।।১।।
চাটুজ্জ্যে বাড়িতে এই সময় কাকচিল আর বসার সাহস পায় না, চারপাশ থেকে যা চিলচিৎকার ধেয়ে আসে, তীর ধনুকের মত, কার সাধ্যি এই গরমে জিরেন করে একটু। পাড়াতেও সকলের জানা, এ’ প্রায় দিনের গল্প।
*************
-“মা যেটা জানো না, সেটা স্বীকার করো না কেন, ভুল তো যে কোন মানুষেরই হতে পারে।”
-“হ্যাঁ, সেই তো, এই বয়সে এসে এখন তোর কাছ থেকে আমায় রান্না শিখতে হবে? রেঁধে খাওয়াতে হবে, আবার কথাও শোনাবি।”
-“আরে, অদ্ভুত, তোমায় আমি অনেকবার মানা করেছিলাম, যে, পারবে না বানাতে পাস্তা, ছেড়ে দাও, আমি করছি, এখন আমায় দোষ দিচ্ছ, কি আশ্চর্য।”
-“তুই চুপ কর, রান্না শেখাচ্ছে আমাকে। রোজ কে রেঁধে মুখের গোড়ায় ধরে? তখন তো দিব্যি খাস চেটে পুটে।”
-“ও, আর আমি রাঁধি না, রোজ অফিস থেকে ফিরে কে রাঁধে রোজ? একটা কিছু অন্তত আমি বানাই-ই…”
-“হ্যাঁ, হয়েছে, সব করে রান্নাঘর ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে যাবে মহারাণী, আমায় সব পরিষ্কার করতে হবে, আবার কথা তার।”
এই ঝামেলা পর্ব লেগেই থাকে, মা মেয়েতে। মনোহরবাবুও এখন খুব বেশী গা করেন না, আগে করতেন, বুঝে গেছেন, লাভ নেই। তার থেকে খবরের কাগজ, গল্পের বই, বিকালে গল্পের ঠেক, এই ঢের ভাল আছেন। আজ রান্না নিয়ে লেগেছে, অন্যদিন ঘর গোছানো নিয়ে লাগবে, তারপর দিন খরচাপাতি, একেক দিন একেকটা টপিক।
এই ঝগড়ার ফলস্বরূপ পাড়া প্রতিবেশী মোটামুটি বাড়ির মাসিক আয়, বা সেই দিনের কী মেনু, বা ঘরে ক’টা তারে গামছা ঝোলে, সবই জানতে পারে।
আপাতত, রাগারাগি কথা কাটাকাটির পর কয়েকদিন, মাত্র কয়েকদিন কম কথা, শান্ত পরিবেশটা থাকবে তারপর আবার।
এখনও যেমন, রাগারাগি করে পৃথা তো বেরিয়ে গেল, এরপর যখন বাড়ি ফিরবে, তখন কিন্তু আরেক নাটক শুরু হবে। কেমন? দেখা যাক।
।।২।।
ফোনে চিৎকারটা করতে করতেই বাড়িতে ঢুকল পৃথা, দরজাটা খুলে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন মায়াদেবী, মনোহর বাবুও একবার আড় চোখে দেখে নিলেন।
“আপনার তো আজ ডেলিভারি করার কথা ছিল, কবে থেকে ঝোলাচ্ছেন, সম্ভব না… ধ্যুর রাখুন মশাই… আপনি আগেই তো বলতে পারতেন…” ফোনের ওপারের ব্যক্তির সাথে চিৎকার চলছিল পৃথার ওষুধ ডেলিভারি নিয়ে।
“তুমি ভাবো বাপি, ওষুধগুলো আজও দিলো না। মা-এর ব্যাথাটা বাড়লে এবার কি হবে বলো। এদের কথার কোন দাম নেই, মানুষকে বিপদে ফেলে।” বলতে বলতেই গজগজ করতে করতে ভিতরে চলে গেল।
বা যেমন ধরুন,”তোমায় এত করে বলে দিলাম পই পই করে তাও তুমি ভুলে গেলে। কবে থেকে মেয়েটাকে একটু ছোলার ডাল করে দেব ভাবছি, তোমার মনে আর থাকে না আনার কথা। কাল যদি না এনে বাড়ি ঢুকেছ, তোমার একদিন কী আমার?
মনোহরবাবু তাই মাঝে মাঝেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন কে কার পক্ষে বা কে কার বিরুদ্ধে।
এই তো সেদিন, উপরের ফ্ল্যাটের মল্লিক গিন্নির সাথে দেখা,
“আপনি এগুলো কী করে মেনে নেন জানি না বাপু, রাত করে বাড়ি ফেরা, প্যান্ট শার্ট পরা, এই ধেড়ে বয়সে, কালও তো দেখলাম রাত প্রায় ১১ টায় বাড়ি ফিরল পৃথা। কিছু বলেন না আপনারা?”
কাপড় শুকোতে দিতে দিতে ছাদে এই কথাবার্তা। যা হয় আর কী, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যেই তো শুভানুধ্যায়ীদের সংখ্যা বেশী কী না? ব্যস, জ্ঞান দেওয়ার পালা শুরু।
“ওদের অফিস ড্রেসকোড ওটাই, তাই ওকে পরতেই হয়, আর প্রাইভেট-কোম্পানীতে কী আর টাইমের ঠিক থাকে রোজ? আর যদি তা নাও হতো, আমার যখন কোন সমস্যা নেই, আপনার এত মাথা ব্যাথা কেন?”
নিজেরা একে অপরকে যা বলে বলুক, কিন্তু বাইরের কেউ কিছু বললেই।।।।।
বড় গোলটা বাধল বুবান আসার দিন।
**************
“মা তোমায় যে বললাম কাল, মাটনটা আমি করব, নতুন রেসিপিটা, তুমি দমে বসিয়ে দিলে? আশ্চর্য তো?
“সাত বেলায় উঠে আর এত রান্নার শখ করতে হবে না। কখন রাঁধবি আর কখন খাবে লোকে? যা, বাসি কাপড়ে আর আমার রান্না ঘরে ঢুকিস না, বেরো এখন।”
কথাটা সেদিন একটু বেশীই গায়ে লাগল পৃথার, মাথাটা অসম্ভব গরম হয়ে গেল, আর মাথা গরম হলে কখন যে কী বলে তার কোন দিশা নেই।
ফস করেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল,”এই জন্যই পাপড়িদি বলে, তোমার সাথে থাকা যায় না, অনেক দুঃখে আলাদা হয়েছে ও।”
কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, পরক্ষণেই উপলব্ধি করল পৃথা, এ কী বললাম? কথা একবার বলে দিলে আর ফেরানো তো যায় না। হতবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন মায়াদেবী। পৃথা আর কিছু বলতে না পেরে উপরে চলে গেল।
**************
বাড়িটা নিশ্চুপ, শুধু বাসন-এর টুং-টাং শব্দ। ফ্যানের শব্দ, ব্যস। পশ্চিমের আকাশটায় মেঘ জমেছে কিছুক্ষন আগে থেকে। মনে হয় ঝড় আসছে। মায়াদেবী নিজের ঘরে একলা শুয়ে জানলাটা দিয়ে মাঠটা দেখছিলেন। ওনার বরাবর মেয়ের শখ। প্রথম যখন ছেলে হলো অনেক আনন্দের মাঝে কোথাও যেন এই ভাবনাটা ছিলই, যদি মেয়ে হতো। ছোট ছেলে হওয়ার পর মনটা আবার কষ্ট পেয়েছিল অনেকটা আনন্দ হলেও। তারপর যখন পৃথা এল, কোথা থেকেই যেন ওনার জীবনে একরাশ খুশির ঝাপ্টা লেগেছিল। সবসময় তিড়িং বিড়িং করছে, বড় হলেও সবসময় কাজকর্ম বাচ্চাদের মত। প্রথমে যথেষ্ট সংশয়ে ছিলেন, এই মেয়ে? পারবে সব সামলাতে?
কিন্তু পৃথা বরাবরই মায়াদেবীকেই শুধু নয়, সমাজের বুকে থাকা মানুষগুলোর গোড়া ধ্যান-ধারণাকেও ভুল প্রমান করেছে বারবার। ওর শিশুসুলভ স্বভাবে, ওর গুনে, ওর প্রতিভায় সবকিছুতে মুগধ না হয়ে থাকে কার সাধ্যি। পৃথা যেমন শিশুর মতো সারল্যও দেখতে পারে, তেমনি সঠিক জায়গায় গলা চড়িয়ে প্রতিবাদও করতে পারে। একধারে যেমন রাগ হলে তুমুল ঝগড়া করতে পারে, তেমনি ভালবাসায় ভালবাসার মানুষটাকে ভরিয়েও দিতে পারে।
পৃথা খুব ভাল একজন মানুষ হিসেবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, বুবান-এর সাথে চলে গিয়ে এই বুড়োবুড়ি গুলোকে একা ফেলে নিজের দায়িত্ব কোনদিনই ঝেড়ে ফেলেনি, যেমনটা গোগোল আর ওর বৌ করল। কিন্তু পৃথার বলা কথাগুলো সব হিসেবে গুলিয়ে দিল আজ মায়াদেবীর। মনে মনে তাহলে এটাই ছিল, তাই আজ রাগের সময় এই কথাটা বেরিয়ে এল।
মায়াদেবীর ভাবনায় বিরতি টানল পৃথাই। ঘরের বাইরে থেকে ভিতরে আসার অনুমতি চাইছে। এর আগে তো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ত, আর এখন এতো ফরম্যালিটি?
-“মা আসবো?”
-“হুম”, ব্যস আর কিছুই বললেন না।
পৃথা এসে খাটের উপর মায়াদেবীর পায়ের কাছে বসল চুপ করে। কোনরকম ভনিতা, ভূমিকা এসব কোন কিছুই পোষায় না ওর কোন কালেই, তাই মৌনতা ভেঙে পৃথাই বলল,”রাগ কমেছে? কথা বলবে না আমার সাথে?”
-“কি বলতে এসছ বলো।”
মায়াদেবীর এই কথাটায় বুঝল যে রাগ বা অভিমান বেশ খানিকটা এখনো জমে আছে। তুমি করে সম্বোধন, বৌমা বলে সম্বোধন এগুলো পৃথার একটুও পছন্দ না। তাই পৃথার আবদারে, কার্যত পৃথার জোরাজুরিতেই মায়াদেবী ওকে নাম ধরে তুই করেই ডাকেন। এই তুমি ডাক, বৌমা ডাক- এগুলো যেন দূরত্ব আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেয়, এটাই ফিল হয় পৃথার। আর পৃথার যেমনটা চাই তেমনটা ও মানিয়ে গুছিয়ে বুঝিয়ে ঠিক হাসিল করে নিতে পারে। মায়াদেবীও তাই আবদার রাখতে তুইই বলেন। কিন্তু এখনকার এই ‘তুমি’টা যে বেশ মেঘ জমেছে তার জানান দিচ্ছে।
“মা, আমি জানি, তুমি বুবানের জন্য ভালবেসে রান্নাটা করতে গেছলে। আমার যাতে গরমে বেশী কষ্ট না হয়, তাই কাজ এগিয়ে রাখছিলে, কিন্তু মা, তোমার কাছে তো আমার কোন রাখঢাক নেই, তোমায় তো যা আমার মনে, সবটা বলি। তুমি তো জানো, আমিও তোমার বুবানকে কতটা ভালবাসি। তোমার ছেলে ছাড়া আমার আর কে আছে বল? নিজের বরের জন্য কতদিন কিছু বানাইনা, ও এতদিন পর আসছে, তাই একটা অন্তত পদ, ওর ফেভারিট বানাবো ভেবেছিলাম, সেই জন্যই তখন খুব রেগে গেছিলাম মা।”
মায়াদেবীর চোখে জল বললেন,”তাই বলে ওভাবে বলবি পোড়ামুখী।।।।”
“না মা, তুমি তো জানো, সবাই এত করে বলা সত্ত্বেও আমি তো তোমায় ফেলে কোথাও যায়নি, সেটাতো তোমায় ভালবাসি বলেই। পাপড়িদি যাই বলুক, আর বাকী লোক যাই বলুক, যে শাশুড়ির সাথে ঘর না করে আলাদা থাকাই শ্রেয়, কিন্তু তুমি তো জানো, আমিও তোমায় ছেড়ে থাকতে পারি না। আমি তো জানি আমার মনটা কতটা ভাল। ও মা, মা, আর রাগ করো না। একটু পর বেরবো, তোমার ছোট ছেলে আসছে কতদিন পর, আর মন খারাপ নয় ব্যস, নয়তো আমি আবার রেগে যাব।”
মায়াদেবী পৃথার মাথায় হাতটা বুলিয়ে বললেন,”ছেলে নেই তো কী হয়েছে, আমার মেয়ে একাই একশো।”
পৃথা মায়াদেবীর চোখটা মুছিয়ে, গাল টিপে বলল,”হ্যাপি মাদার্স ডে, চলো তোমার গিফ্টটাও তো কিনতে হবে।”
এই সংসারের দুই লক্ষী একে অপরকে বড় সুন্দর করে আগলে নিয়ে চলে। ‘শাশুড়িমা’কে শুধু ‘মা’ও বলা যায়, বৌমাকে মেয়ে হিসেবেও গ্রহণ করা যায়, এই সবই দেখায় পৃথা আর মায়ার এই অসাধারণ সম্পর্কের রসায়নটা।
হ্যাপি মাদার্স ডে, সব ‘মা’ কে।
২০১৮ সালের মাদার্স ডে স্পেশাল গল্প “হ্যাপি মাদার্স ডে” পড়তে ক্লিক করুন। আরো অনেক গল্প পড়ুন মুক্তধারার পাতায়। আপনাদের মূল্যবান মতামত ও মন্তব্যই মুক্তধারার আগামী দিনের চলার পথ নির্ধারণ করবে, তাই জানাতে ভুলবেন না গল্পটি কেমন লাগলো।