নতুন সূর্য

||১||

-“কেন আমায় হ্যাঁ বলা যায় না কেন, সত্যি করে বল তুই আমায় ভালবাসিস না?”

সায়কের প্রশ্নের মুখোমুখি আজ প্রিয়াঙ্কা | প্রিয়াঙ্কা আর সায়ক অফিসে একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করে, সেই সুবাদে ‘তুই’ করে একে অপরকে ডাকা, বন্ধুত্ব, আর এখন প্রেমের প্রথম ক্ষণ উপস্থিত | সায়ক প্রিয়াঙ্কাকে কবে থেকে ভালবেসেছে জানে না, প্রিয়াঙ্কাও ওকে ভালবাসে, এই বিশ্বাস থেকেই আজ এতদিন পর সায়ক নিজের মনের কোণে পরম যত্নে লোকানো কথাটা বলল, কিন্তু….|

“কেন না বলছিস, সেটা জানার অধিকার তো আমার আছে নাকী !”, উত্তেজিত স্বরে কথাটা সায়ক কথাটা প্রিয়াঙ্কার দিকে ছুঁড়ল |

-“তুই আমার পরিবারের ব্যাপারে কতটুকু জানিস? হ্যাঁ, আমরা খুব ভাল বন্ধু, কিন্তু আমি আমার অস্বস্তির জায়গাগুলো কারো সামনে আনতে চাইনি, কোনদিনই | তাই তুইও ততটুকুই জানিস, আমায় ততটাই চিনিস, যতটা আমি তোকে জানতে দিয়েছি |”

সায়কের কাছে প্রিয়াঙ্কার এই কথাগুলো খুব হিজিবিজি জটিল রেখা লাগল, বলল, “তুই এসব কি বলছিস, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না…”

সায়ককে কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রিয়াঙ্কা বলল,”আজ অফিসের পর দেখা করে সব বলি?”

||২||

গরমের দিনে সূর্যাস্ত এমনিই একটু দেরীতেই হয়, সূর্যাস্তের লাল আভা গঙ্গার জলে ছড়িয়ে দিয়ে প্রকৃতি বড় যত্নে, বড় সুন্দর করে সাজিয়ে তুলেছে চারপাশটা | গঙ্গার ধারের ঝোড়ো হাওয়ায় প্রিয়াঙ্কার এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো বারবার সামলানোর চেষ্টা, কনে দেখা আলোয় ওর সুন্দর মুখটা যেন আরো মায়াবী দেখাচ্ছিল, ওর মুখে অবাধ্য চুলগুলো পড়ে ওকে আরো বেশি এলোমেলো করে দিচ্ছিল এই প্রকৃতি, মুগধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল প্রিয়াঙ্কার দিকে |

“বল তুই যা কিছু বলতে চাস?” সায়ক প্রিয়াঙ্কার হাতটা ধরল দৃঢ়ভাবে, শুধু ভালবাসা নয়, নিখাদ বন্ধুত্বও ছিল সেই স্পর্শে |

প্রিয়াঙ্কা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যা সায়কের চোখ এড়াল না, প্রিয়াঙ্কা বলতে লাগল, “তোরা তো জানিসই আমার বাবা নেই, কিন্তু এটা জানিস না, কেন নেই | আমি কোনদিন কাউকে বলিনি, আজ তোকে বলাটা দরকার মনে হলো | আমার যখন থেকে জ্ঞান, তখন থেকেই দেখতাম, মা বাবা কাজে, অফিসে একে অপরের পরিপূরক | দুজন একসাথে খুব ভাল কাজ করতেন, কিন্তু, অফিসের মতন একইরকম ভাবে বাড়িতে একে অপরের সাথে সাবলীল ছিল না মানুষদুটো | আমি অত অল্প বয়সেও বুঝতাম, একসাথে কাজে ভালো হলেই যে সংসারটাও একসাথে ভাল করতে পারবে, এমন কোন মানে নেই, মানুষ দুটো মনে হয় এটা বুঝতেই ভুল করেছিল | আমি বুঝতে পারতাম না, এরা বিয়েই কেন করেছিল | বাড়িতে সবসময় ঝগড়া, অশান্তি লেগেই থাকত, আমি বড্ড insecurity তে ভুগতাম, মা তাও বুঝতো ব্যাপারটা, বাবাকে কোনদিন সেভাবে পাইনি | অফিস থেকে ফিরেই হয় অশান্তি, আর নয় সেই অসান্তি থেকে নিষ্কৃতি থেকে বাবার মদ্যপান, ব্যস, এই | নাহ, মিথ্যে বলব না, কোনদিন বাবা মা-র গায়ে হাত তোলেনি, কোন খারাপ ভাষায় প্রয়োগ করেনি, অন্তত আমার সামনে | কিন্তু, মানুষদুটো তো নিজেই ভালোবেসে সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সিদ্ধান্তে এত বড় ভুলের জন্য ওদের সাথে সাথে আমার শৈশবটাও শেষ হয়ে গেল |”

এতটা বলে একটু বিরাম নিল প্রিয়াঙ্কা, সায়কের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল কিছুক্ষন, আবার বলল, “তোর সাথেও আমার এই অফিসেই বন্ধুত্ব, তার মানে তোর আর আমার ভবিষ্যৎ সমীকরণটাও যে এরকম হবে, তা আমি বলছি না, কিন্তু কি বলতো, ঘর পোড়া গরু তো, তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায় | বাবা আর এই অ্যাডজাস্টমেন্ট টা বেশিদিন টানতে পারেনি জানিস, আর একজনকে ভালবেসে চলে গেছিল যখন, তখন আমার ব্যস ১৪, সেই থেকেই মা একা | নাহ, মা-র আর কাউকে ভালবাসা হয়নি, মা-ও আর কোন পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না, মা আর আমি একে অপরকে আশ্রয় করে বেঁচে আছি | এখন আমি না থাকলে মা পুরো একা হয়ে যাবে, কেউ আর নেই মা-র পাশে থাকার জন্য, ছোটবেলাতেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, আমি অন্তত মা-র কাছেই থাকব, মা-কে ছেড়ে কোথাও যাব না | এখন বল, তুই আমার জায়গায় থাকলে কি করতিস? পারতিস এভাবে নিজের সুখের কথা ভেবে মা-কে ছেড়ে চলে যেতে? নাকী এত সহজে বিশ্বাস করতে পারতিস যেখানে সেই একই ঘটনার স্বীকার তোর নিজের মা বাবা? পারতিস?”

বেশ কিছুক্ষন চুপ করে ছিল সায়ক, কিচ্ছু বলতে পারেনি, জাস্ট কিচ্ছু না | ঘরে ফিরবে বলে দলবেঁধে পাখিগুলো উড়ছে আকাশটা জুড়ে, সেদিকে তাকিয়ে সায়ক বলল, “দ্যাখ পাখিগুলো কেমন দলবেঁধে ফিরছে | তোকে একটা কথা বলি, তুই আমায় বিশ্বাস করবি কী না এ ব্যাপারে আমি তোকে কিছুই বলতে পারব না, এটা সম্পূর্ণ তোর ব্যাপার, শুধু তোকে এটুকুই বলতে পারি, তোকে আমি ভালবাসি |” গলাটা একটু হলেও যেন কাঁপল সায়কের, কিন্তু ছেলে তো, তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “একা কেউ বাঁচতে পারে না, প্রত্যেকটা মানুষের কোন আশ্রয়, কোন অবলম্বন প্রয়োজন, এটা তোর মনে হয়নি? কাকীমারও একটু ভালভাবে বাঁচার অধিকার আছে | এটা একবারও ভাবিসনি?”

প্রিয়াঙ্কা তাকাল সায়কের দিকে | আঁধার নামতে শুরু করেছে ততক্ষনে |

||৩||

(বেশ কিছুদিন পর)

-“তোর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কী আবোল তাবোল বকে চলেছিস?” প্রিয়াঙ্কার মা কাকলি দেবী মেয়েকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন কথাগুলো, খেতে দিতে দিতে |

-“এতদিন ঠিক ছিল না মা, এখন practically বুঝতে শিখেছি, ভাবতে শিখেছি, তুমি একবার কথাটা বলে তো দেখ |”

-“তুই খুব বাজে বকছিস, এবার চুপ কর, খেতে যায়, আমি এই নিয়ে কোন কথাই শুনতে চাই না |”

-“মা, প্লিজ, অন্তত আমার জন্য, বাবাতো কবেই নিজের সংসার গুছিয়ে নিয়ে দিব্যি সুখে আছে, তুমি কেন নয়? তুমি মা বলে? তুমি মেয়ে বলে? তুমি সুখী হতে চাও না কেন?”

ক্ষনিকের জন্য কাকলি দেবী বাক্যহারা হয়ে গেছলেন, মেয়ের কথা শুনে, মেয়ে এত বড় কবে হয়ে গেল, উনি বুঝতেই পারলেন না | নিজের অজান্তেই চোখ দুটো কখন জলে ভিজে গেছে বুঝতে পারেননি | মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,”আমার ছোট্ট পিউ কবে এত বড় হয়ে গেল শুনি?”

প্রিয়াঙ্কা মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,”মা তুমি ভাল থাকো, খুশি থাকো, আমি এটাই চাই, সব রং বিসর্জন দিয়ে আমার মা কেন বেরঙিন থাকবে, আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল, ভাবা উচিত ছিল, কিন্তু প্লিজ মা লক্ষিটি, আমার এই কথাটা রাখ আমার সোনা মা |”

মেয়ের জিদের কাছে হার মানল মা, সম্মত হলো দেখা করতে, ‘পাত্র’-র সাথে |

||৪||

মানসবাবু কোনদিন বিয়ে থা করেননি, মানসবাবু সায়কের বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নিপাট ভাল মানুষ | সারাটা জীবন নিজের কাজ আর সমাজ সেবার সাথেই যুক্ত থেকেছেন | প্রেম জীবনে আসেনি, তা নয়, কিন্তু সম্পূর্ণ হয়নি, তারপর আর বিয়েথার কথা ভাবেনও নি | কিন্তু নিজের ভাইপো আর সায়ক তারা অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, দুটিতে মিলে যখন কাকলি দেবীর ব্যাপারে সব বললো, তখন কেমন যেন মনে হলো একবার না হয় দকেহা করি, কথা বলিই |

**************

দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা শুরুর পর বেশ মাসখানেক অতিক্রান্ত | দুটো প্রাপ্তবয়স্ক, একজন ষাটোর্ধ আর একজন পঞ্চান্ন-র দুটো মানুষ কোনদিনই সেই অর্থে প্রেম করবে না | কিন্তু, মুখের হাসি, চোখ অবধি সেই হাসির ঝিলিক, একটু মন খুলে বহুদিন পর শ্বাস নেওয়া, একঝলক সতেজ বাতাসে আবৃত দুটি মন, হৃদয় গগনে এই কথাটাই বারবার বলল প্রিয়াঙ্কা, থাকে, মা অন্তত খুশি আছে, হাসছে, মা ভাল আছে, অনেক অনেকদিন পর, একটা ‘বন্ধু’ পেয়েছে, যাকে সব সময় পাশে পাওয়া যাবে, কখনও অজানা পথে একা ছাড়বে না যে |

বন্ধু, বিশ্বাস, খুশি এই শব্দগুলো মনে হয় স্বামী, ভালোবাসা, সুখের থেকেও অনেক জোরালো | এটা এতদিনে প্রিয়াঙ্কা বুঝে গেছে, বলা ভাল সায়কই ওকে বুঝেছে | নিজের মাকে আবার ভালভাবে বাঁচতে শেখাতে ক’জন সন্তান পারে? প্রিয়াঙ্কা নিজেও তো পারেনি সায়ক ওকে প্রথম চিনিয়েছে, বুঝিয়েছে আসল গলদটা | আজ মা ভাল আছে, একজন প্রকৃত বন্ধু পেয়ে, এটাই প্রিয়াঙ্কার সবথেকে বড় প্রাপ্তি |

এরপর মানুষদুটো আবার ‘বিবাহ’ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হবে কী না জানা নেই, প্রিয়াঙ্কা সায়কও একে অপরকে নিজের করে নেবে কী না জানা নেই, কিন্তু এভাবে মেয়ে হয়েও বন্ধু হয়ে উঠে মাকে ভাল রাখার মধ্যে দিয়ে নিজের শান্তি খুঁজতে পারে ক’জন? এভাবেই সব সন্তান ভাবুক, এভাবেই সব সন্তান ভাবুক, এভাবেই সবাই ভাবুক, হয়তো আর বৃদ্ধাশ্রম থাকবে না, উঠবে নতুন সূর্য, হয়তো |

তুলিকা রায়ের কলমে দুটি ভিন্ন স্বাদের সেরা উপন্যাস একসাথে মাত্র ৯৯/- টাকায় -

Share with

এরকম আরো কিছু গল্প

টিফিনবাক্স

প্রতিবারের মতন এই বছর ও সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে বেরোনোর জন্য ব্যস্ত অমিত, অন্তত সন্ধ্যার মধ্যে বেরোতে না পারলে খুব মুশকিল। পুজোর দিকটা কতদূর কি হলো

Read More »

হারিয়ে যাওয়া ‘আমি’

।।১।। “এই বেলটা বাজছে, একবার দেখ না, তরকারিটা নামাচ্ছি তো, দেখ রে,আরে এই টুসি, কোন সাড়াশব্দ নেই।” “আরে আমি রেডি হচ্ছি মা, তুমি দেখো।” “উফফ,

Read More »

লজ্জা

লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে চুপচাপ সবার নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে এল রিনি। কিছু আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাদটা ভিজে এখনও, মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ

Read More »

আজ বাঁচুন

আবাসনেরর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতেই চিৎকার কানে এলো… সিকিউরিটি কে ছুটে যেতে দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ওরা |কিন্তু তারপরই আবাসনের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেল যেন চারপাশটা…

Read More »

রদ্যি খবর

“তোকে কতবার আর বলব পুপু, আজ অন্তত দস্যিপনাটা একটু কমা। দেখছিস তো বাড়িতে লোকজন আসবে আজ।” মেয়ে পুপুকে আবার একবার খানিক ধমকে দিলো রাধিকা, বিক্রমপুরের

Read More »

এই বেশ ভালো আছি

।।১।। ট্রাঙ্ক থেকে ন্যাপথালিন দেওয়া গুটি কয়েক তোলা শাড়ি থেকে একটা শাড়ি বের করছিল মায়া । ছোট্ট দু’কামরার ঘরে এককোণে খাট, ছোট্ট আলনা, ট্রাঙ্ক, কুঁজো,

Read More »

Share with