।।১।।
রাতুলের বাহুডোর থেকে জোর করে নিজেকে মুক্ত করে কাজে হাত লাগাল মলি । “এখনও ডিমটা সেদ্ধ করা হয়নি, ছাড়বে তুমি?”, আদুরে গলায় খানিক প্রশ্রয়, খানিক রাগত স্বরে অবাধ্য বরটাকে খানিক বকল মলি । জানলা দিয়ে তখন সুয্যিমামার আলো ঝলমলিয়ে দিয়েছে ১০ বাই ১০ ফুটের ছোট্ট ঘরটাকেও ।
জোর করেই মলিকে কাছে টেনে নিল রাতুল । মলির শ্যাম্পু ভেজা চুল আর চন্দন গন্ধের সাবানের সুবাসে নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছিল রাতুলের । লাল টুকটুকে সিঁদুরে বড্ড মিষ্টি লাগছিল রাতুলের নতুন বউটাকে । মলির শাঁখা পলা পরা হাতটা মুঠো করে নিজে হাতে ধরল রাতুল, আর এক হাত মলির ভেজা পিঠে । নিবিষ্ট হলো দুই ওষ্ঠ । ডুবে যাচ্ছিল ওরা একে অপরের মধ্যে । নেহাত, ডানা ঝাপটিয়ে পায়রা দুটো বকবকম করে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করল | নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে রাতুলকে স্নানে পাঠাল মলি, নিজের হাতের কাজ দ্রুত সারতে লাগল, নয়তো আজ আবার লেট হবে অফিসে ।
*******************
রাতুল আর মলি ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে মাস তিনেক হলো । ছোট, 1BHK ফ্ল্যাট, ছিমছাম সুন্দর, যত্নে সাজানো ছোট্টর মধ্যে । মাঝ শহর থেকে খানিকটা ভিতর দিকে, এই টাকায় প্রপার সিটিতে ফ্ল্যাট পাওয়া সম্ভব ছিল না । যাতায়াতে একটু অসুবিধা হয় বৈকী, কিন্তু নির্জন, নিরিবিলি পরিবেশটা ওদের দুজনেরই খুব পছন্দের । অভাবের মাঝেও বড় যত্নে সাজানো সংসারটা, এক চিলতে বারান্দায় ছোট্ট দোলনাটা, যত্নে সাজানো ঘরের পর্দা, ঘরের রং, রং মেলানো ঘরের চাদর, দামী না হলেও ভালবাসায় তা দামী বৈকী । হ্যাঁ, রোজ মাছ মাংসের আড়ম্বর এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোয় না, দামী শাড়ী গয়না আসবাবের এ বাড়িতে বড়ই বাড়ন্ত ।
……”আজ ফেরার পথে একটু বাজার হয়ে আসতে হবে”, বলতে বলতেই নিজের পার্সটা একবার দেখে নিল মলি, “এই শুনছো, তোমার ব্যাগেও একটা লিস্ট দিয়ে দিয়েছি, তুমি একটু দেখে নিও ।”
মাসের শেষ, তাই মধ্যবিত্ত ঘরে হাতে টান । রাতুল আর মিলির এই স্বপ্নের সাজানো ঘরে ২২,০০০ টাকায় একটা মেট্রো সিটিতে সংসার চালানো মুখের কথা নয় ।
।।২।।
“আজ বাবলা দা বলছিল, দোকানে অনেকটাই টাকা জমে আছে, তোমায় কতবার বলেছি এতগুলো টাকা একসাথে জমিও না, একসঙ্গে এতগুলো টাকা দিতে তো আরো প্রব্লেম হয়, কেন বোঝো না?”, অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত মলি ব্যাগটা রাখতে রাখতেই কথাগুলো বলল রাতুলকে ।
কথাগুলো যেন সুচের মতো ফুটল রাতুলের ।
-“টাকা থাকলে কী ধার করতাম? কেন বারবার বলো?”
-“রিঅ্যাক্ট করছো কেন? আমি শুধু বলছি এতগুলো করে টাকা জমিও না…”
-“থাক, আমি তোমার থেকে কম সংসার খরচ দিচ্ছি বলে কথা শোনাচ্ছ, বুঝেছি ।”
-“আশ্চর্য তো ! ভুলভাল কথা কেন শুরু করলে, কী বললাম আর কথা কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছ ।”
কথায় কথা বাড়তে লাগল । দেওয়ালের রঙ, জানলার পর্দা সাক্ষী রইল অগুনতি রূঢ় শব্দগুচ্ছের, টেবিলে খালি থালা বাটি রইল পড়ে ।”
*******************
ছোটখাটো ঝগড়া তো সব সংসারেই লেগে থাকে, কিছুদিন পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়, এখানেও তাই । তবে, মেল ইগো, ভুল বোঝাবুঝিটা বেড়েই যাচ্ছিল ।
*******************
“আজও রিজেক্টেড হলো লেখাটা “, ক্লান্ত বিধ্বস্ত রাতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলল, খোলা জানলাটার দিকে তাকিয়ে ।
মলি ততক্ষনে ইলেকট্রিক বিল আর গ্যাসের বিলের খরচ নিয়ে হিসেবে নিকেশে বড়ই ব্যস্ত । কিছু না ভেবেই মলি রাতুলের উদ্দেশ্যে বলে ফেলল, “তুমি ঐ নিয়েই বসে থাকো আর আমার এখানে সংসার টানতে নাভিশ্বাস উঠছে । শব্দগুলো খরচ করার পর মুহূর্তেই মলি বুঝল ও কী ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু ‘কথা’ এমন একটা জিনিস, একবার অপরপক্ষের দিকে নিক্ষেপিত হলে আর ফেরানো যায় না, দাগটা থেকেই যায় ।
কথাকটা বলেই রাতুলের চোখের দিকে তাকাল মলি । বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি, সঙ্গে বিদ্যুতের ঝলকানি, সেই আলোতেই স্পষ্ট রাতুলের চোখের দৃষ্টিটাও । মলি তো ওর স্বপ্ন, ওর চিন্তা একজন বড় লেখক হওয়ার । মলি তো ওর লেখা পড়েই ওর প্রেমে পড়েছিল, আর আজ সেই মলিই…? মানুষ এভাবে পারে বদলাতে? সত্যিই, কথাতেই আছে, অভাব ঘরে ঢুকলে ভালবাসা জানলা দিয়ে পালায় । সেটা এভাবে সত্যি প্রমাণিত হয়ে যাবে রাতুল ভাবতে পারেনি । একরাশ নিরাশা, অবিশ্বাস বিস্ময় আর আকস্বিকতা ভিড় করেছিল রাতুলের সেই চোখে । বাইরে বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে ওদের সম্পর্কের মধ্যেও যেন বজ্রাঘাত বারবার সাড়া ফেলছিল ।
।।৩।।
ছোট খাটো বিষয় নিয়ে দূরত্ব বাড়ছিলই, অবশ্যম্ভাবী শেষটা যেন এগিয়েই আসছিল ।
-“আজ চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এলাম ।”
রাতুলের হতাশ, বিধ্বস্ত চেহারা আর এই কথাটা শুনে নড়ে চড়ে বসল মলি, “মানে?”
-“মানে আমি আজ রিজাইন দিয়ে এসেছে । এই চাকরি আমার ভিতরের শিল্পী সত্বাকে শেষ করে দিচ্ছিল । ভাষা পাচ্ছি না, কিছুই মাথায় আসছে না, আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, আর পারছিলাম না, আজ তাই ডিসিশনটা নিয়েই নিলাম ।”
কিছুক্ষন সব কিছু চুপচাপ, নিস্তব্ধ, নৈঃশব্দ ভেঙে মলি বলল, “আর আমাদের সংসারটা যে এবার শেষ হয়ে যাবে, সেটা একবারও ভাবলে না তুমি? এত স্বার্থপর তুমি? আমি সংসারটা কিভাবে চালাবো, এবার কীভাবে সব চলবে একবারও ভাবলে না? তোমার ঐ হাবিজাবি লেখাগুলোই আগে হলো? কোন অর্থ উপার্জন হয় ঐ সব লিখে? না, এবার কীভাবে চলবে উত্তর দাও । কোন দায়িত্বই কী তুমি নেবে না? বিয়েই কেন করলে তবে, যখন দায়িত্ব নেবার ক্ষমতা নেই? তোমার লেখায় চলবে পেট?”, উত্তেজিত হয়ে খেয়ালও করেনি রাতুল ওর দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এমন ভাবে, যেন কে এ? একেই কী আমি ভালোবেসেছিলাম? এই সেই মানুষ যার চোখে হারিয়ে গিয়ে নিজের লেখা, নিজের ভাষা, শব্দগুলো পুনরুজ্জীবিত হতো? একরাশ বিস্ময় আর অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে রইল রাতুল । কিছু বলতে পারেনি ও, বলার মতো কী-ই বা আর বাকী ছিল? শেষ হয়ে গেছিল পুরোটা, দুটো ভালোবাসার মানুষ একটু একটু করে কবে এতটা দূরে সরে গেছিল কেউ একটুও বুঝতে পারলো না । যে স্বপ্নের বাড়ি একটু একটু করে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল দুটো মানুষ, সেটা গুড়িয়ে যাবে এভাবে দুজনের একজনও বুঝতে পারেনি ।
রাতুল শুধু অস্ফুট স্বরে বলতে পারল, “আমি তো এত তাড়াতাড়ি বিয়েটা করতে চাইনি, সময় চেয়েছিলাম একটু তোমার কাছে । আমার লেখাই তো একদিন তোমার সব থেকে প্রিয় ছিল, আজ সেই তোমার সব থেকে বড় শত্রু?”…
।।৪।।
এতটা পড়ে বইটা আলতো করে বন্ধ করে মিহিরবাবু, প্রখ্যাত লেখক মিহির রায় । বয়সের ভারে চামড়া কুঁচকেছে, চোখে পাওয়ারের চশমা, চুলে ধরেছে পাক । বয়সের ভারে নুইয়ে গেছেন খানিকটা, কিন্তু লেখার ধার এখনও কমেনি ।
সামনে বসে একমনে শুনছিলেন বৃদ্ধা, মিসেস রায়, জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমায় আজও ক্ষমা করতে পারোনি বলো?”
-“ধ্যুর পাগলী বুড়ি, সেদিনের সেই বিচ্ছেদই আমার মনের জিদের উৎস, আর তাই আজ আমি এখানে, আর তুমি আমার পাশে সবদিন না থাকলে, আবার আমার জীবনে ফিরে না আসলে কিছুই হতো না, না মিহির রায়, না রায় পাবলিশার্স । তুমি না থাকলে লেখনীর এত বড় সাম্রাজ্য আমি একা একা গড়তে পারতাম না ।”
নিজের আত্মজীবনীটা টেবিলে রাখলেন মিহির রায়, শক্ত করে ধরলেন মালিনী দেবীর হাতটা, চামড়া কুঁচকেছে, কিন্তু প্রেম চিরসবুজ, আজও । শুধু মাঝখান থেকে হারিয়ে গেছে কটা মূল্যবান বছর, কত মূল্যবান সময় । দেরীতে হলেও এক খাতে আবার বয়েছে দুটো ভালোবাসার মানুষের জীবন ।