।।।।। মেসেজটা লিখলেও সেন্ড করতে আর পারল না, তার আগেই বীথির এসএমএস ঢুকল।

-“আশা করি প্রিওয়েডিং ফটোশুটটা দারুণ হবে, আপনার কাজ তো দেখেছি, রিয়েলি দারুণ। বাই দ্য ওয়ে, প্রবালকে কেমন মানিয়েছে বললেন না তো?”

-“ঠিক বলতে পারব না”, জাস্ট কিছু না ভেবে কথাটা লিখে সেন্ড করে ফেলল সাগ্নিক, “ভালো না” লিখতে ইচ্ছে করলেও সেটা লিখে উঠতে পারেনি। কয়েক সেকেন্ডের বিরতি, ওপাশ থেকে ফোন বীথির।

বেশি কিছু ভাবার দরকার নেই, তাড়াতাড়ি রিসিভ করে নিল ফোনটা সাগ্নিক।

-“আপনার হঠাৎ এই ধরনের ব্যবহারের কারণটা কী?”

-“আমি আবার কী বললাম?”

-“আপনার উত্তর দেওয়ার ভঙ্গিটা দেখেই তো ফোনটা করতে বাধ্য হলাম।”

-“ফোন করেছেন যখন তখন ভালই। আমি হয়তো আর এই প্রজেক্টটা কন্টিনিউ করতে পারব না কিছু ব্যক্তিগত অসুবিধার জন্য।”

কথাটা আগুপিছু না ভেবেই বলে দিয়েছিল সাগ্নিক। যেটা হওয়ার সেটাই হলো। চূড়ান্ত unprofessional, irresponsible- এই জাতীয় শব্দগুলো শুনতেই হতো, সেগুলো শুনিয়ে ফোনটা কেটে দিল বীথি।

টাকাটাও তো ফেরত দিতে হবে অ্যাডভান্স-এর, সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কী হচ্ছে ওর সাথে, ও-ই বা কেন এরকম করছে? সব কিছুই বড্ড ঝাপসা লাগছিল।

নিজের মধ্যে চলতে থাকা অস্থিরতা, চাঞ্চল্যকে কোনভাবেই বাগে আনতে পারছিল না সাগ্নিক।

একটা অপরাধবোধ, আবার কিছুটা হিংসা, আবার কেমন কেমন একটা ছেলেমানুষি, অদ্ভুত একটা অনুভূতি চলছিল ওর মধ্যে।

মাঝের বেশ কটাদিনের দোলাচলের পর প্রিওয়েডিং ফটোশুটটা সাগ্নিক-ই করেছিল। নিজের সমস্ত পাগলামোকে একপাশে সরিয়ে রেখে, বুকের রক্তক্ষরণটাকে উপেক্ষা করে প্রবাল আর বীথির হাতে হাত সূর্যাস্তের আলোয় লেন্সবন্দী করেছিল। 

প্রেম সেভাবে ওর জীবনে আসেনি, কলেজে পড়াকালীন একতরফা একটা প্রেম ছাড়া। বীথিকে কোনদিন কিছু না বলেও, ওর সঙ্গে কোনরকম সম্পর্কে না জড়িয়েও অদ্ভুতভাবে মিশে গেছিল বীথি ওর জীবনে।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ -এ বীথির প্রোফাইলটা কিছু সময় ছাড়া ছাড়াই স্ক্রল না করে আর পারে না ও এখন। আর কিছুদিন পরই তো বিয়ে। সাগ্নিকের তোলা ছবিগুলোই সাজিয়ে গুছিয়ে লিখে ফেসবুকে শেয়ার করবে বীথি, আর পুড়বে ও। বীথির সিঁদুর দানের ছবিটাও…

না, আর ভাবা ঠিক না, একটা অসম্ভব-এর পিছনে ছোটার তো কোন মানে নেই। এভাবে শুধু নিজেরই ক্ষতি করছে ও।

।।৪।।

(এখন )

“আরে দরজাটা লাগাও না, দরজা দিয়ে স্ট্রীটল্যাম্পের আলোটা পুরো ঘরে ঢুকছে, আমায় রোজ ভোরে উঠতে হয়। এটুকু মানবিকতা তো থাকা উচিত”, কথাকটা ঝাঁঝের সাথে বলে ওপাশ ফিরে শুলো মুন।

কোথাও ভাবনায় হারিয়ে গেছিল সাগ্নিক, রূঢ় বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ল আবার। মুন তো ওর দিকে ভালভাবে তাকায়ও না। তবে হ্যাঁ, আজ অবধি এই ক’মাসে নিজের দায়িত্বে কোন ত্রুটি রাখেনি ও। আর কতদিন এভাবে চলতে পারে?

বারান্দা থেকে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল সাগ্নিক, মুন-এর পাশেই। মাঝে সবসময়ই একটা দূরত্ব থেকেই। মাথাটা বড্ড ব্যাথা করছে আজ ওর, শরীরটাও ম্যাজ-ম্যাজ করছে। জ্বর-টর আসবে নাকী। গায়ে চাপাটা টেনে নিয়ে পাশ ফিরে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ল।

*************

কতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিল কে জানে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেন। ঘুমটা ভেঙে গেল ওর, অসহ্য কষ্ট হচ্ছে মাথায়, আর জল পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু জলের গ্লাস আর জগটা খাটের ওপাশের দিকে, মুন-এর পাশে, আর খাট থেকে উঠে জল খবর ক্ষমতা ওর নেই এখন। গায়ে প্রচন্ড জ্বর বুঝতেই পারছে। কিন্তু, মুনকে ডাকলো না, মুন-এর মাথার কাছ দিয়ে জলটা নেওয়ার চেষ্টা করল, পারছে না। মুনকে ডাকতেই হবে।

মুন-এর মুখের উপর পূর্ণিমার চাঁদের আলোটা পড়েছে পুরো, জানলার গরাদ গলে। সারা ঘর চাঁদের জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে, আর মুনের ঘুমন্ত মুখটা, বড্ড ভালো লাগছিল দেখতে সাগ্নিকের। কত শান্ত, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে, মুন-এর এই ‘মুন’ নামটা বাদ দিয়ে বাকী সবকিছুই তো বড্ড…থাকগে, সাগ্নিকের তো ‘মুন’ নাম ছাড়া কোনো নামে ডাকারও অনুমতি নেই।

কেন? কিসের এতো রাগ বলতো তোমার আমার উপর? কী করেছি আমি? আমি তো শুধু তোমায়… ভীষণ ইচ্ছে করছে মুন-এর নরম গালের একটু স্পর্শ পেতে, ওর ঠোঁট, নাক, চোখ, এলোমেলো হয়ে থাকা চুল, ঠোঁটের কাছের তিলটা।।।। ওর পিপাসা তো এভাবেও মিটতে পারতো।।।। ওর ঠোঁটে যদি ডুবে যেত সাগ্নিকের ঠোঁট। এমনটাই তো হওয়ার কথা।।।। ওর বুকের বাঁদিকটা উন্মুক্ত হয়ে গেছে। না, এভাবে কখনোই ওকে দেখেনি সাগ্নিক কিন্তু, আজ ইচ্ছে করছে দেখতে, হারিয়ে যেতে, মিশে যেতে, ভালোবাসায়। ঐ একটা জিনিসই তো চেয়েছে জীবনে, কিন্তু।।।। বুকের বাঁদিকের লাল তিলটা এর আগে কখনো দেখনি ও। আজ চাঁদের আলোয় দেখল, আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছিল না সাগ্নিক। দুই ওষ্ঠের মধ্যে দূরত্ব মাত্র কয়েক মিলিমিটার, মুনের নিঃশ্বাসটাও ছুঁয়ে যাচ্ছে এখন সাগ্নিককে, তখনই ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে তাকাল মুন। সাগ্নিক ওর একদম কাছে, প্রস্তুত ছিল না ওরা মুহূর্তটার জন্য, কিন্তু, যা হওয়ার হয়ে গেল। পূর্ণিমার চাঁদকে সাক্ষী রেখে মিলিত হলো তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটগুলো, আজ অনেক অপেক্ষার পর। 

কিন্তু… কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সাগ্নিককে নিজের কাছ থেকে ঠেলে সরিয়ে দিলো মুন। ঘটনার আকস্মিকতায় সাগ্নিকও অবাক।

-“কী হলো?”

-“জিজ্ঞেস করতে লজ্জা করছে না কী হলো?”

-“মানে? আমি তো তোমায় জোর করিনি, তাহলে এরকম ব্যবহার করছো কেন?”

-তুমি চুপ করো একদম, সব জানা আছে আমার। ছিঃ।।।”

এতটা অপমান মেনে নেওয়া যায় না বোধ হয় আর, শরীরে জ্বর নিয়ে ঐ অবস্থাতেই খাট ছেড়ে উঠে গেল সাগ্নিক, একপ্রকার জোরে করেই। সবকিছুর আগে আত্মসম্মান ওর কাছে, আর সেটায় একবার ঘা লাগলে……

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

তোমায় আমায় মিলে

।।১।। “উফফ! পা-টায় যা অসহ্য যন্ত্রনা করছে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে। আর পারা যায়?” হাতের , কানের গয়নাগুলো খুলতে খুলতে বলছিল কুহেলী। রাজীব ততক্ষণে মোবাইল

Read More »

নিভৃত যতনে

।। ১।।   কোর্টের বাইরে তখন খাঁ খাঁ করছে রোদ, ঘড়ির দিকে তাকাল একবার রিয়াঙ্কা, কোথা দিয়ে এতটা সময় চলে গেল বুঝতেই পারেনি। একবার বাবার দিকে

Read More »

সন্ধ্যে নামার আগে

।।১।। “প্লিজ তোমার ভাঙা রেকর্ডটা একটু বন্ধ কর তো, সবসময় ভালো লাগে না। একেই অফিসে এত কাজের প্রেশার, বাড়ীতে একটু শান্তিতে বসব, তাও দেবে না।”

Read More »

যদি

।।১।। “আর দেরী করলে কিন্তু, সত্যিই পৌঁছতে পারবে না, অলরেডি সাড়ে চারটে বেজে গেছে” মা-এর উদ্দেশ্যে চেঁচাল মৌমিতা, অয়নের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। অয়নও একটা

Read More »

তুমি রবে নীরবে

।।১।। “বাবু, তোকে আর কতবার বলতে হবে, রোজ একবার করে অন্তত প্র্যাকটিসটা করবি question bank টা। আজও তো করলি না।” পেটির মাছের পিসটা একমাত্র ছেলের

Read More »

একে একে এক

।।১।। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমার আড়ালে ঘন কালো কাজলে মোড়া বড় চোখদুটো সামনের দেবদারু গাছটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে কি যেন একটা খুঁজছিল, হাতের পেপার ওয়েটটা

Read More »

Share with