। । ১। ।
রান্নাঘর থেকে আবার বাসন রাখার তীব্র আওয়াজটা এলো, এবার খানিক বিরক্ত হয়েই নড়েচড়ে লাগোয়া ব্যালকনিটায় কাগজ নিয়ে বসল মানস। বিগত ক’দিন ধরে এই চলছে | যাই হোক| রানীর মর্নিং স্কুল তো ওকে রেডি করতে ওর মা-ও উঠেই পড়ে। বাজারটা রোজ যায় না মানস। সপ্তাহে দু থেকে তিনদিন সারা সপ্তাহের বাজার করে রাখে। বাকী দিনগুলো প্রাতঃ ভ্রমণ, যোগব্যায়ামটা মন দিয়ে করতে পারে। তারপর স্নান করে খেয়ে রেডি হয়ে অফিস| ওটাই ওদের রোজকার অভ্যাস। ওদের মানে, ও, নয়না আর একমাত্র মেয়ে রানীর। সকালের রুটিন বলতে এইটাই। কিন্তু বিগত ১০-১৫ দিন ধরে জিনিসটা যেন অন্যরকম। দিনে রাতে, সর্বক্ষণ মানসের কানের কাছে একটা কথাই এখন চলছে, এখনও সেই নিয়েই বচসা।
-“আরে বাবা ইএমআই তে নিয়ে নাও বলছি। আর আমিও তো কিছু দেব, অসুবিধাটা কোথায় তা তো বুঝছি না। ” চা টা খটাস করে কাঁচের সেন্টার টেবিলের উপর রাখল নয়না।
কাগজটা নামিয়ে চশমাটা খুলে নয়নার দিকে তাকাল মানস। চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, “ইএমআই-তে নেওয়া যায় আমিও জানি। পশ এরিয়াতে এত বড় ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ির ইএমআই, ফার্নিচার-এর লোন — একটু তো বোঝ। সব তো একসাথে সম্ভব না। একটা ইএমআই অন্তত বন্ধ হোক। তারপর না হয় কেনা হবে। এতো অধৈর্য্য হওয়ার কী আছে?”
-“এই ফ্ল্যাটের সাথে টিভিটা কী সত্যিই মানাচ্ছে? নিজেই বলো। কালই মিসেস গুহ বলছিলেন, একটা টিভি কেন। এত সুন্দর ওয়েল ডেকোরেটেড ফ্ল্যাটে বড্ড বেমানান যে। ” নয়না হাত নেড়ে নেড়ে ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে বলল কথাগুলো।
আজকের সকালটা বড্ড সুন্দর। আজ আবার অফিসে মিটিংও আছে একটা জরুরী, হয়তো মানসের প্রমোশনটাও হয়ে যাবে। নিজের মাথাটা যতটা সম্ভব ঠান্ডা রেখে ও চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিল তাতে।
-“কে কী বললো ভাবলো সেটা নিয়ে এত ভাবো? প্রব্লেমে পড়লে তারা তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে তো? এনিওয়ে, আমি দেখছি ম্যানেজ করতে পারি কি না। আর বলার দরকার নেই। “
আর কথা বাড়াল না মানস। স্নান করতে চলে গেল। নয়না রানীর ব্রেকফাস্ট গোছাতে গোছাতে মিনুকে বলল, ওয়াটার বটলে জলটা একটু ভরে দিতে। আরেকটু পরেই স্কুলবাস চলে আসবে।
মিনু এবাড়িতে ঠিকে কাজের লোক। মুখে খুব একটা রা কাড়ে না। বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপার। আর এই নতুন বৌদি যেন একটু কেমন তর! সবই আছে তাও খালি নেই নেই করে। এমন সুন্দর নতুন ফ্ল্যাট, ঝকঝকে তকতকে নতুন সবকিছু, তাও যেন মনে শান্তি নেই। এই ঝগড়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আজ এটা তো কাল ওটা নিয়ে চলতেই থাকে। মিনু তাড়াতাড়ি কাজগুলো সেরে বেরোল যখন তখন ৮টা বেজে গেছে। এইবার মুখার্জীদের ফ্ল্যাট। ঘামতে ঘামতে দৌড় লাগল ও লিফটের দিকে।
। । ২। ।
বেশকয়েকবার বেল বাজার পর খুলল বৌদি। শিল্পী বৌদিকে বেশ লাগে মিনুর। কী সুন্দর ধীর স্থির কথাবার্তা। কোনদিন চিৎকার করতে দেখেনি মিনু বৌদিকে। ভারী মিষ্টি, লক্ষী লক্ষী চেহারা, রোজ সকালের জলখাবার মিনু এখানেই খায়, বৌদির সাথেই। দাদা, বৌদির ছেলে বেরিয়ে গেলে বৌদি একাই। মিনুর সাথে গল্পও হয়ে যায়, ওর জিরোনোও হয়ে যায়, আজ দরজা খোলার আগেই দরজার ওপাশে বেশ চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। বৌদি তো তেমন মানুষ নয়, দাদা বদরাগী বটে। ভাবতে ভাবতেই ততক্ষণে দরজা খুলল বৌদি, মিনু তাকিয়ে হাসল। আজ প্রত্যুত্তরে বৌদির হাসিটা যেন কেমন ছাড়া ছাড়া। ভিতরের ঘর থেকে চিৎকারটা আসছে, দাদার গলা। মিনু কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেল।
-“আরে এবার থামো, বাইরের লোক শুনে কী বলবে? কাল রাত থেকে চলছে। “
-“শুনুক, শুনুক। তাতে যদি তোমার ছেলের একটু লজ্জা হয়। 11th স্ট্যান্ডার্ডের এই রেজাল্ট, এরপর কী করবে? এই মাথা নিয়ে জয়েন্ট উতরোবে, ইঞ্জিনিয়ারিং করবে? নিজের বাবার সম্মানটা তো ভাববে অন্তত, লোকে কী বলবে? প্রফেসর মুখার্জীর ছেলে হয়ে। । । ওর যা রেজাল্ট তাতে তো কোন কলেজে আমার সুপারিশ করার মতো মুখও থাকবে না। “
-“আরে এটা তো 11, 12 তো দেরী আছে এখনও, এখনই এত কিছু কেন ভাবছো?”
-“তুমি থামো। দিনরাত কী করো? লেখিকা! উনি লেখিকা! নিজে দিনরাত লেখা নিয়ে ব্যস্ত, ছেলেকেও তাই বানাও। ওই-ই হবে। তোমার তো দেখা উচিত ছিল অন্তত। “
ধড়াম করে দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে গেল ভদ্রলোক। এবাড়িতে সেভাবে অশান্তি কোনদিনই দেখেনি মিনু। আজ তাই এগুলো দেখে বড্ড খারাপ লাগছিল ওর। ভদ্রলোক বেরিয়ে যেতে এখন পুরো ফ্ল্যাট শান্ত।
-“তোমার ছেলে আজ স্কুলে বেরবে না গো বৌদি?” বাসনটা মেজে ঘরটা ঝাড়ু দিতে দিতে বলল মিনু।
-“না, তুমি ঝাড়ু মোছা হয়ে গেলে আটা-টা মেখে ফেলো। ” অন্যমনস্কভাবে কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকে গেল শিল্পী।
মিনু অশিক্ষিত, অতশত বোঝে না, কিন্তু এটুকু বোঝে, নিজের ভালবাসার জিনিসটা না পেলে কত কষ্ট হয়। ওরও খুব ইচ্ছে ছিল ছোটবেলায় ও স্কুল যাবে, লেখাপড়া করবে, ফটরফটর করে কথা বলবে। কিছুই আর… আজ তাহলে আর বাড়িবাড়ি এভাবে টাকার জন্য ঝাড়ু-ন্যাতা করতে হতো না।
হাতের কাজ সেরে ঝটপট আটাটা মেখে ফেলল মিনু। বৌদির কোনো পাত্তাই নেই। ছেলের সাথে কথা বলছে হয়তো। ছেলেটাও ভারী মিষ্টি, বৌদির মতই। সবসময় মিনু পিসি, মিনু পিসি করে। ওর হাতের আলুরদম খেতে খুব ভালবাসে। বৌদির দেরী দেখে ও রুটি করতে শুরু করল। কালকের তরকারি করে গেছিল। এবাড়িতে দু’বার আসে ও। সবাই বলে, মিনুর হাতের রান্নাটা দারুণ, বৌদি আর মিনু মিলে সন্ধ্যেবেলা হয়ে যায় সব।
আকাশটা কালো করে আসছে। এবার বৃষ্টিটা আসবে মনে হয়, ক’দিন ধরে যা পচা গরম যাচ্ছে। বেশ হাওয়াও দিচ্ছে। ছাদে জামাকাপড় দেওয়া ঠিক হবে না। ব্যালকনিতেই ছায়ায় ছায়ায় মেলতে লাগল মিনু।
রুটি হয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাল একবার ৯:২০ প্রায়। ও এই সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে এবাড়ি থেকে। বৌদি না এলে ঐ বা কী করে খাবার বাড়ে? বাধ্য হয়েই ওঘরে ডাকতে গেল।
-“মা আমি পারছি না সায়েন্স, তুমি তো জানো আমার ভাল লাগে না, কেন বাপি আমায় জোর করছে? আমি পারি না এত ফর্মুলা, এত থিওরেম মনে রাখতে। একটুও ভাল লাগে না আমার। প্লিজ মা, বাপিকে বোঝাও না। এভাবে আমি ভাল নেই। একদম ভাল নেই। এখনই ভাল নেই, তো একবছর পর কীভাবে সুস্থভাবে বাঁচব। প্রতিটা দিন অসহ্য লাগে এই বইগুলো নিয়ে বসলে। । । “
মিনুর কানে কথাগুলো পৌঁছালে ওর ছোট মাথায় এটাই এলো এখন এই মানুষগুলোকে একটু একা ছাড়া দরকার।
-“বৌদি আমি গেলাম গো, আজ শরীরটা আমার ভাল লাগছে না। রুটি তরকারি সব খাবার টেবিলে গোছানো রইল। দরজাটা দিয়ে দাও বৌদি। ” উত্তরের অপেক্ষা না করেই ও তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। ও দাঁড়ালে বা তাকালেই বৌদি বাধা দেবে, অসুবিধা সত্ত্বেও। তাড়াতাড়ি লিফটের দিকে ছুটল। আর একটা বাড়ি, কাজ সেরে ঘরে যাবে তারপর। রান্নাবান্না করে আবার বিকেল থেকে কাজ।
যেতে যেতেই ফোনটা বাজল। নতুন ফোন, মাস তিনেক আগে ওর স্বামী কিনে দিয়েছে। খুব একটা দামী কিছু না। কিন্তু ভীষণ প্রিয় এইটা। খুব যত্ন করে রাখে ও। প্রয়োজনীয় কিছু কথা, সাংসারিক কথাগুলো সারতে সারতে এগোচ্ছিল ঘোষ-চৌধুরীদের ফ্ল্যাটের দিকে।সবাই তো তাই বলে |তাই ও ও বলে |বেলটা বাজাল। এরা আবার একদমই অন্যরকম, এদের ভাবগতিক কিছু বোঝে না মিনু। কী সব বলে লিভ-ইন, কীসব ঐরকম আর কী। তবে দিদিটি খারাপ না। দাদা বেশীরভাগ সময় কাজেই ব্যস্ত, বাড়িতেই, ঐ কীসব কম্পিউটার নিয়ে। দিদি এমনিতে ভাল ব্যবহার করলেও ঠিক মেলাতে পারে না মিনু। কেমন তর হাবভাব, চালচলন, কথাবার্তা, কেমন যেন বিদেশী গোছের। ইংরেজীতে কথা বলে, ওদিকে বাঙালী। স্বামীর সাথে কথা বলতে বলতেই দরজাটা খুলল দিদি, নাম পারমিতা। ওকে খুলে দিয়েই ঢুকে গেল। একটু তাকিয়ে কথাবলা এসব কিছুই নেই। কিছু বললে বলে, ব্যস। মিনু রান্নাঘরের দিকে এগোল। দিদি একটা জ্যুসের বোতল নিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। পরনে জিমের পোশাক। এবাড়িতে ও রান্নাবান্না করে না। যতদ্রুত সম্ভব কাজ করে পালায় ও। কলটা খুলে কাজ শুরু করল।
জলের আওয়াজে স্পষ্ট শোনা যায় না, কিন্তু কিছু কথা ভেসে আসছিল। না চাইতেও এগুলো শুনতেই হয় মিনুকে। ওর ভীষণ আশ্চর্য লাগে এখন। মানুষের কী ভীষণ লোভ? ওরও তো তাই, আর ক’টা বাড়ি ধরলে একটু ভালভাবে চলবে। তেমনি এদরও। এদের এত আছে তাও কত অভিযোগ। ভবিষ্যৎ কী হবে সেই নিয়ে এখন কত তুমুল অশান্তি। এরা তো শিক্ষিত, তাও এত। । । ওর স্বামী শুনে বলে যার যত আছে, তাদের মনের অশান্তি নাকি তত বেশী।
-“তুমি তেমন হলে আরও বেশী কাজ ধরো, আর কতদিন ওয়েট করবো? ফিউচারটাও তো ভাবতে হবে। “
-“আই অ্যাম ট্রাইং মাই বেস্ট পারো। এখন তো দিনরাত শুধু প্ল্যানিংই করে চলেছি যাতে ফিউচারটা স্মুদ হয়। । ।
-“দ্যাখো অনেকদিন হয়ে গেল। রোজ রোজ মাকে কী বলব? আই অ্যাম নাও 31, আর কত? ভবিষ্যৎটা কি হবে। এখনই ডিসিশন নিয়ে কিছু করতে হবে, নয়তো আর লাইফে কিছু করতে পারবে না। “
-“এই ভবিষ্যতের প্ল্যান করে করে, ঝামেলা, অশান্তি ইনসিকিওরিটিতে আমাদের সম্পর্কটা কোন তলানিতে এসে ঠেকেছে বুঝতে পারো?”
-“ও রিয়েলি?”
-“ইয়েস, ইয়েস। দুটোই দরকার।ইউ কান্ট রুইন ইওর প্রেজেন্ট জাস্ট ফর ইওর ফিউচার। একটা ব্যালেন্স দরকার লাইফে, আর আমি কী চেষ্টা করছিনা?”
-“তোমার সাথে কথা বলাই বেকার। । । তুমি বাঁচো তোমার প্রেজেন্টে, ভবিষ্যৎ নিয়ে কিচ্ছু ভেবো না। সম্পর্কটা, আমাদের ভবিষ্যৎটা তোমার এই নীতিকথার থেকে তো দামী নয়। “
-“তোমার জন্যই এই ফ্ল্যাটটা রেন্ট নেওয়া, আমরা সস্তার অন্য কোন। । । “
ধড়াম করে একটা শব্দ। কেউ গটগট করে বেরিয়ে গেল। মিনুর কাজও প্রায় শেষ। দরজাটা লাগিয়ে দিতে বলে ও-ও বেরিয়ে পড়ল মিনিট দশেক পরেই। তখন থেকে আকাশটা গর্জে যাচ্ছে, ঢালার নাম গন্ধ নেই। ঝোড়ো হাওয়া বইতেও শুরু করেছে। ও সঙ্গে ছাতাটাও আনতে ভুলে গেছে। তাড়াতাড়ি পা চালাতে লাগল ও। সামনের সিকিউরিটির গেটের কাছে এসেই গেছে তখনই কেউ যেন পিছু ডাকল। চেনা চেনা গলা পেয়ে ফিরে তাকাতেই দেখল, শিল্পী বৌদি। হাতে কৌটো।
-“না খেয়ে চলে যাচ্ছিস কেন? সব বুঝি। তোর এমনিই গ্যাসের সমস্যা। চুপচাপ খেয়ে নে। আমি এই জন্যই আরো এখন নামলাম। তখন তুই চলে এলি, ঐসময় আর কিছু বলতে পারিনি। “
-“আরে বৌদি, এত কেন ভাব বলতো তুমি? একদিন না খেলে কী এমন হতো। । । “
-“খাটিস তাহলে খাবি না কেন? খেয়ে নে। ওবেলা চলে আসিস, দেরী করিস না। “
বিশাল বিলাসবহুল বহুতল আবাসনের সামনেটায় বাগান, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, ওপাশে গ্যারেজ, সামনে সিকিউরিটির অফিস, গেট পেরিয়ে বেরিয়ে কিছুদূর গেলে বড় রাস্তা আসে। কম্পাউন্ডের ভিতরই গ্রসারী শপ, লন্ড্রি, সবজির দোকান সবই আছে। সচরাচর বাইরে যেতেও হয় না।
-“আমি একটু বেরবোও, ছেলেটার কাল জন্মদিন। এবারে ওর বাবা কিছু করতে দিচ্ছে না। কিছু তো খাওয়াবো। । । ” বললো শিল্পী বৌদি |
গেটের এদিকটায় প্রচন্ড হাওয়া দেয়, সুন্দর করে সাজানো বাগান, গাছগাছালি। আজ আবার সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। বেশ ভালো লাগছিল দাঁড়াতে। হঠাৎই সিকিউরিটির তাড়াহুড়ো করে আবাসনের দিকে দৌড়ালো। কিছু সামনের দাঁড়িয়ে থাকা লোকের চিৎকার, হুড়োহুড়িতে পিছন ফিরে তাকাতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ওরা দুজন। হঠাৎ কী হলো, কী হবে, পুরোটা মিলিয়েই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সবাই মিলে হঠাৎ হুড়োহুড়ি, পিল পিল করে লোকজন বেরতে শুরু করল কয়েকমিনিটের মধ্যেই। ফায়ার এলার্ম বাজছে| এখন আবাসনের মধ্যে আর কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। শিল্পী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না আর। শুধু পার্সটা সঙ্গে আছে, তাই ফোনটা করতে পারবে, কিন্তু ছেলে তো ফ্ল্যাটে, ও ফোনটা ধরছে না কেন। তিনবার পর পর ফোন করেও ব্যর্থ হলো যখন তখন ভিতরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
এত বড় আবাসন, এত বিলাসবহুল ব্যবস্থা, এদের কাছে জরুরী পরিষেবার সমস্ত ব্যবস্থা নিশ্চয় আছে।
-“প্লিজ আমায় একবার ভিতরে যেতে দিন। আমার ছেলে ফোন ধরছে না। “
-“প্লিজ ম্যাডাম, বোঝার চেষ্টা করুন, লিফ্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ফায়ার অ্যালার্ম অনেক পরে বেজেছে, আগুন বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই বেরোচ্ছে, এর মধ্যে আমরা ঢুকতে দিতে পারব না। দমকলকে খবর দেওয়া হয়েছে। আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন। “
-“আরে আমার ছেলেটা ভিতরে একা। ” চিৎকার করে উঠল শিল্পী। ওর অসহায় মুখটা দেখে কী বলবে বুঝতে পারছিল না মিনু। মিনুরও ভীষণ ভয় করছে।
-“আমি তো আমার মোবাইলটাও নিয়ে আসিনি। আমি একটা ফোন করব… ” পারমিতাও ভীষণ রকম ভয় পেয়ে গেছে ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এই বাগানেই এসে বসেছিল|
-“অনি যখন কাজ করে, কানে হেডফোন, ও কিচ্ছু তো শুনতেও পাবে না। ফোনটাও ধরল না। ওহ মাই গড! “
নয়না হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়েছে ততক্ষণে। ওর যে প্রবল শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। বাগানের বাঁধানো রকে গিয়ে বসে হাঁপাতে লাগলো ও। ততক্ষণে দমকল এসে গেছে।
-“দয়া করে আপনারা সরে যান। আমাদের কাজে অসুবিধা হবে, আপনাদের জন্যই বলছি। সরে যান। “
ফোনের স্ক্রিনটা অন করে দেখল শিল্পী। এর মধ্যে ২০ মিনিট হয়ে গেছে। কই ওর ছেলেটা তো এখনও। । । চোখ ফেটে জল আসছিল ওর। আগামীকাল ছেলেটার জন্মদিন, কাল থেকে ঐ প্রবল অশান্তি, কী করছে ও কে জানে।
7th, 8th, 9th, 10th ফ্লোরে আগুন বেশ খানিকটা ছড়িয়ে পড়েছে। সমস্ত লোকজনকে সরে যেতে বারবার অনুরোধ করছে দমকল, সিকিউরিটি। বাইরে এর মধ্যে বেশ ভিড় জমে গেছে। শিল্পী আর কিছু ভাবতে পারছিলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল শুধু। চোখে জল, মুখে আর কোন শব্দ নেই। পাগলের মতো নিজের হাজবেন্ডকে বারবার ট্রাই করছে।
নয়নার স্বামী মানস ইতিমধ্যেই এসে উপস্থিত। ওদের অবস্থাটাই মনে হয় অপেক্ষাকৃত ভাল, ওদের কোন প্রিয়জন নেই ঐ অগ্নিজালে, ওরা সুরক্ষিত, ওরাই ভাগ্যবান। মানসকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিল ও। মেয়ে এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি, ভাগ্যিস ফেরেনি। মিনু তাকিয়েছিল ওদের দিকে।
-“আমরা ঠিক আছি নয়না, আমাদের কিচ্ছু হয়নি। প্লিজ কান্নাকাটি কোরো না। বাকীদের অবস্থাটা ভাব, ওনারা তো আরো ভেঙে পড়বেন। “
সত্যিই তো, ওরা বেঁচে আছে, এটাই তো সবথেকে বড় কথা। জানে না ফ্ল্যাটটার কী অবস্থা। হয়তো দাউদাউ করে জ্বলছে। এই ফ্ল্যাটটাকেই সাজাবে বলে, একটা সামান্য টিভির জন্য কত অশান্তি করছিল ও মানসের সাথে। কী হলো? একনিমেষে জাস্ট শেষ। কোন মূল্যই নেই যেন। আজ সেই ফ্ল্যাটটা শেষ হতে দেখে ও মনে একটাই শান্তি, ওরা সুস্থ আছে, বেঁচে আছে। বাকীদের থেকে ভাল জায়গায় আছে। সবকিছুই কত আপেক্ষিক !
মিঃ মুখার্জী এসে পড়েছেন, শিল্পীর ফোন পেয়ে। স্ত্রীকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলেন, খুঁজে পেয়ে সিকিউরিটির কাছে ছুটলেন।
-“আপনি জানে আমি কে? যেভাবে হোক আমার ছেলেকে ফেরত চাই, নয়তো। । । ” শিল্পীর বাধায় খানিকটা নিজের দম্ভকে প্রশমিত করার চেষ্টা করলেন এই সময়ে।
যে মানুষটা আগামী বছর শুধুমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে সে নিয়ে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হাজারটা কথা বলছিল, সেই আজ বারবার চিৎকার করে বলছিল আমি শুধু আমার ছেলেকে ফেরত চাই, আর কিচ্ছু না!
কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তার চাওয়ার এই পরিবর্তন হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল মিনু। মানুষ কতই পরিকল্পনা করে নিক, ‘আজ’ দাঁড়িয়ে ‘কাল’কের জন্য অশান্তি করে সুন্দর আজটাকে নষ্ট করে নিক, যে ‘কাল’কে সে কখনো দেখেইনি। তবু মানুষ, প্রকৃতির কাছে, নিয়তির কাছে শুধুই একটা পুতুল মাত্র। যে লোকটার চোখে সন্তানের জন্য লজ্জা ছিল সকালেই, সেই লোকটার চোখেই এখন নিজের একমাত্র সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতি।
আবাসনের সামনের অংশে থিকথিক করছে মানুষ। মিনুও হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে। না ওর তো কেউ নেই এখানে, তাও ও যেতে পারছে কই। এই মানুষগুলোর সাথেই তো জড়িয়ে ছিল ও-ও। কীভাবে সব একনিমেষে শেষ হয়ে যাচ্ছে!
পারমিতার বিহ্বল দৃষ্টি দেখে মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল মিনুর। এই দৃষ্টি ও ভুলতে পারবে না এই জীবনে |যে মানুষটা কিছুক্ষণ আগেও ভালবাসার মানুষটার সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্কে মশগুল ছিল, সেই এখন জানেই না আদৌ কী তার ভবিষ্যৎ! আদৌ দেখা হবে তো, ও বেঁচে যাবে তো! বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিল ও।
**********
সকাল থেকেই তোড়জোড় করে তুমুল বৃষ্টিটা অবশেষে নামল। আবার মানুষের হুড়োহুড়ি। সব ফেলে আগে নিজেকে বাঁচানোর আকুতি। প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দমকল বাহিনী, যদি প্রকৃতি একটু সঙ্গ দেয়, হয়তো জিতে যাবে এইবার।
**********
কিছু প্রাণহীন জড়বস্তু, মেটারিয়ালিস্টিক জিনিস পাওয়ার লোভে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নিশ্চিত প্ল্যানিং করতে গিয়ে, আমরা আজটাতে কতটুকু বাঁচছি? নশ্বর বস্তু কতদিন থাকবে জানি না, কাল কী হবে তাও জানি না, আদৌ বাঁচবো তো! তাই আগে ‘আজ’ তো ‘বাঁচুন’।