হ্যাপি নিউ ইয়ার

।।১।।

সন্ধ্যের দিকে ফিরে আরও একবার খবরের কাগজটা নিয়ে বসেন বিশ্বনাথবাবু, সকালে তাড়াহুড়োয় অত ভাল করে তো দেখাও যায় না । সামান্য চা জলখাবার খেতে খেতে খবরের কাগজটাই ওনার একটা ‘বিলাসিতা’ বলা যেতে পারে ।

বর্ষশেষ উদযাপন করতে এখন ছেলে মেয়েরা কত টাকা উড়োয় কে জানে, আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে কম ঝক্কি পোহাতে হলো? মচ্ছব শুরু হয়ে গেছে ওনাদের । আর বাজি পোড়ানোর তো অন্ত নেই | এখন থেকেই দূষণটা বাড়ানোর জন্য নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব নিয়েই নিয়েছে, রাত বাড়লে মাত্রা আরো ছাড়াবে ।

**************

“খাবার দিয়ে দিয়েছি, এসো গো”, ঝিমোচ্ছিলেন বিশ্বনাথ বাবু । স্ত্রী প্রণতা দেবীর ডাকে একটু নড়ে উঠে বসলেন । “ওহ, অনেকটা রাত হয়ে গেলো, কখন যে চোখটা লেগে গেছে”, বলতে বলতেই খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন । বড় মেয়ে ঝুমকো তখন টিভি চালিয়ে বসে গেছে | খাওয়া দাওয়া সেরে, টিভিতে বর্ষশেষের অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত ।

**************

এইভাবেই বাগবাজারের শরিকি বাড়িতে বিগত কয়েক দশক ধরে নিত্য নৈমিত্তিকভাবে বয়ে চলেছে বিশ্বনাথ বাবুদের সংসার ।

বিশ্বনাথবাবু একজন সাধারণ সরকারী কর্মচারী, আশেপাশের মানুষজন ‘কেরানী’ই বলে । প্রণতাদেবী সাধারণ গৃহবধূ, আর দুই মেয়ে ঝুমকো আর টিকলি । কয়েক বছর আগেও সব ঠিকই ছিল, হঠাৎ…

কানে শব্দটা আসতেই মাছের কাঁটাটা হাতে ফুটল বিশ্বনাথবাবুর ।

।।২।।

(তিন বছর আগে)

-“কীরে, আজও দেরী হবে তোর? এত দেরীতে ফোনটা ধরলি কেন? বাড়িতে তো মানুষগুলো চিন্তা করে ।”

-“প্লিজ দিদি প্লিজ, রাগ করিস না, গিয়ে ভাল খবর দেব, এখন রাখছি, টাটা ।”, এই বলে ফোনটা রেখে দিল টিকলি ।

বিরক্ত হয়ে ঝুমকোও ফোন রেখে দিল, “এই ভাবে কতবার তোকে বাঁচাবো বলতো? আজ আবার একটা অশান্তি হবে, উফফ..”, বলেই পাশের ঘরে চলে গেল ।

****************

-“তোমাকে আর কতভাবে আর কত রকম ভাষায় বোঝাতে হবে, এসব পাগলামো এই বাড়িতে থেকে সম্ভব নয় ।”

বাবার রোষের সামনে চুপচাপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল টিকলি, আজ বাড়ি ফিরতে রাত দশটা বাজার অপরাধে ।

“বাবা, অডিশন শেষ হতে দেরী হলো, একটু বোঝার …”

-“আমার আর কিছু শোনার দরকার নেই, ঐ সমস্ত ভুত মাথা থেকে নামও, অনেক হয়েছে, আর কখনও ঐ মুখ হাত বেঁকিয়ে অ্যাক্টিং আর কোমর নাচিয়ে নাচ, ওইসব যেন না দেখি ।”

-“বাবা, প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করো, আমি অভিনয় করতে ভালবাসি, I just love acting, আমি পারব বাবা…”

সপাটে একটা চড় পড়ল টিকলির গালে, অগ্নিমূর্তি বিশ্বনাথবাবু, “শুধু অভিনয় করতে পারলেই হয় না, তার সাথে সাথে আরও যা যা অভিনয় জগতের কাছ থেকে নিতে হয়, বা নিজের যা কিছু দিতে হয়, সেই সম্পর্কে কোন ধারনা আছে তোমার? শুধু ক্যামেরার ঝলকানিটা নিলেই হয় না, তার অন্ধকার দিকটাও গ্রহণ করার ক্ষমতা চাই, আর সেসব আমাদের মতো মানুষের পক্ষে, এই পরিবারে থেকে সম্ভব না । মাথায় ঢুকেছে এবার? আর যেন না দেখি তোমার এই পাগলামো ।”

বেরিয়ে চলে গেলেন ঘর থেকে বিশ্বনাথবাবু । একলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল টিকলি । রগে দুঃখে, অপমানে মুখ চোখ লাল । ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল টিকলি ।

****************

-“ঝুমকো, তোমায় তো কতবার বলা হলো, একবার দেখা করো, কথা বলো…” বলতে বলতেই খাবার টেবিলে রুটিটা ছিঁড়ে মুখে পুড়ছিলেন বিশ্বনাথবাবু ।

“আরে বাবা, দেখা করলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না, দেখা করতে দোষ কী?”, প্রণতা দেবী সায় দিলেন ।

“মা প্লিজ, সবকিছু তোমাদের ইচ্ছে মতন হবে, তার তো কোন মানে নেই, তোমরা মত দাওনি, আমি করিনি রানাকে বিয়ে, তাই বলে যাকে বলবে তাকে…”, আর কিছু বলতে পারল না ঝুমকো, উঠে চলে গেল টেবিল থেকে ।

খাবারের থালাটার দিকে তাকিয়ে টিকলি বুঝতে পারছিল, এখানে নিজের ইচ্ছেয় কিছু করাটা, কিছু পাওয়াটা কতটা কষ্টের, কতটা দুঃসাধ্য ।

।।৩।।

ছোট্ট দু’কামরার শরিকি বাড়ি, এক চিলতে বারান্দাতেই টিকলির স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করছিল একটু একটু করে । মা, বাবা, দিদির চোখের আড়ালে পরম নিষ্ঠায় নিজেকে একটু একটু করে তৈরী করছিল টিকলি, নিজের স্বপ্নকে সত্যি করতে একটু একটু করে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছিল ।

****************

টিকলির ঘরটা একদম সামনের দিকটায়, শীতকালে তাই ওর ঘরটা রোদে ঝলমল করে, আর শীতের দুপুরে এই ঘরটাই ভাল । বোনের ঘরটায় ঢুকে কিছুক্ষন দেখে নিজের মনেই হাসল ঝুমকো । দেওয়ালে চারপাশে ফিল্মস্টারদের ছবি, “পাগলী একদম বোঁটা আমার”, বলতে বলতে অগোছালো ঘরটা একটু গোছাচ্ছিল ঝুমকো, আয়নাটার দিকে চোখ পড়তেই নিজেকে কিছুক্ষন ধরে দেখল ও, কী করছে ও? কেন করছে? ওর জীবনটা কী এরকম হওয়ার কথা ছিল? কই না তো, ভালবেসে বিয়ে করাটা কী করে একটা অন্যায় হতে পারে? ‘ভালবাসা’টাই বা কী করে একটা অন্যায় হতে পারে?

কখন নিজের অজান্তেই দু’ ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে গল্ বেয়ে, বুঝতেই পারেনি ।

চোখটা মুছে টেবিলে মাথা নীচু করে চোখটা বন্ধ করল ঝুমকো, কই এই কথাগুলো একবারও বাবা, মা, বাড়ির কারও সামনে তো মুখ ফুটে বলতে পারেনি, ও তো তখন কোন প্রতিবাদই করতে পারেনি, যদি পারত, তাহলে আজ হয়তো ওর জীবনটা অন্যরকমই হতো,…… মুখটায় একটু জল দিয়ে আসলো । টিকলির আলমারি থেকে তোয়ালেটা বার করতে গিয়েই চোখে পড়ল জিনিসটা ।

****************

-“কিরে আজ ফিরতে আবার দেরী করলি? ভাগ্যিস আজ মা বাবা প্রণব কাকার বাড়ি গেছে, নয়তো… যাইহোক, হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি জলখাবার দিচ্ছি ।”

টিকলি সারাদিনের ক্লান্তির প্ৰ বাড়ি ফিরে আর পড়ার এনার্জি টুকুও থাকে না । নিজের টিউশনির টাকায় বাড়িতে না জানিয়েই একটা গরুমিং ক্লাসে ভর্তি হয়েছে ও, সে সব সেরে বাড়ি ফিরে আবার নিজের পড়া । এক্সামের আর বেশি দেরীও নেই ।

রান্নাঘর থেকে ঘরে আসার বারান্দাটার খুব খারাপ অবস্থা, যেকোন দিন ভেঙে পড়তে পারে, আর সব কিছু ঢেলে সাজানোর মতো ক্ষমতা বিশ্বনাথবাবুর নেই ।

টিকলি ম্যাগিটা মুখে তুলতেই ঝুমকো প্রশ্নটা ছুঁড়ল, “তোর আলমারি থেকে আজ এটা পেলাম” বলতে বলতেই কাগজটা টিকলির হাতে দিল ঝুমকো ।

হঠাৎ করে এটা দিদির হাতে পড়ে যাবে ভাবতে পারেনি টিকলি, ওর স্বপ্ন পূরণের সার্টিফিকেট এটা, অডিশনের রেজাল্টের পর নামজাদা ছবিতে ডেবিউ করার সুযোগ । কতবছর ধরে চেষ্টার পর আজ এটা ওর হাত অবধি পৌঁছেছে । ওকে পড়তেই হবে ।

“দিদি, বিশ্বাস কর, আমি বলতাম সব, আমার পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই আমি বলতাম, কলেজের এক্সামের শেষ হওয়াটার অপেক্ষা করছিলাম, তুই প্লিজ এখন বাবাকে কিছু বলিস না দিদি…. কিরে, এই দিদি….”

মাথা নীচু করে সবটা শুনছিল ঝুমকো । কিছুক্ষন সব চুপচাপ, ঘরে শুধু টিকটিক ঘড়ির শব্দ, আর সিলিং ফ্যানের আওয়াজটা, ঝুমকো বলল, “আমি বলব না, কিন্তু বাবা কী রাজী হবেন?”

ঘরে মুখোমুখি বসা দুই বোনের মৌনতাই জানান দিচ্ছিল আসন্ন ঝড়ের ।

****************

-“তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলার সাহস কোথা থেকে পেলে? তোমার লজ্জা করছে না এই কথাগুলো বলতে?”, টিকলির সামনে রোষে ফেটে পড়লেন বিশ্বনাথবাবু ।

প্রণতাদেবী তখন সন্ধ্যে দিতে ব্যস্ত, ঘরে কীসের অশান্তি হচ্ছে বুঝতে পারছিলেন না, মনটা চঞ্চল থাকায় কিছুতেই মনটা শান্ত হয়ে বসছিল না, বারবার ভুল করছিলেন সন্ধ্যা আরতির কাজে ।

-“বাবা, তুমি বোঝার চেষ্টা করো, এটা একটা গোল্ডেন অপরচুনিটি, আর তুমি আর মা, দিদি পাশে থাকলে আমি নিশ্চই পারব, তুমি শুধু পারমিশনটা দাও…”

-“না, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, এসব ফিল্মি দুনিয়ার ভুত মাথা থেকে নামও, আমাদের মতো ছাপোষা ঘরে এসব হয় না, কোনভাবেই তুমি যাবে না । আর যদি তোমায় অভিনয় জগতে যেতেই হয়, এসব বাড়ির বাইরে থেকে করবে, আমার বাড়িতে এসব চলবে না ।”

-“বাবা, যাব তো আমি বটেই, দরকার পড়লে এইবাড়ির বাইরে থেকেই করব, কিন্তু আমি অভিনয়টা করবই ।”

-“যখন ঠোক্কর খেয়ে এই বাড়িতেই ফিরে আসবে, তখন বুঝবে, তখন দেখব কোথায় তোমার এত তেজ ।”

-“ঠিক আছে বাবা, তাই হবে, কিন্তু আমি যাবই…”।

।।৪।।

(এখন)

“অ্যান্ড দি অ্যাওয়ার্ড গো..জ টু তানিয়া….”

নামটা শুনেই একবারের জন্য থমকেছিলেন, গলাটা শুনে উঠে দাঁড়ালেন, টিভির সামনে ।

*****************

আজ কতদিন পর নিজের মেয়েটাকে দেখে শক্ত আবরণটা গলতে শুরু করেছিল একজন পিতার । চোখটাও বুঝি ছলছল করছিল । ঝুমকো তাকিয়ে দেখছিল বাবা মা-কে । প্রণতাদেবী চাননি ওনার মেয়েকে ছেড়ে থাকতে, কিন্তু স্বামীর জিদের জন্য, স্ত্রীর কর্তব্য পালনের জন্য মা নিজের অবুঝ মনকে বুঝিয়ে নিয়েছিল । ঝুমকো সবই জানতো, বোনের সাথে দিদিই নিয়মিত এতদিন ধরে যোগাযোগ রেখে এসেছে । সেদিন যদি বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের বোনের জন্য, তার ইচ্ছার জন্য, তার স্বপ্নের জন্য প্রতিবাদটা না করত, আজ এই দিনটা কী আসত?

“নিজের ভালবাসাকে হারিয়েছি তোমাদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে গিয়ে, বোনটা অন্তত নিজের জীবনটা নিজের মত বাঁচুক, ও ওর জীবনটা তোমাদের পছন্দ, নীতি অনুযায়ী কেন বাঁচবে বলতো বাবা?”

কথাগুলো আজও কানে বাজে ঝুমকোর, ঐ একটাদিনের ওর প্রতিবাদের জন্য আজ ওর বোনটা…

****************

“সকলকে অনেক ধন্যবাদ, ধন্যবাদ আমার ফিল্মের পুরো টিমকে । এটা আমার প্রথম অ্যাওয়ার্ড । অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক কিছু হারিয়েওছি, আমার সবথেকে ভালবাসার মানুষদেরকে আমি পাশে পাইনি দুঃসময়ে, কিন্তু আমি জানি তারা আমায় কতটা ভালবাসে ।…..”

কারোর মুখে কোন কথা নেই, বিশ্বনাথবাবু হাঁ করে শুনছেন অ্যাওয়ার্ড হাতে মেয়ের কথাগুলো । এভাবে মেয়ের কাছে হেরে গিয়েও এ যে কত বড় জয়, একজন পিতাই জানেন ।

“হ্যাপি নিউ ইয়ার বাবা”, টিকলির চোখ ক্যামেরার দিকে । তখন ঝরঝর করে চোখ বেয়ে নোনতা জলের ধারা নেমেছে বিশ্বনাথবাবুর, আনন্দে চোখ বুজে নিস্বাসটা নিলেন, মনে মনে বলা অনুচ্চারিত কথাগুলো খুব শীঘ্রই এবার উচ্চারিত হবে যে, “তোর বাপির কাছে ফিরে আয় মা ।”

ততক্ষনে নতুন বছর পড়ে গেছে, সারা আকাশ জুড়ে শুধুই আলো, তিন বছর বাদে আজ মিত্তির বাড়িতে সত্যিকারের – হ্যাপি নিউ ইয়ার ।

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

হারিয়ে যাওয়া ‘আমি’

।।১।। “এই বেলটা বাজছে, একবার দেখ না, তরকারিটা নামাচ্ছি তো, দেখ রে,আরে এই টুসি, কোন সাড়াশব্দ নেই।” “আরে আমি রেডি হচ্ছি মা, তুমি দেখো।” “উফফ,

Read More »

লজ্জা

লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে চুপচাপ সবার নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে এল রিনি। কিছু আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাদটা ভিজে এখনও, মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ

Read More »

আজ বাঁচুন

আবাসনেরর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই চিৎকার কানে এলো… সিকিউরিটি কে ছুটে যেতে দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ওরা |কিন্তু তারপরই আবাসনের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল যেন চারপাশটা…

Read More »

রদ্যি খবর

“তোকে কতবার আর বলব পুপু, আজ অন্তত দস্যিপনাটা একটু কমা। দেখছিস তো বাড়িতে লোকজন আসবে আজ।” মেয়ে পুপুকে আবার একবার খানিক ধমকে দিলো রাধিকা, বিক্রমপুরের

Read More »

এই বেশ ভালো আছি

।।১।। ট্রাঙ্ক থেকে ন্যাপথালিন দেওয়া গুটি কয়েক তোলা শাড়ি থেকে একটা শাড়ি বের করছিল মায়া । ছোট্ট দু’কামরার ঘরে এককোণে খাট, ছোট্ট আলনা, ট্রাঙ্ক, কুঁজো,

Read More »

Share with