।।১।।
“ঐ দ্যাখো বেলটা বাজছে, বাবু এসে গেল মনে হয়, দ্যাখো তো”- বলতে বলতেই লুচি বেলার স্পিডটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলেন মিনতি দেবী । বাবুটা গরম সাদা ফুলকো লুচি খুব ভালবাসে তাই এইসময় বাবু অফিস থেকে ফিরলে তাকে দেওয়ার জন্য এত আয়োজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধার । কপাল, মুখ ঘামে ভিজে গেছে, সে দিকে দিকপাত-ই নেই ।
**************
উত্তর কলকাতায় শ্যামপুকুর এলাকায় বাড়ি রাজাদের । রাজা মানে রাজীব মুখার্জী, একটি বেসরকারী কোম্পানীতে কিছুদিন হলো চাকরিতে ঢুকেছে । মা মিনতি মুখার্জী | বাবা রণেন মুখার্জী রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক । জ্যেঠু জ্যেঠী, কাকা কাকী, খুড়তুতো জাড়তুতো ভাইবোনদের নিয়ে ভরা সংসার । হেঁশেল আলাদা হলেও একবাড়িতে একসাথেই থাকে সব ।
***************
টুং টুং শব্দে মুঠোফোনটা হাতে নিল রাজীব, মেসেজ,
-“কথা হলো?”
-“নাহ, সুযোগই পাইনি সেভাবে কথা বলার ।”
-“রোজই এটা বলো, প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো আর কতদিন?”
-“give me sometime, try to understand, এতো easy নয়, একটু ধৈর্য্য ধরো, I’ll manage.”
।।২।।
সময় তার নিজের নিয়মে স্রোতের মতো বইতে থাকে । উত্তুরে হাওয়া জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের । ছাদের টবে শীতের মরসুমের ফুলের চারাগুলো লাগাতে হবে, ভাবতে ভাবতেই জামা কাপড়গুলো রোদ থেকে তুলতে ব্যস্ত মিনতি দেবী । পুরোনো বাড়ির সুবাদে এখনও বারান্দা, ছাদ, উঠোন এইগুলো তাদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, নয়তো এখনকার পায়রার খুপরিতে তো এইসব…
***************
কী অবস্থা করে রাখে ঘরটার? ছাদ থেকে নেমে বাবুর ঘরটায় বসেন কিছুক্ষন মিনতি দেবী । আগে এই ঘরটায় থাকতেন, বিয়ে হয়ে এসে প্রথম এই ঘরেই উঠেছিলেন, তারপর এখন বাবুকে ঘরটা দিয়ে দিয়েছেন, এই ঘরটায় বেশ ভালো রোদ আসে । ঘরটা গুছোতে গুছোতে স্টাডি টেবিলে ছবিটা হাতে আসে, “বাহ্, বেশ মিষ্টি দেখতে তো মেয়েটাকে । কই বাবু তো কিছু বলেনি, আসুক আজ, হচ্ছে তোমার, দাঁড়াও”, বলতে বলতেই মনে মনে হাসলেন মিনতি দেবী । ওনাদের সময় তো এসব কিছুই ছিল না । এখনকার জেনারেশনেও আগের মতো ভালো, খারাপ দুটোই আছে, সব সময়ই থাক । কিছু ছেলে মেয়ে অস্থির, সম্পর্কের টানাপোড়নে নিজেরাই ভেঙে যায় । কিন্তু যারা ভালবেসে এক থাকে, তারা কিন্তু জিতে যায়, সবসময় সব পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে থাকা, দুজনেই ঘর বাইরে দুটোই একসাথে সামলানো, একসাথেই রান্না, বাজার, সংসার, চাকরি, সব একসাথে । এটাকে মিনতি দেবী খুব সাপোর্ট করেন, এরকমই তো হওয়া উচিত একটা সম্পর্ক, দেওয়া নেওয়া সব সমান সমান । ওনার এই এত বছরের বিবাহিত জীবনে ওনার স্বামী কতবার যে রান্না ঘরে ঢুকে ওনাকে সাহায্য করেছেন, বা মাসিক অসুবিধার সময় হটব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়েছেন, ভাবতে বসলে মাথার চুল ছিঁড়তে হবে । মনে মনে নিজেকে খানিক উপহাসই করলেন, অনেক কিছুই স্বপ্ন দেখেছিলেন, আশা ছিল অনেক কিন্তু সেগুলো…. দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ব্যস্ত হয়ে গেলেন আবার নিজের রোজকার রুটিনে ।
।।৩।।
“বাবু, তুই আগে খেয়ে নে, তারপর না হয় শুনব, যা বলবি, তোর জন্য গরম কড়াইশুঁটির কচুরি করলাম, খেয়ে নিবি আয় ।”, বলে চলে গেলেন মিনতিদেবী ।
আবারও বলার চেষ্টা করে বলতে পারল না রাজা, কিন্তু এবার তো বলতেই হবে, আর কত দেরী করবে ও?
****************
-“মা, তুমি এখানে বস, আমি তোমায় কিছু বলতে চাই ।”
-“আচ্ছা বাবা, বসছি, নে বল এবার | খাবার ভাল ছিল তো বাবা?”
“হ্যাঁ মা, খুব ভাল ছিল” বলেই মায়ের পায়ের কাছে বসে মা-এর হাত দুটো নিজের হাতে শক্ত করে ধরলো রাজা, অনেক কষ্টে বলার শক্তি সঞ্চয় করেছে ও আজ, এবার বলবেই,”মা আমি…”
-“আমি জানি তুই কী বলবি? আমি মেয়েটার ছবি দেখেছি, খুব মিষ্টি দেখতে, আর আমার পছন্দও হয়েছে…”
এই অবধি বলে মিঠিমিঠি হেসে তাকালেন ছেলের দিকে । রাজা স্বাভাবিক ভাবেই হতবাক, কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আবার বলল,”তুমি আবার কবে দেখলে?”
-“কেনো তোর ঘরের স্টাডি টেবিলেই তো পেলাম, না দেখার কী আছে?”
রাজা একটু অপ্রস্তুত, মা-এর সামনে মাথা নীচু, কিন্তু আসল কথাগুলো তো বলাই হয়নি ।
-“মা ওর নাম আয়েশা ।”
-“বাহ্, মিষ্টি নাম, তা বাড়ি কোথায়, বাবা কী করেন?”
-“মা তুমি প্লিজ আগে পুরোটা শোনো । ও আয়েশা, ওর সাথে আমার পরিচয় পাঁচ বছর-এর, বাড়ি পাইকপাড়া, বাবা মারা গেছেন মাস ছয়েক হলো, মা….. মা ও ট্রান্সজেন্ডার, আমি তোমায় পুরোটা বলতে চাই, কিছু লুকোতে চাই না, তুমি বুঝতে পারছ তো আমি কী বলছি?”
অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে মিনতিদেবী বললেন,”মানে? সেটা আবার কী?”
-“মা, ট্রান্সজেন্ডার, মানে রূপান্তরকামী, মা মানুষটা মনে মনে নারী-ই ছিল, কিন্তু শরীরটা ছিল পুরুষের, এই টানাপোড়েনে অনেক ভোগার পর ও ওর মনের কথাটা শোনে, এখন ও শরীর ও মন সবদিক থেকেই একজন সম্পূর্ণ নারী । আর আজ ও এই সিদ্ধান্তের পর খুব খুশিও ।”
-“কীসব বলছিস রে তুই? আমার তো শুনেই কেমন করছে, তুই এতবড় একটা কথা এতদিন ধরে আমায় জানানোর প্রয়োজন বোধ করলি না?”
-“মা আমি ওর ঐ সিচুয়েশনে ওর পাশে থাকতে চেয়েছিলাম আর তখন বললে তুমি, বাবা কীভাবে রিয়্যাক্ট করতে আমি জানতাম না ।”
-“তাহলে আজ কেন বলতে এসেছিস?”
-“মা, ওর বাবা মারা যাওয়ার পর এবার ওর বাড়ি থেকে বিয়েটা…”
-“বাহ্, সব কিছু আগে থেকেই ঠিক করে ফেলেছিস, এখন শুধু জানাতে এসেছিস সিদ্ধান্তটা । আচ্ছা একটা মেয়েও জুটলো না তোর, শেষ পর্যন্ত একটা ছেলে না মেয়ে… ছিঃ ছিঃ ।”
-“মা, প্লিজ, ও এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, আর ওর জীবনে ও যা ফেস করেছে, সেটা যে কেউ করতে পারতো, আমিও পারতাম । মানসিক টানাপোড়েনটা কতটা যন্ত্রণার সেটা তুমি উপলব্ধি করতে পারছো না, তাই এভাবে ভাবতে পারছো, নিজের অস্তিত্বটাই যখন নড়বড়ে মনে হয়, আমি, আমার মন যা চায়, যেভাবে চায়, আমার শরীর ঠিক তার উল্টোটা, এটা কতটা কষ্টের তুমি ভাবতে পারছো? এই টানাপোড়েনেই কত মানুষ সারাটা জীবন কাটিয়ে দে, মরতে মরতেই জীবনটা কেটে যায় তাদের । ও তো তাও এবার থেকে বাঁচার মতো করে বাঁচতে পারবে । ভগবান যেটুকু খামতি রেখেছিলেন ওকে গড়তে, আজ তো সেটা তার আশীর্বাদেই পূরণ হয়ে গেছে, আজ তো ও আর পাঁচটা মেয়ের মতোই । তুমিও তো ওর ছবি দেখেছ, তোমারও তো ভাল লেগেছিল, তাহলে?”
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা, শীত পড়ছে, তাই ফ্যানের আয়াজটুকুও নেই । বাইরে পাড়ার কুকুরগুলো মাঝে মাঝেই চিৎকার জুড়ছে, ঘড়িতে ঘন্টার কাঁটা ১টা ছুঁইছুঁই । চুপচাপ বসে আছে মুখোমুখি মা আর ছেলে, মা-র চোখে একরাশ বিস্ময়, অনেক প্রশ্ন আর কোথাও যেন একটু হতাশাও । আর ছেলের চোখে আকুতি, নিজের ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য আকুল প্রার্থনা যেন ।
নিস্তব্ধতা ভেঙে মিনতিদেবী বললেন,”ঠিক আছে, আমি তোর বাবার সাথে কথা বলি, জানিনা বোঝাতে পারব কী না ।” বলেই উঠে যেতে গেলে, রাজা আবার হাতটা ধরে নিল, “মা আমার আরও একটা কথা জানানোর আছে ।”
এবার ততোধিক বিস্ময় প্রকাশ করে মিনতিদেবী ফায়ার তাকালেন, কোঁচকানো ভ্রু জোড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে ওনার ভিতরের চাপা বিরক্তিটা ।
-“আবার কী বলার আছে তোর? আরও কিছু বলা বাকী এখনও?”
-“মা, ওর পুরো নাম আয়েশা ফার্নান্ডেজ”, এইটুকু বলে চুপ করল রাজা ।
মিনতিদেবী ছেলের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালেন, এবারের দৃষ্টিতে যেন আরো ভয়ঙ্কর, “অসম্ভব”, এই একটি শব্দ উচ্চারণ করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে ।
।।৪।।
বাড়িতে দুটো খবর বজ্রাঘাতের মতো পড়ল । এক, রাজা আর আয়েশার খবরটা । দুই, রাজার মামা মামীর সেপারেশন আর ডিভোর্সের আর্জি নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়াটা ।
***************
ঘরজুড়ে নিস্তব্ধতা, মামা মামীর খবরটা যে সত্যি এটাই প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না রাজা । মতভেদ, অশান্তি সবদিনই ছিল, কিন্তু….
****************
(কিছুদিন পর)
শেষ কিছুদিন ধরেই বাড়িটার পরিবেশটাই বদলে গেছে, মা-এর কাছে গিয়ে একটু বসল বারান্দাটায় রাজা । কোন শব্দ বিনিময় ছিল না দুজনের মধ্যে । নিস্তব্ধতা ভেঙে মিনতি দেবীই বললেন, “কোনদিন ভাবিনি আর পাঁচটা বাড়ির মতো আমাদের বাড়িতেও ডিভোর্স, ছাড়া ছাড়ি এইসব হবে, স্বপ্নেও ভাবিনি, আর আজ দ্যাখো…ছি ছি… ।”
মাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রাজা বলল, “মা, মামার বিয়ের সময়কার কথা মনে পড়ে?”
-“হ্যাঁহ, তোর ফাইনাল পরীক্ষা সবে শেষ হলো, যেতেই পারছি না, পরের পরদিনই বিয়ে, তাড়াহুড়ো করে ছুটলাম । খুব মজা পেয়েছিলাম, একসাথে বরযাত্রী যাওয়া, সে কিছুতেই যাবে না রাঙপিসি, অতদূর, কালনা, তখন তো প্রায় গ্রামই । জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মজা হয়েছিল বটে ।”
-“মা মামার কথাটা একবারও ভেবেছিলে?”
মিনতিদেবী ফিরে তাকালেন একবার, রাজা আবার বলল, “মা মামা কিন্তু বিয়েটা তখনই করতে চায়নি, মামা যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, কাস্ট এক ছিল না বলে তার সাথে কিছুতেই তোমরা বিয়েটা দিলে না, জোর করে রাজযোটক পাত্রীর সাথে বিয়ে দিলে, কী লাভ হলো? তখন তো অত বুঝতাম না, এখন বুঝেছি ।”
-“তুই কী আজেবাজে বকছিস, আজ যা কিছু হচ্ছে, তার জন্য আমরা দায়ী? নাকী তুই তোর জন্য এটাকে একটা ঘটনা বানাচ্ছিস?”
-“মা আমি কিছুই অপ্রাসঙ্গিক বলতে চাইছি না, তোমরা যে এই জাত, ধর্ম, গোত্র, ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ করো, কী লাভ হয় বলবে একটু? মামা কী হলো সুখী? আর ছোট কাকা কাকীমাকে বিয়ে করতে চেয়ে যখন এতবার অনুরোধ করেছিল, শুধুমাত্র কাকীমা অব্রাহ্মণ বলে কাকাকে এবাড়ির সবাই বাড়ি থেকেই বের করে দিলে । তখন আমি ক্লাস ১১, সবটাই দেখেছিলাম, তুমি তখন খুব গর্ব করে বলেছিলে আমার ভাই কিন্তু শেষ অবধি মুখটা পড়েনি, আর ঠাকুরপো তো…। যদি মামা তখন সাহস করে মুখটা পোড়াতো হয়তো আজ মামাও ছোট কাকার মতো খুশি হতো, ভাল থাকতো ।”
কোন কথা ছিল না মিনতিদেবীর মুখে, শুধু শুনছিলেন ।
রাজা আবার বললো, “কেউ কাউকে ভালবেসে ভাল থাকতে চাইলে কেন এটা সহজে মানতে পারে না এই সমাজ বলো তো? জাত কী, ছেলের স্যালারী কত, মেয়ের বাড়ি কেমন, ছেলে মেয়ের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব ঘেঁটে ফেলো তোমরা, কেন? এখন তো তারা একসাথে ভাল আছে, ব্রাহ্মণ-এর স্টিকার লাগানো থাকলে এক্সট্রা কী পাবে যেটা অব্রাহ্মণ হলে নেই? বিয়েটা কী ব্যবসা কোনো? সওদা হচ্ছে কোন? না তো, তাহলে এত কিসের বলতো? এত কী? বেসিকালি ছেলেটা আর মেয়েটা ‘ভালমানুষ’ এটাই তো চাহিদা হওয়া উচিত, কই সেটা তো কেউ বলে না । আয়েশা ফার্নান্ডেজ আমায় যতটা ভালবাসে, আর আমি যতটা খুশি থাকব তার সাথে, সেটা তোমার পছন্দ করা কোন চ্যাটার্জী মুখার্জী বাড়ির ঘরোয়া মেয়ের সাথে পারব না মা । মনের যোগটা দরকার, আর সেটা ছাড়া … ইম্পসিবল… মা.. মা তুমি নিজেও কী সুখী?”, থামল রাজা । অনেকগুলো কথা মনে জমা হয়েছিল, পাথরের মতো, আজ বলতে পেরে হালকা লাগছে ।
মিনতিদেবী মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন ।
-“মা পরশু বড়দিন, আমি সেদিন আয়শাকে ওর বড়দিনের সব থেকে সুন্দর উপহারটা দিতে চাই, তুমি আর বাবা যদি আমার পাশে থাকো…” আর কিছু বলল না রাজা, উঠে পড়ল, সূর্য ঢলছে পশ্চিমাকাশে, পাখিগুলো দল বেঁধে বাসায় ফিরছে । মুখ ঘোরাতেই দেখল কখন পিছনে দাঁড়িয়ে আছে বাবা । কিছু না বলে ঘরে ঢুকে গেল রাজীব ।
****************
বড়দিনের দিন রাজীব-এর পাশে ওর মা বাবা থাকবেন কী না জানা নেই, তবে আপনারা চিন্তাধারা দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবেন কী না, সেটা আপনাদের হাতেই । শুভ বড়দিন ।