।।১।।
“আর দেরী করলে কিন্তু, সত্যিই পৌঁছতে পারবে না, অলরেডি সাড়ে চারটে বেজে গেছে” মা-এর উদ্দেশ্যে চেঁচাল মৌমিতা, অয়নের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। অয়নও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে বলল, “এদের নিয়ে যে কী করব, কে জানে, আরে ও বাবা।।।”
মিঃ এন্ড মিসেস সেনগুপ্ত, একসাথে শেষ কবে বেড়াতে গেছেন, এবাড়ির স্মৃতিতে তো নেইই, ওনাদের নিজের স্মৃতিতেও ধুলো পড়েছে। আজ অনেক বাক বিতন্ডার পর অবশেষে ছেলে বৌ-এর পাল্লায় পড়ে একসাথে শুধু দুজনে বেরোচ্ছেন একটু গানের অনুষ্ঠান দেখতে, রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে।
ছেলেই ক্যাব বুক করে দিলো। গাড়ি করে বেরলো যখন তখন ৫টা বেজে গেছে। যেতে ৪০ মিনিট তো লাগবেই। গজগজ করছিলেন সমরেশবাবু। রমাদেবীর জন্যই নাকি এত দেরী হয়ে গেল। আর ছেলের এসব করার দরকারই বা কী ছিল? এখন আর এতক্ষণ ধরে চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান দেখার ধৈয্য, ইচ্ছে, ক্ষমতা কোনটাই নেই, বয়স হয়েছে তো, এই বয়সে রেডি হয়ে আবার যাওয়া আসা, এত পোষায় না। ছেলে টেবিলও বুক করে রেখেছে রেস্টুরেন্ট এ, বিরক্ত লাগছে সমরেশবাবুর। বাড়ি ফিরে কখন একটু বিছানায় গড়াবেন কে জানে। আর হল অন্ধকার হয়ে গেলে ঢুকতে ভীষণ অসুবিধা। এইটা একদম পছন্দ না ওনার। কাকে আর কী বলবেন? কেউ কানে কথা নিলে তো।
গাড়িতে চেপে কত্তার দিকে তাকিয়ে রমাদেবী বললেন, তাড়াহুড়োয় তো ঠিক করে টিপটাও পরা হলো না। মৌ-টাও নেই। একটু দেখ তো।
বহুবছর পর এরকম একটা পরিস্থিতি, খানিক লজ্জা, খানিক অস্বস্তি, খানিক ভালোলাগা, সমরেশবাবুর কোঁচকানো ভ্রুটা আর দেখা গেল না, তার জায়গায় যেন প্রশ্রয়ের আলগা হাসি, সযত্নে লুকিয়ে ফেললেন পাকা গোঁফের আড়ালে।
*************
অনেকগুলো বছর পর এবার কলকাতায় মীনাক্ষী, আজ সকাল থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল আজকের সন্ধ্যেটা নিজের নামেই রাখবে। স্বামী, ছেলের নামে তো বাকী সব রইলোই, নিজের মত করে একা থাকতেই বরাবর ভালোবাসে ও। ব্যস্ত জীবনে সেই ফুরসত আসে বড়ই কম। আজ তাই কোন এদিক ওদিক নয়। গাড়ি নিল না, ক্যাব নিয়ে পৌনে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল সাদার্ন এভিনিউ-এর ফ্ল্যাট থেকে।
হালকা ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে, কাঁচটা ড্রাইভারের অনুরোধে তুলতেই হলো তাই। জানলার কাঁচ পেরিয়ে আজ অনেকগুলো বছর পর নিজের শহরটাকে, একদম নিজের মতো করে, একান্তে দেখছে ও। কত কী বদলে গেছে শহরটায়। পাঁচবছরের বিবাহিত জীবনে তিনবছরের ছোট্ট ছেলেটা আর স্বামীকে নিয়ে কখন যে হুস করে কেটে গেছে, যেন কোন বিরামচিহ্নই ছিল না। অন্তহীন চলে যাচ্ছিল, একনাগাড়ে, একঘেয়ে নয় একদমই, বরং বেশ হ্যাপেনিং-ই ওর লাইফ। কিন্তু এতো একসাইটমেন্টের মধ্যে কোথাও যেন একটু একান্তে নিজের মতো সময় আর কাটিয়ে ওঠা হয়নি বহুদিন।
বৃষ্টিটা ধরেছে একটু, কাঁচটা নামাতেই ঠান্ডা হওয়ার ঝলক লাগল মুখে। সেই চেনা গন্ধটা, সেই অনুভুতিটা, কৃত্রিম হিমশীতল ঘরে যার ছোঁয়া পায়নি বহুদিন। ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের ফুলগুলো রাস্তা ভরিয়ে দিয়ে গেছে অনেকটা। পুষ্প বৃষ্টি একেই বলা যায় হয়তো। ড্রাইভার নিজে থেকেই গানটা বাজাল –
” মন মোর মেঘের সঙ্গী
উড়ে চলে দিগ্দিগন্তের পানে
নিঃসীম শূন্যে,
শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে
রিমিঝিম রিমিঝিম রিমিঝিম।।”
মনটা যেন আরও উদাসী হতে চাইছে আজ, চলতে লাগল গানটা, চলুক, ভালই লাগছিল, চলছে গাড়িও।
**************
বিশুকাকা, ঐ রোলের দোকানটার সামনে দাঁড়াবে কিন্তু, রোল খেয়ে যাব, তুমিও খাবে আজ, তোমারও তো খুব পছন্দ, অনেকদিন খাওনি। বিশুকাকার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছিল অর্পিতা, ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই। অর্ণবের মেসেজগুলো পড়ে হাসছিল নিজের মনেই। কেউ একা কী করে, বেড়াতে যেতে পারে? এনজয় করতে পারে? বরাবরই অনেক প্রশ্ন অর্ণবের মনে, কেউ সোলো ট্রিপ কি করে এনজয় করতে পারে? বারবার আসতে চেয়েছিল অর্পিতার সাথে। ও-ই আসতে দেয়নি। আজ নিজের মতোই ঘুরবে, ঐ যে সামনের বাঁকটা ঘুরলেই সেই রোলের দোকানটা, অর্পিতার ফেভারিট।
গাড়িটা সাইড করে রাখল বিশুকাকা। গাড়ি থেকে নেমে সানগ্লাসটা মাথার উপর তুলল অর্পিতা, একটা টপ আর জিন্স পরনে। ফোনটা জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে দোকানের দিকে এগোল ও। চিকেন রোলের অর্ডার দিয়ে বিশুকাকার সাথে গল্প জুড়ল খানিক। বিশুকাকা অর্পিতাদের বাড়িতে ড্রাইভারের কাজ করে যখন অর্পিতার পাঁচ-ছ’বছর বয়স, নিজের কাকার মতোই শ্রদ্ধা করে ও।
-“আচ্ছা তুমি এখন পৌঁছে দিয়ে চলে যাবে, ফেরার সময় তোমায় আর আসতে হবে না, আমি ক্যাব নিয়ে নেব।”
-“কেন? কী দরকার রাতদুপুরে।।।”
-“কাকীমার এই অপারেশন হয়েছে, কোন মানেই হয় না রাত করার, গাড়িটা নিয়ে চলে যাও আজ। আমি বলছি তো, আর বাবা বেরবেও না, কিছু বলবেও না। তাই।।।”
বিশুকাকা আর কথা না বাড়িয়ে সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন হেসে। ততক্ষণে চিকেন রোল রেডি হয়ে গেছে।
।।২।।
-“চলো, চলো, তাড়াতাড়ি চলো, ওয়াকে বেরিয়েছ মনে হচ্ছে, শুরু হয়ে গেল এতক্ষণে।”
-“তা দেরী করে বেরিয়েছিলটা কে?”
-“হ্যাঁ তোমার তো আমার জন্যই সব জায়গায় বিলম্ব, সবেতে সমস্যা। শুনে শুনে কান পচে গেল।”
বাকযুদ্ধ চলতে চলতে এগোতে লাগলেন দুটিতে। সমরেশবাবু কোনদিনই বিশেষ কিছু বলেন না। রমাদেবী যে ভীষণ ভাল মনের মানুষ, বড় মনের মানুষ সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বিয়ের প্রথমেই সুন্দর ভাসা ভাসা চোখ আর অসাধারণ মাংস রেঁধে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সমরেশবাবু যেমনি খেতে ভালবাসেন, তেমনি মারাত্মক রাঁধেন রমাদেবী।
সময়ের সাথে সাথে সুগার, প্রেশার, কোলেস্টরলের থাবা থেকে বাঁচেননি সমরেশবাবুও। খাদ্যরসিক মানুষটার খাবারের মেনু থেকে বাদ পড়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু যত্ন আত্তির এতটুকু ত্রুটি হতে দেননি রমাদেবী। একাধারে যখন ডাক্তারবাবু সুস্থতার অভিপ্রায়ে এটা চলবে না, ওটা চলবে না বলে মেনু কমিয়ে গেছেন, নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্ট করে সমরেশবাবুর শরীর আর মন মত খাবার জুগিয়ে গেছে রমাদেবী।
পুরুষমানুষের মনে গেঁড়ে বসতে গেলে নাকি পেট দিয়েই প্রবেশ করতে হয়, এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন রমাদেবী। তাই, জীবনের বেশিরভাগ সময়টা রান্নাঘরে স্বচ্ছন্দেই কাটিয়েছেন উনি। সমরেশবাবু এসবই জানেন, বোঝেন, বা জেনে বুঝেও না বোঝার ভান করেন। একটা অদৃশ্য হিমশীতল বরফের চাঁই যেন জমাট বেঁধেছে দুই মানুষের মধ্যে – একটা বিরাট অভিমানের পাহাড়। রমাদেবীর এত যত্ন, এতসব নিপুণতার মধ্যেও সমরেশবাবু বারবার পেয়েছেন সামান্য ভুলত্রুটিতেই সাংঘাতিক মেজাজ, মুখরা জবাব, সোজা কথায় যাকে বলে মুখ ঝামটা। রমাদেবীর এত ভালর মধ্যে ও বদরাগী স্বভাবটার জন্যই হয়তো ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সমরেশবাবু। আর অপরপ্রান্তটা? স্বেচ্ছায় নিজের গান, নিজের শখ শৌখিনতা, নিজের সমস্ত সময়, সারাটা জীবন যাকে ঘিরে, যার জন্য নিজের কিছুই রাখলেন না, সবটুকু দিলেন, সে বুঝল কতটুকু?
নাহ, এই কথাগুলো একে অপরকে কেউই বলেননি, বলা হয়েও ওঠেনি। আর কখনো বলা হবে কী না তাও অজানা।
হল অন্ধকার হয়নি, তার ঠিক আগেই খুব জোর পৌঁছলেন দুজন, সীট খুঁজে বসলেন যখন তখন আলো নিভে গেছে, মঞ্চে তখন অনুষ্ঠান শুরু হলো বলে।
****************
ক্যাবে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে নামল মীনাক্ষী। বাড়িতে বলে দিয়ে ফোন অফ করল, আর কারও ফোন, কারও সমস্যা শোনার কোন ইচ্ছে নেই। আপন মনেই হাঁটতে হাঁটতে এগোল সামনের মোড়টার দিকে, চারপাশে এখন এত দোকান, ঝলমলে আলো, হাজারো জিনিসের পশরা, যেকোন মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে। মীনাক্ষীর শপিংমলে বাজার করার থেকে এই-ই বেশী পছন্দের। খানিক এগিয়ে হঠাৎ খুঁজে পেয়ে গেল ভুলতে বসা সেই ফুচকা কাকুকে। বয়সের ভারে চেহারা অনেকটা বদলে গেছে ঠিকই, কিন্তু চিনতে খুব একটা অসুবিধাও হয়নি। আজ এত বছর পর অনেকটা ভালো লাগায় মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছিল মীনাক্ষীর। তখনই পিছন থেকে পরিচিত ডাকটা পেল, “মিনু।”
****************
-আমি কীভাবে এই সীটটায় বসবো, আপনিই বলুন, আপনি নিজেই তো দেখতে পাচ্ছেন। প্লিজ অন্য কোনো ব্যবস্থা করুন।”
-“দেখুন ম্যাডাম, পুরো হলই ভর্তি, এভাবে কী করবো? আমাদের হাতে থাকলে আমরা নিশ্চয়।।।”
-“সমরদা, এই 94B টা ফাঁকা আছে। ক্যানসেল হয়েছে লাস্ট মোমেন্টে, এই একটাই।”
-“ওহ, বাঁচালি, ম্যাডাম 94B, ঐ একটাই সীট ফাঁকা হয়েছে। আসুন ম্যাডাম, আসুন।”
ভদ্রলোকের সাথে এগোল অর্পিতা। ও একা এলে কর্ণার সীট-ই নেয়, আর তার পাশের সীটও কেটে নেয়, যাতে কোনরকম অসুবিধায় না পড়তে হয়, কিন্তু এমন কপাল, দুটো সীটই যাচ্ছেতাই অবস্থা। এই সমস্ত ঘটনার জন্যই সিঙ্গল হলগুলোর আজ দুরবস্থা। গজগজ করতে করতে এগোল অর্পিতা।
সমরবাবুর দেখানো সীটে বসল ও, ধারের সীট, তবে কর্ণার নয়। এই সাইড দিয়েই এবার হাজারবার লোক ঢুকবে। মুডটাই খারাপ করে দিলো। গুছিয়ে বসলো অবশেষে অর্পিতা। বসে অর্ণবকে একটা টেক্সট করতে ফোনটা নিল। অর্ণব একটা ছবি পাঠিয়েছে। নিজের হাতে আঁকা পেন্সিল স্কেচ। অর্পিতার হাসিমুখের একটা মুহূর্ত। জন্মদিনের দিন-এর মুহূর্ত এটা, যখন অর্ণব ওকে কেক খাইয়ে দিচ্ছিল।
অনেকটা ভালোলাগায় যেন ভরে গেল চারপাশটা। তখনই পাশে এসে দাঁড়াল ওর পাশের সীটের মানুষটা, “এক্সকিউজ মি।”
অতি পরিচিত কন্ঠটা বহুবছর পর, তাকিয়ে দেখল অর্পিতা। আলো আঁধারিতে সাদা পাঞ্জাবীতে আবির।
।।৩।।
অনেক রাত অবধি বন্ধুরা মিলে কনফারেন্স কল-এ গল্প করে মীনাক্ষীরা। সদ্য সদ্য কলেজে ঢুকলে যা হয়। হাতে নতুন মোবাইল ফোন এসছে। মা বার কয়েক ঝাড় দেওয়ার পর ফোনটা কেটে চাদরটা টেনে শুয়ে পড়ল ও। ও, শুভাশিষ, প্রিয়াঙ্কা, রঞ্জন, আকাশ। যদিও আকাশ মীনাক্ষীর একটু বেশীই কাছের বন্ধু। ব্যাপারটা একদমই একতরফা কাউকেই ঘুনাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি মীনাক্ষী। এই লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের মত করে একান্তে এই প্রেমটা ওর খুব পছন্দের। আজ টিউশন থেকে পড়ে ফেরার পথে গল্প করতে করতেই আকাশের হাতটা ওর হাতে লেগেছিল। ওর সারা শরীরে, ওর পেটের ভিতর কীরকমই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল, এর আগে কখনো এরকম হয়নি। একটা ভীষনরকম ভালোলাগার অনুভূতি, একে যেন শুধু উপলব্ধিই করা যায়, কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। রঙ্গীন স্বপ্নে মোড়া ভাবনাগুলো কখন ওর চোখে ঘুমের চাদর ঢেকে গেল, বুঝতেই পারেনি অষ্টাদশীর মিনু।
*************
আজ সবাই বেশ সাজগোজ করেই কলেজ এসেছিল, কলেজে রবীন্দ্রজয়ন্তীর ফাংশান ছিল, তাই সাজ যে বাঙালীই হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কলেজ থেকে বেরলো ওরা যখন তখন বিকেল ৪টে – ৪:৩০টে হবে। এখান থেকেই টিউশন যাবে সব একসাথেই, কলেজস্ট্রিট। ট্রাম ছাড়া গতি নেই, ট্রামের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে যে যার মতো আড্ডা ইয়ার্কিতে মশগুল। বাড়িতে বাবাকে ফোন করছিল মিনু। মিনু মা বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে, ওর বাবার আবার একটুতেই বেশীই চিন্তা, বারবার ফোন চলতেই থাকে। মিনু আগেই ফোন করে জানিয়ে দিল, আর বাড়ি ফিরবে না, কলেজ থেকেই সোজা পড়তে যাচ্ছে, ছোট্ট করে একটু ঢপ-ও দিয়ে দিল, টিউশনে এক্সট্রা ক্লাস। টিউশন শুরু ৬টা থেকে, ওরা সব আগেই যাচ্ছে, যতক্ষণ আড্ডা দেওয়া যায় আর কী।
আজ সকাল থেকেই মিনু দেখছে, আকাশের হাবভাব অন্য বাকী দিনের মতন নয়, একটু আলাদা। ওরা এত ভাল বন্ধু, কিন্তু আজ বাকী সবাই এত গল্প করলেও আকাশ চুপচাপ। কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে, বা বারবার কী করছে চুপচাপ দেখার জন্য তাকাতেই দেখছে ও নজর এড়াচ্ছে বারবার। মীনাক্ষীর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মাথা নীচু করে নিচ্ছে। এতটা আনস্মার্টও নয় ছেলেটা, কিন্তু আজ কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেটাকে নিতান্তই ক্যাবলা গোছেরই লাগছিল মীনাক্ষীর। আকাশের আদি বাড়ি গ্রামে, কিন্তু আগাগোড়া হস্টেল, বোর্ডিং-এ থেকেই পড়াশোনা করার দরুণ এই ঝকঝকে স্মার্ট ছেলেটা মেধাবীর সাথে সাথে ভীষণ সুন্দর কথাও বলে। কিন্তু সেই ছেলেটারই আজ এমন ব্যবহার দেখে অদ্ভুত লাগছিল মীনাক্ষীর। আকাশ আজ পড়েছে গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবী, বড্ড সুন্দর দেখতে লাগছে আজ ওকে। মিনু বারবার নানা অছিলায় যখনই তাকাচ্ছে একটিবার মন ভরে দেখার জন্য, ততবারই দেখছে আগে থেকেই আকাশ ওর দিকে তাকিয়ে। আর সে দৃষ্টি আর পাঁচটা দিনের মতন নয়, অন্যরকম, কেমন বলতে পারবে না ও। কিন্তু যেমনই হোক, ভীষণ সুন্দর।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরই, ট্রাম চলে এল। প্রায় সময়ই ট্রামে যাতায়াতের দরুণ কন্ডাক্টার কাকু ভালই চেনে ওদের।
ওরা পিছন দিকে সেকেন্ড ক্লাসের যে সীটটায় সাধারণত বসে সেই সীট আজও ফাঁকাই ছিল। বসল সব। ট্রাম ছেড়ে দিল ততক্ষণে।
****************
-“এই লস্যি খাবি?”
-“না না, এই তো এত খেলি, এর মধ্যে তোর পেয়েছে ক্ষিদে?”
-“গাধা, লোকে লস্যি ক্ষিদে পেলে খায় না, ইচ্ছে হলেই খায়।”
-“খেলে বল, পরের স্টপেজেই নামতে হবে তাহলে, প্যারামাউন্ট থেকে লস্যি খাবো তাহলে।”
-“আমার কোন প্রব্লেম নেই।”
-“আরে আমার পেট বিগড়োবে, আজ ছাড় না।”
-“কিচ্ছু হবে না, চল তো।”
-“কাকু, সামনেরটায় বেঁধো।।।”
-“চল, চল।”
-“এই থাক, আজ আমারও ইচ্ছে করছে না।”
-“আমিও যাবো না, আজ থাক, বড্ড রিচ খেয়ে ফেলেছি।”
-“আরে আশ্চর্য, আমরা নেমে পড়লাম তারপর তোরা বলছিস, কোন সেন্স নেই নাকি।”
-“আরে, আরে, কাকু বেঁধে।।। আরে ওঠ।”
-“ধ্যুর চলে গেল।”
মীনাক্ষী আর আকাশ বোকার মত নেমে পড়ল আগের স্টপেজেই। বাকীরা হাত নেড়ে ইশারা করে সরি বলল বটে, কিন্তু খুব রাগ হচ্ছিল মীনাক্ষীর।
-“কোন মানে হয় বলতো, এখন আবার এতটা এই গরমের মধ্যে হেঁটে হেঁটে যাও।”
-“তুই বুঝিস না কিছু?”
প্রমাদ গুনল মীনাক্ষী, বুকের ভিতরটা ধুকপুক করছে আবার। ও যা ভাবছে, তাই নয়তো? সকাল থেকেই আকাশের মতিগতি অন্যরকম লাগছিল। আকাশ কী।।।?”
“বুঝি না মানে? কী বুঝব?” আকাশের দিকে না তাকিয়েই হাঁটতে হাঁটতে বলল মিনু।
ও জানে আকাশ কী বলতে চাইছে, ওর কানও সেটাই শুনতে চাইছে যেন। কিন্তু।।। এত ভয় করছে কেন ওর? ভীষণ নার্ভাস লাগছে, হাতটাত ঘেমে যাচ্ছে।
-“আই লাভ ইউ, সেই তো চিরাচরিত তিনটে শব্দ, এটাও বুঝিস না?”
পাশ দিয়ে হুশ করে বাইকটা পেরিয়ে গেল। একটু হলেই ধাক্কা খাচ্ছিল মীনাক্ষী, আকাশই হাতটা টেনে ধরলো।
এরকম অনুভূতি কোনদিন হয়নি, আজ যা অবস্থা ওর। ভীষণ ভীষণ খুশী ও, ওর জীবনের প্রথম প্রেম এভাবে ওর কাছে ধরা দেবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি, জাস্ট ভাবেনি। নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরই সন্দেহ হচ্ছিল যেন। এইভাবে।।। আকাশ।।। নাহ, আর ভাবতে পারছে না। বড্ড লজ্জা লাগছে। হঠাৎ, সেই চিরপরিচিত বন্ধুটার সামনেই আজ এত লজ্জা পাচ্ছে কেন মিনু, ও নিজেও জানে না।
-“কীরে, কিছু বলবি না?”
হাঁটতে হাঁটতে কখন ওদের টিউশনের কাছে চলে এসছে খেয়ালই করেনি মিনু। মনে হচ্ছে, ছুটে পালাক। ওর হাতটা এখন আকাশের হাতেই। বুকের ভিতর যেন হাতুড়ি পিটছে। আকাশও রাস্তার দিকে মাথা নীচু করে চলতে চলতেই কথা বলছে। দুজনের চোখে চোখ রাখার সাহস আর হচ্ছে না, কৈশোরের প্রেম কী এরকমই হয়?
-“আজ রবীন্দ্র জয়ন্তী, ওসব ইংরেজী সবসময় ঝাড়লে হবে না। শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলবি আগে, তারপর দেখছি।” এটা বলেই সেদিনের মতো আকাশের হাত ছেড়ে পালিয়েছিল মিনু।
আকাশ বাঙালী হলেও বাইরে থাকার দরুণ, আর মা অবাঙালী হওয়ার দরুণ বাংলার থেকেও হিন্দিতে বেশী সাবলীল। কথার মধ্যেও টান স্পষ্ট। বাংলা শব্দের সাথে হিন্দি শব্দ মিলিয়েই কথা বলে বেশী।
সেদিন সারা ক্লাসজুড়ে, বাড়ি ফেরার আগে পর্যন্ত দুজনের চোখে চোখে কথার সাক্ষী ছিল শুধু দুজনেই। অনেকটা ভাললাগা, আর সদ্য কৈশোর পেরোনো অষ্টাদশীর কী ভীষণ লজ্জা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল মিনু। আকাশ থাকত পিজিতে, মিনুর বাড়ি থেকে একটু দূরে। একই রাস্তা, তবু আর একটি শব্দ বিনিময়ও হয়নি দুজনের মধ্যে। ফোন অফ করে শুয়ে পড়েছিল সেদিন ও। যেন ভীষণভাবে ঐ বিশেষ দিনটাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা, চলে যাওয়ার আগে বহুমূল্য মুহূর্তগুলোতে পুরোপুরি বাঁচার চেষ্টা।কানে রবিঠাকুরের গান শুধু, প্রেমের আনন্দ কিংবা যন্ত্রণা, এই মানুষটার থেকে ভালো আর কেই বা ব্যক্ত করতে পেরেছে, “আধেক ঘুমে নয়ন চুমে স্বপন দিয়ে যায়।
শ্রান্ত ভালে যূথীর মালে পরশে মৃদু বায়॥”
চুপচাপ চোখ বুজে নিজেকে স্বপ্নের রাজ্যে ভাসিয়ে দিয়েছিল মিনু। পরদিন শুদ্ধ বাংলায় প্রেমপত্র লিখে নিয়ে মিনুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আকাশ। অতি কষ্টে সারারাত ধরে লেখা সেই প্রেমপত্রে ভুলত্রুটি তো ছিল অনেক কিন্তু নিষ্পাপ প্রেমের কোন ঘাটতি ছিল না। সেই থেকেই ওদের প্রেমের শুরু। তখনই ঠিক করেছিল দুজন, ওদের প্রেমের এই দিনটা, রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনটা ওরা এই খানেই আসবে সবদিন। যেখানে প্রথম আকাশ ওর মনের কথা বলেছিল, ওর হাত ধরেছিল, ঠিক সেখানেই।
*************
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অতীতের সমস্ত ঘটনাগুলো যেন ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল মিনুর। ওর হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেম, যাকে খুঁজেছে এতদিন, এতবছর, ওর আকাশ, আজ ওর সামনে।
*************
রমাদেবীর বরাবরই গানের বড় শখ ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে সেই গানের রেওয়াজ শুরু করা আর হয়ে ওঠেনি। না, কেউ কোন বাধা দেয়নি, কেউ চাপও সৃষ্টি করেনি, কিন্তু কেউ বলেওনি সংসারের দায়িত্বটা একটু কমিয়ে রেওয়াজটা শুরু করতে। বাপের বাড়ি থেকে আনা হারমোনিয়ামটা বাক্স সমেত সেই যে খাটেরর তলায় ঢুকেছে, ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে ক’বার বাজানো হয়েছে এতগুলো বছরে, হাতে গোনা যাবে। মঞ্চে শুরু হলো কবিগুরুর গান , “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে…
তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে ।।” গুনগুন করে গেয়েই ফেললেন আজ রমাদেবী। এভাবে শুধুই দুজনে কোনো গানের কনসার্টে আসাও এত বছরে প্রথম। সারা পরিবার মিলেই যেখানে যাওয়ার গেছেন, সবাই এদিক ওদিক ছিটকে যাওয়ার পর ছেলে, বৌমা – ব্যস এই অবধি। তাই তখন এভাবে গেয়েছেন কিনা কখনো চোখে পড়েনি। দেখার চেষ্টাও করেননি সমরেশবাবু।
আজ রমাদেবীর অলক্ষ্যেই আলো আঁধারিতে মুগ্দ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। রমাদেবী চোখ বুজে গুনগুন করছিলেন। রমাদেবীর হাতটা ধরতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কোথাও যেন আটকাচ্ছিল, বাধা তো কেউ দিচ্ছে না, তাও। এই দূরত্ব অব্যক্ত, অদৃশ্য। শুধুই ওনারা দুজন জানেন, আর কেউ নয়, ৩৫বছরের ‘সুখী’ দাম্পত্যের আড়ালে অজস্র কথা বলা বাকী থেকে গেছে। যদি ঠিক সময়ে মুহূর্তগুলোতে বাঁচতো, যদি না বলা কথাগুলো সমস্ত ইগো ভেঙে বলত, যদি অভিনয় না করে অভিমানটা ভাঙার চেষ্টা করত, তাহলে হয়তো আজ এতটা কাছে থেকেও এই অদৃশ্য দূরত্ব টা তৈরী হতো না।
শাড়ীটার দিকে তাকালেন এতক্ষণে সমরেশবাবু। এই শাড়ীটা কিনে এনেছিলেন ওনার ছোট বোনের জন্য। ছোট বোনের পছন্দ হয়নি বলে দিয়ে দিয়েছিলেন রমাদেবীকে। না, তারপর থেকে আর সেভাবে কোন উপহার নিজে হাতে কিনে আনা হয়নি। টাকা দিয়ে দিয়েছেন, নিজের পছন্দ মতো কিনে নিতে বলেছেন, ব্যস এটুকুই। সেই শাড়ীটাই পরেছেন আজ রমাদেবী, যেটা রমাদেবীর জন্য কেনেনইনি সমরেশবাবু।
অনেকগুলো বছর, অনেকটা সময় যেন নষ্ট করে ফেলেছেন, সময় তো কারও জন্য থেমে থাকে না, সবটা অন্যরকম হতেও পারত, যদি।।।
**************
-“কেমন আছিস রে অপু, এখানে? একাই?”
-“হুম, তুই তো জানিস, একা ঘুরতে কতটা।।।”
-“হ্যাঁ, কেমন আছিস? ফোন নম্বরটা।।।”
-“ভাল আছি। তুই?”
-“ঠিকঠাক। এখন কী কলকাতাতেই আছিস?”
-“হ্যাঁ, এখন কিছুদিন কলকাতাতেই আছি, তবে বেশীদিন থাকতে পারব না, তোর কী খবর? এখন কী করছিস?”
-“নাথিং মাচ, যেখানে ছেড়ে গেছিলি সেখানেই আছি।”
হাসতে হাসতে বলল আবির । সে হাসি চোখ অবধি পৌঁছয় না। অর্পিতা হাসল না। চোখ দুটো সরাসরি আবিরের চোখে রাখল। জোর করে হাসির চেষ্টা করেও হাসতে পারল না। মুখটা ঘুরিয়ে নিজের সীটে বসল সোজা হয়ে। আবির ওর পাশের সীটে। ওর অতীত, যার থেকে আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল একদিন। আজ ডিভোর্সের চারবছর পর, হঠাৎ দেখা। সেই কোর্টের বাইরের পর আজ এই অডিটোরিয়াম। না, এই এত বছরে আর কোন কথা হয়নি। তোমার দোষ, তোমার ভুলের কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে কোনদিনই যেতে চায়নি ওরা দুজনই। যেটুকু কথা কাটাকাটি, মান অভিমান, ঝগড়া নিজেদের মধ্যে হওয়া প্রয়োজন ছিল, যেটুকু ভুল অপরের না দেখে নিজেরটা শুধরানোর দরকার ছিল সেটুকুও হয়নি। তাই “ফিরে আয়” বা “যাস না” বলার পথটুকুও হয়তো নিজের অজান্তেই নিজেরাই রুদ্ধ করে দিয়েছিল। ঠিকভুলের হিসেবে কষতে গিয়ে শুধু রক্তক্ষরণই বাড়বে, তার থেকে ঘুমিয়ে থাকুক কিছু স্মৃতি, সুখের কিংবা দুঃখের। তাকে আর জাগিয়ে লাভ নেই। এভাবেই কেটে গেছে মাঝের এতগুলো বছর।
“তোমার খোলা হাওয়া… লাগিয়ে পালে,
তোমার খোলা হাওয়া…
টুকরো করে কাছি , আমি ডুবতে রাজি আছি
আমি ডুবতে রাজি আছি ।
তোমার খোলা হাওয়া…।”
এই গানটা বড্ড প্রিয় ওদের দুজনেরই। লং ড্রাইভে এই গানটাই দুজনের প্রথম পছন্দ ছিল। গানটা শেষ হওয়ার পর হাততালি দিতে দিতে আবিরের চোখের কোণটা অন্ধকারেও চিকচিক করছিল চোখ এড়ায়নি অর্পিতার।
কিছুক্ষণেরর ব্রেক। হলে আলো জ্বলছে। অর্পিতা ব্যাগটা থেকে ফোনটা বের করে অন করছিল। আবির বলল, “পপকর্ণ খাবি না?”
-“না রে, ছেড়ে দিয়েছি, আমার তো কোনদিনই তেমন ভাল লাগত না, তোরই বেশী ভাল লাগত।।।”
-“হুম, সরি, এখনও নিজের পছন্দ নিজের ইচ্ছেগুলো তোরও ভাবি, তোকে কখনো বলা হয়নি, বাট, আই অ্যাম সরি, রিয়েলি সরি।”
-“ছাড় না।”
-“ছেড়ে তো দিয়েছি, তুই অর্ণবের সাথে ভাল আছিস, এটা দেখে আমার কিন্তু বিন্দুমাত্র রাগ, হিংসে হয় না, ভাললাগে। তোর সাকসেসফুল কেরিয়ার নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা সেই আবির এখন অনেক বদলে গেছে রে।”
-“তুই অর্ণবের কথা জানলি কী করে? মানে।।।”
-“জানার ইচ্ছে থাকলে জানাই যায়, নট আ বিগ ডিল। জানিস, সবাই যখন বলতো, এত সাকসেসফুল ল-ইয়ার, বাবার যোগ্য বৌমা, যোগ্য উত্তরসূরী, আমার খুব হিংসে হতো। আমি ছেলে হয়ে পারলাম না আর তুই।।। কিন্তু আজ ভাবলে বুঝি, কতটা নিরর্থক, মূল্যহীন ছিল সেগুলো। আই অ্যাম সরি রে।।। এই কথাগুলো যদি আগে বলতে পারতাম।।।”
-“আই অ্যাম অলসো সরি। আমিও তোর ভালোলাগা, তোর প্যাশন, তোর গানটাকে কোনদিন সিরিয়াসলি নিইনি।।। আই অ্যাম সরি টু, আমিও তো কখনো সরি।।।”
-“আজ আমরা যে এতগুলো কথা বললাম, এগুলো যদি আগে বলতাম তাহলে হয়তো।।।”
আর কিছু বলল না আবির। আবিরের না বলা কথাগুলো ওর দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল। অডিটোরিয়ামের আলো নিভে গেল, মঞ্চে জ্বলে উঠল আলো।
।।৪।।
-“এখানে এতদিন পর? তুই তো বাইরে ছিলিস বেশ ক’বছর? সরে দাঁড়া, গাড়ি।।।” বলে নিজেই মিনুকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিল আকাশ। বহুবছর পর আবার সেই একই জায়গা, একই মানুষ, একই রকমভাবে ছুঁয়ে যাওয়া হাত, কিন্তু, এতদিন।।।”
-“কেমন আছিস?”
-“তুই কেমন আছিস?”
-“আমি ঠিক আছি। তুই দেশে ফিরলি কবে?”
-“মাস পাঁচেক হলো। তোর কী খবর?”
-“আমার খবর? যেমন দেখছিস আর কী। এনিওয়ে, ফুচকাটা এখানকার জাস্ট অসাম, আগে খাওয়া যাক।”
-“হুম, ওকে।”
মনের ভিতর মনে হচ্ছিল কেউ একসঙ্গে ঢাক, ঢোল, ব্যান্ডপার্টি সব একসাথে বাজাচ্ছে। এভাবে কোন এক্সপেক্টেশন ছাড়া হঠাৎ করে সেই মানুষটা যদি সামনে এসে যায়, যাকে একবার দেখার জন্য পাগল হতে হয়েছে, তাহলে নিজের অনুভূতিগুলোকে কীভাবে বাগে আনতে হয় জানা নেই মিনুর।
ঠিক সেইদিনকার মতনই আজকের অবস্থাটা, যেন একলাফে নিজের কলেজজীবনে পৌঁছে গেছে ওরা দুজন। ফুচকা খেয়ে আকাশেরই কথা মতো সেই একই রাস্তা দিয়ে প্যারামাউন্টের দিকেই হাঁটছিল দুজন। আকাশ অনেকটা বদলে গেছে, সেদিনকার কমবয়সী রোগা ছেলেটা আজ পূর্ণবয়স্ক যুবক। চেহারাটাও ভারী হয়েছে খানিকটা। কয়েকটা রুপোলী চুলও উঁকি দিচ্ছে মাথায়। মিনু নিজেও তো কত বদলে গেছে।
রাস্তাটার ফুটপাথ ধরে সেই আগের মতন হাঁটছিল দুজন।
-“তোর ছেলে কত বড় হলো?”
-“এই তো তিন হলো সবে, এক মিনিট, তুই কী করে জানলি?”
-“না জানার তো কিছু নেই, ইচ্ছে থাকলেই জানা সম্ভব।”
-“তুই তো কোন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেও নেই, কোথাও-ই নেই।।।”
-“আমি সেখানেই আছি, ছিলামও, থাকবও, যেখানে আমার থাকার কথা, তুইই এগিয়ে গেছিস।”
বলেই হেসে মাথাটা নামিয়ে নিল আকাশ, সিগারেট ধরালো একটু আড়ালে গিয়ে।
-“এই নতুন বদ অভ্যাসটা কবে থেকে ধরলি?”
-“যেদিন থেকে তুই ছাড়লি।”
-“মানে? আমি তোকে ছেড়েছি না তুই আমাকে? কে ছেড়ে গেছিল? কে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল?”
-“মানে? তুই এই শহর ছেড়ে গেছিলি, আমি তো তোর জন্যই।।।”
-“নামী কলেজে ডাক্তারীতে নাম ওঠার পর কে ছেড়ে গেছিল? কে গেছিল কলেজ ছেড়ে?”
-“ওটা আমার ডিসিশন ছিল না। বাবার, দাদুর ডিসিশন ছিল, তোকে তো বলেছিলাম।”
-“আচ্ছা বেশ, মানলাম। তারপর চলে গিয়ে একটা যোগাযোগ করা গেল না? কোন বন্ধুর কাছেই তোর কোন হদিশ ছিল না, কি জন্য? বল? উত্তর দে।।।”
-“বাড়িতে তোর কথা জানিয়েছিলাম, নিছকই, খুব সাধারণভাবেই বলেছিলাম। হ্যাঁ, মানুষগুলো একটু পুরোনো মানসিকতার সেটা জানতাম, কিন্তু এভাবে রিয়াক্ট করবে সেটা বুঝতে পারিনি। বাড়িতে যখন বললাম, আমি ডাক্তারি পড়তে চাই না, আমি কেমিস্ট্রিটাই পড়তে চাই, মারাত্মকভাবে রিয়াক্ট করেছিল বাড়ি থেকে। কারণে অকারণে আমাদের মধ্যেকার যা কিছু, যতটুকুই ছিল সেটাকেই কারণ হিসেবে ভেবেছিল, আমার ফোন ছিল না আমার কাছে। আমি চেষ্টা করেও তোদের কারও সাথে আর পারিনি যোগাযোগ করতে। বহু চেষ্টা করেও তোর সাথে কনট্যাক্ট করতে পারিনি পাঁচমাস। বাবার দাদুর জিদের কাছে হেরে গিয়ে ডাক্তারী পড়তে চলে গেলাম। প্রথম যে সুযোগ টা পেলাম সে সুযোগেই তোর সাথে কন্ট্যাক্ট করতে চেষ্টা করেছিলাম। শুধু তোর নাম্বার টুকুই মনে ছিল। কিন্তু পেলাম না, নাম্বার চেঞ্জ করে দিয়েছিলি হয়তো, সবাইকে লুকিয়ে এই দিনেই আমি এসেছিলাম কলকাতা, তোর জন্য, আমাদের এইদিনে যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানেই। কিন্তু তুই ছিলি না।”
কি বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না মিনাক্ষী। যে মানুষটা এভাবে চলে যাওয়ার জন্য, যোগাযোগ না করার জন্য এত কেঁদেছিল, এত চিৎকার করেছিল, এত রাগ, এত অভিমান, সেই যখন ওকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে, আর ও তাকে।।। কিন্তু কেউই কাউকে এত খুঁজেও একটিবার দেখা হলো না, এরপর কী বলব নিজের ভাগ্যকে?
রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে ও, মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনগুলো। আকাশ হঠাৎ ওকে ছেড়ে যাওয়ার পর মানসিকভাবে সাংঘাতিক ভেঙে পড়েছিল ও। যে মেয়েটা সাজতে, খেতে, ঘুরতে, আড্ডা দিতে এত ভালবাসত, তার জীবন থেকে ‘জীবন’টাই যেন কেউ উপড়ে দিয়ে গেছিলো। চোখের কাজল, কানের ঝুমকো হারিয়ে গেছিল বহুদিন। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি ও আকাশকে। একটা রাতও যায়নি ও আকাশের জন্য চোখের জল ফেলেনি। হঠাৎ করে এভাবে একটা মানুষ হারিয়ে গেল, শুধু কলেজ চেঞ্জ করছি, ব্যস, আর কোন দেখা সাক্ষাৎ, ফোন, কিচ্ছু না। নম্বর দুটোর কোন অস্তিত্ব নেই, পিজির লোকও কিছু বলতে পারে নি। যোগাযোগের সমস্ত পথ রুদ্ধ। মিনু তো ওর বাড়ির ডিটেলসটাও জানতো না। এত সহজে কেউ এভাবে ভুলে যেতে পারে? ছেড়ে যেতে পারে? যে জায়গাগুলো দিয়ে ওরা হেঁটে যেত, ক্লাসে ওর বসার জায়গা, ওর দেওয়া নিতান্তই সাধারণ কাগজ, পেন, নোটস, ও যেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত, সবকিছুর সামনে গেলে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে কুরে কুরে খেত যেন সবটুকু। পাগল হয়ে যেত ও। কিছুতেই পারছিল না স্বাভাবিক হতে, তাড়া করত যেন আকাশের স্মৃতি।ডাক্তার দেখাতে হয়, বাবা-ই অতীত থেকে টেনে বের করার জন্য সব ছেড়ে পোস্টিং নিয়ে চলে যায় হায়দ্রাবাদ,সপরিবারে ওরা চলে যায় ওখানে, ওর ভালোর জন্যই সব চেঞ্জ হয়,বদলায় নাম্বারও । হ্যাঁ, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে ওরা ঠিক করেছিল সবদিন এখানে আসব, যেখানে আমাদের প্রেমের শুরু, সেই স্থানেই, সেই দিনেই ফিরে ফিরে আসব দুজনে। কিন্তু নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও হারিয়ে গেল এভাবে দুজনে দুজনের জীবন থেকে। ভাগ্য এত নিষ্ঠুরও হয়। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল মিনু। মিনুর হাতটা ধরে আকাশ বলল আবার, সেই দিনটার পর থেকে আজ দীর্ঘ এগারো বছর আমি প্রতিবার এসেছি এখানে, এই দিনে। এবারে এভাবে পেয়ে যাব, ভাবিনি।
-“আমরা এভাবে কেন আলাদা হয়ে গেলাম রে, আমি তো জানতামও না তুই আমার জন্য এসেছিস এখানে বারবার। কত খুঁজেছি তোকে জানিস। কোন বন্ধুও তোর খবর জানতো না। বাবা যখন বিয়ের সম্বন্ধ আনলো, কিছু বলতেই পারিনি বাবাকে। কী বলতাম? কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে একটা ছেলেকে ভালবেসেছিলাম, আজও বাসি, কিন্তু সে কোথায় আছে, কেমন আছে, কিছুই জানি না। যদি আমি হায়দ্রাবাদ না যেতাম, যদি এই দিনে এইখানে এগারো বছর আগে আসতাম তাহলে।।।”
-“কিংবা, যদি আমি ডাক্তারীর জন্য ফর্মই না তুলতাম, যদি না পেতাম, যদি বাড়িতে বোকার মত ভুল সময়ে সব বলে না দিতাম তাহলে হয়তো।।। তোর খবর যখন পেলাম তখন তোর বিয়ে গেছে, সেদিনটা।।।”
একসাথে হাঁটতে লাগলো ওরা দুজন, নির্বাক। যদি ভাগ্য সাথে থাকতো, তাহলে হয়তো ওদের পথ আজ আলাদা না একই হতো, কিংবা যদি আজ দেখায় না হতো, তাহলে কী কষ্ট কিছু কম হতো? ছাইচাপা আগুনটা ধিকধিক করে জ্বলছিল, এভাবে জ্বলে উঠত না হয়তো।।।
দুজন মিলে পৌঁছাল গঙ্গার ঘটে। বেশ শান্ত পরিবেশটা। কোনো কথা বলছিল না ওরা। নির্জন এই পরিবেশটাতে বাঁচছিল আষ্টেপৃষ্টে ওরা দুজন।
ফোনটা বাজল আকাশের, কথা শুনে বুঝল মীনাক্ষী কোনো পেশেন্টের ফোন। আকাশ যখন কথা বলছিল, ওর কথা বলা, ওর অঙ্গভঙ্গি মুগ্ধ হয়ে দেখছিল মিনু। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলে গেছল ও বিবাহিত, ওর সংসারের কথা। প্রেমে কি সত্যিই এসব মনে থাকে? আজ ও তো আকাশের সাথেই কাটাতে পারত ওর জীবনটা। কতদিন পর নিজের প্রথম প্রেমকে প্রাণ ভরে দেখল ও। ছেলেবেলার সেই ভীতু টাইপ সাধারণ ছেলেটা আজ একজন রীতিমত হ্যান্ডসাম সাকসেসফুল ডাক্তার। আকাশ ফোনটা রেখে ওর দিকে তাকালো, এবার আর চোখ ফেরাল না মিনু। একইভাবে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। দূর থেকে কোথাও পুজোর ঘন্টা, মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ ভেসে আসছে। আকাশও চেয়ে রইল আজ। কত কিছু না বলা কথা, যেন বলা হয়ে যাচ্ছিল চোখেচোখে। কত সময় পেরিয়েছে খেয়াল নেই। তাল কাটল ফোনে। ওর ছেলে ফোন করছে। মামমাম কখন আসবে, এতটা সময় মামমামকে ছেড়ে থাকেনি তো কখনো। কয়েক মুহূর্তের জন্য বাস্তবতা ভুলে যেতে বসেছিল, আছড়ে পড়ল সটান বাস্তবের মাটিতে। চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল একে অপরকে এবার যাবার পালা। আকাশই ওর জন্য ক্যাব বুক করছিল, আর ও যেটুকু সময় পাচ্ছে, আষ্টেপৃষ্টে নিংড়ে নিচ্ছিল সময়টা, মন ভরে দেখে নিচ্ছিল ছেলেটাকে, ওর প্রথম প্রেমকে।
-“আসছে, আর পাঁচ মিনিট” একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আকাশ।
-“হুম” নিজের অনুভূতিটাকে যতটা সম্ভব লুকোচ্ছে মিনু।
-“তোর সংসার, বৌ কিছুই তো বললি না।” আকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল মিনু।
-“কোনদিন হলে তোকেই আগে বলব।”
নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলো মিনু|
ট্যাক্সি এসে গেছে। উঠে গেল মিনু। আর পিছন ফিরে তাকাল না।গলার কাছে অসহ্য যন্ত্রণাটা দলা পাকিয়ে ছিল, উগরে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো, সব বাধা ছিঁড়ে একছুটে ঐ মানুষটার কাছে যেতে চাইছিলো ওর মন, ওর প্রথম প্রেম |জোর করে না উঠলে ও হয়তো পারত না আর। ওঠার আগে আকাশের নাম্বারটাও নিল না। যন্ত্রণা বাড়বে শুধু তাতে… এগিয়ে চলল গাড়ি।
“যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে ওরে ওরে, ঝড় এসেছে ওরে এবার
ঝড়কে পেলেম সাথি॥”
**************
-“একাই ফিরবি? আমি ছেড়ে দি?”-আবির |
-“না রে, আই উইল ম্যানেজ।”
-“ইয়েস, অফ কোর্স, থ্যাংক্স।”
-“থ্যাংক্স কী জন্য?”
-“আজকের সন্ধ্যেটার জন্য।।।”
-“ভালো থাকিস |”
-“তুইও… “
-“বাই।”
-“বাই।”
এগিয়ে গেল ওরা দুজন, ওদের রাস্তা এক হতে পারত সারাজীবনের জন্য, এক হয়েও আলাদা হয়ে গেছে পথ, যদি কিছু কথা আগেই বলা হতো।।। তাহলে হয়তো আজ।।। এগিয়ে গেল দুজন দুজনের গন্তব্যের দিকে।
**************
-“তাড়াতাড়ি চলো না, ও ভাই।”
-“বাবা, প্লিজ, একটু শান্ত হও, এরকম করলে তো তোমার শরীর খারাপ হবে।”
সমরেশবাবুর চোখের জল। কিছুতেই শান্ত করতে পারছেন না নিজেকে। কত কথা বলা বাকী এখনও। সবসময় চিৎকার করা মুখরা মানুষটা স্ট্রোকে নেতিয়ে পড়ে আছে চোখের সামনে আজ ।
হসপিটালের পথে ছুতে চলেছে অ্যাম্বুলেন্স। যদি আর কথাগুলো বলা না হয়। না না, এ হতে পারে না, এভাবে হারাতে দেবেন না উনি, কিছুতেই না। রমাদেবীর হাতটা শক্ত করে ধরলেন উনি। আরো আগেই ধরতে পারতেন।।। যদি আগে বলা হতো কথাগুলো, তাহলে হয়তো সম্পর্কের শীতলতা গ্রাস করতো না দাম্পত্যের উষ্ণতাকে। ধরে রইলেন হাত।।। এগিয়ে চললো অ্যাম্বুলেন্স।
“শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা
শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা।।
শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া
শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া
শুধু নব দুরাশায় আগে চ’লে যায়
পিছে ফেলে যায় মিছে আশা।।
অশেষ বাসনা লয়ে ভাঙা বল
প্রাণপণ কাজে পায় ভাঙা ফল
ভাঙা তরী ধ’রে ভাসে পারাবারে
ভাব কেঁদে মরে– ভাঙা ভাষা।।
হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়
আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়
লাজে ভয়ে ত্রাসে আধো-বিশ্বাসে
শুধু আধখানি ভালোবাসা।”