||১||
“বাবু, ব্রেকফাস্টটা করে নাও, মামমা-র কিন্তু এত টাইম নেই, তোমার পাশে বসে থাকার মত | মামমাকে বাবার টিফিনটাও গোছাতে হবে, বেরতে হবে, তাড়াতাড়ি শেষ করো, নয়তো নিজে একা বেরবে |”-বলেই দ্রুত হাতে নিজের কাজ সারতে লাগলেন মিসেস রোহিনী চ্যাটার্জী, অর্ণবের মা |
অর্ণব ক্লাস ইলেভেনে পড়ে | দ্রুত খাওয়া সারতে লাগল মায়ের ধমকানিতে, পাছে ওকে একা বেরতে হয়, মা বাবা বেরিয়ে যায় | একা থাকতে খুব কষ্ট হয় অর্ণবের | মা তাও সারাদিন কথা বলে, বাবার তো কথা বলার, ওর দিকে তাকাবারও সময় নেই | কতদিন যে বাবার সাথে কোথাও একসাথে বেড়াতে যেতে পারেনি অর্ণবরা, কে জানে |
অর্ণবের বাবা মিঃ অভিমন্যু চ্যাটার্জী ছেলেকে “বাই বেটা ” বলে তড়িঘড়ি অফিস বেরিয়ে গেলেন | গোগ্রাসে থালার খাবার টুকু শেষ করে উঠে পড়ল অর্ণব, মায়ের রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হতে লাগল | অবশেষে বেরিয়ে পড়ল মা ছেলে, দু’জন দু’জনের গন্তব্যে |
||২||
অর্ণবদের আদি বাড়িটা হলো উত্তর কলকাতায়, বাগবাজারে, সেখানে দাদু ঠাকুমা, কাকা, কাকী, ভাই সবাই থাকে | অর্ণবরা যখন এই বাইপাসের কাছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে উঠে আসে তখন অর্ণব ক্লাস সিক্সে | বাবা মা, দাদু ঠাকুমাকেও এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিল, ওনারাই নিজেদের বাড়ি ছেড়ে আসতে রাজি হননি | এখান থেকে মা বাবার অফিস, অর্ণবের স্কুল কাছে হয় | তারপর থেকেই অর্ণবের বকবক শোনার মত আর কেউ নেই | তাই জন্যই তারপর থেকে একাকিত্ব-কে এত ভয় অর্ণবের, যেন দম বন্ধ হয়ে আসে | স্কুলে বন্ধুরা, টিউশনের বন্ধুরা, তারপর একটু খেলতে যাওয়া, এই সবকিছু নিয়েই ব্যস্ত রাখে নিজেকে ও যথাসম্ভব | আঁকাটা ওর আরেকটা সঙ্গী | ছোট থেকেই লেখাপড়ায় খুব জিনিয়াস ও, তাই পড়াশোনাতেই দিনের বেশির ভাগ সময়টা দিয়ে দেয়, তারপর কথাবার্তা বলতে ডাইনিং টেবিলে টুকটাক মা বাবার সাথে কথাবার্তা, ব্যস এইটুকুই | রাত্রে ঘুম, পরদিন সকাল থেকে আবার নতুন করে বাঁচার লড়াই শুরু |
||৩||
অর্ণবদের সামনের ফ্ল্যাটে আজ নতুন একটা ফ্যামিলি এসেছে, রোহিনী রাত্রে খেয়াল করল ফিরে | খুব স্বাভাবিক ভাবেই সামনের ফ্ল্যাটের নতুন পরিবারের যিনি গৃহিনী ছুটির দিন আলাপ করতে এলেন | গল্প জমে উঠল, ভারী মিশুকে মহিলা, কথায় কথায় বেলা বাড়তে লাগল | অর্ণব একটু বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছিল আজ | বাড়ি ফিরে ওনাকে দেখে আলাপ করল ও-ও | ওনাদের সদস্য সংখ্যা চার, ছেলে মেয়ে স্বামী স্ত্রী | ছেলে চাকরী সূত্রে আপাতত বাইরে, মেয়ে কলেজে পড়ে, স্বামীও চাকরী করছেন | বেশ খানিক আড্ডার পর উনি উঠলেন |
*************
ছুটির দিন, আজ দুপুরটা সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া | ডাইনিং টেবিলে রোহিনী-ই প্রথম শুরু করল, “সামনের ফ্ল্যাটের নতুন ফ্যামিলিরা ব্যানার্জী, ওনাদের মেয়ে কলেজে পড়ছে কেমিস্ট্রি নিয়ে | অর্ণবের বরাবরই কেমিস্ট্রি নিয়ে সমস্যা, তো এখন যখন আলাপ হয়েই গেছে, অর্ণব তো সাবজেক্টটা একটু দরকার মত শিখে নিতেই পারে |”
অর্ণবও খেতে খেতে মাথা নাড়ল |…..
*************
(বেশ কিছুদিন পর)
সামনের ফ্ল্যাটের ব্যানার্জী কাকুদের সাথে অর্ণবদের ভালোই সম্পর্ক এখন, সমস্ত উৎসব, পার্বণ, সবেতেই ডাক পড়ে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি | তিন্নিদি মানে প্রিয়াঙ্কার সাথে অর্ণবের বেশ ভাল একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে | তিন্নিদি অর্ণবের ফ্রেন্ড, ফিলোজফার, গাইড বলা চলে | অর্ণবকে সাধ্যমত ওর লেখাপড়ায় সাহায্য তো করেই, সমস্ত রকম বিষয়ে গল্প হয় | অর্ণবের তাই তিন্নিদির সাথে গল্প করতে তাই খুব ভাল লাগে, কেউ তো ওর কথা শোনার মতোই নেই, তিন্নিদির অন্তত ওর সাথে গল্প করার টাইম আছে |
*************
অর্ণব আজ স্কুলে যায়নি, স্কুল ছুটি আজ | কিন্তু মা বাবার অফিস ছুটি নেই | তাই বেচারা একাই রয়েছে বাড়িতে | মালতী মাসি খেতে দিয়ে চলে গেল, খেয়ে দেয়ে পড়তে বসেছিল অর্ণব | হঠাৎ অর্ণবের মনে পড়লো, আচ্ছা তিন্নিদির কাল জন্মদিন না? ইসস, অর্ণবের তো খেয়ালই ছিল না, ভাগ্যিস মনে পড়ে গেল আজ | কিছুক্ষন ভেবে অর্ণব ওর তিন্নিদির জন্য একটা কার্ড আঁকবে ঠিক করলো | যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, অর্ণবের হাতের কাজ, হাতের আঁকা খুব ভাল, পরম যত্নে তিন্নিদের অবয়বটা ফুটিয়ে তুলতে লাগল নিপুণ দক্ষতায় | অর্ণবের আঁকা চলতে লাগল, আর তার সাথে দিক বিদিক ছাড়িয়ে ছুটে চলল ওর মন, বাধা নেই যেখানে | ও নিজেও জানে না, মন ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে |
বেশ কিছুক্ষন পর ওর বাঁধভাঙা মন আর হাতের কারুকলা যখন ওকে থামাল, তখন ভাল করে তাকাল অর্ণব ছবিটার দিকে | মুগধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল অর্ণব, এভাবে তো কখনো তিন্নিদিকে দেখেনি | খোলাচুল, ঝোড়ো হাওয়ায় এলোমেলো, অগোছালো, কপালে ছোট্ট টিপ্, মুখের মন ভরানো হাসিটা অপরিবর্তিত, এটা কীভাবে আঁকলো অর্ণব? তাহলে কী ও এভাবেই তিন্নিদিকে দেখতে চায়? এই রূপে? তাই এঁকে ফেলেছে? মনের কোন গভীর কোণে এই ছবিটা চাপা পড়েই ছিল, যার হদিশ অর্ণব নিজেও জানত না, আজ ওর মন আর হাতের জন্য ছবিটা ওর চোখের সামনে |……
ভারী অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর এখন | তিন্নিদির কথা ভাবতে খুব ভাল লাগছে, খুব | তিন্নিদির কথা বলা, হাসি, সব কিছুই খুব ভাল লাগছে অর্ণবের | নাকি আগেই ভাল লাগত? অর্ণব বোঝেনি এতদিন? খুব মিষ্টি একটা অনুভূতি অর্ণবের আশপাশটা মুড়ে রাখলো… অর্ণব ডুবে রইল একটা নিষ্পাপ ভাল লাগার ঘোরে… ভাল লাগা নাকি ভালোবাসা…. কে জানে |
||৪||
তিন্নিদিকে নিজের মনের কথা বলার সাহস অর্ণব এখনও করে ওঠেনি | তবে আজকাল তিন্নিদি বড় বেশিই ব্যস্ত | অর্ণবের একাকিত্ব কাটানোর, গল্পের এখন অন্যতম ঠিকানাই এই তিন্নিদি | কিন্তু তিন্নিদির এখন সামনে পরীক্ষা, তাই খুব ব্যস্ত | অর্ণবের মন খারাপ, এখন সারাদিন তিন্নিদিকে নিয়েই ভেবে যায় ও, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল এসবের ধারা ধরে না মন, তাও আবার এই বয়সে | অর্ণবের ক্ষেত্রেও তাই | অর্ণবের গোটা পৃথিবীটাই যেন এখন তিন্নিদি | মা বাবা সবদিনই ব্যস্ত, তাই ওর ঠিক, ভুল-এর পথ দেখানোর কেউ নেই ও | অর্ণব নিজের অজান্তেই এগিয়ে যাচ্ছিল এক অচেনা ভয়ংকর পথে, যে পথের যাত্রাটা বড় মিষ্টি লাগছিল ওর |
**************
আজ তিন্নিদির টিউশন থেকে ফিরতে একটু রাত হয়েছিল, তাই অর্ণব দেখল একজন দাদা তিন্নিদিকে পৌঁছে দিয়ে গেল | অর্ণবের কেন জানি না, সরল নিষ্পাপ মনটা ঠিক ভাল সার্টিফিকেট দিল না ছেলেটাকে, হিংসে হচ্ছিল যেন ওর খুব | ছেলেটা তিন্নিদির সাথে পড়ে হয়তো, দেখে যা মনে হলো, তিন্নিদির হাতটা ধরেছিল যাওয়ার আগে, অর্ণব দেখছিল ওদের ব্যালকনি দিয়ে | খুব অসহ্য লাগছিল অর্ণবের, ও সরে গেল, কিন্তু এর প্রভাব ওর মন থেকে কিছুতেই গেল না | এরপরও কয়েকদিন ঐ দাদাটার সাথে তিন্নিদিকে দেখল অর্ণব | নাহ, আর পারছে না ও সহ্য করতে, ও তিন্নিদিকে সোজা সব বলে দেবে | তিন্নিদি আর কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে পারে না, ওর সাথেই শুধু তিন্নিদি গল্প করবে, ব্যস |
***************
ঘরটা অন্ধকার, এ.সি চলছে তাও যেন দরদর করে ঘামছে অর্ণব, সাহসে ভর করে নিজের ভাললাগার কথা আজ তিন্নিদিকে জানিয়েই দিয়েছিল অর্ণব | তিন্নিদির থেকে এমন ব্যবহার পাবে ও ভাবতে পারেনি | তিন্নিদি কী এখন আর ওকে পছন্দ করে না? নাকী কোনদিনই করতো না | তাহলে যে বলল,”আমি তোকে শুধুমাত্র একজন ভালো বন্ধু, ভাই-ই ভেবে এসেছি |”, বের করে দিয়েছে আজ তিন্নিদি | তিন্নিদি বলেছে ওর নাকী অর্ণবের সাথে কথা বলতেও অস্বস্তি হচ্ছে, অর্ণবের মনে এসব ছিল জানলে নাকী অর্ণবের সাথে মিশতই না |
কেন? অর্ণব কী খারাপ কিছু বলল? অর্ণব তো তিন্নিদিকে খুব ভালবাসে | বয়সে বড় হলে কী ভালবাসা যায় না? সমাজ আমাদের নিয়মে বেঁধে দিয়েছে ঐ জন্য? ঐ নিয়মের বাইরে গেলেই ভুল? আর নিয়মের বেড়াজালে বন্দি থাকলেই ঠিক? কে বিচার করবে ঠিক ভুলটার? আর বিচার করবেই বা কোন অধিকারে? কে সে বিচার করার? এমনই হাজারো জট পাকাতে লাগল বোকা, পাগল ছেলেটার মাথায় | তিন্নিদির সাথে কথা না হলে কিছুতেই থাকতে পারবে না ও, তিন্নিদিকে খুব ভালবাসে অর্ণব | তিন্নিদি কী সুন্দর ভাবে অর্নবকে কত কিছু বোঝাত, কত গল্প করত, ও তো এবার আবার একা হয়ে যাবে | এসব কথা কাকে বলবে অর্ণব? মা বাবার তো সময়ই নেই | খুব মনে পড়ছে আজ দাদু ঠাম্মার কথা | ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে শুলে সব ঠিক হয়ে যেত, ঠাম্মা ঠিক বুঝিয়ে দিত, অর্ণব কোথায় ভুলটা করেছে | তিন্নিদি না থাকলে অর্ণব থাকবেই বা কী করে?……
||৫||
মেঘলা করে আছে আকাশটা | ঝোড়ো হাওয়ায় পর্দাটা বারবার উড়ছে, অশান্ত চঞ্চল পাখির মত | অর্ণবের মা বাবা, কাকা, কাকী, দাদু, ঠাম্মা, ভাই সবাই ঘিরে রয়েছে অর্ণবের দেহটাকে | সুসাইড কেস, পোস্টমর্টেম হবে | কে কাকে শান্ত করবে, কী বলে সান্ত্বনা দেবে, কার ঘাড়ে কে দোষ দেবে?
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে হঠাৎ এসে পড়া ছোট অর্ণব একাকিত্ব-য় ভুগত, সেই একাকিত্ব এতটাই বেড়ে গেছিল যে একটা গার্জেন ফিগার খুঁজত ও সবসময় | তখনই ওর জীবনে আসে তিন্নিদি, বকে, ধমকে, সামলে রাখতে অর্নবকে | অর্ণবের প্ৰতি তিন্নির অনুভূতি কিন্তু একদম সাধারণ, জুনিয়র হিসাবেই ওর খেয়াল রাখা, কেয়ার করা | কিন্তু অর্ণবের মানসিকভাবে সংবেদনশীল একাকীত্বময় জীবনে ঐ যত্নটাই অসাধারণত্বের ছাপ ফেলেছিল | ভালোলাগা, ভালোবাসা, ঠিক, ভুল, উচিত, অনুচিত, এই সমস্ত কিছু বিচার করার উর্ধে ছিল অর্ণবের দুর্বল মনটা, বিপর্যস্ত ছিল | তিন্নি বা অর্ণব কাকে এসব কিছু বোঝার পর দোষী করা যায়? অর্ণব বারবার ওর তিন্নিদির প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেনি, কেন তিন্নিদি অর্ণবকে প্রত্যাখ্যান করছে, এড়িয়ে চলছে সেটাও বোঝার চেষ্টা করেনি অর্ণব | আরও একবার, একা হয়ে, অন্ধকারে পথ হারিয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয় অর্ণব | কিন্তু, এখনকার যা জগৎ, মা বাবা উভয়ের উপার্জনও প্রয়োজন একটা সুন্দর, স্বচ্ছল জীবন যাপনের জন্য, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য | তাহলে দোষ কার? আসলে নিষ্পাপ অবুঝ প্রাণটা ঝরে যাওয়ার জন্য দায় নেবে কে? আপাত দৃষ্টিতে দেখে চটজলদি বিচার না করে, কারো ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে একটু ভাবা দরকার |