আমি আমার মতো

||১||

“ম্যাথস-এ মাত্র ৭৮, ৮০টাও হলো না, ছিঃ ছিঃ ছিঃ | হিস্ট্রি-ও তাই, তাও কম্পিউটারটা একটু বলার মতো, ৮৫, বলতে বলতেই রিপোর্ট কার্ডটা সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে চশমাটা খুলে ফেললেন, রাজীব বাবু | ছোট্ট বাবান তখনও স্কুল ড্রেসে ভারী ব্যাগ কাঁধে মাথা নীচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে |

**************

বাবান, মানে অনির্বান গাঙ্গুলী, ক্লাস ফাইভে উঠল | বাবা রাজীব একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, মা ঘর সংসার সামলানোর পর নিজের একটা শাড়ীর ব্যবসা চালায় | দাদু ঠাকুমা নিয়ে ছোট্ট বাবান থাকে বাগবাজারে, নিজেদের বাড়িতে |

তা’ এহেন, বাবানের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে, বেশির ভাগ পেপারেই বাবানের প্রাপ্ত নম্বর ৮০ ছুঁতে ছুঁতেও ৮০ ছোঁয়নি, তাই লজ্জায় রাজীব বাবু মাথা হেঁট করে বসে আছেন | বাবানের মন পড়ে খেলার মাঠে, নিশ্চয় সব বন্ধুরা খেলতে চলে এসেছে এতক্ষনে, ওর এখন স্কুল ড্রেসটাও ছাড়া হয়নি, খিদেও পেয়েছে কত | বাবানের মা-ও খুব রেগে, তবে বাবার মতো অতোটা না | আজ মা বলেছিল বাড়ি ফিরে চাউমিন দেবে খেতে, এই এতো বকার পর আর মা চাউ দেবে খেতে?

বাবানের ভাবনা থামিয়ে রাজীব বাবু বললেন,”আজ থেকে তোমার টিভি দেখা, খেলা সব বন্ধ | বড্ড বেড়েছ তুমি, চুপ চাপ ঘরে চলে যাও, এবার তোমার ব্যবস্থা আমি করব, যাও… কি হলো যাও !”

বাবার ধমকানিতে ছোট্ট বাবান চলে গেল ঘরের ভিতর |

||২||

নতুন ক্লাসে সবাই খুব খুশি, নতুন বই-এর গন্ধ, নতুন মলাট, নতুন নতুন স্টিকার, নতুন ব্যাগ, পেন্সিল বক্স, বোতল, টিফিন এসবের মাঝে বাবানের মনটা ভাল নেই | বাবান খুব ভাল আঁকে, খেলা ধূলাতেও ভাল, কিন্তু বাবা কখনো এসব নিয়ে উৎসাহ দেয় না, উল্টে সময় নষ্ট হচ্ছে বলে বকছে | এবারের রেজাল্টও ভাল হয়নি বাবা তাই আরও রেগে গেছে, ওয়ার্ক এডুকেশন-ও নম্বরটা ৯০ ছোঁয়নি, সব মিলিয়ে বাবান একটুও ভাল নেই | বাবা খুব সুন্দর কবিতাও লেখে, কিন্তু এই এত গুলো গুণের মধ্যেও বাবান সবার থেকে পিছিয়ে | বাবা বলে, ওদের ক্লাসের নিলয়, অনীক, অভীক ওর থেকে বেশি নম্বর কি করে পেল ম্যাথস-এ, বাবা খুব বকে আজকাল | মা প্রায়ই স্কুলে পৌঁছে যায় অন্য সেকশনের ছেলেমেয়ে-দের থেকে নোট নিতে, বাবান তো “ম্যানেজ” করে অন্যদের থেকে নোট টাও নিতে পারে না, তাই |

***************

(কয়েক বছর পর)

সেদিনের বাবানের বয়স খানিকটা বেড়ে গেছে, তবে পরিস্থিতি পাল্টায়নি, ব্যাগের বোঝা বেড়েছে আরও, খেলার সবুজ মাঠ-এর জায়গা দখল করে নিয়েছে টেবিলের স্তূপাকার বই, প্রশংসার জায়গা আজও নিতে পারেনি ওর রেজাল্ট, জুড়েছে আরও কিছু তুলনা | বাবানের এখন নাইন হলো, ভালোলাগার ছবি আঁকা, খেলা ধূলা, কবিতা সবাই আজ বাবানের পথ ভুলেছে | বাবা চায় বাবান ডাক্তারি পড়ুক নয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং, বাবান কি চায় কেউ জানতে চায়নি যদিও |

||৩||

বাবানের আজ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলো, ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষাটা তেমন ভাল হয়নি | খুব অস্থির লাগছে আজ, সবার ঘরের আলো নিভে গেলেও বাবানের ঘরে আলো জ্বলছে | দুশ্চিন্তা, আশঙ্কার ভিড়ে শৈশবটা কবেই শেষ হয়ে গেছে, টেরই পায়নি আশপাশের মানুষগুলো |

“দাদু ভাই তুমি এখনও জেগে?”-দাদুর গলার আওয়াজে টনক নড়লো বাবানের |

-“দাদু তুমি হঠাৎ?”

-“তা তোমার ঘরে আলো জ্বলছে দেখে এলাম, ভাবলাম কী করছে দেখি |”

খুব ইচ্ছে করলো দাদুর কোলে মাথা রেখে শুতে, খুব নিশ্চিন্ত লাগে বাবানের | দাদুর কোলে মাথা রেখে শুলো একটু বাবান, দাদু বাবানের মনের কথাটা যেন পড়তে পারলো,

-“দাদুভাই-এর কী পরীক্ষা নিয়ে টেনশন?”

-“কীভাবে বুঝলে দাদু?” অবাক চোখে তাকায় বাবান দাদুর দিকে |

-“আরে তোর বাবার ও বাবা, আমি বুঝব না? কোনচিন্তা নেই তোর, তোর দাদু তো আছে, তোর যা মনে হয় যেভাবে ভালো লাগে পড়বি, পড়ে পড়ে তো চোখের তলায় কালি পড়ে গেল….”

দাদুর কথাটা টেনেই বাবান বলল, “বাবা তো টাও খুশি হয় না দাদু, ভালো লাগে না সবসময় তুলনা শুনতে, মাথায় ঢোকে না অত অঙ্ক, সায়েন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছেও নেই, কিন্তু বাবা তো কিছুতেই শুনতে চায় না, আমি কী চাই বাবা তো শোনেই না, তুমিও কী বাবাকে এভাবেই জোর করতে দাদু? বাবা তো এখন আমায় এবাড়ি থেকেও নিয়ে চলে যেতে চায়, আমি ফ্ল্যাটে যেতে চাই না দাদু, আমি তোমার আর ঠাম্মার সাথেই থাকতে চাই | প্লিজ দাদু….”

কান্নায় গলাটা বুজে এল পনেরোর বাবানের, দাদুর কোলে মাথা গুঁজে নিজের মনের কাউকে বলতে না পারা যন্ত্রনাটা অবশেষে উগরে দিল বাবান |

“ধ্যুর, পাগল ছেলে, তোর বাবাকে আমি কোনদিন লেখাপড়া নিয়ে জোর করিনি, সে নিজের খেয়ালে যেমন ভাল লেগেছে পড়েছে | তুই একদম ভাবিস না, আমি আছি, তোর দাদু আছে |”

(কিছুদিন পর)

“তোর লজ্জা করছে না আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে? এই নম্বর নিয়ে কী করবি তুই, বোর্ডের এক্সামের পর কোথাও চান্স পাবি? ৭০% মার্কস, লিটারেচারে ৮০% ছিঃ ছিঃ, এই বাড়িটাই যত নষ্টের গোড়া, সবসময় শুধু দাদু ঠাকুমার সাথে আড্ডা, তোমার ব্যবস্থা দেখছি এবার করতেই হবে | অফিসে বাকী কলিগরা যখন মার্কস নিয়ে আলোচনা করে ছেলে মেয়ের, আমার মাথাটা হেঁট হয় সবসময়….”

রাজীব বাবুর অনর্গল কথার মাঝে খেয়ালই করেননি, বাবানের চোখে জল, আর কখন ওনার বাবা এসে দাঁড়িয়েছেন | রাজীব বাবু এটাও ভুলে গেলেন ঐ বয়সে উনি নিজে কী চাইতেন, কী পড়তে ভালবাসতেন, বাবার কথায় হুঁশ ফিরল রাজীব বাবুর | রাজীব বাবুর ডাকনাম রাজু, গুরুজনরা এই নামেই সম্বোধন করেন |

-“রাজু তুমি নিজে এই স্ট্যান্ডার্ডে বা এর আগেও কীরকম নম্বর পেতে খেয়াল আছে কী তোমার?”

-“বাবা তুমি বাবানের সামনে…”

-“জানি, আমার এসব কথা দাদুভাই-এর সামনে বলা উচিত নয়, কিন্তু, আমি দেখে দেখে আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি | ওর ভাল লাগার সব জিনিস তো একে একে কেড়ে নিলি, ব্যাগের বোঝা বেড়ে স্তূপাকার, সবসময় শুধু পড়লে, বই পোকা হলেই কী পড়াশোনায় ভাল হওয়া যায়? নাকী যারা সবসময় বই পড়ে না তারা জীবনে উন্নতি করতে পারে না | এখন আবার ওকে বাড়ি থেকেও নিয়ে চলে জাবি, ও দাদু ঠাকুমার কাছে নিজের ছোটবেলাটা খুঁজে বলে? তুই নিজে কী খুব ব্রিলিয়ান্ট ছিলিস? তুই কী প্রতিষ্ঠিত হোসনি? না আমি হইনি? সবাইকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারই হতে হবে? কেন ওর যেটা ভাল লাগে ও সেটা হতে পারবে না কেন? তুই চাসনা বলে? সমাজ চায় না বলে? আরে জীবনটা তো ওর, তাহলে ওকেই বাছতে দে না | আর মাধ্যমিকের মারকাটারি রেজাল্ট কবে কোথায় লেগেছে বলতো বাপ্? ছেলেটাকে ছেলেটার মত করে একটু বাঁচতে দে না, জীবনটা বাঁচার আগেই তো ভারেই মরে যাবে ও, বেঁচেও মরে থাকবে, ওর মুখটা দেখে বুঝতে পারিস না?”

-“কিন্তু বাবা…..”

-“না, তুমি চুপ কর, বাচ্চা তোমার কলিগের ছেলে মেয়েরা এত সুন্দর আঁকতে পারে? খেলাধুলায় এত ভাল? এত সুন্দর শব্দ নিয়ে খেলতে পারে? তাহলে বাবান অঙ্ক ভাল পারে না সেটা নিয়ে কেন এত তুলনা তোমার? ও যাতে ভাল ওকে সেটা নিয়েই এগোতে দাও, ওর ওপর নিজের প্রত্যাশা কেন চাপাচ্ছ? আর ক্লাস নাইনে লাইফ সায়েন্স কত পেয়েছে, ৮০ পেয়েছে কীনা সেটায় কী আদৌ কিছু যায় আসবে ৫ বছর পর? তাহলে?

….. রাজীব বাবুর মুখে আর কোন কথা নেই |

||৪||

সব বাবানের দাদুভাই থাকে না তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য, তাই অনেক বাবান এভাবেই প্রত্যাশার চেইপ অকালে ঝরে যায়, মা বাবার সমর্থন আর ভালোবাসা পেলে এরকম অনেক প্রতিভাকে আমরা খুঁজে পেতে পারি, যারা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের থেকে কম কিছু নয়, যার হাজার হাজার বই বিক্রি হচ্ছে রোজ, বা যার তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হচ্ছে অজস্র ছবি, দেশকে পদক এনে দিচ্ছে যে, গর্বিত করছে নিজের প্রতিভার জোরে | ছেলেমেয়েকে “বিগড়ে যাচ্ছে” বলে তার উপর চাপ না দিয়ে, শুধু তার কাউন্সেলিং না করিয়ে, তাকে সমর্থন করি না কেন? তাহলে মা বাবার কাউন্সেলিং-এর প্রয়োজন নাকী? চিন্তাধারা দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো দরকার নয় কী? একটু ভাবুন |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

হারিয়ে যাওয়া ‘আমি’

।।১।। “এই বেলটা বাজছে, একবার দেখ না, তরকারিটা নামাচ্ছি তো, দেখ রে,আরে এই টুসি, কোন সাড়াশব্দ নেই।” “আরে আমি রেডি হচ্ছি মা, তুমি দেখো।” “উফফ,

Read More »

লজ্জা

লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে চুপচাপ সবার নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে এল রিনি। কিছু আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাদটা ভিজে এখনও, মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ

Read More »

আজ বাঁচুন

আবাসনেরর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই চিৎকার কানে এলো… সিকিউরিটি কে ছুটে যেতে দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ওরা |কিন্তু তারপরই আবাসনের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল যেন চারপাশটা…

Read More »

রদ্যি খবর

“তোকে কতবার আর বলব পুপু, আজ অন্তত দস্যিপনাটা একটু কমা। দেখছিস তো বাড়িতে লোকজন আসবে আজ।” মেয়ে পুপুকে আবার একবার খানিক ধমকে দিলো রাধিকা, বিক্রমপুরের

Read More »

এই বেশ ভালো আছি

।।১।। ট্রাঙ্ক থেকে ন্যাপথালিন দেওয়া গুটি কয়েক তোলা শাড়ি থেকে একটা শাড়ি বের করছিল মায়া । ছোট্ট দু’কামরার ঘরে এককোণে খাট, ছোট্ট আলনা, ট্রাঙ্ক, কুঁজো,

Read More »

Share with