||১||
“কী গো বৌদি, শরীরটা কী খুব খারাপ লাগছে?” প্রিয়াঙ্কার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল ফুলি | ফুলি এবাড়ির ঠিকে কাজের লোক হলেও এই বাড়িতে বহুদিন কাজ করার ফলে বাড়ির সদস্যদের দরকারে-আদরকারে সবসময় পাশে থাকে |
প্রিয়াঙ্কা মাথা নাড়া দিয়ে জানান দিল যে না এখন ঠিক লাগছে | এই নিয়ে আজ বার ছয়েক বমি হলো, এই সময় এরকম হয়-ই, শাশুড়িমা এই বলেই বারবার সামলাচ্ছেন | শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, স্বামী নিয়ে ভরা সংসার প্রিয়াঙ্কার | বিয়ে হয়েছে মাস আটেক হলো | ভরা এই সংসার সুখেরই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু, না, হয়নি সুখের |
||২||
প্রিয়াঙ্কা আর অরিত্র-র বিয়েটা প্রেম করেই, ওরা বিয়ের পর খুব ভাল থাকবে, এটাই স্বাভাবিক ছিল, সবাই তেমনই আশা করেছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু যে কীভাবে বদলে গেল | অরিত্র-র কাছে প্রিয়াঙ্কার সন্তান ধারণটা প্রথম থেকে মতের বিরুদ্ধে ছিল, পরিকল্পনা ছিল না কোন | অরিত্র চায়নি এই সন্তান পৃথিবীতে আসুক, এত তাড়াতাড়ি বাবা হওয়ার দায়ভার নিতে চায়নি ও, ফলস্বরূপ যা হয় তাই, নষ্ট করতে চেয়েছিল অরিত্র আর প্রিয়াঙ্কার ভালবাসার প্রথম সন্তানকে | প্রিয়াঙ্কা স্বাভাবিক ভাবেই পারেনি মেনে নিতে, পারেনি নিজের ভিতরের কচি প্রাণটাকে উপড়ে ফেলতে | তুমুল অশান্তির পর অবশেষে প্রিয়াঙ্কার-ই জয় হয়, দুই বাড়ির লোকজন প্রিয়াঙ্কাকেই সমর্থন করে | তারপর থেকেই অরিত্র-র মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে | হোক না এক্সিডেন্ট, হয়ে গেছে, দায় দুজনেরই , ভাগ করে নি না এই দায় দায়িত্বগুলো | অনেকবার বুঝিয়েছে প্রিয়াঙ্কা, লাভ হয়নি | এই সময় তাই প্রিয়াঙ্কার পাশে সব থেকে বেশি যাকে প্রয়োজন, সেই আজ ওর পাশে নেই |
**************
ঘড়িতে রাত ১১টার ঘন্টা পড়ল | অরিত্র-র এখনও কোন পাত্তা নেই, ফোনটাও রিসিভ করছে না, মাঝে মাঝে খুব অসহায় লাগে প্রিয়াঙ্কার, এই কী ওর সেই চিরপরিচিত ওর অরিত্র? যাকে ভালবেসে এই বাড়ি এসেছিল প্রিয়াঙ্কা? শুধুমাত্র দুই বাড়ির মানুষগুলোর আর নিজের পাঁচ বছরের প্রেমের দিকে তাকিয়ে মুখ বুজে সবটা সহ্য করছে ও | মা, বাবা, শ্বশুর শাশুড়ি সব সময় সামলে রাখেন | তাদের সামনে ভুলেও চোখের জল ফেলতে পারে না ও, তাহলে যে ঐ মানুষগুলো মারাত্মক কষ্ট পাবে | আরও একবার ফোন করল প্রিয়াঙ্কা, কেটে দিল ফোনটা, ফোনটা পাশে রেখে শুয়ে পড়ল ও, ঘর আলো আঁধারি | নিজের বিয়ের ফটোগুলো ফোনে স্ক্রল করছিল প্রিয়াঙ্কা, চোখ কখন আর্দ্র হয়ে গেছে, নোনতা জলের ধারা গাল বেয়ে বালিশ ভিজিয়েছে, বুঝতেই পারেনি, যখন টনক নড়ল তখন বুঝল ঘুমিয়ে গেছিল ও | বাইরে ঢং ঢং করে রাত দুটোর জানান দিল বনেদী বাড়ির বিশাল ঘড়িটা, পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল অরিত্র ঘুমোচ্ছে | অরিত্র-র ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে অতীতের পাতায় ফিরে যাচ্ছিল প্রিয়াঙ্কা, যখন ওর জন্য অরিত্র পাগল ছিল, দুজন দুজনের হাত ধরে হাঁটতে পারত নিমেষেই, দুজন দুজনের চোখে চোখ রেখে কেটে যেত ঘন্টার পর ঘন্টা | কী এমন হলো গো, যে এই আনন্দের সময়ও তুমি আমার পাশে নেই | এভাবে আর কতদিন? প্রিয়াঙ্কার চাপা দীর্ঘনিশ্বাসটার সাক্ষী রইল শুধু আকাশের জেগে থাকা তারাগুলো |
||৩||
আজ ছুটির দিন, সবাই একটু দেরী করেই উঠেছে | শাশুড়িমা বৌমা-র পছন্দের লুচি বানাতে ব্যস্ত, শ্বশুরমশাই গেছেন বাজারে | প্রিয়াঙ্কা জামা কাপড়গুলো গোছাচ্ছিল ঘরে | ফোনের শব্দে খুঁজতে গিয়ে ফোনটা দেখল, অরিত্র-র ফোন বাজছে, SK লেখা, বুঝতে না পেরে ফোনটা রিসিভ করল প্রিয়াঙ্কা, অরিত্র তখন বাথরুমে |
***************
ফোনটা রাখল প্রিয়াঙ্কা, ওপাশ থেকে ভাবছে অরিত্র-ই ফোনটা ধরেছে | ফোনের কথোপকথন আজ পরিষ্কার করে দিল, অরিত্র আজ অন্য কারো | প্রিয়াঙ্কা ধপ করে খাটে বসে পড়ল, সম্পূর্ণরূপে হতভম্ব | ওর অরিত্র যে এরকম আমূল পরিবর্তিত হতে পারে ও স্বপ্নেও ভাবেনি, কিছু বলবার ভাষা নেই আর আজ ওর, সম্পর্কের সুতোটা এত আলগা হয়ে গেছে ও বুঝতেই পারেনি | সুতোটা ও-ই ধরেছিল, এক প্রান্ত থেকে, অপর প্রান্তের মানুষটা কখন যে সুতোটা ছেড়ে দিয়েছে, ও বুঝলই না? হঠাৎ কী যে হলো এতকিছু ঘটে গেল বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে | যখন এতটা আনন্দের সময়, প্রিয়াঙ্কার আনন্দে থাকার কথা, তখনই এরকম কীভাবে হলো?
অরিত্র বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্রিয়াঙ্কাকে এই ভাবে বসে থাকতে দেখে হতচকিত হয়ে গেল |
প্রিয়াঙ্কা কিচ্ছু বলল না, শুধু একবার তাকাল অরিত্র-র চোখের দিকে | চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দিল আমি অপরাধী নই, বরং, যে অন্যায় করেছে তার চোখ নামিয়ে নেওয়ার পালা | অরিত্র ফোনটা হাতে নিয়ে চেক করতেই বুঝে গেল, গোলমালটা কোথায়? বুঝে প্রিয়াঙ্কার দিকে তাকালো, ততক্ষনে প্রিয়াঙ্কা অরিত্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, এবং সর্বোপরি কোন কথা না বলে চলে গেল |
অরিত্র কী বলবে কী করবে খুঁজে পেল না | এতদিন ধরে ওর অপরাধের উপর ঢাকা পর্দা একলহমায় এভাবে সরে যাবে, ভাবতে পারেনি | প্রিয়াঙ্কার কাছে নিশ্চয় সবটা এখন স্বচ্ছ | এসব ভাবতে ভাবতেই অফিসের দিকে পা বাড়াল অরিত্র | অফিস যেতে যেতে ভাবল,”আচ্ছা, ও তো এটাই চাইছিল, প্রিয়াঙ্কাকে পরিষ্কার ভাবে বলে দিতে যে ও সোফিয়াকেই ভালবাসে, ও সোফিয়ার সাথেই থাকতে চায়, কী দেবে প্রিয়াঙ্কা ওকে? বিয়ে হতে না হতেই বাচ্চা | কত কী স্বপ্ন দেখেছিল বিয়ের আগে, সব শেষ | এরপর তো বাচ্চা নিয়ে সারাটাক্ষন কেটে যাবে, অরিত্র ওকে পেল কতটুকু | স্থূল চেহারায় কী আর সেই আবেদন থাকবে, যেটা অরিত্র চায়? না, অরিত্র যেভাবে প্রিয়াঙ্কাকে দেখতে চায়, পেতে চায়, সেই রূপে ফিরে আসা তো আর সম্ভব না প্রিয়াঙ্কার পক্ষে | সবারই কিছু আশা আকাঙ্খা থাকে, অরিত্র-রও ছিল | সে সব আশায় ইচ্ছে করে জল ঢেলে দিল প্রিয়াঙ্কা | অন্তত সোফিয়াকে ভালবেসে ও এবার সুখী হতে পারবে, যা হওয়ার ভালই হয়েছে | অজস্র দায়দায়িত্বর চাপে বুড়িয়ে যাওয়ার বয়স এটা নয়, বরং এটা আনন্দের সময়, জীবনটাকে চুটিয়ে উপভোগ করার সময় | সবাই একদিন না একদিন জানবেই |” এত কিছু ভেবে নিজেকে একটু রিল্যাক্সড করতে চাইল অরিত্র | কিন্তু ও কিছুতেই পারছে না রিল্যাক্সড হতে | কেমন যেন বুকের উপর পাথর চেপে বসে রয়েছে, কিছুতেই অস্বস্তিটা যাচ্ছে না, শান্তি পাচ্ছে না অরিত্র |
****************
সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরল অরিত্র, আজ আর সোফিয়াকে নিয়ে বেরনোও হলো না | বাড়ি ঢুকতেই মা বাবার মুখ থমথমে | এবার বেশ চাপে পরে গেল অরিত্র, নিশ্চয় সব বলে দিয়েছে প্রিয়াঙ্কা, বাঁচা গেছে, ওকে আর কষ্ট করে বলতে হয়নি, ও-ও তো বলবেই ভাবছিল, ও প্রিয়াঙ্কার থেকে তো মুক্তিই চায়, তাই না?
কিছু না বলে চুপচাপ উপরে নিজের ঘরে গেল অরিত্র | ঘরে ঢুকতে গিয়েই তাল কাটল, ঘরটা অন্ধকার কেন? আলো জ্বালাতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো | প্রিয়াঙ্কা ঘরে নেই | তাহলে কী প্রিয়াঙ্কা চলে গেল? ঘরে ঢুকে ব্যাগ ফেলেই খুঁজতে লাগল অরিত্র, কী খুঁজছে জানে না | আলমারি, কাবার্ড, খুলে দেখল অরিত্র,…..ফাঁকা, প্রিয়াঙ্কার কোন জিনিস নেই আর এই ঘরে | চলে গেছে ও, ধপ করে বসে পড়ল অরিত্র | এরকম কিছু ভাবতে পারেনি ও, শুধু খাটের পাশের টেবিলের উপর ওদের বিয়ের বাঁধানো ছবিটা রাখা | একবার হাতে নিল ওটা, আনমনে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল অরিত্র | কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আজ, মেনে নিতে পারছে না যেন হঠাৎ প্রিয়াঙ্কার এভাবে চলে যাওয়া |
||৪||
(বেশ কিছুদিন পর)
প্রিয়াঙ্কা অরিত্রকে ছেড়ে, শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাগুইহাটিতে নিজের মা বাবার কাছে চলে এসেছে কয়েকমাস হলো | কাউকে কিচ্ছুটি বলতে পারেনি ও, যাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল তার এই বিশ্বাস ঘাতকতা কোন মুখে কাকেই বা বলবে, কেউ প্রিয়াঙ্কার মুখ থেকে কিচ্ছু বের করতে পারেনি |
***************
অরিত্রকে ছেড়ে প্রিয়াঙ্কা চলে গেছে মাস ছয়েক, এক আধবার ফোন করেছিল, ধরেনি প্রিয়াঙ্কা |
***************
আজ সোফিয়ার সাথে দেখা করে বেরতে দেরীও হলো একটু, অন্যমনস্ক লাগছিল, মনটাকে কেমন একটা শূন্যতা গ্রাস করেছিল, যেন কি যেন একটা হারিয়ে ফেলেছে | মা বাবা, বোন-ও এক প্রকার একঘরেই করে দিয়েছে যেন | সম্পর্কের সবকটা সমীকরণ একলহমায় উল্টে গেছে, একটা সম্পর্কের সুতোয় টান পড়তে না পড়তেই | বেশ কিছুক্ষন হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে বসল অরিত্র | ও কী করছে? এতদিন কী করল? ও তো প্রিয়াঙ্কাকেই ভালবাসতে চেয়েছিল, তারপর এল সোফিয়া, সোফিয়াকেও তো ও ভালবাসে, কীভাবে অস্বীকার করে সোফিয়ার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো? পার্কটার পাশেই রাস্তা, হুহু করে গাড়ি যায় | সিগন্যাল পড়ল একবার | একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়িয়েছে | অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র আওয়াজে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়, এদিকে সামনের গাড়িগুলো রাস্তাও ছাড়ছে না, সামনের রাস্তাটা ব্লক | অনেক্ষন আওয়াজ শুনে সবাই-ই ফিরে তাকাচ্ছে, অরিত্রও তাকাল | অবশেষে অ্যাম্বুলেন্স থেকে একজন ভদ্রলোক নামলেন, অরিত্রর মতোই কী তার থেকে একটু হয়তো বড় | সামনে গিয়ে বলে কয়ে রাস্তাটা পরিষ্কার করতে চেষ্টা করলেন | ওনার কাকুতি মিনতিতে যেটুকু বোঝা গেল, ভিতরে ওনার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, এখুনি হাসপাতালে পৌঁছানোটা খুব জরুরি | ভদ্রলোকের মুখটার দিকে তাকালো অরিত্র, বিধ্বস্ত, খুব প্রিয় কাউকে হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় স্পষ্ট চোখে মুখে | ধক করে উঠল অরিত্রর বুকটা | প্রিয়াঙ্কা এই অবস্থায় কেমন আছে, কী করছে, কোন তো খোঁজই নেয়নি অরিত্র | ও-ও হয়তো এরকমই কষ্ট পাচ্ছে |…..আজ কেন জানি না হঠাৎ করেই খুব মনে পড়ছে প্রিয়াঙ্কার কথা, ইচ্ছে করল ওকে একটা ফোন করে, ওর একটা ছবি দেখে, পকেটে হাত দিতেই থমকাল অরিত্র | ফোন পার্স কিছুই তো নেই | ওহ হো, এতটাই অন্যমনস্ক ছিল সব কিছু ওই সোফিয়ার ফ্ল্যাটেই রেখে এসেছে মনে হয় | ভাগ্যিস দেখল, তাড়াতাড়ি আবার হাঁটা লাগল অরিত্র |
ফ্ল্যাটে পৌঁছে বেলটা বাজাতে যাবে, এমন সময় মনে হলো সোফিয়া কারো সাথে যেন কথা বলছে, ফ্ল্যাটে ও ছাড়াও আরও যেন আছে, আর সেটি পুরুষ কন্ঠ | খটকা লাগল অরিত্র-র, সোফিয়া তো ফ্ল্যাটে একাই থাকে, তাহলে? তার মানে কী?…..ছি ছি | কিন্তু ওকে হাতে নাতে ধরতে হবে আগে | বেলটা বাজাল অরিত্র | দরজা খুলল না | দ্বিতীয়বার,…..”কে…?” ভিতর থেকে সোফিয়ার গলা… তৃতীয়বার…. বাধ্য হয়ে দরজাটা খুলল শুধু মুখটা বাড়িয়ে…. ভাগ্যিস দরজায় আই-হোল ছিল না | দরজা খুলে অরিত্রকে দেখেই যেন মুখটা, সাদা, ফ্যাকাশে হয়ে গেল সোফিয়ার | অরিত্র একটি শব্দও খরচ করল না, সোফিয়ার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই ঢুকল, ঘরে উপস্থিত পুরুষটিকে অরিত্র চেনে না, চেনার দরকারও নেই | শুধু তার এবং সোফিয়ার অবিন্যস্ত পোশাকেই সবটা বলে দিল অরিত্রকে আজ | নিজের ফোন পার্সটা নিয়ে বেরনোর সময় দেখল সোফিয়ার চোখ অবনত, ঠিক যেমন প্রিয়াঙ্কার সামনে অরিত্র-র চোখ অবনত ছিল |
“টাকার জন্য আর কত নীচে নামবে তুমি? এরকম আর কতজনের সাথে করেছ? কতজনের কাছে নিজের সম্মান বিকিয়েছ টাকার লোভে? এত লোভী তুমি”- কথাগুলো বলেই বেরিয়ে গেল অরিত্র | সোফিয়া নিজের পক্ষে কী বলল, শোনার প্রয়োজনও বোধ করেনি অরিত্র | অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে ও, আজ যেন চোখে আঙুল দিয়ে কেউ বুঝিয়ে দিয়ে গেল নিজের ভুলটা | ও ওর প্রিয়াঙ্কাকে ছেড়েছে, শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার লোভে সোফিয়ার কাছে ছুটে গেছে | ওর আর সোফিয়ার মধ্যে তাহলে তফাতটা কী? দুজনেই লোভী, স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক |
সোফিয়া টাকা চেনে আর অরিত্রও তো নিজের স্বার্থ সিদ্ধি, নিজের ভালোলাগা, নিজের চাহিদা মেটাতে নিজের স্ত্রীর হাত এমন সময় ছেড়েছে, যখন প্রিয়াঙ্কার ওকে সব থেকে বেশি প্রয়োজন | ছি ছি ছি, কোন মুখে দাঁড়াবে? কোন মুখে ক্ষমা চাইবে ও প্রিয়াঙ্কার কাছে? ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, দুই বাড়ি আর প্রিয়াঙ্কার মুখোমুখি হতেই হবে, নয়তো নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ রাখতে পারবে না আর এই জীবনে |
||৫||
কিছুতেই দেখা করতে চায়নি প্রিয়াঙ্কা | ডাক্তার ওকে উত্তেজিত না হতে বলেছে, তাই প্রিয়াঙ্কার মা বাবাও চাননি অরিত্র প্রিয়াঙ্কার সামনে আসুক | সামনের মাসেই নতুন অতিথি আগমণের সময়, এই অবস্থায় কোনরকম উত্তেজনা খুব খারাপ হতে পারে মা এবং সন্তানের জন্য | বারবার অরিত্র-র কাকুতি মিনতির কাছে নতি স্বীকার করে প্রিয়াঙ্কা দেখা করল অরিত্র-র সাথে |
-“আমায় কী ক্ষমা করা যায় না? আমরা আবার নতুন করে শুরু করতে পারি না?”
প্রিয়াঙ্কা আধো শুয়ে বই পড়ছিল | বইয়ের পাতা থেকে চোখ না তুলেই বলল,”ক্ষমা তো অনেক আগেই করে দিয়েছি, আবার ক্ষমা চাইছ কেন?”
অরিত্র প্রিয়াঙ্কার কথায় যেন ধড়ে প্রাণ পেল, যেন একটা পাথর নামল বুক থেকে | সত্যিই তো ভালবাসা তো এরকমই হওয়া উচিত, মানুষকে ক্ষমা করবে না তো কাকে করবে? অরিত্র প্রিয়াঙ্কার পায়ের কাছে বসল, বলল, “আমার ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই, আমি সত্যি ভাগ্যবান যে এত কিছুর পরও তুমি আমায় ক্ষমা করেছ, অন্তত, নিজের দিকে তাকাতে পারব | কবে ফিরবে বাড়ি?”
-“বাড়ি? কোন বাড়ি? তোমায় ক্ষমা করেছি বললাম, তোমার সাথে সংসার করব বলিনি তো |”
-“মানে?”
-“মানে তুমি তোমার জীবনে যা খুশি করতে পারো, আমার আর কিচ্ছু যায় আসে না, দয়া করে আর এবাড়িতে এসো না | কী ভাবো তুমি? তোমরা ছেলে বলে যা খুশি তাই করবে, যখন খুশি যাবে, যখন খুশি আসবে, আর আমরা মেয়ে বলে তোমার সব কিছু মেনে নিয়ে পুতুলের মত আবার সংসার করতে শুরু করব? মেয়ে বলে কী মানুষ না? মন নেই? এরপর তোমার হাতটা স্পর্শ করতেও আমার ঘেন্না করবে, সংসার করা অনেক দূরের কথা |”, কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামল প্রিয়াঙ্কা |
কিছু বলার আর শব্দ ছিল না অরিত্র-র, বাকি বোঝাপড়াটা ওদের কোর্টেই হবে |
**************
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত, “ছেলেরা সোনার আংটির মত, সোনার আংটি তাই আবার বাঁকা !”, মানে প্রথম থেকেই একটা কথাই বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে যা করে করুক, সে ছেলে, তাই তার দোষ না ধরাই শ্রেয় | ছেলে মেয়ে অন্যায় যারই হোক, শাস্তি সবারই প্রাপ্য | সম্মান, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস হারিয়ে একটা দাম্পত্য সম্পর্ক আজও আমাদের সমাজে ঠিক চলতেই থাকে, কিন্তু, সেটাকে সংসার বলে না, সমঝোতাই বলে | সোনার আংটির ধারণাটা বদলাবার সময় এসে গেছে |