।।১।।
ট্রাঙ্ক থেকে ন্যাপথালিন দেওয়া গুটি কয়েক তোলা শাড়ি থেকে একটা শাড়ি বের করছিল মায়া । ছোট্ট দু’কামরার ঘরে এককোণে খাট, ছোট্ট আলনা, ট্রাঙ্ক, কুঁজো, তেলচিটে রান্নাঘরের নুন, তেলের কৌটোর সাথে হাতে গোনা বাসন, অনেকটা অভাব আর তার থেকেও বেশী ভালবাসা নিয়ে চলে মায়ার জীবন।
মায়া আর অমল-এর ছোট্ট পাপাইকে নিয়ে এই সংসার।
মাকে শাড়ী বের করতে দেখেই ছোট্ট পাপাই দৌড়ে এল। মা এই ট্রাঙ্কটা থেকে শাড়ী বের করা মানেই ভাল কোথাও যাওয়া হবে এটা পাপাই বোঝে।
আজ পাপাই-এর জন্মদিন। তাই কী মা শাড়ী বের করছে? ছোট্ট পাপাই-ও সাজবে? বেড়াতে যাবে ওরা? ওর জন্মদিনে আগের বারও বাবা মা মিলে ময়দান গেছিল, মা রান্না করে নিয়ে গেছল। ওরা একসাথে পাপাই-এর জন্মদিনেই তাও বেরোয়, নয়তো বেরলেই তো খরচা।
-“মা, আমরা কোথায় যাবো?”
ছোট্ট পাপাই-এর প্রশ্নে চোখের কোণের জলবিন্দুটাকে আটকে দিল মায়া, “না সোনা, কোথাও যাওয়া হবে না আজ, আজ মাকে নতুন বাড়িতে কাজে যেতেই হবে সোনা, কিন্তু পাপাইবাবুর জন্য ভাল খাবার নিয়ে আসবে মা, কেমন?” বলেই ছোট্ট পাপাইকে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে চুমু দিয়ে আদর করে দিল মায়া।
পাপাই-এর ঝলমলে মুখটা মুহূর্তে মলিন হয়ে গেল। চোখ এড়াল না মায়ার। কী করবে ও? নতুন যে বাড়িটায় কাজ ধরেছে সে বাড়িতে কিছুতেই ছুটি পেল না। সেই বাড়ির ছেলেরও আজ জন্মদিন। তাই কিছুতেই ছুটি পাওয়া গেল না। বড়লোকের বড় ব্যাপার, অনেক লোকজন আসবে। কিন্তু ওকেই সব তদারকি, রান্নাবান্না করতে হবে। তাই হাজার কষ্ট হলেও ছোট্ট পাপাইটাকে একটু ভাল মন্দ খাবার, একটু ভাল জীবন যদি দিতে পারে, ওকে কাজে বেরতেই হবে।
অমল যে কারখানায় কাজ করে সেখানে প্রায়ই ওভারটাইম করতে হয়। ওভারটাইমের কিছু বেশী টাকা পায় , কিন্তু কিছুদিন আগেই যা অসুস্থ হয়েছিল অমল, অনেক কামাই হয়েছে, তারপরও ওর চাকরিটা আছে এই রক্ষে। তাই অমলকেও কাজে বেরতেই হলো।
**************
আজকের দিনটা তাই আর পাপাই-এর জন্য আলাদা কিছু না, রোজকার মতোই। আজ শনিবার, তাই স্কুলটাও নেই, বাড়িতেই মন খারাপ করে বসে রইল ছোট্ট পাপাই।
মা জন্মদিন উপলক্ষে পায়েস করে রেখে গেছে পাপাই-এর জন্য, আর সামান্য ভাত, শাক, ডাল আর আলুভাজা। আগেরবার চৌধুরীদের বাড়ি থেকে ওদের ছেলের ছোট হয়ে যাওয়া দামী জামাটা মায়াকে দিয়ে দিয়েছিল। এটাই এখন পাপাই-এর সবথেকে ভাল জামা। ভেবেছিল আজ পরবে, কিন্তু পাপাই তো আজও একা। সস্তার সেলাই করে তাপ্পি দেওয়া জামা আর হাফপ্যান্টে আজও পাপাই একা একাই নিজের মতো খেলছে।
।।২।।
সারা বাড়িটা বেলুন দিয়ে সাজানো হচ্ছে। মায়াও কাজের তদারকিতে ব্যস্ত। পাশের ঘরের বেডসীটটা পাল্টাতে যেতে পা বাড়াতেই কানে এল ফোনের রিং-এর আওয়াজ। দাদাবাবুর ফোন বাজছিল। ফোনটা ধরে কানে লাগালো না, ফোনটা দিয়ে কত জোরে রেডিওর মতো আওয়াজ বেরচ্ছিল, আর দাদাবাবু কথা বলতে বলতে রেডি হচ্ছিল।
-“কী হলো? তোমার আর ফিরতে কত দেরী হবে? আমায়ও তো একবার বেরতে হবে?”
-“কী করবো বলো? মিটিংটা শুরু হতেই এত দেরী হলো, তুমি সেরকম হলে বেরিয়ে যাও ।”
-“বেরিয়ে যাবো? আজকের দিনেও ছেলেটাকে একা ফেলে চলে যাব? তুমি তো ওকে একটুও সময় দাও না, ওর-ও তো মাকে প্রয়োজন।”
-“মাকে প্রয়োজন বললে তো হবে না, আমি তো কাজ-কর্ম ফেলে বাচ্চা মানুষ করতে বসবো না, তাই ওসব ভুলভাল কথা বোলো না। যাক গে, আমার ফিরতে দেরী হবে আর একটু, সেটা বলতেই ফোন করলাম। পার্টির আগে ঠিক চলে আসব, আর ছেলের জন্য ভেবো না, দামী কোন গিফ্ট বা খেলনা দিয়ে দিলেই ওর রাগ কমে যাবে।”
-“আর কোন দামী খেলনা দিতে বাকী রেখেছ তুমি? এভাবে আর কত।।।”
বলতে বলতেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হলো, রাগে ফোনটা খাটেই ছুঁড়ে ফেলল রাজীব। রুকাই-এর বাবা।
দরজার পাশ থেকে সরে এল মায়া। কী অদ্ভুত, মায়া ছেলের কাছে থাকতে না পেরে কত দুঃখ পাচ্ছে, আর একজন।।। যাক গে, বেশী না ভেবে মায়া নিজের কাজে মন দিল।
**************
“আমি বললাম তো খাবো না, যাও এখান থেকে” বলেই পাস্তার বাটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রুকাই। রুকাই-এর ব্যবহার দেখলে কেউ বলবে না ও এত ছোট। কথাবার্তা, চালচলন, বাচন ভঙ্গি, আচরণ সবই বড়দের মতো, যার ঘরে দামী খেলনা, আসবাব, পোশাক-এর অন্ত নেই। কিন্তু মায়া ওর লেখাপড়া না জানা মস্তিষ্কে এইটুকু বুঝতে পারে, সব থেকেও এদের ঘরে সূর্য ওঠে না, হাওয়া খেলে না। LED বাল্বের চাকচিক্যে, দামী আসবাবে সাজানো ফ্ল্যাট আপাত দৃষ্টিতে চোখ ঝলসানো হলেও এখানে খুশী নেই। অপরিসীম সুখ আছে, আরাম আছে, আয়েশ আছে, কিন্তু আনন্দ নেই। এখানে টাকা ওড়ে কিন্তু বাতাস নয়। মুঠোফোনের ভিতর Talking Tom হাসে, কিন্তু রুকাই নয়। শৈশব চাপা পরে গেছে অহংকারের পায়ের তলায়। জন্মদিনে সাজানো চোখ ধাঁধানো ফ্ল্যাট, থরে থরে সাজানো হরেক রকম খাবার, তাও যার জন্মদিন তার মুখে হাসি নেই। সবাই এখানে ছুটছে, আরও আরও বড় হওয়ার আশায়, আরও উঁচুতে ওঠার আশায়।
।।৩।।
“আর একটু ওয়েট করো সোনা, মা ঠিক চলে আসবে।” রুকাই-এর ঠাম্মি রুকাই-এর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল।
-“নো ঠাম্মি, আমার বন্ধুরা চলে এসেছে, আমি কারো জন্য ওয়েট করতে পারবো না, আমি যখন কেক কাটার তখনই কাটব।”
পুরো ফ্ল্যাট তখন লাল, নীল বাহারি আলোয় ঝলমল করছে। একে একে লোকজন আসতে শুরু করে দিয়েছে। রুকাই-এর জন্মদিন উপলক্ষে জামাটার দামই নাকি হাজার পাঁচেক, শুনে মায়ার ভিরমি খাবার জোগাড়।
সবাই রুকাই-এর জন্য গিফ্ট নিয়ে আসছে, রিটার্ন গিফ্ট হিসাবে রুকাইও তাদের গিফ্ট দিচ্ছে। আর একদিকে লোকজন স্ন্যাক্স খেতে ব্যস্ত।
আর মায়ার মনটা শুধু ছটপট করছে, কখন পাপাইটার কাছে যেতে পাবে। বেচারা আজও একা।
অবশেষে, রুকাই ওর মাকে ছাড়াই হাসিমুখে তিনতলা কেক কাটল, বেলুনও ফাটল। কতরকমের নামী দামী চকলেট ছড়াল ইতিউতি। খাওয়াদাওয়া শুরু হলো। চিংড়ির মালাইকারী থেকে ভেটকি পাতুরী, মটন রেজালা থেকে শাহী পোলাও, কী নেই তাতে?
আহা, এগুলো যদি কখনো পাপাইকে খাওয়াতে পারতো, কী ভালোই না হতো। ভাবতে ভাবতে কখন রাজীব আর ওর মা মায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে খেয়ালই করেনি ও।
আজকের বাড়তি খাটার জন্য, বলা ভাল আজকের দিনে নিজের সন্তানকে দূরে রেখে কাজ করতে আসার জন্য পারিশ্রমিক বাবদ বেশ কিছু টাকা আর একটা বড় খাবারের প্যাকেট দিল।
মায়ার মনটা খুঁতখুঁত করছিল, সবাই যেখানে উপহার দিচ্ছে, ওরও কিছু দেওয়া উচিত, কিন্তু কোন মুখেই বা দেবে? ওর সামর্থ্যই বা কতটুকু? হেসে উড়িয়ে দেবে এরা, তাই ভাবনার ঘরে চাবি লাগিয়ে যতটা দ্রুত এগোনো যায় পায়ে হেঁটে ততটাই দ্রুত দৌড়ল মায়া, পাপাই-এর কাছে।
।।৪।।
ঘরে ঢুকে পাপাই বলে ডাকতেই ছোট্ট পাপাই কোথা থেকে ছুটে মায়াকে এসে জড়িয়ে ধরেছে। মায়া চকলা ওঠা দেওয়ালে লাগানো ছোট্ট ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল মোটামুটি তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে। এবার পাপাইটার বাবা এসে পড়লেই হলো। কিন্তু এ কী করেছে পাপাই? সারাদিন ধরে একলা থেকে ছোট্ট ছোট্ট হাতে সারা ঘরটা কত সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে, যাতে মাকে এসে আর খাটতে না হয়। নিজে নিজে আলুও ভেজেছে। এত বুঝদার কবে হলো ওর ছেলে? দারিদ্রই কী সময়ের আগে পাপাইকে বড় করে দিচ্ছে? আর্দ্র চোখে ছেলেকে চুম্বনে ভরিয়ে দিল মায়া। পাপাই-এর জন্য নিজেদের সাধ্য মতো একটা কেকও কিনে এনেছে। ওর বাবা এলে কাটবে।
ছোট্ট কেকের পাশে দুটি মোমবাতি সাজিয়ে মা, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যখন কেক কাটা শুরু করলো তখন রাত প্রায় ৯:৩০টা।
ঘরে দারিদ্রতার ছাপ থাকলেও মায়া, পাপাই আর অমল-এর মুখের ঝলমলে হাসি চোখ অবধি পৌঁছছে। অমলের আনা ছেলের পছন্দের মিষ্টি, মায়ার আনা সাধারণ কেক সবাই মিলে মহানন্দে খেতে খেতে গল্প যখন শেষ হলো তখন রাত প্রায় ১১টা।
ছেলের জন্য ঐ বাড়ি থেকে আনা খাবারের প্যাকেট থেকে ভেটকি পাতুরীটা তুলে দিতে পেরে কী শান্তি যে পেল মায়া তা অবর্ণনীয়।
নাহ, খাওয়া পরার বাড়বাড়ন্ত নেই, অতিথি সমাগম নেই, ঘরে দামী ফ্রিজ, টিভিও নেই। স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল আছে, সস্তার খাট, ট্রাঙ্ক আছে, মাটিতে পা মুড়ে বসে খাবার রেওয়াজ আছে, দামী ডিনার সেট-এর বদলে স্টিলের থালা বাসন আছে। মাসের শেষে বিদ্রোহ করা ফাঁকা তেল, নুনের কৌটো আছে, হাজারো পাওয়া না পাওয়ার মাঝেও এই ছোট্ট ঘরে খুশী আছে, আনন্দ আছে, শান্তি আছে, যা ঐ বিলাসবহুল আবাসনের হিমশীতল ঘর আর নরম গদিতেও নেই।
এক অঙ্কে, সারাদিন মা বাবাকে না পেয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারে পাপাই, পাপাই-এর কাছে থাকতে না পেরে কষ্ট পায় মায়া। অন্য অঙ্কে, মা রুকাই-এর জন্যও কষ্ট পায় না, রুকাই-এর আনন্দও মা-র জন্য থেমে থাকে না।সারাদিনের শেষে সস্তার বিছানা বালিশে মাথা রেখে এই মানুষগুলো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে এইটুকু অন্তত বলতে পারে, “এই বেশ ভাল আছি।”