নিভৃত যতনে

।। ১।।  

কোর্টের বাইরে তখন খাঁ খাঁ করছে রোদ, ঘড়ির দিকে তাকাল একবার রিয়াঙ্কা, কোথা দিয়ে এতটা সময় চলে গেল বুঝতেই পারেনি। একবার বাবার দিকে তাকাল ও, মনটা একটু শান্ত হল এবার। বাবার মুখে আবার সেই হাসিটা ফিরে এসেছে অনেকদিন পর, নিজের মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে হয়তো। মা আসেনি, মা এখনো পুরোটা মেনে নিতে পারেনি, তাই এখনো সেভাবে…যাক গে। বাবার দিকে তাকিয়েই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছল ও । বাবা ফিরে তাকাল একবার, ওর থেকে কয়েকটা সিট ব্যবধানে বসে রয়েছে বাপি। পাকা চুল, ভেঙে যাওয়া মুখমণ্ডলে সদা সর্বদা লেগে থাকা প্রাণ খোলা সেই হাসি, এই তো সেই পরিচিত মানুষটা। ওর জীবনের সবথেকে প্রিয় মানুষ, রিকুর আদরের বাপি। ভবতোষবাবু চোখের ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন একবার মেয়েকে, উত্তর না পেয়ে আবার ফিরে তাকালেন সামনে। বাপির দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই রিয়াঙ্কার মুখের লেগে থাকা হাসিটা যেন আরো খানিকটা প্রসারিত হল। ছোট্টবেলা থেকে আজ অবধি এই মানুষটাই একমাত্র মানুষ যার ব্যবহার, ভালোবাসা, মানসিকতা এতটুকুও বদলায়নি রিকুর জন্য। কাজ প্রায় শেষের পথে, আর মিনিটে পাঁচেকের ব্যাপার। ঘড়িটা আর একবার দেখে নিয়ে সামনে তাকাতে যেতেই চোখ পড়ল সাগ্নিকের চোখে। রিয়াঙ্কার দিকেই তাকিয়েছিল, যেন অপেক্ষাই করছিল কখন রিয়াঙ্কাও তাকাবে। ঠিক আগের মতন। আশ্চর্যজনক ভাবে আজ ওদের দুজনের চোখেই একে অপরের প্রতি কিন্তু কোনো ঘৃণা নেই, নেই কোনো রাগ। এইটুকুই তো চেয়েছিল ও। রাগ, অভিমান, ঘৃণা এইসব কিছুর উর্দ্ধে গিয়ে দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মানুষের মানসিকতার সশ্রদ্ধ সহাবস্থান। এইটুকুই তো হয়না, আজ শেষ মুহূর্তে এসে এটুকুই অন্তত রিয়াঙ্কার প্রাপ্তি। আগের মতোই আলতো হাসল রিয়াঙ্কা, যেমনটা আগে হাসতো ক্লাস চলাকালীন সবার নজর এড়িয়ে। চোখ দুটো একটু তড়িঘড়ি করেই নামিয়ে নিলো ও, সাগ্নিক পাছে কিছু দেখতে পায়। সামনের দিকে তাকালো এবার, সই সাবুদটা মিটে গেলেই এবার ছুটি। এই ছুটিটাই তো চেয়েছিল ও, আজ তাহলে ওর এরকম মনে হচ্ছে কেন? নিজেকে আর বেশি ভাবার সুযোগ না দিয়ে হাতে পেনটা নিয়ে নিলো রিয়াঙ্কা। সইটা করে উঠে পড়ল যখন তখন ঘড়ির কাঁটা বেলা ১ টা পেরিয়েছে।

**********

জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচন্ড গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায়, কোর্ট চত্বরের বাইরের ভিড়টা পেরিয়ে একটা দোকান খুঁজছিল রিয়াঙ্কারা। জলটাও শেষ, বাবার ওষুধ খাবার সময় ও হয়ে গেছে।আগেরবারের এটাকটা হওয়ার পর থেকে রিয়াঙ্কা আর ওর মা একটু ভয়ে ভয়েই থাকে। তাও এই ব্যাপারটা ওর বাবা এতটা সহজে মেনে নিতে পারবে কল্পনাও করতে পারেনি ও। উবেরটা বুক করে বাম দিকে তাকাতেই একটা লোক চোখে পড়ল আখের রস বিক্রি করছে। এই গরমে এর থেকে ভালো এখন আর কি হতে পারে। উবেরটা আসতে এখনো মিনিট দশেক দেরি দেখাচ্ছে, বাবাকে নিয়ে ওদিকটায় এগোলো ও। দু গ্লাস দিতে বলে একটু দূরে দাঁড়াল ওরা । সামনে আরো কজন আছে এখনো। একটু অন্যমনস্ক হয়েই চেয়ে রইল ঐদিকে রিয়াঙ্কা। ওর আর সাগ্নিকের সম্পর্কের শুরুটাও এইরকম একটা দুপুরেই। এরকমই একটা অলস দুপুরেই সারা জীবনটা একসাথে পথ চলার কথা দিয়েছিল ওরা একে অপরকে। পি বি স্যারের ক্লাস কেটে বেরিয়ে ওদের পাঁচ জনের দলটা বেরিয়ে পড়েছিল সেদিন এরকম একটা দুপুরে। গন্তব্য সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অটোগ্রাফ’। সেই পাঁচজন থেকেই ওরা দুজন কেমন করে যেন টুক করে আলাদা করে নিয়েছিল নিজেকে, ইচ্ছে করেই হয়তো। হারিয়ে গেছিল ধীরে ধীরে ওরা শহরের বুকের একটুকরো সবুজে, ধূসরতাকে মনেপ্রাণে অগ্রাহ্য করে। সেইদিনই হয়তো খুনসুটি, ঝগড়াঝাটি আর শুধু বন্ধুত্বের বেড়াটা পেরিয়ে গেছিলো ওরা দুজন সযত্নে। তারপর থেকে আর কোনোদিন ও শেষ রাতের ঝগড়া, কান্নাভেজা লুকোনো বালিশটা, বছর আটেকের ডিসটেন্স রিলেশনশিপ, কিংবা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের হাজারো বন্ধুদের ছবির ভিড়, ওদের প্রেমটা একবারের জন্য ও আর হারিয়ে যায়নি। বরং যেন আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরছিল ওরা একে অপরকে, চারপাশের তুচ্ছ ঘটনাগুলোর চড়া রং ওদের প্রেমের কাছে ফিকে হয়ে যেত নিমেষে। ওরা তো কোনোদিন আলাদা হতে পারে না। হতেই পারে না, বাকি সবার মতো ওরা দুজনেও তো এটাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। সব পেরিয়ে কাছে আসার পর তাহলে এমন কোন সুরটা পাল্টে বেসুরো হয়ে গেলো ওদের জীবনে যে দুজন দুজনের কাছে এতটা অপরিচিত হয়ে গেলো? কবে হলো কিভাবে হলো কেন হলো এর উত্তর গুলো আজ ও খুঁজে বেড়ায় ওর মনটা। এই চারটে বছরের দাম্পত্যের ছাপটা এতটা গভীর হয়ে গেলো যে এত বছরের প্রেমের রংটা হারিয়েই ফেললো ওরা ! আজ তো মনেই পড়ে না ওর ভালোবাসার মানুষটা কে? এই কি সেই সাগ্নিক? ওর সাগ্নিক? যে মুহূর্তগুলো স্মরণীয় করতে ওরা কাছে এসেছিল তা এতটা মর্মান্তিক হবে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি রিয়াঙ্কা। এর কারণ বহুবার হাতড়েছে ও, হয়তো সাগ্নিক ও। উত্তর মেলেনি। সব কিছুর সোজাসুজি উত্তর হয় না বলেই হয়তো এর উত্তরটা আর পাওয়া হয়নি ওর।  

“দিদি নিন গ্লাসটা।” সামনের লোকটার ডাকে টনক নড়ল রিয়াঙ্কার। নিজেকে সামলে নিল তাড়াতাড়ি ও। টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে ওখান থেকে এগিয়ে এলো ও। ফোনটা বেজে উঠল তখনই। ক্যাব এসে গেছে।  

।। ২।।

সন্ধ্যে ৬টার দিকে কাঁটা এগোলেই মায়ের এই বাঁজখাই গলাটা শোনার সৌভাগ্য হয় রিকুদের। মায়ের বার তিনেক ডাকার পর নড়ে চড়ে উঠে বসল ও খাটের উপর। খাটের একদম সামনেই আয়নাটা, চোখটা রগড়ে নিজের এলোমেলো রূপটা দেখছিল রিকু। কলেজ এ উঠে এই ঘরটা পেয়েছিল ও, এই ঘরে থেকেই তারপর কলেজ, ইউনিভার্সিটি, চাকরি, বিয়ে, ফিরে আসা সব কিছু। ও বড় হওয়ার সুবাদে প্রথম ঘরটা ওই-ই পেয়েছিল, নিজের মতো করে সাজিয়েছিল এই ঘরের সবকিছু। তারপর ও চলে যাওয়ার পর ভাই নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয় ঘরটা। এখন ভাই ও পড়াশোনার সূত্রে বাইরেই থাকে বেশিরভাগ সময়টা, ভাগ্যিস ভাইটা ছিল। নয়তো বাড়িতে ও একা কি করে কি করতো ভাবতেই কেমন লাগে। বাইরে কলিংবেলটা বাজল, এখন তো আসার মতন কেউ নেই। প্রচন্ড গরমে ঘুম থেকে উঠেও চোখগুলো যেন এখনো অল্প জ্বলছে, উঠে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে বারান্দায় দাঁড়াল ও। ওর ঘরের সাথেই একটা লাগোয়া বারান্দা আছে, সঙ্গে ওর সাধ করে লাগানো ছোট্ট একটা সাদা দোলনা। মন খারাপের দুপুরগুলো কিংবা ঘুম না আসা রাতগুলো এখানেই নির্বিঘ্নে কাটাতো ও। একটা ঠান্ডা হওয়ার ঝলক লাগল মুখে। এখন তো কালবৈশাখীরই সময়, আকাশটা এবার ঘিরে আসছে, ঝড় উঠবে মনে হয়। ওদের সল্টলেকের এই ফাঁকা ফাঁকা এলাকাতে ঝড়টা বোঝায় আরো বেশি। ছাদে উঠলে আরো ভালো ভাবে দেখা যায় আকাশটার বিশালতাকে।  চোখ দুটো বুজে ফেলল রিয়াঙ্কা। অল্প অল্প জলের ছিটে লাগছে মুখে, সূর্য পাটে বসেছে, পশ্চিমাকাশটা সোনালী আর লাল আবিরের সাথে সাথে একটা মন কেমনের ধূসরতা জড়িয়ে নিয়েছে যেন। জলের ছিটে গুলো এবার একটু যেন দ্রুত পড়তে লাগল ওর মুখে। “আরে এই রিকু দ্যাখ তোর নামে কি যেন এসেছে।”  মা ডাক দিল আবার।

**********

এখনকার যুগে দাঁড়িয়ে চিঠিপত্র আদানপ্রদান খুব একটা কেন, হয়না বললেই চলে, অফিসিয়াল কাজকর্ম ছাড়া। কিন্তু এই চিঠিটা তো সেই গোত্রের মনে হচ্ছে না। বাবার সাথে বসে চা জলখাবার খাচ্ছিল বটে, কিন্তু বুকের ভিতরটা যেন এক অজানা আশঙ্কায় ধড়ফড় করেই যাচ্ছিল, কিছুতেই না দেখা অবধি শান্ত হচ্ছিল না মনটা। কোনোক্রমে আলুর চপটা শেষ করেই ঘরে এসে দরজা লাগাল ও। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে।

**********

তোর তো সবুজ রং বড্ড প্রিয়, তাই আজ লেখার জন্য এই রংটাই বাছলাম। আগেরদিন তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম জানিস, সাহসে কুলোয়নি। আর সঙ্গে তোর বাবাও ছিলেন, তাই আর এগোলাম না। কিন্তু কথাগুলো বলতে না পারলেও তো কিছুতেই মন শান্ত হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই এই চিঠির দ্বারস্থ। এইসব আমার দ্বারা কোনোদিনই হয় না জানিসই, তাই তোর অনেক অভিযোগ ও ছিল জানি, আর আজ যে এই জন্য তুই খুব অবাক ও হয়েছিস তাও জানি আমি। তোকে কথাগুলো বলা বোঝানো অনেক আগে দরকার ছিল জানি, এখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু না বললেই নয়। তুই যেদিন আমাদের ব্যারাকপুরের বাড়ি ছেড়ে চলে এলি সেদিন ও ভাবিনি যে আর জীবনে কখনো তোর কথা ভাববো, খুব স্বার্থপর মনে হয়েছিল তোকে। খুব রাগ হয়েছিল তখন তোর উপর। তাই তুই চলে যেতে কতটা কষ্ট হয়েছিল বলতে পারবো না, কিন্তু তার থেকেও রাগ আর অভিমানটা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু বিশ্বাস কর আমাদের এই আলাদা হওয়ার ডিসিশনটা কিন্তু আমি রাগের বশে নিইনি। বরং অনেক ভেবে চিনতে ঠান্ডা মাথায় যদি কোনো ডিসিশন নিয়ে থাকি তাহলে এইটা, এত ভেবে আমাদের বিয়ের ডিসিশনটাও নিইনি আমি। যদি নিতাম তাহলে হয়তো…  এই ডিসিশন এ তুই আমি দুজনেই ভালো থাকবো জানি আমি। তুই নিজে মুখে এত বড় একটা কথা বলতে পারতিস না, তাই সিদ্ধান্তটা আমিই নিলাম। না তোর সামনে এসে কথা গুলো বলা হয়নি, হবেও না কোনোদিন। আচ্ছা কখনো ভেবে দেখেছিস আমরা কেন আলাদা হলাম? আমরা তো ভালোবেসে একসাথেই থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছু চাওয়া পাওয়া কখন যেন আমাদের মধ্যেকার সজীবতাকে নিংড়ে ধূসর থেকে কালো করে দিচ্ছিল একটু একটু করে। আমরা তো একাই ভালো ছিলাম, সম্পর্কের শাখা প্রশাখাগুলো বাড়তে শুরু করার পর থেকেই সবকিছু কেমন জটিল হতে লাগল। আমরা এতটা অপরিচিত কি করে হয়ে গেলাম কে জানে। আমাদের মধ্যেই কি কোনো শুন্যস্থান ছিল? সম্পর্কের তকমা লাগার পর থেকে সেগুলো আরো প্রকট হলো হয়তো। তোর বাড়ি আমার বাড়ি, তোর মা বাবা আমার মা বাবা, তোর বাড়ির নিয়ম আমার বাড়ির নিয়ম এই সব কিছুর মাঝে আমরা কবে যে তলিয়ে গেলাম বুঝতেও পারলাম না। যখন হুঁশ ফিরল তখন ফেরার রাস্তা আর নেই।  কলেজ জীবনে যখন একসাথে হাতে হাত রেখে গঙ্গার ধারে বসতাম তখন একসাথে জীবনটা বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম, সব বাধা পেরিয়ে এক হওয়ার কথা ভাবতাম। সম্পর্কের এত জটিলতা দূর দুরান্তেও আসেনি মাথায় তখন। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর মানুষের ধ্যান ধারণা, পরিবার, নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে একটু একটু করে আমার কাছে থেকেও খুব আবছা হয়ে যাচ্ছিলি তুই। কাছে ছিলাম হয়তো কিন্তু সেই টান, সেই ভালোবাসাটা হারিয়ে গেছিল বহুদিন। ওই যে যেদিন আমার জন্মদিন জেনেও তুই কাজের অজুহাতে চলে গেছিলি সল্টলেকে, খুব রাগ হয়েছিল সেদিন। পরে বুঝেছিলাম বাচ্চা নিয়ে মেজো পিসির এই বাড়ি এসে বারংবার তির্যক মন্তব্য সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছিল না তোর পক্ষে। আর ওই যে আগের বছর আমাদের বিবাহবার্ষিকীর দিন, ওই দিনটার থেকেও আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাঙা কাকীর বাড়ির গৃহপ্রবেশে বাড়ির সকলকে নিয়ে যাওয়াটা। ওই দিনটার কথা খেয়ালই ছিল না আমার, আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। আমার দিকের সমস্ত অসম্পূর্ণতা, আমার না পারা সবকিছু, আমার  বিফলতা সবকিছু নির্দ্বিধায় বাড়ির বাকি সকলের মতো তোর দিকেই ঠেলে দিয়েছি বারবার, বুঝতে বড় দেরি হয়ে গেল। কিন্তু বিশ্বাস কর এখন এই একলা ঘরে তোকে চিঠিটা লেখার সময়ে ভীষণ ভাবে অনুভব করছি এখনো তোকে কতটা ভালোবাসি আমি,আর আজীবন বাসবো ও। এখনো  আমার স্টাডি টেবিলের কোণে তোর হাসিমুখটা দেখতে দেখতেই ঘুম আসে রোজ । সমাজের চোখে হয়তো আজ আমাদের পথ আলাদা, হয়তো কোনোদিন ও তোর হাতটা ধরে বলা হবে না তোকে ঠিক কতটা মিস করেছি সারাদিন, হয়তো দিনের শেষে তোর ফোনের জন্য আমার অপেক্ষাও অন্তহীন হবে, কিন্তু এইগুলো নিয়ে আমি দিব্যি কাটিয়ে দেব বাকি জীবনটা।  মাঝের কয়েক বছরের তিক্ততাটা না হয় কোনো দুঃস্বপ্ন বলে কাটিয়ে দেব, ওইটুকু সময়ের অপূর্ণতা, বিচ্ছেদ আমার আর তোর এত বছরের সম্পর্কের থেকে বহু যোজন দূরেই থাক না ! সবার জীবনে তো সব কিছু পাওয়া হয় না, তুই আমার জীবনে ব্যানার্জী বাড়ির নববধূ রূপে নয়, বরং কলেজের এস. আর – এর ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে পিছনের বেঞ্চে উঠে প্রথম আমার পাশে এসে বসা সেই রাগী, জেদি পাগলী মেয়েটাই থাক। সবকিছু সবার জন্য নয়, এটা বুঝতে দেরি করে ফেললাম। আবার একটা ১৪ই ফেব্রুয়ারী আসছে ! তোকে ঝাপসা হতে দেব না কোনোদিন, তাই আর কাছে আসিস না, এভাবেই দূরে আমার ভালোবাসা হয়ে থাকিস আজীবন। ইতি তোর…এটা বরং শূণ্যস্থানই রাখা থাক। আমার জন্য…

বাইরে বাজ পড়ল সজোরে, শব্দে আর আলোর ঝলকানিতে একটু যেন কেঁপে উঠল রিয়াঙ্কা। চিঠিটা হাতের মুঠোয় ভাঁজ করে চোখ দুটো বুজে ফেলল ও । আর পারছে না যে নিজেকে আটকাতে। হু হু করে উঠল যেন বুকের ভিতরটা। চারপাশে এত মানুষ, এত আপন জন, মা বাবা ভাই সবাই পাশে থেকেও যেন সবটুকু অন্তঃসারশূন্য। সাগ্নিককে ভালোবেসে ওর সাথে থাকার জন্য তো একদিন সব কিছু ছাড়তে রাজি ছিল রিয়াঙ্কা, ছেড়েওছিল।  তারপর সব কিছুর শেষে ওর কাছে সাগ্নিকের সাহচর্যটাই কবে যে গৌণ হয়ে গেল কে জানে। ও তো সাগ্নিক ছাড়া আর কাউকে ভালোও বাসতে পারবে না কোনোদিন। দেওয়ালের টাঙানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালো ও, আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারী। ভালোবাসার দিন, হাতে হাত রেখে কত শত যুগল কথা দেবে একে অপরের পাশে থাকার। একদিন ওরাও তো এরকমই… কিন্তু আজ যেন এতটা পথ পেরিয়ে এটাই মনে হয়, একসাথে থাকার নামই শুধু প্রেম নয়। কখনো কাউকে খুব খুব ভালোবাসলে তবেই হয়তো তাকে এভাবে যেতে দেওয়া যায়। চিঠিটা সযত্নে ভাঁজ করে নিজের বালিশের নীচে রাখল রিয়াঙ্কা। বৃষ্টি থেমে গেছে, কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে অজানা এক বাঁশির সুর, সে সুর মন উদাস করে। বৃষ্টি শেষের ঠান্ডা হওয়ার ঝলক লাগলো মুখে, জোরে শ্বাস নিল রিয়াঙ্কা। না আর কান্না পাচ্ছে না। হালকা লাগছে এখন মনটা। আর নিজের থেকে নিজের পালিয়ে বেড়ানোর ও কোনো জায়গা নেই। ভালোবাসি। আজ ও , আর এটা অস্বীকার করার আর তো কোনো জায়গা নেই, করতে চায় ও না ও। ” এই আঙুলের ছোঁয়ায় না থাকো, মনের গভীরে থাকবে এভাবেই, সবদিন, নিভৃত যতনে।”

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

তোমায় আমায় মিলে

।।১।। “উফফ! পা-টায় যা অসহ্য যন্ত্রনা করছে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে। আর পারা যায়?” হাতের , কানের গয়নাগুলো খুলতে খুলতে বলছিল কুহেলী। রাজীব ততক্ষণে মোবাইল

Read More »

সন্ধ্যে নামার আগে

।।১।। “প্লিজ তোমার ভাঙা রেকর্ডটা একটু বন্ধ কর তো, সবসময় ভালো লাগে না। একেই অফিসে এত কাজের প্রেশার, বাড়ীতে একটু শান্তিতে বসব, তাও দেবে না।”

Read More »

যদি

।।১।। “আর দেরী করলে কিন্তু, সত্যিই পৌঁছতে পারবে না, অলরেডি সাড়ে চারটে বেজে গেছে” মা-এর উদ্দেশ্যে চেঁচাল মৌমিতা, অয়নের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। অয়নও একটা

Read More »

তুমি রবে নীরবে

।।১।। “বাবু, তোকে আর কতবার বলতে হবে, রোজ একবার করে অন্তত প্র্যাকটিসটা করবি question bank টা। আজও তো করলি না।” পেটির মাছের পিসটা একমাত্র ছেলের

Read More »

একে একে এক

।।১।। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমার আড়ালে ঘন কালো কাজলে মোড়া বড় চোখদুটো সামনের দেবদারু গাছটার দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে কি যেন একটা খুঁজছিল, হাতের পেপার ওয়েটটা

Read More »

১-২-৩ স্মাইল প্লিজ… শেষ অংশ

।।৫।। গভীর নিম্নচাপের কারণে, পুরো কলকাতা আজ কার্যত ভাসছে, জল জমে অচলাবস্থা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। বসার ঘরে টিভিতে কলকাতার অবস্থা যতই দেখাচ্ছে, ততই টেনশন বাড়ছে

Read More »

Share with