।।১।।
আজ এই প্রথম তাতান ওর মা-কে ছেড়ে একা থাকবে । বোর্ডিং-এ আসতে চায়নি ও, মা-কে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলেই । মা কিছুতেই কথা শুনলো না, সেই ওকে পাঠিয়ে দিল । কি হতো মা-এর সঙ্গে থাকলে? ও কী মা-কে এতই জ্বালাতো? মা তো ভয় দেখাতো, সত্যি কোনদিন পাঠিয়ে দেবে ও কল্পনাও করতে পারেনি । কেন এমন করলে মা? ছোট্ট তাতান মুখটা চেপে ককিয়ে কেঁদে উঠল, রাত তখন প্রায় ১২টা ।
****************
পাহাড়ের কোলে এই বোর্ডিং স্কুলটার পরিবেশ খুবই ভাল । লেখাপড়াই বলো বা খেলাধুলো, সবদিক থেকেই বেশ নামকরা এই আর.জি বয়েজ স্কুল । এইখানে তাতান এসেছে মাত্র তিনদিন হয়েছে, কিন্তু এই তিনদিনেই তাতানের দুজন বন্ধুও হয়ে গেছে । তাই গুমোট ভাবটা একটু হলেও কেটেছে ওর । ঠান্ডার দেশে হরেক রকম ফুলগাছের ভিড়ে দাঁড়িয়ে দাদাদের খেলা দেখছিল আর টিফিন খাচ্ছিল ওরা তিনজন, ও, গোপাল আর পাপাই ।
গোপালের বাবা সরকারি চাকুরে, মা শিক্ষিকা । পাপাই-এর বাবা একজন আর্টিস্ট, আর্ট গ্যালারীতে ওনার ছবির এক্জিবিশন হয়, পাপাই-এর মা হোম মেকার ।
“তোর মা বাবা কী করে?”
সেই অনিবার্য প্রশ্নটা আবারও তাতান-এর সামনে এসেই গেল । কী বলবে ও? ও তো কখনো বাবাকে দেখেনি, হ্যাঁ, মা বাবার বিয়ের ছবিতে বাবাকে দেখেছে । বাবাকে সামনে সামনি কখনো দেখেনি । মা বলে, বাবা আসবে, কিন্তু কবে আসবে ও জানে না । মা-কে বিশ্বাস করে ও-ও বিশ্বাস রাখে বাবা আসবে একদিন, ঠিক আসবে ।
**************
(বেশ কিছুদিন পর)
আর কিছুদিন পরই ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হবে । সবার মা বাবাই আসছে, বাড়ি ফিরছে সকলে ছুটিতে । তাতান চেয়েছিল ফিরতে, মা নিতে আসেনি ওকে । ও একাই হোস্টেলে রয়ে গেল । ওর বন্ধুরাও বাড়ি যাচ্ছে, বলেছিল ওকে যেতে, ও আর যায়নি ।
নিজেকে বড্ড একা লাগে মাঝে মাঝে তাতানের । সবার বাবা মা তাদের কত ভালবাসে, তাতানের তো কেউ নেই । সকলের দাদু ঠাকুমা, মাসি, পিসি কত ভালবাসার মানুষ, ওর কেউ কেন নেই? কেন? মাকে কতবার প্রশ্ন করেও কোন সদুত্তর পায়নি কখনো । মা-এরই বা কী এত কাজ, তাতানের থেকেও কাজ এত বড়? ছোট্ট তাতানের চোখগুলো জলে টইটম্বুর । একলা অন্ধকার ঘরে ছোট্ট তাতান, আঁধার আর মন খারাপকে সঙ্গে নিয়ে ।
**************
মা-এর সাথে আজ কথা কাটাকাটি হয়েই গেল, তাতান গেলে নাকী মা-এর ক্ষতি হবে কাজ-এর মা নাকী এখন খুব ব্যস্ত । মা কী তাতানকে একটুও মিস করে না? আগে তো আরো অনেকের সাথে ওরা থাকত, জবা মাসি, রোজী মাসি, এখন মা-তো আলাদাই থাকে । ওদের সাথে আর থাকে না, মা কী ওদেরও মিস করে না?
আস্তে আস্তে মা ছেলের মধ্যে ব্যবধানটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই যাচ্ছিল ।
।।২।।
(কয়েক বছর পর)
তাতানের সাথে ওর মা-এর এখন আর দেখা হয় না বললেই চলে । তাতান-এরও টানটা অনেক কমে গেছে, এখন ওর একা থাকতেই ভাল লাগে, একাকীত্বই ওর সাথে থাকে, ভুলে যায় না ওকে ।
তাতান-এর মা এখনও অবধি জানাননি ওনার কাজের ব্যাপারে, তবে তাতান তো বড় হচ্ছে, ও কী কিছু আঁচ করতে পারে? এটাই সবসময় আশঙ্কা করেন মীনাক্ষী । উনি ছেলের সামনে সবসময়ই একটা পর্দা রেখেছেন আর সবদিন যেন সেই পর্দাটা বর্তমান থাকে, সেটাই চান উনি । যতই হোক, সবকিছুর উর্ধ্বে একজন নারী, সর্বোপরি একজন মা, তাই, তাতান আর ওর মা-এর মধ্যে পর্দাটা রয়েই গেছে ।
**************
(আরো বেশ কয়েক বছর পর)
আজ বন্ধুদের সাথে বিশাল ঝগড়া হলো তাতানের । তাতান এখন কলেজে পড়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্যাম্পাসিং শুরু হবে আর কিছুদিন পর । আজ ওর মা-এর সম্পর্কে বাইরে একটা ছেলের কাছে এরকম কিছু শুনবে ও কল্পনাও করেনি, হাতাহাতি হয়েছে কিছুটা, ঠোঁটের কাছটা কেটেও গেছে, আয়নায় সেটাই দেখছিল ও । হঠাৎই ওর মনে একটা খটকা লাগল, আচ্ছা, ও কী আদৌ জানে ওর মা এই মুহূর্তে কোন পেশার সাথে যুক্ত? যতবারই জিজ্ঞেস করেছে শুধু শুনেছে ও তুই অতো বুঝবি না, বা এখন একটা ব্যবসা দাঁড়করানোর চিন্তা ভাবনা করছি ইত্যাদি ইত্যাদি । ও তো সত্যিই ঠিক মতো জানে না, তাই তো । কথাটা মাথায় আসতেই যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল তাতানের সারা গায়ে ।
(কয়েকদিন পর)
-“চলুন”
ক্যাবে চেপে ড্রাইভারকে বলল তাতান । কাউকে কিছু না জানিয়েই কলকাতা এসেছে ও, ওকে সত্যিটা জানতেই হবে, যে করেই হোক, নয়তো ওর মনে শান্তি নেই । রাস্তা পেরিয়ে ছুটে চলল গাড়ি । অশান্ত মনে বাইরের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়েছিল তাতান ।
।।৩।।
নিঃস্তব্ধ ঘর, মা ছেলে আজ মুখোমুখি । রান্নাঘরের কলটা চুঁইয়ে জল পড়ছে টুপ্ টুপ্ টুপ্, আর শুধু নিঃস্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ।
-“বাবু আমার কথাটা শোন … “
-“একদম চুপ, একটা কথাও বলবে না তুমি, লজ্জা করে না তোমার, ছিঃ ছিঃ ছিঃ ।”
বলে চলল তাতান, “একবারও তোমার মনে হলো না আমি কীভাবে সমাজের কাছে মুখ দেখাব? কি বলব আমার মা কী করে? এত তোমার টাকার খাই?, বাড়ি বাড়ি কাজ করাটাও তো অনেক সম্মানের, অন্তত…. একজন যৌনকর্মীর থেকে তো ….।
কথাটা আর শেষ করতে পারল না তাতান । মুখ চাপা দিয়ে খাটের উপর বসে পড়ল ও, সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি কিছু থাকলে তেমন এক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মীনাক্ষীদেবী, যার অশ্রু সজল চোখের দিকে তাকানো তো দূর, তাকে মা বলে ডাকতেও ঘেন্না পাচ্ছে তাতানের ।
…….হাওয়ায় ফুলদানিটা পড়ল মাটিতে, চোখ খুলল তাতান । কোন অতীতে হারিয়ে গেছল যে সময়ের খেয়ালই করেনি, ফিরে তাকাতেই ঘড়িতে দেখল কখন ঘড়ির কাঁটা বিকেল পার করে রাত-এর কাছে যাচ্ছে, বিকেল প্রায় ৫টা । নিস্তব্ধ ঘর, শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ মিটেছে বেলা ২টো নাগাদ প্রায় । এতটা সময় কীভাবে যে কেটে গেল, চোখটা ভাল ভাবে রগড়ে আবার হাতের ডায়েরিটা তুলে নিল তাতান । মায়ের ডায়েরি এটা । বহুবছর আগে ভালবেসে, মন থেকে মা বলে ডাকত, কখনো । তারপর কতদিন মা-কে দেখেনি, ভালভাবে মা-র সাথে কথা অবধি বলেনি তাতান, তার হিসেবে নেই । মা-কে যে আর দেখতেই পাবে না, এটা ভাবতে পারেনি, যতক্ষনে এলো, সব শেষ…
মা-এর ছবিটার দিকে তাকিয়ে হাতে ধরা ডায়েরিটার পাতাটা উল্টোল ও, ছবি, কিছু বিয়ের, কিছু এমনি । কিন্তু এই লোকটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে, মা-এর বিয়ের ছবি কোনদিন দেখতে পায়নি, এটাই তাহলে মা-এর বিয়ের ছবি, কিন্তু এই লোকটা, মানে হিসেবে মতো ওর বাবা তো এই-ই…. oh my god, এটা তো মিঃ প্রদীপ সান্যাল, ওর আগের কোম্পানিতে ওর ইমিডিয়েট বস ছিল, এনার সাথে তো খুব ভাল সম্পর্ক তাতানের…. সব গুলিয়ে যাচ্ছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না, পাতা ওল্টালো আবার ।
সারাজীবন পাশে থাকার আশ্বাস দেয় যে মানুষটা, সে যখন পিঠে ছুরি মারে, তখন কোথায় দাঁড়াব? বাবুকে কী করে সত্যিটা বলব? কোনদিন পারব না, ওর সামনে ওর বাবার ঐ রূপটা আনতে । যে প্রমোশনের লোভে, নিজের স্ত্রীকে অন্যের কাছে জোর করে পাঠাতেও কুন্ঠা বোধ করে না, যার কাছে নারী মাত্রেই শুধু শরীর সর্বস্ব লালসা, ভোগ আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না, তার আসল রূপ কী ভাবে নিজে মুখে নিজের সন্তানকে বলব? কেরিয়ারে উপরে ওঠার তাগিদে যখন স্বেচ্ছায় আমার ঘরে অন্য পুরুষকে আনতে পেরেছিল, ধর্ষিত হয়েছিলাম যেদিন, বিক্রি হয়েছিলাম সেদিনই, সেদিন থেকেই বেশ্যা । কে করেছিল আমায় বেশ্যা? নিজেরই স্বামী? ক’জন স্ত্রীর ভাগ্যে থাকে এমন স্বামী ।
আচ্ছা, বেশ্যা না হয় পতিতা, নোংরা, মানুষের পর্যায়েই ফেলা যায় না তাকে, আর যে সমস্ত পুরুষ নিজের লালসা মেটাতে ঐ ‘নোংরা’ শরীরেই ঝাঁপ দে, ঐ বেশ্যার দেহেই নিজের আরাম খোঁজে, তাদেরকে ঠিক কী নাম দেয়া যায়? নিজের স্বামীকে কী ‘স্বামী’ বলা যায়?
**************
তাতান, আমার নিজের সন্তান, সেও আমায় চিনতে পারলো না, বুঝল না, যৌনকর্মী মানেই মহিলাটাই নোংরা, অপর পক্ষের পুরুষটাকে ধোয়া তুলসী পাতার তকমা কেন দেওয়া হবে? বাবু, তুইও এরকমই ভাবিস, পারলাম না তোকে মানুষ করতে, তোকে কীভাবে বড় মানুষ করব, অনেক লেখাপড়া শেখাব, মানুষের মত মানুষ তৈরী করব, সেই চিন্তাতেই প্রতিটা দিন নিজেকে বিকিয়েছি ।
**************
তাতান আর আমায় কোনদিন মা বলে ডাকবে না হয়তো, এভাবেই একদিন আমার শ্বাস চলাটাও বন্ধ হয়ে যাবে, শান্তি, মুক্তি পাব একদিন এই যন্ত্রণার জীবন থেকে ।
।।৪।।
আর পড়তে পারছিল না তাতান, ডায়েরিটা বন্ধ করল ও, হাতে ছবিগুলো । ওর মনে আছে, সত্যিটা জানার পর, ও মহিলা জাতটাকেই ঘৃণা করতে শুরু করেছিল, সঙ্গে নিজের মা-কেও, আর তাতে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিল ওর সেই বস, যে কীনা ওর বাবা, আর ও সেটা এতদিন জানতও না । সত্যিই তো, মেয়েদেরকে ভোগ্য পণ্যই তো ভাবত মিঃ সান্যাল, আর সেই ধারণাগুলো ধীরে ধীরে তাতানের মধ্যেও ছড়িয়ে দিয়েছিল, যার নিজের মা-ই এই, সে আর অন্য কোন মহিলাকে সম্মান কীভাবে করবে । কিন্তু, না, আজ নিজের চোখের দিকে নিজে তাকাতেও পারবে না ও, মা-এর ছবির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর যোগ্যতা টুকুও হারিয়েছে । আজ মা, যে ওর একান্ত আপন, তাকেও হারাল ।
***************
মিঃ প্রদীপ সান্যাল, আজ প্যারালাইজড, নিজের পাপের শাস্তি তো মানুষকে এই জন্মেই ভোগ করতে হয় ।
বেশ্যা শুধু মেয়েটাই? আর অপরপক্ষের পুরুষটা? প্রেম, ভালবাসাহীন, অর্থ আর শরীর সর্বস্ব সমাজে দোষী কী শুধু মেয়ে পক্ষই? উত্তর আপনারা দেবেন ।