||১||
“বৌমা, রোজ রোজ এতদেরী হলে কিন্তু এবার তোমার শ্বশুর মশাইকে আমায় জানাতেই হবে ব্যাপারটা |”, বেশ রাগের সঙ্গে কথাটা স্বর্ণালীর দিকে ছুঁড়লেন আরতি দেবী |
“কী করবো মা, এখন এই রাস্তাটায় কাজের জন্য এতো জ্যাম হচ্ছে, আর স্যারকে কী এভাবে বলা যায় ছেড়ে দিন তাড়াতাড়ি?”, যতটা সম্ভব ম্যানেজ দিয়ে তাড়াতাড়ি উপরে চলে গেল স্বর্ণালী |
নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগাল স্বর্ণালী | উফফ, শাশুড়ি তো নয়, এটম বোমা, একবারও যদি কিছু আঁচ করে আর রক্ষে থাকবে না |
||২||
(কিছুদিন আগের ঘটনা )
“বুঝলে আরতি, আর বোধ হয় ‘রসে বশে’ টাকে বাঁচাতে পারবো না…”,বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিজয়বাবু |
– “কেন গো? এ কী অলক্ষনে কথা বলছ ভর সন্ধেবেলা, কী হয়েছে?”
– “লাভ না থাকলে কী হবে বলতো চালিয়ে? বিজনেসের ফিক্সড কস্টটা তো মাসে মাসে গুনতেই হচ্ছে, তার ওপর যদি ক্ষতিই হয়, টানবো কতদিন?”
কথার মাঝেই থামিয়ে আরতিদেবী দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্বর্ণালী কে দেখে বললেন,”বৌমা, তুমি সব ব্যাপারে কেন থাকে? একটু আগে ফিরেছ, বিশ্রাম নাও | মিনু জলখাবার বানাচ্ছে, একটু পর দিচ্ছি, যাও এখন |”
“হ্যাঁ মা তুমি যাও, তুমি এসব নিয়ে এত ভেবো না, তোমার বাবা আছেন, কিছু একটা ঠিক ব্যবস্থা হবে |”
কথা না বাড়িয়ে চলে গেল স্বর্ণালী |
****************
রাতে খাওয়ার পর সাগ্নিককে জিজ্ঞেস করল স্বর্ণালী,”আচ্ছা তুমি রিসেন্ট আমাদের, আই মিন তোমার বাবার রেস্টুরেন্টটায় গেছ?”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত সাগ্নিক উত্তর দিল,”হ্যাঁ গেছি, কেন বলতো?”
-“তোমার কিছু মনে হয়নি?”
অবাক চোখে তাকিয়ে সাগ্নিক বলল,”মনে হবে মানে? কী মনে হবে?”
-“উফফ, মানে কী ফিল হলো? অন্য রেস্টুরেন্টের সাথে তফাত কী লাগল?”
সাগ্নিক খানিক ভেবে উত্তর দিল, “সেভাবে তো ভেবে দেখিনি কখনো, একইরকম, বোরিং টাইপ |”
-“একজাক্টলি ! বোরিং | তুমি ভাবো না কখনো কেন বোরিং?”
-“বোরিং তো হবেই, একইরকম চলে আসছে, নো চেঞ্জ, তো কী হবে? তা তুমি এসব কেন বলছ হঠাৎ?”
-“তুমি কখনো বাবাকে বলোনি যে সময়ের সাথে সাথে চেঞ্জ দরকার?”
-“বলিনি আবার? কিন্তু বাবা তো আমল দেয় না, আর এই মুহূর্তে ঢেলে সাজানোর মতো অত টাকা কোথায়? আর প্রফেশনাল আর্টিস্ট, ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর অনেক কিছু প্রয়োজন | কিন্তু কেন এসব বলছো প্লিজ বলবে?”
-“আজ শুনছিলাম,’রসে বশে’-র অবস্থা ভালো না | বাবা তোমায় কিছু বলেননি?”
-“কই না তো? আমিও নিজের জব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি | কথা বলব একবার তাহলে বাবার সাথে?”
-“হুম, বলতে তো হবেই |”
||৩||
(এখন)
-“তোমার বৌমা বেশ কিছুদিন ধরে কিন্তু বড্ড দেরী করে বাড়ি ফিরছে, এতক্ষন ধরে আঁকার ক্লাস? তুমি কিছু বল নয়তো…”
-“বাবা”|
ক্লান্ত চেহারায় গা এলিয়ে সোফায় বসে চোখ দুটো বুজেছিলেন বিজয়বাবু, স্বর্ণালীর গলার স্বরে চোখ খুলে তাকালেন |
-“এসো, মা, বাড়ির একটা নিয়ম কানুন আছে, তুমি এবাড়ির বৌ, শুনলাম রোজ রাট করে বাড়ি ফিরছ |”
-“বাবা, সেই ব্যাপারেই আপনার কাছে পারমিশন চাইতে এলাম | স্যার বলছিলেন এখন একটু দেরীই হবে, তাই এখন ক’টা দিন …”
কথা শেষ করতে না দিয়েই বিজয়বাবু বললেন,”তুমি একটা সম্ভ্রান্ত বাড়ির বৌ, বাড়ির সম্মানটুকু তো দেখবে মা | রোজ যদি রাত দশটায় বাড়ি ঢোকো লোকে কী বলবে? এমন আঁকার ক্লাসে যাওয়ার দরকার নেই তাহলে |”
-“বাবা প্লিজ, একটু বোঝার চেষ্টা করুন…”
বেশ কিছুক্ষন কথা কাটাকাটির পর বিজয়বাবু কিছু না বলে উঠে চলে গেলেন | এমনিতেও ব্যবসাটার অবস্থা খারাপ, মানসিক অবস্থা ভাল নয়, তার মধ্যে এসব ঝামেলা | উনি আর কথা বাড়ালেন না |
||৪||
(কিছুদিন পর)
“বাবা, আসব?” সাগ্নিক আর স্বর্ণালী আজ একসাথে বাবার সামনে |
“আয় বাবা আয় “, আরতিদেবী হাতের সেলাই রেখে ওদের বসতে ডাকলেন,”কী ব্যাপার বাবু? কিছু হয়নি তো?”
মাকে আশ্বস্ত করে সাগ্নিক উত্তর দেয়,”না মা, আসলে বাবার কাছে একটা পারমিশন নেওয়ার আছে |”
“বল”-বিজয়বাবু |
-“বাবা বলছিলাম যে আমাদের রেস্টুরেন্টটা নতুন করে সাজালে কেমন হয়? এর আগেও…”
-“অবান্তর কথা বোলোনা দয়া করে, এখন এসব সম্ভবই না আমার পক্ষে |”
কথার রেশ টেনে স্বর্ণালী বলল,”বাবা কৃতিকা আমার খুব ভাল বন্ধু, আমি ওর সাথেই কাজ করি | ওর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের কালেকশন দেখার মতো, আর সাথে আমার আঁকা, আই এম সিওর…”
“এসব কাজ কবে থেকে শুরু করলে?”, বিজয়বাবু এবার রাগত চোখে তাকালেন ওদের দিকে,”আমারই বাড়িতে থেকে আমাকেই না জানিয়ে এত কিছু করে ফেললে আর আজ বলতে এসেছ? ক্লাসের নাম করে এসব কর তাহলে তুমি?”
আরতিদেবী অবাক হয়ে বললেন,”একি সাংঘাতিক কান্ড? তুমি কাজ করছ বলনি একবারও? এত মিথ্যে বললে আমায়?”
-“মা মিথ্যে না বললে আপনারা কী আমায় কাজ করতে দিতেন? আজ এই কাজটাই…”
– “আমি আর কিছু শুনতে চাই না | তোমরা এস | তোমার বাবুও সব জানতো, সেও তো কিছু বলেনি |” আরতিদেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন বিজয়বাবু |
“বাবা ‘রসে বশে’ তোমার যতটা, ততটা আমারও, এর আগেও অনেক বার বলেছি, তুমি পাত্তা দাওনি, আজ যখন শেষ অবস্থা…., যাই হোক, আমরা যেটা ভেবেছি সেটাই করব, ব্যস |”মেজাজ হারিয়ে উত্তর দিলো সাগ্নিক|
অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন বিজয়বাবু, এ কাকে দেখছেন? এত ঔদ্ধত্য ! “যা ইচ্ছে কর তাহলে, আমি আর কাল থেকে যাবও না |”
“ঠিক আছে তাই |”, বলেই রেগেমেগে বেরিয়ে গেল সাগ্নিক |
বিজয়বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন | স্বর্ণালী মাথা নীচু করে চলে গেল |
-“ভেবেছিলাম আর কটা দিন টানতে পারব, তাও হতে দিল না তোমার সাধের ছেলে আর বৌমা, এত চিনতে ভুল হলো আমার?”
-“তুমি সামলাও নিজেকে, ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে |”-আরতিদেবী উদ্বিগ্ন মুখে উত্তর দিলেন |
*****************
“এভাবে কথাটা না বললেও পারতে”, স্বর্ণালী সাগ্নিকের পিঠে হাত রেখে বলল |
-“কী করতাম বল আর? নিজের ভালটা সবাই বোঝে? আর চেষ্টাটা তো করতে হবে, কতবার বলেছি এর আগেও, তখন শুনলে আজ এই পরিস্থিতি হতো না |”
*****************
মা বাবা, ছেলে বৌ-এর মধ্যে মান অভিমানের একটা অদৃশ্য দেওয়াল উৎপত্তি সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল |
||৫||
(বেশ কিছুদিন পর)
“তোমার ছেলে বৌ রেস্টুরেন্ট টাকে বন্ধ করে শান্ত হয়নি, সব লেবারদের বসিয়ে বসিয়ে টাকাও দিচ্ছে | আমার এত সাধের দোকানটাকে মচ্ছবের জায়গা বানাচ্ছে, আমি এরপর কিন্তু সহ্য করব না…”, বলতে বলতেই মাথা ঘুরে সোফায় বসে পড়লেন বিজয়বাবু | আরতিদেবী এখন কাকে সামলাবেন? কার পক্ষ নেবেন? একদিকে বাবা একদিকে ছেলে , তার উপর জুটেছে ঐ মেয়ে, আরও উস্কাচ্ছে | ওর উস্কানিতেই এত কান্ড, উফফ.. |”
***************
বিজয়বাবুর এখন বেডরেস্ট | এত প্রেশার বেড়েছিল ডাক্তার খুব সাবধানে থাকতে বলে দিয়েছেন , আর চিন্তাটা একটু কম | কিন্তু চিন্তা কম করতে বললেই কী চিন্তা কম করা যায়?
-“বাবা |”
সাগ্নিকের গলায় ভাবনায় ছেদ পড়ল বিজয়বাবুর |
-“বাবা, কাল একবার আমার সাথে বেরবে বাবা? আমি কথা দিলাম এরপর তোমার যা মনে হবে করো, যা শাস্তি দেবার দিও, প্লিজ বাবা, না করো না |”
***************
সাগ্নিকের অনেক অনুনয় বিনয়ের কাছে হার মেনে অবশেষে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরলেন বিজয়বাবু, ছেলের গাড়ি করে |
নিজের চোখে নিজের স্বপ্নকে ভাঙতে দেখবেন, তাও নিজের ছেলের হাতে, কখনও ভাবেননি | সব কিছুতেই শুধু নতুন করে সাজানোর ফন্দি, আরে পুরোনো বনেদিয়ানায়, আভিজাত্যে যা আছে তা নতুন পারবে দিতে? খুব গর্ব করতেন নিজের ‘রসে বশে’ নিয়ে, কোনদিন বদলাতে দেব না আমার স্বপ্নকে, কী হলো? ছি ছি ছিঃ, মাথাটা হেঁটে হয়ে গেল |
***************
গাড়ি থামল ‘রসে বশে’র সামনে, গাড়ি থেকে নামলেন বিজয়বাবু | এত ঝামেলায় তো ভুলেই গেছিলেন যে আজ পয়লা বৈশাখ | বাঙালিয়ানা আর স্বর্ণালীর সুনিপুণ হাতের আঁকা ছবিতে দারুন ভাবে সেজে উঠেছে ‘রসে বশে’ | মুগধ হয়ে এগোলেন বিজয়বাবু | ছেলে বৌমা, সমস্ত লেবার, সমস্ত সদস্যদের সামনে ফিতে কেটে ঘরেও ঢুকলেন |
কি অপরূপ ভাবে সাজিয়েছে পুরোটা এরা, পুরোটাই নতুন কিন্তু বনেদিয়ানার ছাপ স্পষ্ট | আভিজাত্য যেন আরো বেশি করে ধরা দিচ্ছে আনাচে কানাচে | ছোট বড় রঙিন ঝাড় লন্ঠন, পাথরের টেবিল, কলাপাতার ধাঁচে তৈরি কাঁচের থালা, মাটির গ্লাস, আদ্যন্ত বাঙালিয়ানায় মোড়া পুরোদস্তুর বাঙালি মেনু, কড়িকাঠ ধাঁচের সজ্জিত উপর মহল | আরে নলেন গুড়ের আইসক্রিমও হয়?
স্বর্ণালীর হাতের আঁকায় সাজানো দেওয়ালগুলো | ওর এত গুণ কখনো ভাল করে খেয়ালই করেননি | চলতে চলতে থমকে দাঁড়ালেন ফটোটার সামনে, কি অসামান্য গুণে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছে বিজয়বাবু আর আরতিদেবীর ছবিটা, অতুলনীয় তুলির টান | স্বর্ণালী পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বলল,”শুভ নববর্ষ বাবা, পছন্দ হলো?”
“হ্যাঁ মা, খুব পছন্দ হয়েছে |”, চোখে তখন আনন্দাশ্রু বিজয়বাবুর | প্রকৃতই এ এক নব বর্ষ, শুভ সূচনা, অযথাই ভুল বুঝেছিলেন উনি | যেমন নাম স্বর্ণালী, সত্যি প্রকৃত অর্থেই খাঁটি সোনার মেয়ে | ওনার স্বপ্নকে শেষ তো করেইনি, উল্টে পুনরুজ্জীবিত করেছে নিজ গুণে |
*****************
‘রসে বশে’র পথ চলা শুরু হলো নতুন করে, পুরোনো আমেজ কিন্তু নতুন রূপে | কর্নারের টেবিলটায় বসে সাগ্নিককে স্বর্ণালী বলল, “নিজেদের সবটুকু দিয়ে সাজালাম | হাতে কিন্তু আর এতটুকু সেভিংস নেই | কেন এত করলাম জানো?”…”এই ‘রসে বশে’তে এসেই প্রথম আমাদের শুভদৃষ্টি…তুমি বন্ধুদের সাথে এখানে আর আমি সেদিন….” কথা শেষ হলো না সাগ্নিক এর, ভালবাসার আবেশে জুড়লো দুটি মন, এক নতুন শুরুকে সাক্ষী রেখে |