।।১।।
“এই বেলটা বাজছে, একবার দেখ না, তরকারিটা নামাচ্ছি তো, দেখ রে,আরে এই টুসি, কোন সাড়াশব্দ নেই।”
“আরে আমি রেডি হচ্ছি মা, তুমি দেখো।”
“উফফ, এদের দিয়ে যদি একটা কোন উপকার হয়। ঝিঙে পোস্তটা কোনোরকমে তাকের উপর রেখে ডেচকিটা নিয়ে ছুটল মিঠু।
“এই আগের দিন এলে না কেন, এত কামাই করলে তো খুব মুশকিল। হঠাৎ হঠাৎ না বলে কয়ে বসে যাও। তারপর আমি বিপদে পড়ি। আবার দোকানে ছুটতে হয়। আর ক’দিন ধরে দুধটা একদম জল, সর-টর কিছুই তো পড়ছে না। এরকম চললে ছেড়ে দাও তুমি।”
মিঠুর কথার মাঝেই উল্টো দিকের মিসেস সাহা মানে সোমাদি দরজা খুলল।
“ওহ, এসেছে তাহলে আজকে।” বলেই একগাল হেসে মিঠুর দিকে তাকাল সোমা। সামনে রতন গোয়ালা তখন বিনা বাক্যব্যয়ে মিঠুদের ফ্ল্যাটের কাজ মিটিয়ে সোমাদের ফ্ল্যাটে মেপে দুধ দিতে ব্যস্ত।
“এই আমায় আজ মোষের দুধ দাও।” রতনকে বলে আবার মিঠুর দিকে তাকাল সোমা।
“আমি যাই বুঝলে, এখনও টিফিনটা বাকি। ঠিক ১১টা, মনে থাকবে তো? ভুলবে না।”
“না, না, তুমি যাও। আমি চলে আসব।”
কথা শেষ করে দরজা লাগিয়ে আবার ফ্ল্যাটে ঢুকে এল মিঠু। ভাতটা এখনও হলো না নাকি, একবার দেখে নিল ঝট করে। ঝিঙে পোস্তটা টেবিলে সরিয়ে তেলে ভাজাটা ছাড়ল এবার। ঘড়িতে দেখে নিল একবার, সময় আছে এখনও, হয়ে যাবে। মনে মনে হিসেবটা কষে নিয়ে দ্রুত হাতে সব্জিটা কাটতে লাগল মিঠু। নুডলসটা তো আগেই সিদ্ধ হয়ে গেছে। ঘামে ভেজা মুখটা একবার আঁচল দিয়ে মুছে নিয়ে হাঁক পাড়ল আবার মেয়ের উদ্দেশ্যে।
“তোকে আমার ফোনটা দেখতে বলেছিলাম, দেখলি? এবার তো দুজনেই বেরিয়ে যাবে বাপ মেয়ে, আগে ঠিক করে দিয়ে যাবি। বারবার বলছি কাল থেকে। কিচ্ছু আসছে না, ঐ কি বলে নোটিফিকেশন না কি যেন। কিরে, এই টুসি, শুনতে পাচ্ছিস?”
“সকাল থেকে এত চিৎকার কিসের, তোমাদের জ্বালায় একটু খবরের কাগজটাও শান্তিতে পড়া যায় না। যা বলার ধীরে সুস্থে বল না। অফিস গিয়ে তো সেই চিৎকার চেঁচামেচিই শুনি রোজ, বাড়িতে অন্তত একটু শান্তি রাখ। আর এই টুসি, মা কাল থেকে কি বলছে করে দে না।”
“উফফ, আমায় বলার সুযোগ দাও তোমরা দুজন? আমি ঠিক করে দিয়েছি। কিছুই হয়নি আনফলো হয়ে গেছিল কোনভাবে, তাই আসছিল না কিছু। এবার আসবে।”
“উফফ!শান্তি!আর মেসেজ টেসেজ? না মানে…”
“আরে সবই হবে। তুমি আবার একটু বেশীই… যাক গে, আমায় এবার খেতে দিয়ে দাও নয়তো ট্রেনটা মিস করলে আর পি কে বি স্যার রক্ষে রাখবে না।”
“বস, বাড়ছি।”
তাড়াতাড়ি ভাতের ফ্যান ছেঁকে গরম ভাত, ডাল, ভাজা, পোস্ত দ্রুত হাতে মেয়েকে সাজিয়ে দিল মিঠু। ও যখন কলেজ যেত তখন ওর মাও ঠিক এভাবেই সাজিয়ে দিত, আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে। তখন মিঠুও টুসির মতন একবারও জিজ্ঞাসা করত না, মা তুমি কখন খাবে? বা কি খাবে? একা একা খেতে কার আর ভাল লাগে? তাও কোনদিন কথাগুলো বলা হয়নি মাকে।
মেয়েকে খেতে দিয়ে টিফিনটা বানাতে ছুটল রান্নাঘরে মিঠু। মিনিট পনের-র মধ্যে চাউমিন বানিয়ে মেয়ের ব্যাগে টিফিন বক্স, জল ভরে দিল ও, মেয়ে যাওয়ার সময় বারান্দায় দু’দন্ড দাঁড়িয়ে মেয়েকে দেখেই আবার দৌড়। এবার বরের ভাত, টিফিন গুছিয়ে তার হাতের কাছে সব এগিয়ে দেওয়া আরেক প্রস্থ কাজ মিঠুর। বর অফিস বেরিয়ে যেতে রান্নাঘর পরিষ্কার, কাজের মেয়ে রত্না এলে তাকে দিয়ে সব কাজ করিয়ে দম ফেলার ফুরসত পেতে পেতে বেলা ১০টা বেজে যায়। নিজের স্নান, পুজো সেরে জলখাবার খেতে বসতে বসতে সাড়ে দশটা – এগারোটা। একা একা ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে ভাল লাগে না মোটেই, মা-র কথা খুব মনে পড়ে। তারপরে অবশ্য মিঠুর হাতে অফুরন্ত সময়। ঘড়িটা একবার দেখে বরকে, মেয়েকে ফোনটা করে নিয়ে এতক্ষণে একটু আমেজ করে বসল মিঠু। বেলটা বাজল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, সোমাদি এল বোধ হয়।
**********
বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ একটি প্রাপ্তি যোগ ঘটেছে মিঠুর জীবনে – স্মার্টফোন। না, স্মার্টফোন নিয়ে বাড়াবাড়ি, হিড়িক এসব কোনদিনই ছিল না মিঠুর। তাই এতদিন ব্যবহারও করেনি, করার প্রয়োজনও বোধ করেনি। কিন্তু কয়েকমাস হল অফিস থেকে এই ফোনটি গিফ্ট পেয়েছে সৌমিত্র। বর বা মেয়ের উৎসাহেই অবশেষে ফোনটা মিঠুর হল। আর তারপর থেকেই ওর চেনা জানা পরিবেশটা যেন আমূল বদলে গেল। এইটুকু একটা ফোন যে এত কিছুর ভান্ডার, তা এতদিন মিঠু জানতই না। উল্টে মেয়ে দেখানো বোঝানোর চেষ্টা করলেও বিশেষ পাত্তা দিত না। আর এখন সেই মিঠুই একদিন ওর পছন্দের জিনিসগুলো দেখতে না পারলে, পড়তে না পারলে মনে হয় কি যেন একটা নেই। ছোট থেকে গল্পের বই পড়ার ভীষণ শখ মিঠুর। এছাড়াও হাতের কাজ, নানারকম শৌখিন জিনিস বানিয়ে ঘর সাজানোয় রীতিমত পটু ও। এখন স্মার্টফোনের দৌলতে এই দুটো শখই পূরণ হয় মিঠুর। বিয়ের পর থেকেই একান্ত নিজস্ব এই ভালোলাগাগুলো চাপা পড়ে গিয়েছিল দায়িত্বের ভিড়ে। না, কেউ যে জোর করেছিল এমনটাও নয়, নিজেই সবটুকু ভুলে একটা অন্য মিঠুই হয়ে গেছে যেন আজ এই দীর্ঘ বিশ বছরে। এই মিঠু আর সেই আগের মিঠুর মধ্যে বিস্তর ফারাক। যে মেয়ে কখন পাটভাঙা শাড়ি ছাড়া পরত না, সেই আজ কোঁচকানো শাড়ি পরে সংসারটা চালায় দশভুজার মত; যে মেয়ে কোনদিন কাঁটার মাছ খেত না, আজ দিব্যি রোজ ল্যাজার মাছ খেয়ে ফেলে; যে মেয়ের ঝিঙে কোনদিন মুখে রুচতো না, সেই মেয়ে বর আর মেয়ের ভালো লাগার জন্য দিব্যি খেয়ে নেয় ঝিঙে পোস্তও, কারো প্রতি কোন অভিযোগ ছাড়াই।
আর এতে যে ও খারাপ ছিল তাও তো নয়। তবে হ্যাঁ, ও নিজেকে আর খুঁজে পায়নি, খোঁজার চেষ্টা যে করেছে খুব, তাও নয়। দিনের পর দিন মিঠু মিত্রর কাছে অবহেলিত হয়ে মিঠু বসু হারিয়ে গেছে বহুকাল। কিন্তু ইদানীং যে ব্যাপারটা খানিক আলাদা, আবার যেন চিরপরিচিত ‘আমি’টাকে খুঁজে পাচ্ছে ও, কিংবা খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করছে। দিনের শেষে নিজের যত্ন নিতে ইচ্ছে করছে, প্রতিদিন বরের মেয়ের পছন্দের রান্নার পাশাপাশি নিজের প্রিয় পদটাও বানাতে ইচ্ছে করছে। ঘরের রঙে বা বেড়াতে যাওয়ার ডেস্টিনেশনের লিস্টে নিজের ইচ্ছেটাও বলতে ইচ্ছে করছে, সিনেমা দেখতে গেলে নিজের পছন্দের মুভির নামটাও জানাতে ইচ্ছে করছে। একটু নিজেকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে এবার, যেটা এতদিন ছিল না। এটা ভাল না মন্দ মিঠু জানে না। কিন্তু এটা হচ্ছে, আর তার ক্রেডিট এই স্মার্টফোন আর চিত্রলেখা। হ্যাঁ, নামটার মতই মানুষটাও ভারী সুন্দর যে। মিঠুর মতন আরো শত মানুষের মধ্যে নিজেকে খোঁজার তাগিদটা যে জাগিয়েছে মেয়েটা! কি সুন্দর করে কথা বলে, কি ভাল লাগে শুনতে। ওর কথাগুলো কখন শুনতে বসবে, ওর লেখাগুলো কখন পড়তে বসবে, সেই জন্য কাজের ফাঁকে মনটা যেন হাঁকপাঁক করতে থাকে মিঠুর। আর তারপর? চুপচাপ বসেই যেন কেটে যায় দিনটা নিমেষে, নিজেকে চিনতে, জানতে, বুঝতে এর আগে কি ও সত্যিই চেয়েছিল? ওর সাজানো ছোট্ট বাগানটা, ওর বনসাই-এর গাছটা, বা ছাদের কার্নিশে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলা, কিংবা মন কেমনের কালো মেঘ — এইসবের বাইরেও ওর সত্যিকারের ভালোলাগার জগৎটা যে এতদিন ধরে ওরই অপেক্ষায়, তা কি দেখছিল ও? না, কিন্তু চিত্রলেখার একেকটা কথা, একেকটা শব্দ যেন ভীষণভাবে আঘাত হানে মিঠুর হৃদয়ে। না, এই আঘাত যন্ত্রণার নয়, এই আঘাত নিজেকে চেনার, জানার, খুঁজে নেওয়ার রাস্তা দেখায় যেন। আর বাকী মানুষের কথা জানা নেই, অন্তত মিঠুর ক্ষেত্রে তাই। এই মানুষটাই মনে হয় ওর এখনকার এই পরিবর্তিত জীবন দর্শনের জন্য দায়ী। আর তাই আজ এই অতি সাধারণ এক গৃহবধূ, মিঠু মিত্র একটিবার দেখা করতে চায় মানুষটার সাথে।
**********
দরজাটা খুলতেই সোমাদি একগাল হেসে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে।
“এত দেরী করলে যে? এসো, এসো, ভিতরে এসো।”
“আর বল কেন? ওই মিনু দেরী করে এসেছে আজ, ঐজন্য দেরী হলো একটু। তবে সময় আছে হাতে।”
“হ্যাঁ, এসো, বসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, তুমি এনেছ ঐ মেরুন শাড়ীটা? আমি তোমার পছন্দের পেস্তা রঙের শাড়ীটা বের করে রেখেছি, ম্যাচিং জুয়েলারিও, ঐ ঘরে রেখেছি। রেডি হয়ে নাও।”
“হ্যাঁ গো সব এনেছি, আর কিছু লাগবে কি দ্যাখো।” দ্রুতহাতে প্যাকেট খুলে জিনিসগুলো দেখে নিল মিঠু। আর বেশী দেরি করা যাবে না, ১টা থেকে সেমিনার স্টার্ট।
।।২।।
“আর কতক্ষণ লাগবে দাদা?”
“এই তো আর আধঘন্টা ম্যাক্সিমাম।”
“একটু তাড়াতাড়ি চলুন দয়া করে।” ঘড়িটা একবার দেখে উদ্বিগ্ন মুখে বলল মিঠু।
পাশে সোমা চোখের ইশারায় বেশি টেনশন করতে মানা করল মিঠুকে। মিঠু বরাবরই বড্ড টেনশন করে, ওর মনটা ঘোরাতেই বলল আবার, “জানো তো যখন কলেজে পড়তাম, আমার ১০টা শাড়ী বা সালোয়ারের মধ্যে ৫টাই বোধহয় পেস্তা রঙের হত। মা পছন্দ করে খুঁজে খুঁজে পিস কিনে আনত, আর পুজোর সময় তো মাস্ট। তারপর কবে যে আমার প্রিয় রংটা বদলে নীল হয়ে গেল খেয়ালই করিনি। সেদিন তুমি বলার পর আলমারিটা খুলে বসলাম, কিন্তু একটাও পেস্তা রঙের শাড়ী খুঁজে পেলাম না। নীল তো কোনদিনই আমার প্রিয় রং ছিলই না, অথচ আমার আলমারিতে বেশীর ভাগ রঙ-ই যে নীল। আকাশী নীল, গাঢ় নীল, কালচে নীল, কেন? নীল আমার স্বামীর প্রিয় রঙ বলে? তোমাকে তাই সাত পাঁচ ভেবে বলেই ফেললাম আগেরদিন, আর এবার পুজোয় আমি আমার প্রিয় রঙের পোশাকটা আগে কিনব, বরের প্রিয় রঙের নয়।”
“আসলে আমরা নিজের প্রিয় মানুষগুলোর জন্য বাঁচতে বাঁচতে নিজের জন্য বাঁচতে, নিজের জন্য সময় বার করতে যে কবেই ভুলে গেছি, খেয়ালও নেই। অন্তত একে অপরের কাছে নিজের হারিয়ে যাওয়া পছন্দগুলোর খোঁজ তো করলাম আজ!”
ট্যাক্সিটা সাইড নিয়ে দাঁড়াল রাস্তার পাশে। কথা থামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে সেমিনার হলের দিকে রওনা হলো মিঠুরা।
**********
এর আগে কখনো একলা, নিজের মর্জিতে কোথাও সিনেমা, থিয়েটার দেখতে গেছে বলে মনে পড়ে না মিঠুর। বিয়ের আগে বাড়ির সবার সাথে, আর বিয়ের পর হাজবেন্ড বা মেয়ের সাথে,ব্যস। নিজের বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা, ঘোরা কিংবা আড্ডার ইচ্ছে ছিল, কোনদিন আর হয়ে ওঠেনি। মিঠুও আর বেশী মাথা ঘামায়নি, বাকী ইচ্ছেগুলোর মতন এই ইচ্ছেটাও ভুলে গেছিল ও। আজ এই প্রথম একলা ট্যাক্সিতে চেপে একলা নিজে টিকিট কেটে নিজের পছন্দের সেমিনারে এসে কেমন যেন লাগছিল মিঠুর! অনেক কিছুই ওর কাছে প্রথম যে! বেশ রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার যেন। কিন্তু বড্ড ভাল লাগছিল। সোমাদিরও একই অবস্থা। বাড়িতে কেউ কিচ্ছু জানে না। এই একলা আসার সিদ্ধান্তটা ওদের একান্তই নিজের।
মুগ্ধ হয়ে চিত্রলেখাকে সামনে থেকে দেখছিল মিঠু। এতদিন তো ফোনেই দেখেছে, তখনই ভাল লাগতো, আর এখন তো একদম সামনে। সামনের দিকের সীটই পেয়েছে ওরা। হাঁ করে চিত্রলেখার কথাগুলো শুনছিল মিঠু। চিত্রলেখাকে প্রথম যখন চিনেছিল, কি যেন লেখা ছিল নামটার পাশে? ও হ্যাঁ, ইনফ্লুয়েন্সার, ইনস্পিরেশনাল স্পীকার, অথর, এগুলোই তো মানুষটার পরিচয়, এই হিসেবেই চিনেছিল ও। আর আজ ওর মধ্যে যতটুকু যা পরিবর্তন তা এই মানুষের জন্যই। হ্যাঁ, বয়সে অনেক ছোট মিঠুর থেকে, কিন্তু জ্ঞানের পরিধি বা বাচনভঙ্গি অনেক অনেক উন্নত।
মিঠুর মতই আরো কত শত দর্শক এসেছেন, সবাই যে কোন নির্দিষ্ট কারণ নিয়ে আসে, তা তো নয়। কথাগুলো শুনলেই তো মন ভালো হয়ে যায়। মিঠু কথাগুলো শোনার সাথে সাথে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল মানুষটাকে। কি অসম্ভব ভাল কথা বলে, আর উজ্জ্বল দুটো চোখ। এই যে শাড়ী ধরার স্টাইলটা, এটাও বেশ লাগছে। চুলটা বাঁধা, কি ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে! হাতগুলো নেড়ে যখন কথা বলছে লক্ষ্য করছিল মিঠু, ডানহাতের ঘড়িটা, কপালের ছোট্ট কালো টিপটা, কানের ছোট্ট দুলটা সবকিছুই কত সাধারণ তাও কত সুন্দর, বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখে কী মারাত্মক কনফিডেন্স!
নিজের হাত দুটোর দিকে তাকাল একবার ও, একবার নিজের শাড়ির প্লিটের দিকে, কপালের লাল বড় টিপটায় হাত ছোঁয়াল একবার। “বিয়ের পর কালো ছোট্ট টিপ মানায় না, তার থেকে লাল টিপেই মানায় বেশি।” বহুবার বিয়ের পর শুনেছে কথাটা, কথাটা ঠিক না ভুল জানা নেই, কিন্তু এরপর থেকেই ওর ড্রেসিং টেবিলের প্রিয় ছোট্ট কালো টিপের পাতাটা বদলে লাল বড় টিপের পাতা জায়গা করে নিয়েছে আজ বহু বছর। কিন্তু ওর তো চিত্রলেখার মতোই ছোট্ট কালো টিপই পছন্দ ছিল চিরকাল। আজ এখানে এত ঝলমলে আলো, এত লোক, এত বড় সেমিনার হল এই সবকিছুর মাঝে বসে বারবার গুলিয়ে যাচ্ছিল ওর সবটা। ওর মনটা পাগলের মত হাতড়াচ্ছিল ওর চাওয়াগুলোকে, ওর প্রিয় মেরুন রঙটাকে, ওর টাকা জমিয়ে কেনা প্রিয় বইগুলোকে, ওর ফেভারিট মটন কষাটাকে, ওর প্রিয় চুনো মাছের ঝালটাকে, সর্বোপরি ওর হারিয়ে ফেলা ‘আমি’টাকে। হাততালির শব্দে সারা হল ঘর ফেটে পড়ল, নিজেকে একটু সামলে নিল মিঠু। মুখ চওড়া হাসিটা টেনে ও-ও করতালিতে সামিল হল সবার সাথে।
।।৩।।
“হল থেকে বেরোবার পর থেকে হঠাৎ চুপ করে গেলে কেন বলতো? আচ্ছা, চিত্রলেখাকে সামনে থেকে দেখতে কি সুন্দর লাগছিল বল? ভিডিওতে যা লাগে তার থেকেও ঢের সুন্দর। কি সুন্দর কথা বলে। আমি তো শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। কথাগুলো বড্ড সত্যি। কিন্তু আমরা কখনও ভেবেও দেখিনি, কত জটিল কথাগুলো কত সহজে বলে দিল, তাই না?”
“আচ্ছা শেষ নিজের জন্য, একদম নিজের জন্য কি করেছিলে তুমি?”
“মানে? চিত্রলেখার মতন কথা বলছ যে তুমিও?”
“না গো, ভাবার আছে বিষয়টা। একান্ত আপন করে ঠিক কোন কাজটা করেছিলে তুমি? কোন রান্না, শপিং, কোন শো দেখা একদম তোমার পছন্দের, কবে? শুধু নিজের জন্য, মনে পড়ে?”
সোমাদির দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে হাসল মিঠু, “মনে পড়ছে না তো? আমারও মনে নেই, হাতড়াচ্ছিলাম ওখানে বসেই। নিজের জন্য দিনের খানিকটা সময়, একটা কোল বালিশ আর বারান্দার কোণের চেয়ারটা, আর এক কাপ চা খুব দরকার খুব। সবার সাথে সাথে নিজের যত্ন নেওয়াটাও খুব দরকার। দিনের কিছুটা সময়, সেটা যতটুকুই হোক নিজের মতন করে নিজের সাথে কাটানো উচিত জানো তো, আমরা কি তা করি? সবার জন্য বাঁচি, নিজের জন্য বাঁচা আর হয় না। কিন্তু এবার বাঁচতে চাই, একদম নিজের মত করে, ঘরের একটা কোণ, ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে খানিকটা সময় বাঁচিয়ে নিজের জন্য রাখা, সপ্তাহে অন্তত একটা দিন, বাড়ির পছন্দের সাথে সাথে নিজের পছন্দের পদটাকেও টেবিলে জায়গা দেওয়া, চিত্রলেখা তো ঠিকই বলেছে। সবার সাথে নিজের ভালো-মন্দের, পছন্দ-অপছন্দের খোঁজটাও রাখা উচিত। নিজের জন্য আগে বাঁচা উচিত, নিজে ভাল না থাকলে আশপাশের মানুষগুলোকে কিভাবে ভাল রাখব? আর আরো দশ-বিশ বছর পর মরার আগে নিজের কোন কোন সাধ অপূর্ণ রইল সেই ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলব। কেন? কেউ কি সাধ পূরণ করতে বাধা দিয়েছিল? নিজেই কি যথেষ্ট নয় নিজের ছোট্ট ছোট্ট সাধগুলো পূরণ করতে? নিজের খুশীর জন্য নির্ভরশীল হওয়া উচিত শুধুমাত্র নিজের উপরেই। আমরা নির্ভর করি, অন্যদের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের ইচ্ছেগুলোকে একেবারে লিস্টের শেষে রাখি, আর শেষ বয়সে এসে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কেন? নিজের উপর এত দয়া কেন? ভালবাসা নয় কেন?”
“আচ্ছা, তুমি তো চাকরি করতে, তাহলে তারপরও…”
“সংসারের প্রয়োজনেই চাকরি করতাম, সংসারের প্রয়োজনেই ছেড়েওছি। শুধু নিজের জন্য করেছি এটা বলব না। অন্যের কোম্পানীতে কাজ করে খেটে সে কোম্পানীটাকে বড় করা, না, সেটা আমার ভাল লাগার কাজ কোনদিনই ছিল না। করতে হয়েছিল। টুসি হওয়ার পর ছেড়ে দি। আমার সবদিনই ইচ্ছে ছিল নিজের একটা স্টার্টআপ… যাক গে থাক এখন… দাদা, সামনের মোড়টা পেরিয়ে বাঁধবেন, নামব।”
“একি এখানে কেন? এখনও তো দেরী খানিকটা।”
মিঠু ট্যাক্সি থেকে নামতে উদ্যত, সোমার দিকে ততক্ষণে ভাড়া মিটিয়ে তাকিয়ে হেসে বলল, মাটন খেতে আমার মতোই তুমিও যে কতটা ভালবাসো সেকি আর জানি না? হাজবেন্ড আর মেয়ের অপছন্দ, তাদের গন্ধ লাগে তাই আমারও যেমন মাটন খাওয়া ঘুচে গেছে, তেমনি তো তোমারও। আমরা ওদের জন্য কষ্ট করতে পারলে ওরাও একদিন করবে ক্ষণ। আপাতত মাটন খাবো, তারপর বাকীটা খেতে খেতে প্ল্যান করব না হয়।
দুজনে মিলে হাঁটা লাগাল গোলবাড়ির দিকে।