“কীরে, ওনাকে ডাকলি না, নতুন যিনি এসেছেন, নিয়ে আসবি তো।”
নিজের জন্মদিনের কেকটার সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিল খেয়াদেবী। বিশাল মাপের ভ্যানিলা ফ্লেভার কেক, আকৃতিটা একটা বাড়ির, লেখা ‘আমাদের বাড়ি’।
‘আমাদের বাড়ি’ প্রত্যেকটি সদস্যের জন্মদিন এভাবেই ধুমধাম করে পালন করে। এই যেমন আজ খেয়াদেবীর হচ্ছে, কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে আজ সবাই উপস্থিত থাকলেও একজন নেই, এবাড়ির নতুন সদস্য বিমলা দত্ত।
***************
বিমলা দেবী ‘আমাদের বাড়ি’র সদস্য হয়েছে হপ্তাখানেক হয়েছে সবে। ঘরের চেয়ার, টেবিল ল্যাম্প, আলমারি, আলনা, আয়নাটা এখনও অভ্যস্ত হয়নি নতুন মানুষটার সাথে। সামনের বাগানের পায়রাটা, কাঠবেড়ালীটাও নতুন মানুষটার সাথে আলাপ জমাতে পারেনি এখনও।
আর বিমলাদেবী? এইখানে আসার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও নিজের বাড়িটাকে ভুলতে পারেননি। মানুষ যেমন নিশ্বাস নিতে ভোলে না, সেরকমই। ছেলে যখন এখানে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, বিমলাদেবী সেই পানে চেয়ে থাকলেও ছেলে ফিরে তাকায়নি। কিন্তু, উনি পারছেন কই? পারছেন না তো। তাই কালকের অনুষ্ঠানে অনেক আলো থাকলেও বিমলাদেবীর মনটা অন্ধকার।
আহ্ণিকটা সেরে মুখে একটু জল দিয়ে বসলেন বিমলা দেবী। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন, মানিয়ে তো নিতেই হবে, এসব বলেই নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিলেন। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি এখানে কোনদিন সূর্যোদয় দেখতে হবে। নিজের বাড়ি, নিজের ঠাকুর ঘর, নিজের রান্না ঘর সব থেকেও ওনার আজ কিছুই নেই। ছোট্ট দাদুভাই রোজ সকালে ওনার কাছেই কমপ্ল্যানটা খেত, কী করছে কে জানে? ছেলে বিরক্ত হয়, বাড়িতে থাকতেই যা কথা শোনাত… যাক গে থাক, আর এত ভেবেই কীই বা হবে। নিজের অজান্তেই কখন কুঁচকানো গালটা নোনতা জলে ভিজেছে বুঝতেও পারেননি।
আচমকা একজনের গলায় ভাবনা থামল, দরজায় খেয়াদেবী। খেয়াদেবী বেশ মিশুকে মানুষ, বিমলা দেবীর আবার একটু বেশিই মিশুকে মনে হয় তাকে। নয়তো এই বয়সেও বাড়ি ঘর পরিবার পরিজন ছেড়ে কেউ এতো খুশি কীভাবে থাকতে পারে, মাথায় আসেনা বিমলা দেবীর।
সামনের চেয়ারটায় এসে বসলেন খেয়াদেবী, কম বয়সে যে যথেষ্ট সাজগোজ করতেন, তা এখনও দেখলেই বোঝা যায়। এখনও এতো টিপটপ, চোখে সুন্দর চশমা, দেহে অল্প অলংকারে, মাথার খোঁপায় নিজেকে ভালই গুছিয়ে রাখেন।
চশমাটা ঠিক করে তাকালেন বিমলাদেবীর দিকে, “কাল আমার জন্মদিনের পার্টিটায় এলেও না, আর একটা শুভেচ্ছাও জানালে না?”
এভাবে কেউ সোজাসুজি এই ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন, ভাবতেই পারেননি বিমলাদেবী। একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন।
তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খেয়াদেবী বললেন, “সবসময় এত মনমরা হয়ে থাকো কেন গো? যেদিন থেকে এসেছ দেখছি এমনটা। যাক গে, এখানে এসে গেছ, তোমার মন খারাপের দিন শেষ। যেটা বলতে আসা, আমরা মাসে একটা দিন সকলে মিলে একটু হৈহুল্লোড়, মজা করি। কাল তো তুমি এলে না, আজ কিন্তু সন্ধ্যেবেলা অবশ্যই আসতে হবে, বলে গেলাম। এখন যাই, সন্ধ্যে বেলা দেখা হবে।” এটুকু বলেই উঠে পড়লেন খেয়াদেবী, যেভাবে ঝড়ের মত এসেছিলেন, সেভাবেই চলেও গেলেন।
বিমলা দেবী সেভাবেই বসে রইলেন। সামনের বারান্দাটায় রোদ পড়েছে, গাছে বসা ছোট্ট কাঠবেড়ালীটা বারান্দায় এসে নেচে বেড়াচ্ছে মনের সুখে। ওনার শ্বশুরের ভিটে, বাপের বাড়ি সব জায়গাতেই খুব গাছ ছিল। তাতে কত ফল, ফুল, পাখি, সে এক আলাদা জগৎ। তারপর স্বামী নিজে বাড়ি করলেন, ইট কাঠ-এর প্রাচুর্য্যে সবুজ তখন পাত্তাড়ি গুটিয়েছে। মানুষটা যতদিন ছিলেন, ততদিন কিচ্ছুটি বুঝতে দেননি, চলে যাওয়ার সময় বাড়িটা বিমলাদেবীর নামে করে গেলেন – ‘বিমলা নিবাস’। কিন্তু, ছেলের বিদেশের চাকরি, তাই ছেলের মতে সেখানে এই বয়সে একা থাকা ঠিক না। অগত্যা বিমলাদেবীর নতুন ঠিকানা এই বৃদ্ধাশ্রম – ‘আমাদের বাড়ি’। আর ছেলে, বৌমা, নাতির নতুন ঠিকানা এখন বিদেশের ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট – আর ‘বিমলা নিবাস’ এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
বাইরের উঠোনটায় নিশ্চই শুকনো পাতা, ধুলো পড়ে ঢেকে গেছে বিমলাদেবীর নিজের হাতে আঁকা আল্পনাটা। মৃণালবাবু মানে বিমলাদেবীর স্বামী বড় সাধ করে বানিয়েছিলেন সেগুন কাঠের আসবাব – কাঠের আলমারি, পালঙ্কর খাঁজ আজ নিশ্চয় বিস্তর ধুলোয় চাপা পড়ছে। রান্নাঘরের ওনার গুছিয়ে রাখা নুন, তেলের কৌটো গুলোও আজ খালি। ফুলগাছ গুলোয় আজ জল দেবার নেই কেউ।
স্বামীর ছবির দিকে ফিরে চাইলেন,”এভাবে এখানে কীভাবে থাকবো বলতে পারো? কে আছে এখানে আমার নিজের”, ভাবে ভাবতেই ঘরের দরজায় টোকা পড়ল আবার।
শিবানী, এই বৃদ্ধাশ্রমটা ওরই।
-“তুমি খেতে আসোনি কেন ঠাম্মি? সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে তো।” বলেই বিমলাদেবীর শীর্ণ হাতটা ধরল গিয়ে, খাবার ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বিমলাদেবীর তখন আর একপ্রস্থ অবাক হওয়ার পালা। একদিন খেতে যাননি বলে সবাই বসে? কই বাড়িতে তো…।
সবুজ বাগান, ফোয়ারা, বাগানে ছোট্ট মন্দির, এই সবটুকু মিলিয়েই যেন শান্তির নীড় এই ‘আমাদের বাড়ি’। এখানে দিনের শেষে দীর্ঘশ্বাসের জায়গায় কলরব শোনা যায়। রাতের আঁধার এখানে নামার আগে নানা অনুষ্ঠানের আলোয় ঝলমল করে এই ‘আমাদের বাড়ি’। একটা বৃদ্ধাশ্রম হয়েও অন্য যেকোনো বাড়ির থেকে আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উল্লাসে যেন অনেক বেশি সজাগ।
শিবানীর বৃদ্ধশ্রমের কথাটা মাথায় এসেছিল ছোটবেলাতেই, যখন নিজের ঠাম্মি, নিজের দিদুকে হারিয়েছিল চোখের সামনে। খুব অসহায় লেগেছিল তখন, ইসস, যদি আরেকটু সময় পেত। যদি প্রাণের মানুষগুলোর জন্য কিছু করার সুযোগ পেত…
নিজের দাদুদের কোনদিন দেখেনি শিবানী। আজ এই ‘আমাদের বাড়ি’র প্রতিটা সুন্দরীই তাই শিবানীর চোখের মণি। প্রাণের মানুষগুলোর প্রতি যত্ন, সেবা, ভালোবাসার কোন ত্রুটি আজ অবধি হয়নি। বিমলাদেবীর একটু শুধু সময়ের প্রয়োজন, এটা শিবানী বুঝেছিল।
।।২।।
অনেক দোনা মোনা করে সেদিনকার সন্ধ্যের আড্ডায় অবশেষে এলেনই বিমলাদেবী। ইচ্ছা করছিল না একদমই, চুপচাপ ঘরের বাতিটা নিভিয়ে বসেই ছিলেন, কিন্তু এখানকার মানুষগুলো বসতে দিলে তো। অগত্যা…
আড্ডায় বসার খানিক পরেই হোঁচট খেলেন, এই বয়সে কী ভীমরতি হলো নাকী? এই বয়সে সব গলা ছেড়ে গানের লড়াই খেলতে লেগেছে, কী অবস্থা! এ কোন পাগলদের আড্ডায় এসে পড়লেন। নাহ, এভাবে কী থাকা যায়?
চোখের দুর্বল দৃষ্টি তো কী? হাসিটা মানুষগুলোর চোখ অবধি পৌঁছাচ্ছিল। মাথায় পাকা চুল, চোখে চশমা, সাদা শাড়ি, কুঁচকে যাওয়া চামড়া, কী যায় আসে এতে? খুশি থাকার জন্য, সর্বোপরি বাঁচার মতো করে বাঁচার জন্য কোন শর্ত লাগে নাকি। বিমলাদেবী অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন এঁদের দিকেই। কীভাবে? কী করে সম্ভব? কই উনি তো প্রতিদিন, এই একটু আগেও অন্ধকারে বসে কাঁদছিলেন, দাদুভাইটাকে কতদিন দেখেননি, এই ভেবেই চোখের কোণে জল চলে এসেছে কখন, তাহলে এঁরা?
ভাবনা থামল একজনের ডাকে। প্রণতাদেবী ডাকছিলেন, এবার ওনার গাওয়ার পালা।
গান? সে তো কোন জন্মে ছেড়ে দিয়েছেনা। এখন এসব হয় নাকি? ধ্যুর, “না না আমি পারব না গো, তোমরা গাও, আমি শুনছি।”
বাতিল করলেন যখন নিজের গান গাওয়াটা তখনই কথাটা বললেন খেয়াদেবী,”যেদিন থেকে এসছ, সেদিন থেকে দেখছি। কেন বাপু? তোমায় ছেড়ে বাকী সবাই তো দিব্যি খুশি আছে, তাহলে? বুড়ো বলে কী হাসতে নেই, গাইতে নেই, আমোদ আহ্লাদ করতে নেই, পাগলামো করতে নেই?”
কথাগুলো তীর-এর মতো বিঁধছিল বিমলাদেবীর বুকে, কিন্তু এতগুলো মানুষের সামনে কিছু বলতেও পারছিলেন না। আর পারলেন না, বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে এলেন, যাদের জন্য উনি রোজ অপেক্ষা করেন, তারাই তাকে ছাড়া আজ বেশী সুখী। কোন মা এটা মেনে নিতে পারে?
সারাটা রাত বিমলাদেবীর দু’চোখের পাতা এক হয়নি। না, হাতের মুঠো ফোনটা একই রকম পাথর – নিশ্চুপ, কোম্পানির ফোন আর মেসেজ ছাড়া আর কারওরই ওনার কথা মনে পড়েনি।
**************
খেয়াদেবীর ঘরটা বারান্দা পেরিয়ে একদম এই প্রান্তে। আজ আর না এসে পারলেন না বিমলাদেবী। যতক্ষন না কথাগুলো বলতে পারছেন, স্বস্তি নেই। যদিও কথাগুলো উনি আসলে কাকে বলবেন, খেয়াদেবীকে নাকি নিজেকে, বুঝতে পারছেন না।
খেয়াদেবীর ঘরটা বেশ গোছানো, বেশ অন্যরকম। সকালবেলার হালকা নরম রোদে ঘরটা আলোয় আলো। বাইরে হাস্নুহানার গন্ধে ম-ম করছে আশপাশটা।
চশমার কাঁচটা পরিষ্কার করছিলেন খেয়াদেবী, নিজের পরনের সুতির থানটা দিয়ে। সামনে খোলা সেলাই-এর কৌটো, সুতো বের করতে যেতেই বিমলাদেবীর দরজায় টোকা…।
-“আসবো?”
-“আরে এসো গো। তা বাপু, চোখ মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?”
স্বামী মারা যাওয়ার পর বহুদিন হলো এভাবে কেউ জিজ্ঞাসাই করেনি। নিজের অজান্তেই নিজের উপর যেন হেসে ফেললেন বিমলাদেবী, বসলেন পাশটিতে।
কথায় কথায় সাধারণ আলাপচারিতা শুরু হলো দুজনের মধ্যে। খেয়াদেবীর বাড়ি, পরিবারের সদস্য, স্বামী কী করতেন, এসব নিয়েই এগোচ্ছিল আলোচনা।
বিমলাদেবীও সুযোগ খুঁজছিলেন কীভাবে কথাটা পাড়বেন। অবশেষে মুখ খুললেন, “আসলে নিজের ছেলে, বৌমা, দাদুভাই, নিজের ভিটে সব কিছু ছেড়ে, এখানে এসে সত্যিই ভাল লাগছে না খুব একটা, মানতে পারছি না, কবে পারবো জানিও না। সেদিন ওভাবে আপনার কথাটা আমায় কষ্ট দিয়েছে, ঐভাবে উল্লাস করাটা আমি ঠিক মানতে পারছি না আসলে, এরপর থেকে…”
বিমলাদেবীকে থামিয়ে দিলেন খেয়াদেবী, চোখে মুখে যেন একরাশ বিস্ময় আর কৌতুক। যেন এ কী বলে যাচ্ছে? “দেখ বাপু, তুমি ‘আপনি’ বললেও আমি তোমায় ‘তুমি’ করেই বলছি। এসব আপনি, আজ্ঞে আমার আসে না, আর বলবোই বা কেন? তা যাই হোক, একটা কথার উত্তর দাও তো হে, তুমি যে এই আনন্দ, উল্লাসের বিপক্ষে, তা কেন? আমাদের তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তাই? বয়স হলে উল্লাস করতে নেই? নাকি, জীবনে সবাইকে ভাল রাখার দায়িত্ব নিয়ে নিজের খারাপ থাকার দায়িত্বটাও নিতে হয়? নাকি আমরা বিধবা বলে? কোনটা? নাকি তোমার পরিবার তোমায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সুখে আছে এটা মানতে অসুবিধা হচ্ছে? তারা যদি ভাল থাকতে পারে, তোমার কী খুশি থাকার অধিকার নেই?”
চোখের সামনে দেখতে না চাওয়া সত্যিগুলোকে অবলীলায় পর্দা ছিঁড়ে বেআব্রু করে দিছিলো মানুষটা বিমলাদেবীর সামনে। কথায় কথা বাড়ছিল, কথার উত্তাপে জানলার কাঁচে যেন বাষ্পের ছোঁয়া।
নিজের ঘরে ফিরে আসেন বিমলাদেবী।
।।৩।।
বিয়ের পর স্বামীর ঘরই তোমার ঘর, আর বাপের বাড়ি বিয়ের আগে তোমার আশ্রয়। তোমার কোন ঘর থাকতে নেই। মাছের মুড়োটা তোমার খাওয়া মানা, ওটা বাড়ির ছেলেদের জন্য। মেয়ে মানুষের আবার পছন্দ-অপছন্দ। বিধবা হয়ে আবার আনন্দ উল্লাস! ছিঃ ছিঃ। এগুলোই তো প্রথম থেকে মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয় – এই শিক্ষাতেই শিক্ষিত করা হয়। জোরে হাসা, রাত জেগে আড্ডা হৈহুল্লোড় এসব আবার মেয়েরা করে নাকি, তাও আবার নিজের পরিবারের থেকে দূরে থেকে।
কিন্তু পরিবারই দূরে সরিয়ে দেয় যখন? অবাঞ্চিত আগাছার মতো। তারপর সারাটা জীবন দিয়ে, নিজের সবটুকু অন্যের জন্য বিলিয়ে দিয়ে, রিক্ত হাতটা যখন সম্বল খোঁজে, তখন যদি এভাবে…। হ্যাঁ, বাইরে অঝোর বৃষ্টি আর মনের গভীরে বাঁধ ভেঙেছে আজ। ফাঁকা ঘরটার নিস্তব্ধতা যেন গ্রাস করছিল আজ বিমলাকে।
ছোটবেলায় খোকা একা ঘরে থাকতে যখন ভয় পেত, ছুটে আসতেন উনি। আর আজ উনি একা, কিন্তু ছেলে খোঁজ টুকুও নেয়নি। এখানে আসার পর থেকে কতবার ফোন করল ও? নিজের উপরেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। এই জন্য উনি বাইরের মানুষদের সাথে লড়তে গেছিলেন? সত্যি কথাগুলো বড্ড গায়ে বিঁধেছিল সেদিন। আজ মনের কোণে একরাশ বৈপরীত্যের কালো মেঘ। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, ঠিক ভুলের বিচার দন্ডই বা কার হাতে? সমাজ? হুহ! আজ অবধি কোনদিন ওনার স্বামী বা ছেলে ওনার জন্মদিনটুকু পালন করেছেন কখনো? অথচ ছেলের জন্মদিনে এবারেও অশক্ত হাতে পায়েসটুকু করেছেন। ওনার জন্মদিনও আসছে, কিন্তু কারও থেকেই কোন আশা নেই আর। সত্যিই তো, সারাটা জীবন, নিজের জন্য, শুধুমাত্র নিজের জন্য কী করলেন? কী পেলেন? সবার পাওয়া থেকেই নিজের পাওয়াটুকু ভাগ করে নিয়েছেন। শুধু ওনার জন্য একটা দিন? কখনো আসেনি। তাহলে আজ যখন নিজের মতো করে, নিজের জন্য কটাদিন বাঁচার সুযোগ এসেছে, এতো কীসের দ্বিধা? সমাজের ঠিক করে দেওয়া ঠিক ভুলের ভুয়ো মানদন্ডটা মনে গেঁথে আছে বলে?
**************
এখানে আসার পর থেকেই এখানকার মানুষগুলোর সংস্পর্শে নিজের ভাবনা-চিন্তাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছিল বিমলাদেবীর। এতদিন যেগুলোকে ঠিক বলে মেনেছেন, আজ সেগুলোই হেলায় ভেঙে বেশ ভাল আছে মানুষগুলো, তাহলে উনিই বা কেন নয়?
শুধু খেয়াদেবীই নন, আরও অনেকগুলো মানুষের সাথে মতবিরোধ লাগলেও পরে নিজের প্রশগুলোর উত্তর নিজেই পেয়ে গিয়েছেন। যে বৈপরীত্য সৃষ্টি হয়েছিল নিজের মনের দেয়ালে, আজ সেগুলো একটু একটু করে সহজ, সরল হচ্ছে – স্বচ্ছ হচ্ছে আশপাশটা। যেগুলো এতদিন ধরে আঁধার হানছিল, আজ সেগুলোই সূর্যের মতন উজ্জ্বল।
**************
চিৎকারটা শুনে চমকে উঠলেন বিমলাদেবী, নিজের হাতের ভাঁজ করা চাদরটা ফেলেই ছুটলেন ওদিকে।
।।৪।।
কথায় আছে বিপদ যখন আসে বলে কয়ে আসে না, সত্যিই তাই। নয়তো কে ভেবেছিল পয়লা বৈশাখের কিছুদিন আগে এরকম একটা অঘটন ঘটবে। প্রতিবছর নববর্ষের দিন ঘটা করে অনুষ্ঠান হয় এখানে, কিন্তু এবারে কী হবে কে জানে? এবাড়ির সবথেকে মিশুকে মানুষটা আজ আই সি ইউ তে। হার্ট অ্যাটাকে কাবু অত হাসিখুশি মানুষটা। আজ বিমলাদেবীর ঘরও অন্ধকার। কেন কে জানে, আজ ওনার মনটাকেও গ্রাস করছে একরাশ শূন্যতা। খেয়াদেবীর সাথে কোনদিনই সেভাবে মন খুলে গল্প, আড্ডা এসব কিছুই হয়নি, খুব বেশিদিন চেনেনও না, খুব যে ভাল সম্পর্ক তাও নয়। কিন্তু তবু যেন আজ মনটা বড্ড ভার। মানুষটা স্পষ্ট কথা বলেন বটে, কিন্তু ভুল তো কিছু বলেন না। সত্যি তো এটাই যে, আজ খেয়াদেবী, এবাড়ির বাকী মানুষগুলোর জন্যই বিমলাদেবী নিজের ভালো লাগাটা, সর্বোপরি নিজেকে মানুষ ভাবাটা, নিজেকে ভালোবাসাটা শুরু করেছিল।
-“ও ঠাম্মি তুমি আবার একলা বসে এভাবে? তোমায় বলেছি না এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবে না।”
শিবানী ঘরে ঢুকল, সবদিকে খেয়াল আছে মেয়েটার; ভারী হাস্যমায়া ভরা মুখটা, এইটুকু বয়সে এতকিছু সামলায়, বিমলাদেবীই অবাক হয়ে যান মাঝে মাঝে।
-“মনটা খারাপ তাই না, ওই বড় ঠাম্মির জন্যে।”
খেয়াদেবীকে শিবানী বড় ঠাম্মি বলেই ডাকে।
বিমলাদেবী অবাক হলেন, ওনার মুখের ভাবই কী সব কিছু বলে দেয়?
-“হবে না মা বল? এই ভালো মানুষটা, হাঁটছিল, চলছিল, হম্বিতম্বি করছিল, হঠাৎ কী থেকে কী হয়ে গেল বলতো?”
এত হাসিখুশি সুস্থ মানুষটার হঠাৎ… হ্যাঁ আমার সাথে সেভাবে… তাও মানুষটা খারাপ না রে। এটুকু বলে থামলেন বিমলাদেবী, বাইরেটায় বেশ মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। কয়েকটা জোনাকী পোকা অন্ধকারে বেশ আলোও ছড়াচ্ছে। বিমলাদেবী বসেছিলেন ঘরের লাগোয়া বাইরের বারান্দাটায়। শিবানী বিমলাদেবীর ইজি চেয়ারটার ঠিক পাশটিতে আরো গা ঘেঁষে বসল। বুড়ো হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”ঠাম্মি, ঐ মানুষটার মতন মানুষ হয় না গো সচরাচর।”
ফিরে তাকালেন বিমলাদেবী।
-“মানুষটা জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছে গো ঠাম্মি। ভালবেসে বিয়ে করেছিল, কিন্তু স্বামী তার মর্যাদা রাখেনি, ছেড়ে চলে গেছে অন্য কারো সাথে। উনি বিধবা নন গো ঠাম্মি, ওনার স্বামী আজও বেঁচে আছেন, সম্পূর্ণ সুস্থ। আর নিজের সবটুকু দিয়ে নিজের ছেলেকে মানুষ করার পর ছেলে যখন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে বিদেশে চলে গেল, তখন স্বেচ্ছায় উনি আমার এখানে চলে আসেন। কেউ ওনাকে এখানে দিয়ে যায়নি, উনি স্বেচ্ছায় এসেছেন, আমার বৃদ্ধাশ্রমটার প্রথম সদস্য ঐ মানুষটাই। জীবনের সার মর্মটা উনি বুঝে গেছেন, তাই জানেন, তোমার জন্য কেউ ভাববে না, এভাবে আগাছার মতো ফেলে দিয়েই চলে যায় তারা, নিজের ভালো থাকা, ভালো ভাবে বাঁচার ভাবনাটা নিজেরই, আর তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের জন্য বাঁচার। নিজের সারাটা জীবন তো পরিবারের জন্য আহুতি দিয়েই দিলে, এখন অন্তত হাসো, খুশিতে থাকো। কার জন্য দুঃখ? কার জন্য চোখের জল? সে দেয় তোমার চোখের জলের দাম? সে তো ভাবে না, সে তো ভালো আছে, তুমি কেন থাকবে না, তোমার কী নিয়ে অধিকার? হাজারবার আছে, আর এটা আমি ভীষণভাবে মানি, ঠাম্মি।”
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন বিমলাদেবী। কেন জানা নেই, আজ ওনার এটাই মনে হচ্ছে, যা হয় তার পিছনে সত্যিই কোন কারন থাকে। যদি আজ এই ‘আমাদের বাড়ি’ না থাকত, শিবানী, খেয়াদেবী না থাকত, ওনার তো নিজেকে বোঝাই হয়ে উঠত না। বাঁচতে শুরু করার কোন বয়স হয় না, আজ সেটা বুঝে গেছেন বিমলাদেবীও।
************
আই সি ইউ-এর ঘরটায় একবার একজনের বেশী আসার অনুমতি নেই, তাও রোজ নিয়ম করে এখানে আসেন বিমলাদেবী, কথা তেমন কিছুই হয় না, মানুষটা চোখ বুজে পড়ে থাকে, কিন্তু তার হাতের আঙ্গুলটা ধরে তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন বসে চলে যান বিমলাদেবী। আজ বিমলাদেবীর দিদি বেঁচে থাকলে এরকমই বয়স হতো। একটা টান অনুভব করেন, একটিবার না দেখতে পেলে মনটা শান্তও হয় না। যার সাথে একদিন কথা বলতেও ভাল লাগত না, সেই মানুষটার সুস্থতার কামনায় আজ বিমলাদেবী রোজ ঠাকুরকে ডাকেন – সময় হয়তো এভাবেই বদলায়।
*************
আই সি ইউ থেকে অবশেষে জেনারেল বেডে দেওয়া হয়েছে খেয়াদেবীকে, এখন অনেকটাই সুস্থ।
-“কাল তোমায় ছেড়ে দেওয়া হবে, কী এবার খুশি তো?” হ্যাঁ, এখন বিমলাদেবীও ‘তুমি’ করে সম্বোধন করেন খেয়াদেবীকে, খুব আপন লাগে এই তুমি ডাকটা, নিজের দিদিকেও তো এভাবেই ডাকতেন।
সেই মিশুকে মানুষটা, যে সবসময় কথা বলত, আজ বিমলা দেবীও জানেন, সেই মানুষটার জীবনেও কত ঝড় বয়ে গেছে, তাও উনি হাসতে জানেন, বাঁচতে জানেন, আর জেনে বা না জেনেই বিমলাদেবীকেও এটা শিখিয়ে দিয়েছেন।
অনেক কটা দিন চুপ করে শুয়ে থাকার পর আজ মানুষটা বুড়ো হাড়ে একটু জোর পেয়েছে, তাই হাসি ফুটেছে মুখে। চোখের পাশের কোঁচকানো চামড়াটাও আজ চোখের খুশির ঝিলিকের কাছে ম্রিয়মান।
-“হ্যাঁ, নতুন বছর আসছে, তার আগে নিজের বাড়ি ফিরতে হবেই তো, তাই না?”
হাসতে হাসতে গল্পে মাতলেন দুই বাড়িতে। হ্যাঁ, নিজের বাড়িই বটে, যে বাড়িতে থাকা প্রতিটি সদস্য সুখে দুঃখে একসাথে হাসে কাঁদে। এই স্বার্থপর দুনিয়ার মধ্যে থেকেও আজ স্বার্থ, হিংসা, বিদ্বেষ এই সবকিছু অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছে মানুষগুলো।
।।৫।।
“ঠাম্মি, তোমার ফোন”, শিবানীর কথায় মুখটা ঘোরান বিমলাদেবী, মুখে পায়েস, খেয়াদেবী বড় যত্নে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন আজ। কোনদিন তো ফোনটোন আসেনা এখানকার ল্যান্ড লাইনে, ভাবতে ভাবতেই দেখলেন মুঠোফোনটা বন্ধ আজ।
ধরলেন ফোনটা।
-“মা, কেমন আছ?”
বাবু, ওনার একমাত্র ছেলে আজ ফোন করেছে, ও তো নিজে থেকে ফোনই করে না, ফোন করলেও বেশীর ভাগ সময় ব্যস্ত।
-“ভাল আছি বাবা, তুই কেমন আছিস, দাদুভাই? বৌমা?”
-“সবাই ভাল, আসলে ক’দিন ব্যস্ত ছিলাম, ফোন করা হয়নি। বলছি উইলের ব্যাপার তোমার সই-টই লাগবে, কাজও আছে কিছু, ভাবছি মাস খানেকের মধ্যে একবার গিয়ে সব মিটিয়ে আসব, বার বার তো যাওয়া সম্ভব না। ও, বলছি শুভ নববর্ষ মা।”
ওপাশ থেকে ডাক দিচ্ছে তখন সবাই, কেকটা কাটার জন্য মোমবাতি জ্বালানোও হয়ে গেছে, নববর্ষের দিন যে বিমলাদেবীর জন্মদিনও।
মা বাবা আর দিদি যতদিন ছিল, তাদের মনে থাকতো, মা পায়েস রেঁধে খাওয়াতেন, কিন্তু এসব কেক টেক কাটা কোনদিনই না, আর বিয়ের পর তো জন্মদিন! ধ্যুর। ছেলেও কোনদিন মায়ের জন্মদিন নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। মেয়েমানুষের ছোট ছোট চাওয়া, তার খুশি আনন্দ কিসে, এ নিয়ে কোন কালেই বিশেষ মাথা ঘামায় না কেউ, তাও আবার বুড়ো বয়সে।
-“আমি রাখছি রে, সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। এই প্রথম কেক কাটবো আজ। পরে কথা হবে, দরকার হলে ফোন করিস বাবা, রাখছি এখন।”
-“মা।।।। ম্যান? কেন!।।।।”
ফোনটা ততক্ষনে রেখে দিয়েছেন বিমলাদেবী। আজ সত্যিই নববর্ষ, নতুন দিনের সূচনা ওনার জন্য। হোক না দেরিতে, শুরু তো হলো। নিজের জন্যও ভাবতে হয়, নিজেকেও ভাল রাখতে জানতে হয়, নিজেকেও ভাল বাসতে হয়।
ফুঁ দিয়ে নেভালেন মোমবাতি, কেকের প্রথম টুকরোটা তুলে দিলেন খেয়াদেবীর মুখে।
-“হ্যাপি বার্থডে রে।”
-“শুভ নববর্ষ দিদি।”
সারা ঘর তখন হাততালির শব্দে ভরে উঠেছে ।